#নিবেদিতা
#পর্ব_৩২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
______________
বাইরে আজ তুমুল বৃষ্টি। জানালার কাচে একেকটা বর্ষণ আছড়ে পড়ছে। আকাশ অন্ধকার হয়ে আছে। ঘড়ি না দেখলে বোঝাই যাবে না এখন সকাল দশটা বাজে। বাইরের এই পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হবে বলে। পড়ার টেবিলে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে নিবেদিতা। পরীক্ষার পড়ার প্রেশারে মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে। ঘুমুতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সেই সুযোগটা এখন নেই। হাতে সময় কম কিন্তু পড়া বেশি। অনেক পড়াই আছে যেগুলো সে সময়ের অভাবে আগে কমপ্লিট করতে পারেনি। এখন বইতে নাক-মুখ ডুবিয়ে পড়তে হচ্ছে। ঘুম ঢলে পড়ার আগ মুহূর্তে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। চা খাওয়ার অভ্যাস তার আগে ছিল না। ছোটো থেকেই সে মোটেও চা প্রেমী নয়। এখনো নয়। ডেনমার্কে আসার পর থেকে শুধুমাত্র কাজের সুবাদে, নিজেকে প্রাণবন্ত রাখতে নিয়ম করে চা খায়। চা রাখার জন্য একটা ফ্ল্যাক্সও কিনেছে সে এখানে এসে। যেদিন পড়ার প্রেশার থাকে কিংবা পরীক্ষা থাকে সেদিন ফ্ল্যাক্স ভরতি চা বানিয়ে রাখে পড়ার টেবিলে। বারবার উঠে চা বানানো কিংবা গরম করা খুবই ঝামেলার কাজ। তাছাড়া নিবেদিতার হাতে এত সময়ই বা কোথায়? পরীক্ষাটা শেষ হলে এবার বাংলাদেশে যেতে হবে। ফোন দিলেই বাবা-মায়ের একই প্রশ্ন, ‘কবে বাড়ি আসবি?’
নিবেদিতা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল। কোলের ওপর বই রেখে বিড়বিড় করে পড়তে লাগল সে। বার দুয়েক চোখ লেগে আসছিল ঘুমে। হাই তুলে আবার পড়ায় মনোযোগ দিয়েছে। নির্ণয়ের সাথে অনেকক্ষণ আগে কথা হয়েছিল। এখন একবার কল করবে কিনা ভেবে দোনোমনা করছিল। নির্ণয় কড়াকড়িভাবে বলে দিয়েছে, পড়া শেষ না করে কোনো কথা নয়। অগত্যা নিবেদিতা আবারও পড়ায় মনোযোগ দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করল।
.
.
নির্ণয় এখন অনেকটা সুস্থ। একা একা হাঁটতেও পারে। আগের মতো এখনো স্বাভাবিক হয়নি হাঁটা। তবে কারো সাহায্য ছাড়াই হাঁটতে পারে। তার পুরনো কনফিডেন্স ফিরে এসেছে। মনে ভর করেছে একরাশ স্বপ্ন। এবার শুধু পূরণ করার পালা। সেই স্বপ্নের একমাত্র সঙ্গী তার ভালোবাসা।
লনে নির্ণয় একা একাই হাঁটছিল। দূর থেকে দেখতে পেল রুহি আসছে। নির্ণয়কে দেখেই হাসল সে। নির্ণয়কে যখন হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে দিয়েছিল তখন থেকে প্রতিদিনই বাসায় এসে সে খোঁজ-খবর নিয়ে যেত। এখন নির্ণয়কে সুস্থই বলা যায়। তবুও রুহি আসবে নানা অজুহাতে। নির্ণয় সবই বোঝে। কিছু বলে না।
রুহি কাছে এসে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল,
“কেমন আছেন?”
নির্ণয় মৃদু মাথা নাড়িয়ে বলল,
“ভালো, আপনি?”
“ভালো আছি। হাঁটতে কোনো অসুবিধা হয় না তো?”
“উঁহুঁ! তেমন নয়।”
“গুড। ভালো লাগছে আপনাকে এতটা প্রাণবন্ত দেখে।”
“থ্যাঙ্কিউ।”
রুহি কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে বলল,
“আপনার যদি সমস্যা না হয় তাহলে আমরা কি একদিন কোনো কফিশপে যেতে পারি?”
“সরি! আসলে এই অবস্থায় বাইরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই আপাতত।”
“আমার গাড়ি আছে।”
“কিন্তু আমার ইচ্ছে নেই।”
রুহির মুখে আঁধার নেমে এলো। কিছুটা অপমানও অনুভব করল বোধ হয়। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
“ওহ! আচ্ছা আমি যাই আন্টির সাথে দেখা করে আসি।”
নির্ণয় মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়াল।
রাতে নাদিম হোসাইন এবং বিউটি বেগম নির্ণয়ের রুমে এলেন। নির্ণয় একটা বই নিয়ে বিছানায় বসে ছিল তখন। বাবা-মাকে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করল,
“বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার টিকিট কেটেছ?”
নাদিম হোসাইন বললেন,
“হ্যাঁ। আগামী সপ্তাহে ফ্লাইট।”
নির্ণয় নিশ্চিন্তবোধ করল। বাংলাদেশে গিয়ে তাকে আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে নিবেদিতার ফিরে আসার। কতদিন পর দেখা হবে দুজনের! এবার আর কোনো সময় বিলম্ব নয়। শুভ কাজটা সেরে ফেলবে।
নাদিম হোসাইন ছেলের নির্লিপ্ত মুখ দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
“কী ভাবছিস?”
নির্ণয় স্থির হয়ে বলল,
“কী? কই! কিছু না।”
“আচ্ছা। তোর চাচ্চু কি তোকে কিছু বলেছে?”
নির্ণয় ভ্রু কুঁচকে বলল,
“না তো! কী বলবে?”
“রুহির ব্যাপারে কিছু বলেনি?”
“না।”
“তোর চাচ্চু রুহিকে তোর জন্য পছন্দ করেছেন। রুহিও তোকে পছন্দ করেছে। তুই অনুমতি দিলে রুহির পরিবারের সাথে কথা বলব আমরা।”
নির্ণয় বুঝতে পারত রুহির মনের কথা, চোখের ভাষা। সে বুঝত যে, রুহি তাকে পছন্দ করে। কিন্তু সেটা যে বিয়ের কথাবার্তা পর্যন্ত চলে আসবে এটা ভাবেনি। সে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
“এসব কথা এখানেই বন্ধ করো।”
নাদিম হোসাইন এবং বিউটি বেগম দুজনই বেশ অবাক হলেন। এত সুন্দরী মেয়ে, পেশায় ডাক্তার, রাশিয়ায় থাকছে এমন কাউকে রিজেক্ট করছে নির্ণয়! তিনি কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“কেন?”
নির্ণয় আর কোনো রাখঢাক রাখল না। সরাসরি বলল,
“আব্বু, আমি নিবেদিতাকে ভালোবাসি।”
এবার যেন সবচেয়ে বড়ো ধাক্কা খেলেন বাবা-মা। বিউটি বেগম অস্ফুটস্বরে বললেন,
“নিবেদিতা!”
“হ্যাঁ, মা। নিবেদিতাকে ভালোবাসি।”
“আর নিবেদিতা?”
“আমরা দুজনই দুজনকে ভালোবাসি।”
“তোদের সম্পর্ক কবে থেকে? আমাদের আগে বলিসনি কেন?”
“সময়-সুযোগ বুঝে বলব ভেবেছিলাম। দেশে গিয়েই বলতাম।”
দুজনে আর কোনো কথা বললেন না। নাদিম হোসাইন আগে রুম থেকে গেলেন। এরপর বিউটি বেগম। নির্ণয় দুজনের যাওয়া দেখে চুপ করে রইল। বাবা-মায়ের এমন নিরবতা তো সে আশা করেনি। শেষ পর্যন্ত বাবা-মা কি কোনোভাবে বেঁকে বসতে পারে? হঠাৎ করে মাথায় নতুন চিন্তা ঢুকে গেল। বই হাতে নিয়ে ছটফট করছিল সে।
ত্রিশ মিনিট বাদে তার রুমে চাচাতো ভাই রিয়াদ এলো। রুহি রিয়াদেরই বান্ধবী। সে এসেই প্রফুল্লভাবে জিজ্ঞেস করল,
“হেই ব্রো, হোয়াট’স আপ?”
নির্ণয় বিরসমুখে জবাব দিল,
“গুড।”
“বই পড়ছিলে? বিরক্ত করলাম নাকি?”
“আরে না। তেমন কিছু না। বসো তুমি।”
“কী হয়েছে? মন খারাপ কেন?”
“কিছু হয়নি।”
রিয়াদ নির্ণয়ের পেটে গুঁতা দিয়ে দুষ্টু হেসে বলল,
“উম…জানি কিন্তু আমি সব।”
“কী জানো?” জিজ্ঞেস করল নির্ণয়।
“এইযে রুহি তোমাকে পছন্দ করে। সবাই চাচ্ছে তোমাদের বিয়ে হোক। কিন্তু তোমার নাকি গার্লফ্রেন্ড আছে?”
“তোমাকে কে বলল?”
“ছোটো চাচ্চু আব্বুকে বলছিল। তখন শুনলাম। চাচিও বলেছে, এই বিয়ে হবে না। তাই আমিই ছুটে এলাম তোমার কাছে। তোমরা সবাই কি বোকা?”
“কেন?”
“রুহির মতো এমন বেটার অপশন বোকা ছাড়া আর কে হাতছাড়া করে বলো তো? শোনো, এসব গার্লফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড বিয়ের আগে এখন সবারই থাকে। প্রেম এত ভেবে-চিন্তে হয় না। কিন্তু বিয়ের ডিসিশন ভেবে-চিন্তেই নিতে হয়। তোমার গার্লফ্রেন্ড আছে তাতে কী সমস্যা? ব্রেকাপ করে ফেলো। রুহি খুব ভালো মেয়ে, ভাই। ওকে বিয়ে করে এখানেই সেটেল হয়ে যাও। জীবনে সুখ-শান্তির কোনো অভাব হবে না কোনো।”
নির্ণয় বিদ্রুপ করে হাসল। রিয়াদ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
“হাসছ কেন?”
“হাসছি তোমার কথা শুনে, ভাই।”
“মজা ভাবো আর যাই ভাবো,আমি কিন্তু সিরিয়াস। এখনো হাতে সময় আছে আমার কথাগুলো ভেবে দেখো।”
”এখানে ভাবার তো কিছু নেই। আমার সিদ্ধান্ত আমি জানি। তোমার কিছু কথা তবুও সংশোধন করে দিচ্ছি শোনো। রুহির মতো বেটার অপশন আমার প্রয়োজন নেই। কারণ আমি যাকে ভালোবাসি, যাকে বিয়ে করব সে আমার কাছে কোনো অপশন নয়। সে আমার ভালোবাসার মানুষ। আর রইল বেটারের কথা? ভাই, আমার ভালোবাসার মানুষটা আমার কাছে বেস্ট। বেস্ট রেখে কেউ কখনো বেটার খোঁজে বলো? অনেকে খুঁজতে পারে। অনেকটা বেটার খুঁজতে গিয়ে বেস্ট কাউকে হারানোর মতো। কিন্তু আমি নিবেদিতাকে হারাতে চাই না। তুমি যত সহজেই নিবেদিতাকে ঠকানোর কথা বললে, অত সহজে এই কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না। ওকে ছাড়া আমি নিজেকে ভাবতেও পারিনা। তুমি নিবেদিতাকে হয়তো সেভাবে চেনো না। দেখলেও হয়তো খুব ছোটোবেলায় দেখেছিলে। যাই হোক, ওকে যদি বর্তমানে তুমি এক পার্সেন্টও চিনতে তাহলে অবলীলায় এই কথাগুলো বলতে পারতে না। ওর ভালোবাসা কতটা প্রখর তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। আমার এই এক্সিডেন্টের পর আমি আদৌ হাঁটতে পারব কিনা, সুস্থ হব কিনা জানতাম না। আমার এই ত্রুটিপূর্ণ অবস্থাতেও ও আমাকে ছেড়ে যায়নি। তুমি বাইরের দেশে থাকো, তাই বাইরের দেশ সম্পর্কে তোমার খুব ভালো ধারণা আছে। নিবেদিতা ডেনমার্কে থাকে। তাও একা। ফ্যামিলি, আপনজন ছাড়া একা একটা মেয়ে বাইরের দেশে সার্ভাইভ করা কতটা কঠিন সেটা তোমার খুব ভালো করেই জানার কথা। এত কঠিন মুহূর্তেও নিবেদিতা কখনো আমার খবর নিতে ভুল করে না জানো? ওর সকল প্রায়োরিটির শীর্ষে আমার স্থান। এমন একটা মেয়েকে তুমি ঠকানোর কথা বলছ? আমার মনে এসব চিন্তা আসার আগেই আমি নিজের মৃত্য কামনা করি, ভাই। শী ইজ মাই হ্যাপিনেস, শী ইজ মাই লাভ, শী ইজ মাই নিবেদিতা।”
চলবে…
[কপি করা নিষেধ।]