#নিবেদিতা
#পর্ব_১০
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_______________
রেস্টুরেন্ট থেকে ফিরে নির্ণয়দের বাড়িতে এলো সবাই। সুখীর বাবা-মাও উপস্থিত ছিলেন। তাদের জন্যই মূলত এত আয়োজন। আর এজন্যই খালাও নিবেদিতাকে আসার জন্য এত তাগাদা দিচ্ছিলেন।
বাড়িতে আসার পর থেকেই নিবেদিতা একা এক রুমে শুয়ে আছে। বলা বাহুল্য, ঘুমের অভিনয় করছে সে। কেননা সে চাইছে না কারো সাথে কোনো কথা বলতে অথবা খুব বেশিক্ষণ নির্ণয়কে দেখতে।
দুপুরের রান্নাবান্না শেষ হলে বিউটি বেগম নিবেদিতাকে ডাকতে গেলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“নিবু, ওঠ। খাবি চল।”
নিবেদিতা চোখ মেলে তাকাল। বিউটি বেগম স্নেহমাখা কণ্ঠে শুধালেন,
“তোর কি শরীর খারাপ লাগছে?”
“না তো! কেন?”
“ক্লান্ত দেখাচ্ছে ভীষণ।”
নিবেদিতা হাসার চেষ্টা করে বলল,
“ঠিকমতো ঘুম হয় না। হয়তো এজন্যই এখন ক্লান্ত দেখাচ্ছে।”
“এছাড়াও তুই অনেক শুকিয়েও গেছিস। ঠিকমতো খাসও না মনে হয়।”
“আরে সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি একটু বেশিই চিন্তা করছ।”
“তা কবে ঠিক হবে শুনি? দেশ ছাড়ার পর?”
নিবেদিতা চুপ করে রইল। খালা বললেন,
“হঠাৎ দেশ ছাড়ার বুদ্ধি তোকে কে দিল বল তো?”
“কেউ না। আমারই মনে হয়েছিল। আমি কি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি খালা?”
“আমার জানামতে, একদমই না। কিন্তু তোর মা তো এখনই ভেঙে পড়েছে। তুই চলে গেলে থাকবে কী করে?”
“তুমি একটু মাকে বুঝিও। দেখে রেখো।”
“তা তো রাখবই। এখন আয় খাবি চল।”
খাওয়ার টেবিলে গিয়ে নিবেদিতা খালুর পাশের চেয়ারে বসল। তার পাশে বসেছে সুখীর মা, বাবা। মুখোমুখি বসে আছে নির্ণয়, সুখী আর স্বপন। নিবেদিতা কাঠ হয়ে বসে রইল। খাবার সার্ভ করা হলে কোনো রকম খেয়েই সবার আগে উঠে গেল টেবিল ছেড়ে। হাত ধুয়ে রুমে গিয়ে চুপ করে বসে রইল। কেমন যেন দম বন্ধ করা অনুভূতি হচ্ছে তার।
সবার খাওয়া শেষ হলে সবাই যখন রেস্ট নিচ্ছিল তখন নিবেদিতা হোস্টেলে চলে যাওয়ার জন্য বায়না ধরল। খালামনি বললেন,
“এখনই কেন? সন্ধ্যায় নাস্তা করে যাবি। তোর খালু গিয়ে দিয়ে আসবে।”
“না, খালামনি। অনেক পড়া বাকি আছে। ঐগুলা শেষ করতে হবে। কাল আবার ক্লাস টেস্ট। প্রতিটা সময় আর দিনই আমার জন্য এখন গুরুত্বপূর্ণ জানোই তো।”
“তাহলে তুই বইগুলো নিয়ে এলি না কেন?”
নিবেদিতা অপরাধীর মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। খালাও কিছুক্ষণ মৌন থেকে বললেন,
“আচ্ছা এখন আপাতত রেস্ট কর। রোদ কমুক। নির্ণয় গিয়ে তোকে দিয়ে আসবে।”
“আমি একা যেতে পারব।”
“ও দিয়ে আসলে সমস্যা কী?”
নিবেদিতা উত্তর দেওয়ার মতো কিছু পেল না। বলল,
“সমস্যা নেই।”
.
তিনটার দিকে নির্ণয় নিবেদিতাকে নিয়ে বের হলো। সুখী ওরা এখনো যায়নি। রাতে ডিনার করে যাবে একেবারে। নিবেদিতা গম্ভীর হয়ে বাইকে বসে আছে। ভাবলেশহীন থাকার চেষ্টা করছে। নির্ণয় কথা বলতে চেয়েও বলতে পারছে না। কী বলবে আসলে বুঝতে পারছিল না। অনেকক্ষণ পর শুধু বলল,
“ভালোই সিদ্ধান্ত নিলে তাহলে।”
“কী?”
“এইযে দেশ ছাড়ার।”
“ওহ। হয়তো!”
“তারপর প্ল্যান কী?”
“কীসের প্ল্যান?”
“কোন দেশে যাওয়ার ইচ্ছে?”
“কানাডা, সুইজারল্যান্ড নয়তো লন্ডন।”
“ভালো দেশ চ্যুজ করেছ। একা সার্ভাইভ করতে পারবে?”
“কষ্ট হবে হয়তো তবে অসম্ভব কিছু না। মানুষ জীবনে কত কষ্টই মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছে। সেখানে এই কষ্ট আর এমন কী?”
নির্ণয়ের কেন জানি মনে হলো নিবেদিতার কথাগুলোতে অদৃশ্য তীক্ষ্ণ খোঁচা ছিল। গোপনে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
“নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা।”
“আপাতত শুভকামনা তুলে রাখুন।”
“কেন?”
“আগে IELTS-এ তো টিকি! তারপর না যেতে পারব।”
“অবশ্যই টিকবে।”
“আমার এত কনফিডেন্স নেই। জীবনে কোনো কিছুই আমি খুব করে চেয়েও পাইনি।”
“তোমার খুব করে চাওয়ার মধ্যে কি দেশের বাইরে পড়তে যাওয়াও ছিল?”
“ছিল না। এখন আছে। আপাতত এটাই এখন আমার একমাত্র ইচ্ছে। বাকিটা আল্লাহ ভরসা।”
“ভালো কিছুই হবে ইন-শা-আল্লাহ্।”
“হুম। আপনার জন্যও শুভকামনা।”
“কেন?”
“বিয়ের জন্য।”
“বিয়ে তো এখনো হয়নি।”
“হয়ে যাবে তো।”
নির্ণয় কিছু বলল না। পুরোটা পথে আর কোনো কথাও হলো না দুজনের। হোস্টেলের সামনে এসে নির্ণয় নিবেদিতাকে নামিয়ে দিল। যাওয়ার পূর্বে শুধু বলল,
“সবসময়ই এমন হাসি-খুশি থেকো।”
“আপনিও সুখী আপুকে নিয়ে সুখে থাকবেন।”
এরপর নিবেদিতা চলে গেল হোস্টেলের ভেতর।
নিবেদিতাকে পরখ করার পর থেকেই ওর কথাগুলোরও যেন অর্থ আপনা-আপনি মাথায় চলে আসছিল নির্ণয়ের। যেই মেয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারত না, সেই মেয়ে এখন চোখের দিকে তাকিয়ে নির্দ্বিধায় কথা বলে। কতটা পরিবর্তন! তবে নির্ণয় বুঝতে পারে না নিবেদিতার ঐ চোখে ঠিক কী আছে? অভিমান, অভিযোগ, জেদ, ভালোবাসা নাকি ঘৃণা? নিজের চিন্তাভাবনার লাগাম দেখে নির্ণয় নিজেই ভীষণ অবাক হলো। নিবেদিতাকে নিয়ে সে কবে থেকে এতটা ভাবা শুরু করল? তবে ভাবনা একবার এসে গেলে মাথা থেকে সরানো মুশকিল। নির্ণয়ের পক্ষেও এই মুশকিল আহসান করা সম্ভব হলো না।
বেশ কিছুদিন পরের কথা। নির্ণয় অফিস থেকে ফিরে মাকে রুমে ডাকল। খুবই করুণসুরে বলল,
“মা, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
.
.
নদীর স্রোতের মতো সময়ও চিরপ্রবাহমান। এক সেকেন্ডও কোথাও বিরতি অথবা অপেক্ষা নেই। চোখের পলকেই সময় চলে যাচ্ছে। এই সময়ের মাঝে নিবেদিতাও নিজের মনকে নিজের আয়ত্তে এনে ফেলেছে অনেকটা। এখন তার শুধু একটাই উদ্দেশ্য যেভাবেই হোক তাকে দেশের বাইরে যেতে হবে। এজন্য সে তার পুরোটা সময় প্রায় পড়াশোনার পেছনেই ব্যয় করে। বাবা-মা অনেকবার করে বলেছিল গ্রামে এসে কয়েকদিন থাকার জন্য। কিন্তু সে রাজি হয়নি। গ্রামে যাওয়া মানে আবারও একটা মায়ায় আটকে পড়া। তার এখন বড়ো শ’ত্রু’ই হচ্ছে মায়া। সে কোনো ব্যক্তি বা কোনো কিছুর মায়াতেই আর আটকাতে চায় না। কথাগুলো শুনতে অনেকটা স্বার্থপরের মতো লাগলেও মাঝে মাঝে নিজেকে ভালো রাখার জন্য একটু স্বার্থপর হতে হয়। এর মাঝে নির্ণয়ের সাথেও আর নিবেদিতার কোনো যোগাযোগ হয়নি। সেও আর ঐ বাড়িতে যায়নি। কখনো খালা অথবা কখনো খালু এসে রান্না করা খাবার দিয়ে যেত। এছাড়া গ্রাম থেকে বাবা-মা, দুই ভাই তো প্রতি সপ্তাহেই নিবেদিতাকে দেখতে আসতো।
অবাক করা বিষয় হলো মিদহাদ এত কাছে থেকেও কখনো প্রয়োজন ব্যতীত নিবেদিতার সঙ্গে দেখা করতে আসেনি। কোনো ফোন করেনি। যতবার দেখা হয়েছে ততবার শুধু নিবেদিতার প্রয়োজনেই দেখা হয়েছে। এমন না যে নিবেদিতা তাকে যেচে ডেকেছে অথবা মিদহাদ নিজে যেচে এসেছে। প্রতিবারই নয়নের নির্দেশনা মোতাবেক মিদহাদ হাজির হতো। দূরে থেকেও যেন ছায়ার মতোই ছিল। প্রথম প্রথম মানুষটাকে বিরক্ত লাগলেও ম্যানার্স জানার পর নিবেদিতা বুঝতে পেরেছে মানুষটা খারাপ নয় এবং সে তার ভালোই চায় সর্বদা।
নিবেদিতার IELTS এক্সামের আর মাত্র তিনদিন বাকি আছে। এত বেশি নার্ভাস হয়ে পড়েছে যে তার মনে হচ্ছে এতদিন সে যা পড়েছিল সব ভুলে গেছে। পরীক্ষায় হয়তো সে কিছুই লিখতে পারবে না। দুশ্চিন্তায় তার কান্না পাচ্ছে এখন। কী করবে না করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। ঠিক সেই সময়ে মিদহাদের কল আসে। নিবেদিতা ঘড়ির দিকে তাকাল। সন্ধ্যা সাতটা বাজে। এই সময়ে হঠাৎ তার কল? দরকার ছাড়া তো কখনো কল করে না। নিবেদিতা নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে ফোন রিসিভ করল,
“হ্যালো।”
“হ্যালো, তুমি কি হোস্টেলে?”
“হ্যাঁ, কেন?”
“একটু নিচে আসতে পারবে?”
“কোনো দরকার?”
“হ্যাঁ, আহামরি না যদিও। তবে আসতে পারলে ভালো হতো। বেশি সময় না। পাঁচ মিনিটের জন্য।”
“আসছি।” বলে চোখমুখ মুছে নিচে নামল নিবেদিতা।
মিদহাদ হোস্টেলের গেইটের বাইরে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। নিবেদিতাকে দেখে প্রথমে মৃদু হাসলেও পরক্ষণে হাসি মিলিয়ে গেল। নিবেদিতা কাছাকাছি আসার পর চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কি কান্না করেছ?”
নিবেদিতা নিশ্চুপ। মিদহাদ ফের বলল,
“বলো? কী হয়েছে? কোনো সমস্যা?”
নিবেদিতা দুদিকে মাথা নাড়াল। মিদহাদ বলল,
“কেউ কিছু বলেছে?”
এবারও নিবেদিতা দুদিকে মাথা নাড়াল। তার এত বেশি কান্না পাচ্ছে! এমন দুশ্চিন্তা তার আগে কখনো হয়নি। সে ফোঁপানোর স্বরে বলল,
“আমি যদি IELTS-এ না টিকি তাহলে বিষয়টা ভীষণ খারাপ হবে!”
“টিকবে না মানে? কে বলেছে তোমাকে এসব কথা?”
“কেউ বলেনি। আমারই মনে হচ্ছে। টেনশন হচ্ছে খুব। আমার এত কষ্ট, শ্রম বৃথা গেলে আমি মানতেই পারব না।”
“এমন কিছুই হবে না, প্রাণ। তুমি ভালো স্কোর নিয়েই টিকবে দেখে নিও। আপাতত মাথাকে ঠান্ডা রাখো। পরীক্ষার আগে এত চিন্তা করা যাবে না। জাস্ট রিল্যাক্স থাকবে আর ভাববে, ‘যা হওয়ার হবে। আমি চেষ্টা করব বাকিটা আল্লাহ্ ভরসা।’ দুশ্চিন্তাকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। তাছাড়া IELTS আহামরি কঠিন কিছু না। টেইক ইট ইজি।”
নিবেদিতা চুপ করে আছে। মিদহাদ বলল,
“তুমি কি বুঝতে পেরেছ আমার কথা?”
“হু।”
“এখনো টেনশন করবে?”
“না। আপনি হঠাৎ ডাকলেন যে? কোনো দরকার?” প্রসঙ্গ বদলাল সে।
“হ্যাঁ, আমি চলে যাচ্ছি। তাই ভাবলাম একবার দেখা করে যাই।”
নিবেদিতা বোকার মতো প্রশ্ন করল,
“কোথায় যাচ্ছেন?”
“কোথায় আবার? লন্ডন। ছুটি শেষ।”
“ওহ, হ্যাঁ! ভুলে গিয়েছিলাম। আজই ফ্লাইট?”
“হ্যাঁ। রাত এগারোটায়।”
“ওহ। সাবধানে যাবেন।”
“ইন-শা-আল্লাহ্। তুমি নিজের খেয়াল রেখো। রিল্যাক্সে থেকো। ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষা দিও।”
“আচ্ছা।”
“তোমাকে মিস করব।”
নিবেদিতা প্রত্যুত্তরে মৃদু হাসল শুধু। মিদহাদ গাড়িতে ওঠার আগে বলল,
“আল্লাহ্ হাফিজ, প্রাণ।”
“আল্লাহ্ হাফিজ।”
প্রত্যুত্তরে এবার মিদহাদও একটা হাসি উপহার দিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। জানালা গলিয়ে মাথা বের করে হাত নাড়িয়ে বাই জানাল। নিবেদিতা নিজেও হাত নাড়িয়ে বিদায় দিল মিদহাদকে। চোখের পলকেই সাদা রঙের গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে গেল। নিবেদিতা অনেকক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইল গেইটের কাছে।
(প্রথম পরিচ্ছেদের সমাপ্তি)
[কপি করা নিষেধ।
বিঃদ্রঃ এই পর্ব থেকে পরের কয়েকটা পর্ব হয়তো একটু দ্রুত এগুতে পারে কারণ স্লো কাহিনি পড়ার মনোযোগে বাঁধা সৃষ্টি করে। তবে হ্যাঁ, আজকের পর্বটা ভালো করে পড়বেন আর কিছু জিনিস মাথায় রাখবেন।]