নিবেদিতা #পর্ব_১৬ #মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া

0
121

#নিবেদিতা
#পর্ব_১৬
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
______________
নির্ণয় এক কর্ণারে একটা চেয়ারে চুপ করে বসে আছে। ওর সামনে সফ্ট ড্রিঙ্কস। কিন্তু সেদিকে ওর মন নেই। ওর দৃষ্টি ওর থেকে একটু দূরে হাসিমুখে কথা বলতে থাকা নিবেদিতার দিকে। কী সুন্দর করে হাসছে মেয়েটা! ওরা এখানে পৌঁছানোর আগেই নিবেদিতার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তবে ঘুম ভেঙে সে নিজেকে নির্ণয়ের কাঁধে আবিষ্কার করেনি। কারণ ওর নড়াচড়া টের পেয়েই নির্ণয় ওর মাথা সীটের সাথে হেলিয়ে দিয়েছিল।

নির্ণয়ের একটা জিনিস বেশ ভালো লাগল যে, এখানে যারাই আছে কেউ কোনো অশালীন পোশাক পরেনি কিংবা উশৃঙ্খল কোনো আচরণও কারো মধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি। ইনভাইটে যারা এসেছে তাদের মধ্যে বিদেশিই বেশি। ছেলে-মেয়ে উভয়ের সংখ্যাই প্রায় সমান।

কিছুক্ষণ পর পল এলো নির্ণয়ের কাছে। ইংরেজিতে বলল,

“তুমি এখানে একা বসে আছো কেন? আমাদের সাথে জয়েন করো।”

নির্ণয় হেসে বলল,

“সমস্যা নেই। আমি এখানেই ঠিক আছি।”

“তুমি কি আনইজি ফিল করছ?”

“উম…সত্যি বলতে একটু করছি! আসলে আমি এসব পার্টি, অনুষ্ঠানে অভ্যস্ত নই তো!”

পল মাথা দুলিয়ে বলল,

“বুঝতে পেরেছি। ঠিক আছে, তবুও ইচ্ছে হলে কিন্তু আমাদের সাথে জয়েন হতে পারো।”

“ইচ্ছে হলে যাব।”

পল হেসে চলে গেল। কিছুক্ষণ নাচল সবাই। নিবেদিতা আর সাবিহা একসাথে নাচছিল। নির্ণয় এই প্রথম নিবেদিতাকে নাচতে দেখল। যদিও নাচ বিশেষ কিছু নয়। এমনিতেই একটু হাত-পা নাড়ানো, ঠোঁটে মুগ্ধ করা হাসি। নাচ শেষ হলে কেক কাটার সময় নির্ণয়কে গিয়ে ওদের সাথে জয়েন হতেই হলো। সাবিহা কেক কেটে নিবেদিতা ও পলকে খাইয়ে দিল। ওরাও সাবিহাকে খাইয়ে দিল। এই পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। কিন্তু পল যখন নিবেদিতাকে কেক খাইয়ে অল্প একটু কেক ওর গালেও মাখিয়ে দিল তখনই ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল নির্ণয়ের। রাগ, জেদ যেন উপচে বের হয়ে আসতে চাচ্ছিল। পল হাসছে। নিবেদিতা দুম করে ওর পিঠে একটা কিল দিয়ে বলল,

“খুব খারাপ হলো এটা। আমার স্কিন খুব সেনসিটিভ!”

এইযে নিবেদিতা রাগ করে পলকে মারল, এটাও নির্ণয়ের ভালো লাগল না। কেন? অদ্ভুত! সে তো মোটেও হিংসুটে স্বভাবের নয়। তার ভেতর যে জেলাসি সত্তাও আছে এটা তো সে কখনোই টের পায়নি। সবাইকে কেক কেটে দেওয়া হলো পিরিচে। নির্ণয়কেও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে কেক খেল না। চুপ করে আবার আগের জায়গায় গিয়ে বসে রইল। যথাসম্ভব চেষ্টা করল নিজের অনুভূতি সুপ্ত অবস্থায় রাখতে।

এখানে বিভিন্ন আইটেমের খাবারের পাশাপাশি অ্যালকোহলেরও ব্যবস্থা আছে। চাইলে যে কেউ খেতে পারবে। বিল সব সাবিহার। এই সুযোগ অনেকেই হাত ছাড়া করল না। পল এসে নির্ণয়কে রেড ওয়াইন অফার করল। নির্ণয় ভদ্রতার সাথে বলল,

“আমি এসব খাই না।”

পল হেসে বলল,

“তুমি এবং নিঠা দেখি একই। নিঠাও খায় না।”

নির্ণয় হাসল। তাকাল একবার নিবেদিতার দিকে। মেয়েটাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তবুও সে স্বতঃস্ফূর্ত থাকার চেষ্টা করছে সাবিহার সামনে। হোয়াটসএপে তখন বিউটি বেগমের কল এলো। নির্ণয় কল রিসিভ করে অন্য সাইডে চলে গেল।

বিউটি বেগম জিজ্ঞেস করলেন,

“কেমন আছিস বাবা?”

“ভালো আছি, মা। তুমি কেমন আছো?”

“আমিও ভালো আছি। তুই এখন কোথায়? নিবেদিতার সাথে দেখা হয়েছে?”

“হ্যাঁ, ওর সাথেই আছি এখন।”

“নিজের মনের কথা জানিয়েছিস?”

“না, মা। উলটো আরো হার্ট করে কত কী বলে ফেলেছি!”

বিউটি বেগম অবাক হয়ে বললেন,

“সে কী! কেন?”

“জানিনা মা। আমি বলতে চাই একটা, ভেতরের সত্তা বলে আরেকটা।”

“এমন দোনোমনা করলে তো চলবে না নির্ণয়। নিবেদিতারও তো জানা প্রয়োজন যে, তুই শুধু ওর জন্যই ডেনমার্কে গিয়েছিস। আর এরজন্য তোকে কত কষ্ট করতে হয়েছে।”

“বলব মা। আমার বোধ হয় আরেকটু সময় নেওয়া প্রয়োজন।”

“আর কত সময়? পরে না আবার দেরি হয়ে যায়।”

”হবে না। তুমি…”

পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই নিবেদিতা চলে এল সেখানে। পরে কথা বলবে বলে নির্ণয় কল কেটে দিল। নিবেদিতা বলল,

“কে? খালামনি?”

“হুম।”

“ওহ। কল কাটলেন কেন? কথা বলতাম আমিও।”

“আচ্ছা কল দিচ্ছি।”

“না, থাক! এখন আর কল দিতে হবে না। বলছিলাম যে, আপনি কি আরো থাকবেন এখানে?”

“কেন? তুমি থাকবে না?”

“আমার ভীষণ মাথাব্যথা করছে। বাসায় যেতে চাচ্ছি। আপনি চাইলে থাকতে পারেন।”

“তুমি না থাকলে আমি থেকে কী করব? আমি কি এদের কাউকে চিনি?”

“থাকতে জোর করিনি। তাহলে চলুন আমরা চলে যাই।”

“চলো।”

নির্ণয় ও নিবেদিতা সাবিহার থেকে বিদায় নিয়ে বাসার উদ্দেশে রওনা দিল। দ্বীপ থেকে বোটে করে ওরা মেইন রোডে এলো। নিবেদিতা বলল,

“এখান থেকে আমার বাসা কাছেই। আপনাকে আরেকটু সামনে গিয়ে ট্যাক্সি নিতে হবে। আপনি কি আমার বাসায় যাবেন?”

সংকোচে সরাসরি ‘হ্যাঁ’ বলতে পারল না নির্ণয়। বলল,

“তোমার বাসায় গিয়ে কী করব?”

“কিছুই না। চাইলে রেস্ট করতে পারেন।”

“ঠিক আছে।”

নিবেদিতা ভেবেছিল নির্ণয় রাজি হবে না। কিন্তু ওকে আশ্চর্য করে দিয়ে সে রাজি হয়ে গেল। ওর মুখের বিস্মিত ভাব লক্ষ করে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে হাসল নির্ণয়। বাড়িতে গিয়ে ওকে বসতে দিল নিবেদিতা। ব্যাগ টেবিলের ওপর রেখে বলল,

“আমার এই রুমের ভেতরই সব।”

এক সাইডে ওয়াশরুম, অন্য সাইডে কিচেন। বেড বরাবর বিশাল বড়ো একটা জানালা। বেডের পাশেও একটা জানালা। সামনে বড়ো একটা বারান্দা। নির্ণয় চোখ ঘুরিয়ে পুরো রুমটা দেখল। এক রুমের ভেতর সব হলেও রুমটা বিশাল।

নিবেদিতা বলল,

“আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি চা বানাই।”

নির্ণয় মাথা দুলিয়ে সায় জানিয়ে ওয়াশরুমে গেল। নিবেদিতা কিচেনে গিয়ে বড়ো করে শ্বাস নিল। তার বুক ধুকপুক করছে। এভাবে একা বাড়িতে সে নির্ণয়ের সাথে ভাবতেই শরীরে কাঁটা দিচ্ছে। যদিও জানে যে উলটা-পালটা কিছু হওয়ার সম্ভাবনা একদমই নেই। তবুও বুকের ভেতরটায় কেমন যেন দম বন্ধ করা অনুভূতি হচ্ছে। নিবেদিতার তো মনে হচ্ছে, সে ঠিকমতো নির্ণয়ের সামনে শ্বাসও নিতে পারছে না। কখন না জানি আবার নির্ণয় বলে বসে,

“তুমি শ্বাস আটকে রেখেছ কেন?”

কয়েকবার কিচেনেই পায়চারি করে নিজেকে ও মনকে ধাতস্থ করার ট্রাই করল নিবেদিতা। এরপর চুলায় চায়ের পানি বসিয়ে দিয়ে পেয়াজ-মরিচ কাটতে লাগল। শুধু চা তো আর দেওয়া যায় না। সাথে নুডলস বানিয়ে দেবে ভাবল সে। চা আগে বানাল। চা খেতে খেতে নুডলস রান্না করা হয়ে যাবে। চা ও বিস্কুট নিয়ে গিয়ে দেখল নির্ণয় উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। তাও আবার আড়াআড়িভাবে। ওর অর্ধেক পা বিছানার বাইরে। বেডের সাথে থাকা জানালাটি নির্ণয় খুলে দিয়েছিল। সেখান থেকেই প্রচণ্ড বাতাস আসছে। সেই বাতাসে নির্ণয়ের চুল দুলছিল। উপুড় হয়ে শুয়েছে বলে মুখের এক সাইড শুধু দেখা যাচ্ছে। চোখ বন্ধ। ঘুমাচ্ছে নাকি? হঠাৎই নিবেদিতার মনে হলো, নির্ণয় ভীষণ ক্লান্ত। এই ক্লান্ত মুখটা দেখে বড্ড মায়া হলো নিবেদিতার। মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে হলো। তবে সেই ইচ্ছেকে সংবরণ করে বার দুয়েক ডাকল সে নির্ণয়কে। নির্ণয়ের সাড়া না পেয়ে বুঝতে পারল সে এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাই আর বিরক্ত না করে চায়ের কাপটা টি-টেবিলের ওপর রাখল। নির্ণয়ের পা দুটো বিছানায় উঠিয়ে একটা পাতলা চাদর গায়ের ওপর দিয়ে দিল। এতক্ষণে চা অনেকটাই ঠান্ডা হয়ে গেছে। ঠান্ডা চা টুকু এক চুমুকে শেষ করে নিবেদিতা রান্নাঘরে গিয়ে নুডুলস রান্না করল। যদি মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে কিছু খেতে চায়? রান্না শেষ করে রুমে এসে সে কী করবে বুঝতে পারছে না। লাইট নিভিয়ে দিয়ে সে বারান্দায় চলে গেল। যদিও কাচের এপাশ থেকে পুরো রুমটাই দেখা যাচ্ছে। নিবেদিতা একটা চেয়ারে বসে রইল চুপচাপ। কতক্ষণ নির্ঘুম বসে ছিল সে জানে না। এক সময়ে চেয়ারে পা তুলে গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে যায় সে।
.

নির্ণয়ের ঘুম ভাঙল একটা সুন্দর স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নে নিবেদিতা টুকটুকে লাল রঙের একটা জর্জেট শাড়ি পরা। দুহাত ভরতি খাঁজকাটা লাল রঙের কাচের চুড়ি। হালকা সাজ আর খোলা চুল। এত সুন্দর লাগছিল যে নির্ণয় মুগ্ধ হয়ে শুধু তাকিয়েই ছিল। দুজনে তখন সাজেকে ছিল। বারান্দায় যখন দুহাত মেলে নিবেদিতা দাঁড়িয়ে ছিল তখন সাদা মেঘের মাঝে তাকে অপরূপ সুন্দরী লাগছিল। চোখ ধাঁধানো সুন্দর যাকে বলে। যেই না নির্ণয় নিবেদিতার খুব কাছে গেল ওমনি ঘুম ভেঙে গেল তার।

ঘুম ভাঙার পর আশেপাশে তাকিয়ে বেশ অবাক হলো নির্ণয়। তৎক্ষণাৎ মনে করতে পারল না সে কোথায় আছে! এই ঘর, বিছানা কোনো কিছুই তো তার নয়। সে শোয়া থেকে উঠে বসল। আশেপাশে তাকাতেই তার চোখ গেল কাচের বারান্দার ঐপাশে চেয়ারে ঘুমিয়ে থাকা নিবেদিতার দিকে। একটা মানুষ এমন দলা পাকিয়ে ঘুমায় কীভাবে? নির্ণয় গুটি গুটিয়ে পায়ে এগিয়ে গেল। নিবেদিতা গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। নির্ণয় চেয়ারের হাতলে দুপাশে হাত রেখে নিবেদিতার মুখের দিকে ঝুঁকে দাঁড়াল। এখন অনেকটা কাছে আছে দুজনে। নির্ণয়ের খুব ইচ্ছে করছিল অপূর্ণ স্বপ্নটাকে বাস্তবে পূর্ণতা দিতে। কিন্তু সে এমন কিছু করল না। করবেও না। সঠিক সময়ের জন্য রেখে দিল। এখন কেবল খুব কাছ থেকে মন ভরে দেখল নিবেদিতাকে। হঠাৎ করেই নিবেদিতা চোখ মেলে তাকাল। কয়েক সেকেন্ড দুজনের কেউই যেন কিছু বুঝতে পারল না। থম মেরে রইল। এরপর একসাথে দুজনই ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল। নির্ণয় চিৎকার দিয়ে সরতে গিয়ে ধপাস করে ফ্লোরে পড়ে গেল। ব্যথায় আর্তনাদ করে বলে উঠল,

“বাবারে!”

চলবে…

[কপি করা নিষেধ।
মিদহাদ ভক্তগণ, অপেক্ষা করুন। মিদহাদের কাহিনি সামনে আসবে।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here