নিবেদিতা #পর্ব_১৫ #মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া

0
108

#নিবেদিতা
#পর্ব_১৫
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_______________
নির্ণয়ের নিষ্পলক মুখের দিকে জবাবের আশায় চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে আছে নিবেদিতা। সে ঐ চোখের ভাষা পড়তে পারছে না। নির্ণয়ই বা বলছে না কেন কিছু? কেন সে এখানে?

ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের নির্ণয় বুকের মাঝে আস্ত একটা ডায়ারি লিখে ফেললেও নিবেদিতার সামনে এসে সে মুখে কিছুই বলতে পারল না। কেবল নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কী বলবে সে? আসলে মন তো অনেক কিছুই বলতে চায়। বলার জন্যই তো এত পরিশ্রম, এত কষ্ট করে এই দূর দেশে চলা আসা সবাইকে রেখে। কিন্তু ভাগ্যের কী পরিহাস, নিবেদিতাকে সেসবের কিছুই সে বলতে পারছে না। আশেপাশে তাকিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করল এবং সত্যিটা লুকিয়ে বলল,

“আমি এখানে জবের জন্য এসেছি।”

কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ল নিবেদিতার। অস্পষ্ট স্বরে বলল,

“জবের জন্য!”

এত দেশ থাকতে তাকে ডেনমার্কেই আসতে হলো জবের জন্য? তাহলে তার এত কষ্ট আর দেশ ছাড়া কি সব বৃথা গেল? কী চায় সে? তিলে তিলে মে’রে ফেলতে?

নিবেদিতাকে এরকম নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে নির্ণয় জিজ্ঞেস করল,

“তুমি এমন অস্বাভাবিক আচরণ করছ কেন? আমার এখানে আসাটা কি খুব বেশিই অস্বাভাবিক?”

নিবেদিতা বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। বলল,

“আমার কাছে সেরকমই। আপনি যে ডেনমার্কে আসবেন বা এসেছেন এমন কিছু তো আমি কারো থেকে শুনিনি। এমনকি আপনিও আমাকে জানাননি।”

“তুমি বোধ হয় ভুলে গেছ, তোমার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না।”

“এজন্য যোগাযোগ করে জানানো যায়নি?”

নির্ণয়ের মন বলতে চাইল, নিবেদিতাকে বল,

“তোমাকে সারপ্রাইজ দেবো তাই বলিনি।”

কিন্তু তার ভেতরকার কাঠখোট্টা স্বভাবের সত্তা বলে ফেলল,

“প্রয়োজন মনে করিনি তাই।”

নিবেদিতা আহত দৃষ্টিতে তাকাল। ঐ দৃষ্টি দেখে ভেতরে ভেতরে এলোমেলো হয়ে যেতে লাগল নির্ণয়। নিজেকে নিজেই মনে মনে গালাগাল করল। বলতে চাইল,

“আমি এসব বলতে চাইনি নিবেদিতা। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি।”

কিন্তু হায়! তার এই নরম, ভালোবাসাময় সত্তা যেন নিবেদিতার সামনে আসতে নারাজ। সে কোনোভাবেই মনের সত্যিকার ভাব প্রকাশ করতে পারছে না।

নিবেদিতার ভীষণ অভিমান হলেও সেটা সে নির্ণয়কে বুঝতে দিতে চাইল না। গলার স্বর কঠিন করে বলল,

“বেশ তো! তাহলে আমার কাছে কেন?”

নির্ণয় বুঝল নিবেদিতার লুকানো অভিমান। তবুও সে বাইরের অদৃশ্য প্রাচীর টপকে নিবেদিতার অভিমান ভাঙাতে যেতে পারল না। বলল,

“দরকার ছিল। কফিশপে গিয়ে তখন তোমায় দেখলাম।”

অথচ সত্যিটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে তার মাকে দিয়ে নিবেদিতার মায়ের থেকে ও কোথায় থাকে, ও কোথায় জব করে সব জেনে নিয়েছে। আর এখানে এসেছেও নিবেদিতার সঙ্গেই দেখা করতে। ডেনমার্কে আসার আজ দুদিন হয়েছে তার। সবকিছু গুছিয়ে আজই দেখা করার সময় হয়েছে। তাই সরাসরি নিবেদিতার বেকারিতে চলে এসেছিল। খোঁজ নিয়ে জানল, আজ নিবেদিতা ছুটি নিয়ে আগেই বের হয়ে গেছে। তাই বিষন্নচিত্তে নির্ণয় চলে যাওয়ার সময় বাইরের কাচ ভেদ করে ক্লান্ত নিবেদিতাকে কফিশপে দেখতে পায়। এতগুলো মাস পর নিবেদিতাকে দেখে আনন্দে, উল্লাসে তার বুকটা ধ্বক করে উঠেছিল। যেই ছেলে কখনো প্রেম-ভালোবাসার ধারেকাছেও ছিল না সেই ছেলেরই তখন ইচ্ছে করছিল নিবেদিতাকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করতে। জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করছিল,

“আমি চলে এসেছি তোমার কাছে।”

কিন্তু সব গোলমাল করে ফেলেছে সে। নিবেদিতাকে খুশি করতে গিয়ে উলটো কষ্ট দিয়ে ফেলেছে।

নিবেদিতা বিদ্রুপ করে হেসে বলল,

“ঠিক আছে। আমার এখন যেতে হবে।”

“আমি পৌঁছে দেবো?” সাহস করে বলল নির্ণয়।

নিবেদিতা বলল,

“না। আমার ফ্রেন্ড আসবে।”

“কখন?”

“এখনই।”

“ততক্ষণ আমি থাকি তোমার সাথে?”

নিবেদিতা কিছু বলল না। আবার বেঞ্চটিতে বসে পড়ল। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে সাবিহাকে কল করল কতদূর আছে জানার জন্য। নির্ণয়ও বসল পাশে। অপেক্ষা করতে লাগল নিবেদিতা হয়তো তাকে কিছু জিজ্ঞেস করবে। জানতে চাইবে অনেক কিছু। কিন্তু নিবেদিতা আর কিছুই জানতে চাইল না। কোনো প্রশ্নই করল না। নির্ণয়ও আগ বাড়িয়ে কিছুই বলতে পারল না। অথচ কত কিছুই বলবে বলে ভেবে এসেছিল সে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে সাবিহা চলে এলো। সঙ্গে পলও আছে। সে নিবেদিতাকে দেখেই স্পষ্ট ইংলিশে বলল,

“হেই নিঠা, কেমন আছো?”

নিবেদিতা মৃদু হেসে বলল,

“ভালো। তুমি?”

“ভালো।”

নির্ণয় তাকিয়ে আছে ফ্যালফ্যাল করে। নিবেদিতাকে বলল,

“নিঠা না পিঠা কী যেন বলল? তুমি কি এখানে এসে নিজের নামও বদলে ফেলেছ?”

নিবেদিতার মেজাজ খারাপ হলো। তার নাম নিয়ে এত কাহিনি আর ভালো লাগছে না। সে চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,

“নাম বদলাইনি। পল এত বড়ো নাম বলতে পারে না। তাই সংক্ষেপে নিঠা বলে।”

“মাই গুডনেস! পিঠা বলে না এই অনেক।”

সাবিহা হেসে ফেলল নির্ণয়ের কথা শুনে। নিবেদিতাকে বলল,

“উনি কে? তোমার বয়ফ্রেন্ড? তুমি যে বয়ফ্রেন্ডও জুটিয়ে ফেলেছ এর মাঝে বলোনি তো?”

নিবেদিতা তড়িৎ গতিতে মাথা নাড়িয়ে বলল,

“না, না। আমার কাজিন সে।”

এরপর ভদ্রতা রক্ষা করতে ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল,

“আমার খালাতো ভাই নির্ণয়। আর ওরা হচ্ছে আমার বন্ধু। ওর নাম সাবিহা আর তার নাম পল। আমি পলের নানির বাড়িতে ভাড়া থাকি।”

নির্ণয় ভদ্রতাসূচক ওদরকে হাই বলল। ওরাও প্রত্যুত্তরে হাই বলল। সাবিহা নিবেদিতাকে বলল,

“তুমি তো আগে বলোনি যে, ডেনমার্কে তোমার কাজিনও থাকে?”

নির্ণয় সাবিহার ভুল ভাঙাতে বলল,

“আসলে আগে থাকতাম না। আমি নিবেদিতার পরে এসেছি। দুদিন হয়েছে।”

“ওহ আচ্ছা। আপনি ফ্রি থাকলে আমাদের সাথে জয়েন হতে পারেন পার্টিতে।”

পার্টির কথা শুনেই নির্ণয় বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকাল নিবেদিতার দিকে। নিবেদিতা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে এভাবে তাকানোতে। সে কোন পার্টি ভেবে নিয়েছে কে জানে! হয়তো উলটা-পালটাও ভাবতে পারে। ভাবতে পারে যে, নিবেদিতা বিদেশে এসে স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। সাবিহা হয়তো বিষয়টা বুঝতে পারল দুজনের চোখ চাওয়া-চাওয়ি দেখে। সে নির্ণয়কে বলল,

“ভাইয়া, এটা বার্থডে পার্টি। আজ আমার জন্মদিন তো তাই ছোটোখাটো একটা আয়োজন করেছি।”

নির্ণয়ের বুক থেকে যেন একটা ভার নেমে গেল। সে সৌজন্যতা দেখিয়ে সাবিহাকে উইশ করে বলল,

“ঠিক আছে। ওর খেয়াল রাখবেন।”

“আপনার কি কাজ আছে এখন? না থাকলে আপনিও আসুন ভাইয়া। দ্বীপে সেলিব্রেট করব। মজা হবে।”

নির্ণয়ের দ্বীপ-ট্বীপের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। এত রাতে নিবেদিতা পার্টিতে জয়েন করবে তাও আবার কিনা দ্বীপে! এই দুশ্চিন্তাতেই তার মাথা নষ্ট। সাথে আবার পলকে দেখে সে আরো দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। বার্থডে সেলিব্রেট করবে মানে আরো মানুষজন থাকবে। এখানে মানুষজন বলতে ছেলে নিয়েই তার বেশি চিন্তা। যদিও না জেনে কারো সম্পর্কে খারাপ ধারণা করা ঠিক না। তবুও মন তো! প্রিয় মানুষের ব্যাপারে সব সময়ই সতর্ক থাকতে চায়। সে নিবেদিতার জন্য বার্থডে পার্টিতে যেতে রাজি হয়ে গেল। বলল,

“তাহলে আপনারা একটু ওয়েট করুন। আমি শপ থেকে আসি?”

সাবিহা বলল,

“কেন?”

“খালি হাতে যাই কী করে?”

“এখন কিছুবলাগবে না ভাইয়া। পরে এক সময় দিয়ে দিয়েন। আমরা এমনিতেই দেরি করে ফেলেছি।”

“ঠিক আছে। আমি নিবেদিতার কাছে আপনার গিফ্ট পাঠিয়ে দেবো।”

সাবিহা হেসে বলল,

“ঠিক আছে।”

এতক্ষণ পল এবং নিবেদিতা দুজনই চুপচাপ ছিল। এবার পল বলল,

“চলো যাওয়া যাক।”

সাবিহা বলল,

“চলো।”

ড্রাইভিং সিটে পল বসেছে। ওর পাশে বসেছে সাবিহা। নতুন মানুষের সাথে ইজি হতে পারবে কিনা ভেবে নির্ণয়কে পেছনে নিবেদিতার সাথে বসতে দিয়েছে সাবিহা।

গাড়ির জানালা খোলা। বাতাস আসছে বেশ। নিবেদিতা ও নির্ণয় দুজন গাড়ির দুই মাথায় বসা। ভাব এমন যে একজন আরেকজনের শত্রু। কেউ কারো সাথে কোনো কথাও বলছে না। সাবিহা নিজেই নির্ণয়কে জিজ্ঞেস করল,

“ভাইয়া এখানে কোথায় উঠেছেন?”

“কোপেনহেগেন শহরেই।”

“ওহ আচ্ছা। আমরা শহর থেকে একটু ভেতরের দিকে থাকি। দ্বীপটাও ঐদিকেই। আমাদের বাড়ি ক্রস করেই যাব।”

“এত রাতে দ্বীপে সমস্যা হবে না?”

নির্ণয় কথা কম বলা মানুষ। কিন্তু আজ যেচে এত প্রশ্ন করছে নিবেদিতার সেইফটির কথা ভেবেই। আফটারঅল, সে নিজেই এই দেশে নতুন।

সাবিহা হেসে বলল,

“না, ভাইয়া। সিকিউরিটির ব্যবস্থা আছে।”

“দ্বীপে কি মানুষজন বাস করে?”

“না। তবে রিসোর্ট আছে, রেস্টুরেন্ট আছে। বেশি না। দ্বীপটাও ছোটো। পর্যটকমহল আসে তো মাঝে মাঝেই।”

“আরে বাহ্! ডেনমার্কে এমন কিছু আছে জানা ছিল না।”

সাবিহা হাসল। নির্ণয় এতক্ষণে খেয়াল করল নিবেদিতা জানালায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। মেয়েটার কি মাথা খারাপ? এভাবে কেউ জানালায় মাথা রাখে? সে নিস্তেজ স্বরে ডাকল,

“নিবেদিতা? নিবেদিতা?”

নিবেদিতার ঘুম ভাঙল না। সাবিহা বলল,

“থাক ভাইয়া। ঘুমাক একটু। পৌঁছেই না হয় ওকে উঠাব। কিন্তু ওর মাথাটা সরিয়ে দেন জানালা থেকে।”

নির্ণয় তাই করল। নিবেদিতার মাথা জানালা থেকে সরিয়ে গাড়ির সীটের সাথে হেলান দিয়ে রাখল। কিন্তু এতে করে বারবার ঢুলে পড়ছিল নিবেদিতা। তাই সাহস সঞ্চয় করে নির্ণয় নিজেই নিবেদিতার মাথা নিজের কাঁধে রাখল। বুকটা হঠাৎ করেই যেন নিস্তেজ হয়ে গেল নির্ণয়ের। এতটা শান্তি সে শেষ কবে অনুভব করেছিল মনে নেই। সে কখনো নিবেদিতাকে নিয়ে কিছু ভাবেনি এ কথা যেমন সত্য, তেমনই আবার যখন থেকে ওকে নিয়ে ভাবা শুরু করেছে তখন থেকে ওর প্রতিটা মুহূর্ত কাটত অস্থিরতায়। নিবেদিতার ভরসার জায়গা হবে সে কল্পনা করত। এইযে আজ, এখন হলো নিবেদিতার অজান্তেই। কেন জানে না তার চোখে মুহূর্তেই অশ্রু জড়ো হলো। আনন্দের অশ্রু।

চলবে…

[কপি করা নিষেধ।
ডেনমার্ক নিয়ে অনেক রিসার্চ করেই গল্প লিখছি। তবুও আমি যখন সেখানে যাইনি তাই অনেক কিছুই আমার অজানা। সবকিছুই অদেখা। তাই ডেনমার্কের ঘটনায় বাস্তবতার সাথে কিছুটা কল্পনাও থাকবে আমার। অসম্ভব কিছু বা ভুল কোনো তথ্য লিখে ফেললে আমাকে জানাবেন। কারণ কোনো মানুষই ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here