#নিবেদিতা
#পর্ব_৯
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
________________
কিছুটা বিস্ময় ও বিরক্তিমাখা কণ্ঠে নিবেদিতা বলল,
“ছেলে হয়েও হিজড়া দেখে এত ভয় পান?”
মিদহাদ পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“ছেলে বলেই ভয় পাই। তোমার মতো মেয়ে হলে তো আর ভয় পেতাম না। তোমাদের সাথে তো আর কিছু করে না।”
“মানে?”
“তখন আমি কলেজে পড়ি। বন্ধুরা মিলে ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফিরছিলাম। ঐ সময় বেশ কয়েকটা হিজড়া আমাদের পথ আটকিয়ে টাকা চায়। আমরা বলেছিলাম, আমরা তো স্টুডেন্টস, টাকা নেই। তারা নাছোড়বান্দা টাকা না নিয়ে যাবে না। আর তাদের মধ্যে কিছু মানুষের স্বভাব তো জানোই? একজন হিজড়া আমার এক বন্ধুর প্যান্ট ধরে টান দিয়েছিল। বেচারা সেদিন বেল্টও পরেনি। একটুর জন্য খোলেনি প্যান্ট। তখন আমরা তাদের টাকা দেওয়ার পর চলে যায়। ঐসময় থেকে আমি হিজড়াদের য’মের মতো ভয় পাই।”
“সেই তো টাকা দিলেনই, শুরুতে দিলে কী হতো?”
“আরে বোঝো না অল্প বয়স তখন! সবাই মিলে একটু ভাবসাব নিতে গিয়েছিলাম।”
“এরপর থেকে হয়ে গেলেন ভীতু।”
“সবার সামনে তো আর না। শুধু তাদেরকেই ভয় লাগে এই যা আরকি!”
নিবেদিতা আর কথা বাড়াল না। দুজনে মিলে একটা সুপারশপে ঢুকল। কিছু শুকনা খাবার কিনতে হবে। হোস্টেলের খাবার গলা দিয়ে নামে না নিবেদিতার। বাড়িতে অবশ্য সেকথা জানায়নি। এমনিতেই তাকে নিয়ে বাড়ির সবার দুশ্চিন্তার শেষ নেই। তারওপর খাবার নিয়ে আর বাড়তি চিন্তা দিতে চাচ্ছিল না। ঘুরে ঘুরে খাবার নিচ্ছিল নিবেদিতা তখন নয়নের কল এলো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নয়ন বলল,
“কীরে পিচ্চি, খবর কী তোর?”
নিবেদিতা হাসার চেষ্টা করে বলল,
“ভালো। তোমার?”
“তোকে ছাড়া ভালো থাকি কীভাবে বল? বাড়িটা পুরো ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।”
“কিন্তু তুমি তো এখন অফিসে।”
“কী জ্বালা! অফিস শেষ করে রাতে তো বাড়িতে ফিরি তাই না?”
“তা ঠিক।”
“কী করছিস তুই এখন? ক্লাস শেষ?”
“হ্যাঁ। সুপারশপে এলাম।”
“মিদহাদ যায়নি?”
নিবেদিতা পেছনে ঘুরে একবার মিদহাদকে দেখল। সেও তার মতো ঘুরে ঘুরে খাবার দেখছে। নিবেদিতা গোপনে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
“এসেছে। তুমি তাকে কেন আসতে বলেছ?”
“তুই ঢাকা-শহরের কিছু চিনিস নাকি?”
“চিনি না। কিন্তু চিনে নিতাম। এরজন্য শুধু শুধু তাকে পাঠাতে হবে?”
“শুধু শুধু না। তুই বুঝবি না আমাদের টেনশন।”
“হ্যাঁ, সব শুধু তোমরাই বোঝো।”
“তুই দেখি দূরে গিয়ে ঝগড়ুটে হয়ে গেছিস পিচ্চি!”
“বাজে কথা বলবে না।”
নয়ন হেসে বলল,
“আচ্ছা বলব না। ফোনটা মিদহাদকে দে।”
নিবেদিতা ফোন মিদহাদকে দিয়ে নিজের মতো খাবার নিতে লাগল। কেনাকাটা শেষ হলে হোস্টেল পর্যন্ত নিবেদিতাকে পৌঁছে দিল মিদহাদ।
রুমে গিয়ে দেখল ওর দুই রুমমেট বই নিয়ে নিঃশব্দে পড়ছে। ওদের একজনের নাম হিয়া, আরেকজনের নাম বৃষ্টি। দুজনই প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে। নিঃসন্দেহে মেধাবীও বটে। নিবেদিতার সাথে এত খাবার-দাবার দেখে বৃষ্টি বলল,
“এত খাবার?”
নিবেদিতা বিছানায় বসে বলল,
“আসলে হোস্টেলের খাবার তো আমি খেতে পারি না। তাই কিছু শুকনা খাবার নিয়ে এলাম।”
“আমরাও পারতাম না। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।” বলল হিয়া।
বৃষ্টি বলল,
“তোমার সাথে যে একটা ছেলে এলো, সে কে?”
নিবেদিতা একটু থতমত খেয়ে বলল,
“কেন?”
“না, এমনিই জিজ্ঞেস করলাম। সুন্দর আছে। বয়ফ্রেন্ড?”
“উঁহুঁ! আমার ভাইয়ার বন্ধু।”
বৃষ্টি ও হিয়া একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। নিবেদিতার অস্বস্তি হচ্ছে। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে ওরা কেউ নিবেদিতার কথা বিশ্বাস করছে না। তাই সে বলল,
“হাসছ কেন তোমরা? আমি সত্যি কথাই বলেছি।”
“আরে আমরা মজা করছি। তুমি সিরিয়াস হইও না। ফ্রেশ হয়ে নাও।” বলল হিয়া।
নিবেদিতারও এই ব্যাপারে আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছিল না। ওদের যা ভাবার ভেবে নিক। সে তো সত্যিটাই বলেছে। এখন বিশ্বাস করা বা না করা তাদের ব্যাপার। সে আনমনে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই হুট করে নির্ণয়ের কথা মনে পড়ে গেল। সেই সাথে শুরু হলো বুকের ভেতর পরিচিত সেই ব্যথাটা। কবে মুক্তি পাবে সে এই কষ্ট থেকে?
.
.
ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়িতে ফিরল নির্ণয়। ফ্রেশ না হয়েই বিছানায় শুয়ে পড়ল। নিবেদিতার হাসিমাখা মুখটা চোখের সামনে ভাসছে। একটু ভালোও লাগছে এটা ভেবে যে, মেয়েটা অন্তত ভালো আছে। বাকি সবাই যেখানে ভাবছে নিবেদিতা পাবলিকে চান্স পায়নি বলে দেশের বাইরে যেতে চাচ্ছে, সেখানে কেন জানি নির্ণয়ের মনে হচ্ছিল নিবেদিতা আসলে নির্ণয়ের জন্যই দূরে সরে যেতে চাইছে। অবশ্য এটা সে তখন থেকেই ভাবে যখন থেকে জানতে পেরেছিল নিবেদিতা তাকে ভালোবেসে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে নিবেদিতা আসলে পাবলিকে চান্স পায়নি বলেই অন্য দেশে পড়তে যেতে চাইছে। হয়তো নির্ণয়ের প্রতি তার ভালোবাসাটা একটা আবেগ মাত্র। হতেই পারে! সে নিজেই হয়তো বিষয়টা নিয়ে অনেক বেশি ভেবে ফেলেছে। আবার মিদহাদকে আজ সাথে দেখে মনে হলো ওদের মধ্যেও কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে। সত্য-মিথ্যা কোনোটাই সে জানে না। কিন্তু এসব নিয়ে ভাবতে গিয়ে মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। তাই সে সম্পূর্ণ বিষয়টাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। সবাই সবার মতো করে ভালো থাকুক। দিনশেষে হাসি-খুশি থাকুক এটাই চায় সে।
কিন্তু তবুও মনের এক কোণের কোথায় যেন বারবার নিবেদিতার বলা একটা কথাই কানে বাজছে,
“ভালোবাসি!”
কী অভিমান, অনুরাগ মিশে ছিল কথাটিতে!
_______
দেখতে দেখতে ঢাকায় আসার আজ বিশ দিন হয়ে গেল নিবেদিতার। এর মাঝে বাবা-মা, নয়ন এসে দুবার দেখা করে গেছে। বিউটি বেগম বেশ কয়েকবার ফোন করে বাড়িতে যেতে বলেছেন। কিন্তু নিবেদিতা পড়ার বাহানা দিয়ে যায়নি। গতকাল ফোন দিয়ে খুব করে যাওয়ার কথা বললেন। আজ তো শুক্রবার ক্লাস নেই। সকালে গিয়ে আবার বিকেলে চলে আসলেই হবে। নিবেদিতা জানে, কেন খালা তাকে যাওয়ার জন্য এত জোরজবরদস্তি করছে। গতবার যখন মা হোস্টেলে দেখা করতে এসেছিল তখন দুপুরে হোস্টেলের খাবার দেখেই বুঝতে পেরেছিল তার মেয়েটা খাওয়া-দাওয়া নিয়ে কী পরিমাণ কষ্ট করছে। এজন্যই সে বড়ো বোনের সঙ্গে কথা বলেছেন যেন নিবেদিতাকে মাঝে মাঝে খাবার দিয়ে যায় আর নিবেদিতাকেও যেতে বলে বাড়িতে। বিউটি বেগম নিজেও নিবেদিতাকে ভীষণ সমীহ, স্নেহ করেন। নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসেন। মেয়েটা খাবারে এত কষ্ট করছে শুনেই বুকটা হুহু করে উঠেছিল তার। তাই তিনদিন আগেই স্বামীকে দিয়ে তিনি ভর্তা, ভাজি, তরকারি রান্না করে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আজ বাড়িতে ভালো-মন্দ খাবার রান্না হবে বলেই খালা নিবেদিতাকে এত তাগাদা দিচ্ছিলেন যাওয়ার জন্য। নিবেদিতারও তো ইচ্ছে করে খালার কাছে যেতে। একটু আদর পেতে। ভালো খাবার খেতে। কিন্তু সে তো এক জায়গাতেই আটকে আছে। যার থেকে পালানোর জন্য সে দেশ ছাড়তেও দ্বিধাবোধ করছে না, তার মুখোমুখি সে হবে কী করে? পুরনো ব্যথাগুলো তো আরো বেশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। তবে এতেও কিছু করার নেই। অদৃশ্য কষ্টকে আড়ালে রেখেই আজ খালার বাসায় যেতে হবে। এত করে বলেছে যে, এবার না গেলে বিষয়টা সত্যই দৃষ্টিকটু দেখায়।
সকাল নয়টার দিকে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়ে নিল নিবেদিতা। নাস্তা করে বের হতে হতে দশটা বেজে গেছে। এরমধ্যে খালা অলরেডি পাঁচবার ফোনে করেছে, নিবেদিতা আসছে কিনা। শেষ ফোন করেছে নিবেদিতা যখন রিকশাতে। ফোন রিসিভ করে নিবেদিতা বলল,
“আসছি খালা। আমি রিকশায়।”
“তোকে আমি বলছি সকাল সকাল আসবি। সকালের নাস্তা এখানে এসে করবি। আর তুই আসতেছিস দুপুর বারোটায়?”
নিবেদিতা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“এখনো তো সাড়ে দশটাই বাজেনি…”
“চুপ কর! মুখে মুখে তর্ক করবি না। জলদি আয়। রিকশায় ওড়না সামলে রাখিস। আর ফোন ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখ। এখানে কিন্তু রাস্তাঘাটে ফোন টান দিয়ে নিয়ে যায়। সাবধানে থাকবি।”
“আচ্ছা বাবা আচ্ছা। তুমি এত চিন্তা কোরো না তো!”
কথা বলা শেষ করে ফোন রাখতে রাখতেই রিকশাওয়ালাও রিকশা থামাল। নিবেদিতা বলল,
“কী হয়েছে মামা?”
রিকশাওয়ালা চাকা পরখ করে বলল,
“চাক্কা পাংচার হইয়্যা গেছে আম্মা।”
নিবেদিতা বিরক্ত হলো, সাথে হতাশও। এই মাঝ রাস্তায় এখন সে রিকশা পাবে কোথায়? এতটা পথ তো হেঁটেও যাওয়া সম্ভব নয়!
“আম্মা, আপনে একটু কষ্ট কইরা সামনে হাঁইটা গেলেই রিকশা পাইবেন।”
নিবেদিতা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ছায়ার মধ্যে হাঁটতে লাগল। পাশ থেকে তখন একজনের কণ্ঠ ভেসে এলো,
“মিস নিবেদিতা?”
নিবেদিতা চমকে তাকাল। দেখতে পেল সুখীর ভাই ডাক্তার স্বপনকে। সে বলল,
“আপনি?”
“কোথায় যাচ্ছেন?” প্রশ্ন করল স্বপন।
“খালার বাসায়।”
“নির্ণয়ের বাড়িতে?”
নিবেদিতা উপর-নিচ মাথা ঝাঁকাল। স্বপন বিস্মিত হয়ে বলল,
“হেঁটে?”
“আরে না! রিকশা করেই যাচ্ছিলাম। মাঝ রাস্তায় রিকশা নষ্ট হয়ে গেল। তাই হেঁটে সামনে যাচ্ছি। ওখানে বোধ হয় রিকশা পেয়ে যাব।”
“আমার সাথে আসুন।”
নিবেদিতা অবাক হয়ে বলল,
“কোথায়?”
“আমিও যাব ওদের বাসায়। আমার সাথে যেতে পারবেন। তার আগে আমার সাথে আসুন।”
“কোথায় যাব?”
“আরে আসুন তো। সারপ্রাইজ আছে।”
নিবেদিতা দ্বিধান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে স্বপন জিজ্ঞেস করল,
“আপনি কি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না?”
নিবেদিতা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল,
“তেমন কিছু নয়।”
“ভয় পাবেন না। আমি আপনার ক্ষতি করব না। নির্ণয় কি তাহলে আমাকে আস্ত রাখবে?”
নিবেদিতার বিতৃষ্ণা লাগছে। বিরক্তও। তার অবশ্য এখন সব কিছুই বিরক্ত লাগে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে স্বপনের পিছু পিছু যাচ্ছে। স্বপন একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে ঢুকল। একটা টেবিলের সামনে গিয়ে নিবেদিতার সামনে থেকে সরে দাঁড়িয়ে বলল,
“সারপ্রাইজ!”
নিবেদিতা ও নির্ণয় দুজনই দুজনকে দেখে চমকে গেল। একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে আছে। সাথে বসে থাকা হাস্যজ্বোল সুখীকে দেখে পুনরায় বুকের ব্যথাটা শুরু হয়ে গেল নিবেদিতার। সুখী উঠে এসে নিবেদিতাকে জড়িয়ে ধরল। স্বপনকে জিজ্ঞেস করল,
“ওকে কোথায় পেলে ভাইয়া?”
স্বপন ভাব নিয়ে বলল,
“ম্যাজিক!”
সুখী ও নিবেদিতা পাশাপাশি বসেছে। ওদের সামনে বসে আছে নির্ণয় ও স্বপন। নিবেদিতা মাথা নত করে রেখেছে। নির্ণয়ের দিকে তাকাতে পারছে না। তার চোখ ছলছল করছে। পাছে কারো চোখে ধরা পড়ে যায়। নির্ণয় সকলের দৃষ্টির আড়ালে নিবেদিতার আরক্তিম মুখখানা দেখছিল। নিবেদিতা এবার না চাইতেও ভাসা ভাসা দৃষ্টিতে নির্ণয়ের দিকে তাকাল। যার জন্য প্রতিটা মুহূর্ত তার দহনে কাটে, সেই মানুষটাই দিব্যি সুখে আছে সুখী নামক মেয়েটার সাথে। কী নিদারুণ তাকদির তার!
চলবে…
[কপি করা নিষেধ।]