#নিবেদিতা
#পর্ব_৩১
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____________
(চতুর্থ পরিচ্ছেদ)
ঝকঝকে রোদ আজ বাইরে। রাশিয়ার বাইরের পরিবেশ আজ ভীষণ সুন্দর। স্বচ্ছ মৃদু বাতাসে গাছের পাতাগুলো হালকা নড়ছে। নির্ণয় রাশিয়ায় এসেছে আজ দশদিন হবে। এর মাঝে তার পায়ের অপারেশন হয়েছে আজ তিনদিন। এখনো সে হাসপাতালেই আছে। মনে মনে এক নতুন উত্তেজনা টের পাচ্ছে সে। এবার সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে আর দেরি করবে না। দুই পরিবারকেই নিজেদের ভালোবাসার কথা জানাবে। তারপর নিবেদিতাকে বিয়ে করে ফেলবে। শুধু আর একটু সময় প্রয়োজন তার।
নির্ণয়ের ফোন বেজে উঠল তখন। স্ক্রিনে নিবেদিতার হাসিমাখা মুখটার ছবি দেখেই তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। মনের ভেতর বয়ে গেল শান্ত বাতাস। প্রণয়িনীর কণ্ঠস্বর যেকোনো রোগের ব্যথানাশক। নির্ণয় কল রিসিভ করে দেখল নিবেদিতা শুয়ে আছে। জিজ্ঞেস করল,
“আজ বাসায়?”
নিবেদিতা ফোন নিয়ে অন্যপাশে ঘুরে শুয়ে বলল,
“হ্যাঁ। শরীরটা ভালো লাগছে না আজ।”
“কেন? কী হয়েছে তোমার?” নির্ণয়ের চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ে গেল মুহূর্তেই। কণ্ঠ তত্রস্থ।
নিবেদিতা ওকে শান্ত করে বলল,
“তেমন কিছু না। এমনিই ক্লান্তবোধ করছিলাম। একটানা কাজ, পড়াশোনা করতে হচ্ছে তো তাই আজ আর যাইনি বেকারিতে। ছুটি নিয়েছি।”
নির্ণয় গোপনে দীর্ঘশ্বাস নিল। মনে মনে বলল,
“আর কয়েকটা দিন কষ্ট করো। এরপর আর কোনো কষ্ট করতে হবে না।”
নিবেদিতা বলল,
“আমার কথা ছাড়ুন। আপনার কী অবস্থা এখন? ঠিকমতো মেডিসিন নিচ্ছেন? নিজের খেয়াল রাখছেন?”
“হ্যাঁ, সব নিয়ম মেনেই করছি। আমারও তো সুস্থ হওয়ার তাড়া আছে। নিজের বউকে আর কতদিন দূরে রাখব বলো?”
নিবেদিতা ফিক করে হেসে ফেলল। কিঞ্চিৎ লজ্জাও পাচ্ছে সে। লজ্জা এড়িয়ে যেতে জিজ্ঞেস করল,
“খালা কোথায়?”
নির্ণয় দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
“কথা তো ভালোই ঘোরাতে পারো। অবশ্য লজ্জা পেলে কিন্তু তোমাকে আরো বেশি সুন্দর লাগে। গাল দুটোকে টমেটোর মতো লাগে। অবশ্য রাগলেও এমনই লাগে। শুধু তখন মুখে হাসি থাকে না এটুকুই পার্থক্য।”
“হয়ে গেছে আপনার গবেষণা? শেষ?”
“না, শেষ আর কীভাবে হবে? এখনো তো শুরুই হলো না। দেখা হোক আমাদের। আমি সুস্থ হয়ে ফিরে আসি তারপর…”
“খালামনি কোথায় বলেন?” নির্ণয়কে আর সুযোগ দিল না লজ্জা দেওয়ার। তাই চট করে আবারও সে কথার প্রসঙ্গ বদলে ফেলল।
নির্ণয় বুঝতে পেরে ঠোঁট টিপে হাসল। তবে এবার আর লজ্জা দিল না। বলল,
“ওষুধ আনতে গেছে।”
“হেই নির্ণয়, কেমন আছেন আপনি?”
ডক্টর রুহির প্রশ্নে নির্ণয় দরজার দিকে তাকাল। রুহিই ওর অপারেশন করেছে এবং মাঝে মাঝেই সে নির্ণয়ের খোঁজ নিতে আসে। সে বাংলাদেশি হলেও জন্ম ও বেড়ে ওঠা তার রাশিয়াতেই। তাই চালচলন, কথাবার্তা একদম দেখতেও অনেকটা সে বিদেশিনীদের মতোই। গায়ের ত্বক ধবধবে ফরসাই বলা যায়। যেন টোকা দিলেই সাথে সাথে লাল হয়ে যাবে জায়গাটা। চুলগলো ব্রাউন কালার। স্বচ্ছ কালো মণি চোখের। ঠোঁটে সবসময় লিপগ্লস দেওয়ায় দেখতে লাগে মুক্তোর মতো উজ্জ্বল। যেকোনো পুরুষের ড্রিম গার্ল তাকে বলাই যায়। সে ডক্টর, এটা ছাড়াও তার আরো একটা পরিচয় আছে। রুহি মূলত নির্ণয়ের কাজিনের বন্ধু। হয়তো সেজন্যই রুহি নির্ণয়ের এক্সট্রা কেয়ার করে থাকে।
এপ্রোনের পকেটে দুহাত রেখে রুহি নির্ণয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নিবেদিতা তখনো ভিডিয়ো কলেই আছে। নির্ণয় মৃদুস্বরে রুহির প্রশ্নের জবাব দিল,
“ওয়েল।”
রুহি এবার সামনে দাঁড়িয়ে নির্ণয়ের কপালে হাত রেখে বলল,
“জ্বর আছে এখনো? আন্টির কাছে শুনলাম, গতকাল রাতে নাকি জ্বর এসেছিল?”
নির্ণয় হাত সরিয়ে দিল। চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,
“জ্বর নেই।”
রুহি এবার নির্ণয়ের ফোনের দিকে খেয়াল করল। মিষ্টি করে হেসে বলল,
“সরি। আমি খেয়াল করিনি আপনি ফোনে কথা বলছেন। এনিওয়ে, আমি বেশি সময় নেব না। আপনি ঠিকমতো খাবারও খাচ্ছেন না শুনলাম। এমন করলে তো চলবে না। এই সময় আপনাকে পুষ্টিকর খাবার বেশি বেশি খেতে হবে। সময়মতো ঘুমাতে হবে। গতকালও তো আমি এসব বলে গেলাম। আপনি আমার কথা শুনছেন না কেন?”
নির্ণয় কী জবাব দেবে বুঝতে পারছে না। তাই সে চুপ করেই রইল। ডক্টর রুহি বলল,
“প্লিজ! আর এমন করবেন না। নিজের খেয়াল রাখবেন। আমি পরে আসব আবার।”
নির্ণয় এবারও কোনো জবাব দিল না। রুহি চলে যাওয়ার পর নিবেদিতা জিজ্ঞেস করল,
“আপনার ডক্টর?”
নির্ণয় ছোটো করে বলল,
“হু।”
“বাংলায় কথা বলছে। অথচ দেখতে লাগে বিদেশিনী।”
“হু, বাদ দাও তার কথা। তুমি এখন কী করবে?”
নিবেদিতা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল,
“একটু ঘুমাব। আপনিও একটু ঘুমিয়ে নিন।”
“ঠিক আছে। ঘুম থেকে উঠে ফোন দিও।”
“ঠিক আছে। রাখছি।”
“নিবেদিতা?”
“বলেন।”
“মিস ইউ।”
নিবেদিতা মৃদু হেসে বলল,
“মিস ইউ টু।”
ফোন রাখার পর নিবেদিতা কেমন যেন উশখুশ করতে লাগত। ডক্টর রুহি আসার পর থেকেই বুকের ভেতর একটা অস্বস্তি শুরু হয়েছিল। নির্ণয়ের কপালে হাত রাখার দৃশ্যটি চোখ থেকে সরতে পারছে না। কানে বাজছে রুহির যত্নশীল কথাগুলো। মনে হচ্ছিল, না জানি কত অধিকারবোধ রয়েছে তার নির্ণয়ের প্রতি। নিবেদিতা মনকে বোঝাতে চাইল, রুহি একজন ডাক্তার। সে তো নির্ণয়ের খোঁজ-খবর নিতেই পারে। এজন্য তো এত আকাশ-পাতাল ভাবার কিছু নেই। তারপরও মনের কোথায় যেন একটা কিন্তু কিন্তু ভাব। আজ অনেকদিন পর আবার সেই দুঃস্বপ্নের কথাটা মনে পড়ে গেল!
.
.
মিদহাদ ও মৌটুসী বাড়ির মাঠে ব্যাডমিন্টন খেলছিল। মমতা বেগম বাগানের গাছগুলোতে পানি দিচ্ছেন। লনে একটা চেয়ারে বসে আছেন আহসান আহমেদ। ছেলে আর মেয়ের খেলা দেখছেন তিনি। তার হঠাৎ করে ছেলে-মেয়ের ছোটোবেলার কথাগুলো মনে পড়ছে। দেখতে দেখতে কবে যে দুজন এতটা বড়ো হয়ে গেল তিনি ভেবে অবাক হোন মাঝে মাঝে। সময় কি আসলেই খুব দ্রুত যায় নাকি কাজের ব্যস্ততায় তিনিই ছেলে-মেয়ের বেড়ে ওঠা পর্যবেক্ষণ করতে পারেননি কে জানে!
মমতা বেগম গাছে পানি দেওয়া শেষ করে স্বামীর নিকট এগিয়ে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
“চা, কফি কিছু খাবে?”
আহসান আহমেদ একটু ভেবে বললেন,
“না, তুমি বরং শরবত বানিয়ে আনো। মিদহাদ আর মৌটুসীর জন্যও।”
মমতা বেগম হেসে বললেন,
“ঠিক আছে।”
আরো কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে তিনি দুজনের খেলা দেখলেন। এরপর গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“খেলা শেষ হয়নি? এখন একটু রেস্ট নিয়ে নাও। এদিকে এসো।”
মিদহাদ, মৌটুসী বাবার কাছে এসে পাশাপাশি চেয়ার দুটোতে বসল। মমতা বেগম শরবত নিয়ে এসেছেন। মিদহাদ শরবতের গ্লাসে চুমুক দিতেই প্রশান্তিতে মনটা ভরে গেল। সে হাসি উপহার দিয়ে বলল,
“থ্যাঙ্কিউ আম্মু।”
“ইউ আর ওয়েলকাম মাই বয়।” হেসে বললেন মমতা বেগম।
আহসান আহমেদ রয়েসয়ে এবার কাজের কথায় এলেন। আজকে মিদহাদ ফ্রি আছে। তাই আজই সুযোগ কথাটা তোলার। তিনি শরবতের গ্লাসটা স্ত্রীর হাতে দিয়ে মিদহাদকে জিজ্ঞেস করলেন,
“সূবর্ণলতাকে তোমার কেমন লাগে?”
বাবার হঠাৎ এমন প্রশ্নে মিদহাদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে আছে। এই প্রশ্ন করার অর্থ খুঁজে পাচ্ছে না সে। নিজেকে সামলে নিয়ে সে পালটা প্রশ্ন করল,
“কেমন লাগে মানে?”
“সেটাই তো জিজ্ঞেস করলাম।”
“কোন অর্থে জিজ্ঞেস করেছ সেটা বুঝিনি।”
“বিয়ের জন্য।”
“আমার?”
আহসান আহমেদ একটু সংশোধন করে দিয়ে বললেন,
“তোমাদের। সূবর্ণলতার বাবার সাথে আমার কথা হয়েছে। তাদেরও তোমাকে ভীষণ পছন্দ। আবার আমরাও সূবর্ণলতাকে তোমার জন্য পছন্দ করেছি। এখন তোমার মতামত কী বলো?”
“আমার কোনো মতামত নেই, আব্বু।”
“এটা তো কোনো জবাব হলো না। তোমার পছন্দের কেউও তো নেই। তাহলে সমস্যা কী?”
“না থাকলেও আমার একটু সময় লাগবে।”
“সময়ের কথা তো কবে থেকেই শুনছি। দিয়েছিও। কিন্তু তোমার অপেক্ষার প্রহর তো শেষ হয় না। সূবর্ণলতাকে কি তোমার পছন্দ নয়?”
“পছন্দ, অপছন্দের কিছু নেই এখানে। তাছাড়া সূবর্ণলতা পছন্দ করার মতোই একটা মেয়ে। কিন্তু সমস্যা আমার। আমিই এখনো বিয়ের জন্য প্রস্তুত না।”
“বিয়েতে হ্যাঁ, না বলতে কি এখন ঢাক-ঢোল পিটিয়ে প্রস্তুতি নিতে হবে?”
মিদহাদ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
“তুমি যা-ই বলো না কেন আব্বু, আমার সত্যিই সময়ের প্রয়োজন। হুটহাট আমি কোনো বিয়ে করতে পারব না। সরি।”
নিজের কথা শেষ করে মিদহাদ বাড়ির ভেতর চলে গেল। মৌটুসী ছোটো মানুষ। এতক্ষণ এসব আলোচনা শুনলেও এবার আর বাবা-মায়ের আলোচনার মাঝে রইল না সে। তাই মিদহাদের পিছু পিছু সেও বাড়ির ভেতর চলে গেল। আহসান আহমেদ একবার মিদহাদের যাওয়ার পথে তাকিয়ে থেকে হতাশ হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। মমতা বেগমের চোখে-মুখেও ছেলেকে নিয়ে হতাশা স্পষ্ট।
চলবে…
[কপি করা নিষেধ।]
ছবি- সংগৃহীত