#নিবেদিতা
#পর্ব_৩৩
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____________
নির্ণয় বাংলাদেশে ফিরে এসেছে গতকাল। রুহির বিষয়টি রাশিয়াতেই শেষ করে এসেছে। আসার আগেরদিন রুহি অবশ্য তার এবং নিবেদিতার জন্য শুভকামনা জানিয়েছে। রুহির নিবেদিতার কথা জানার কথা নয়। কারণ সে বলেনি। রুহিকে যথাসম্ভব এড়িয়েই চলত সে। তাছাড়া নিজেদের পার্সোনাল কথা সবাইকে বলাও তার পছন্দ না। সে যদি খুব বেশি ভুল না হয়, তাহলে হয়তো রিয়াদই রুহিকে নিবেদিতার কথা বলেছে। সে যাই হোক, রাশিয়ার স্মৃতি সে রাশিয়াতেই রাখতে চায়। নিজ দেশে সে যার সঙ্গে থাকতে চায়, বাঁচতে চায় সেই মানুষ একজনই। নিবেদিতা।
নির্ণয় ছাদে একা একা হাঁটাহাঁটি করে হাঁটার অভ্যাসকে স্বাভাবিক করছিল। বিউটি বেগম ওষুধ এবং পানি নিয়ে এসে বললেন,
“ওষুধ খেতে ভুলে যাচ্ছিস কেন দিনদিন?”
নির্ণয় ছাদে রাখা একটা চেয়ারে বসল। মুচকি হেসে বলল,
“মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য তুমি আছো তাই।”
“নাটক করিস না। এত আলগা পিরিতও দেখাস না। তোকে আমার চেনা হয়ে গেছে।”
বিউটি বেগমকে হঠাৎ এত ক্ষিপ্ত হতে দেখে একটু অবাকই হলো নির্ণয়। এছাড়া রাশিয়াতেও মা একটু ভার ভারই ছিলেন। তখন সে এটি নিয়ে এত মাথা ঘামায়নি। কিন্তু ঘামাতে হচ্ছে। সে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি রেগে আছো কেন, মা?”
“কারণ নেই বলতে চাচ্ছিস?”
“কারণটা জানতে চাচ্ছি। বাচ্চাদের মতো করছ কেন?”
“তোর এক্সিডেন্টের পর একদিন আমায় কী বলেছিলি? তুই আর নিবেদিতার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবি না। আমি তোকে বোঝানোর পরও তুই তোর সিদ্ধান্তে অটল ছিলি। এরপর দেখলাম নিবেদিতাও ডেনমার্কে ফিরে গিয়েছে। তখন আমি ধরেই নিয়েছিলাম, তোদের মধ্যে আর কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ এখন শুনছি, তোরা দুজনই দুজনকে ভালোবাসিস। এসবের মানে কী? তুই নিবেদিতার সাথে সম্পর্কটা আবার ঠিক করতে চাচ্ছিস? রাশিয়ায় তোর মন-মেজাজ খারাপ ছিল বলে এসব কিছুই তখন জানতে চাইনি। কিন্তু আমাকে সবটা ক্লিয়ার করে বল তুই।”
নির্ণয় শান্ত হয়ে সব শুনল। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
“মা, আমি নিবেদিতার সাথে সম্পর্ক ঠিক করতে চাচ্ছি না। যেই সম্পর্ক ঠিক আছে ঐ সম্পর্ক আবার আমি ঠিক করব কীভাবে? আমি আসলেই তখন ওর সাথে সম্পর্ক রাখতে চাইনি। অনেক রুড আচরণ করে ওকে ডেনমার্কে ফেরত পাঠিয়েছি। ও চলে যাওয়ার পর আমার কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও অনেকদিন ইগনোর করেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর পারিনি। বিশ্বাস করো মা, এতদূর থেকে আমাকে এমনভাবে আগলে রেখেছিল! আমি নিজেকে দূরে রাখতে পারিনি। সম্ভবও হয়নি। এত ভালোবাসা, কেয়ার, প্রায়োরিটি কোনো মানুষের পক্ষেই উপেক্ষা করা সম্ভব না। আমি ভেবেছিলাম দেশে ফিরে একেবারে বিয়ে করার কথাই বলব তোমাকে। কিন্তু মাঝখানে হঠাৎ করে এমনকিছু হবে আমি বুঝতে পারিনি। তুমি প্লিজ আমার ওপর রাগ কোরো না, মা!”
বিউটি বেগম মুচকি হাসলেন। মমতাময়ী হাতে নির্ণয়ের গালে, মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“আমার ছেলের ওপর রাগ করে থাকার ক্ষমতা কি আছে আমার?”
নির্ণয়ের বুক প্রসন্নতায় ভরে গেল মায়ের ভরসায় এবং হাসি দেখে। বিউটি বেগম বললেন,
“তাহলে বল, কবে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাব এবার?”
“আর কিছুদিন পরই নিবেদিতার পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে। ও দেশে ফিরুক তারপর।”
“ঠিক আছে। তুই খারাপ বলিসনি। কিন্তু আমার কাছে একটা প্ল্যান আছে।”
“কী প্ল্যান? উৎসুক হয়ে জানতে চাইল নির্ণয়।
বিউটি বেগম বিজ্ঞের ন্যায় বললেন,
“প্ল্যানটা হলো আমরা কিন্তু এখনই তোদের বিয়েটা ঠিক করে রাখতে পারি। এটা নিবেদিতাকে জানানো হবে না। দেশে আসলে পরে সারপ্রাইজ দেবো। তাহলে আর ও দেশে আসার পর বিয়ে ঠিক হওয়া নিয়ে আর সময় নষ্ট হবে না। নিবেদিতা আসার পর দুজনে মিলে ঝটপট বিয়ের শপিংটা করে ফেলবি। তাহলে বিয়ের পর একসাথে দুজনে সময় কাটানোর জন্য একটু বেশিই সময় হাতে পাবি।”
নির্ণয় মাথা দুলিয়ে বলল,
“তোমার প্ল্যানটাই পার্ফেক্ট, মা। তুমি তাহলে আগে বাবার সাথে কথা বলো। তারপর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাও খালার বাসায়। কিন্তু ওরা সবাই মানবে তো?”
“ওসব তুই আমার হাতে ছেড়ে দে। তাছাড়া মানবে না কেন? নিবেদিতার জন্মই তো হয়েছে আমার ছেলের জন্য।”
নির্ণয় কিঞ্চিৎ লজ্জা পেয়ে হাসল।
.
.
অফিসের কাজের জন্য মিদহাদকে তার অফিস থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটি ঠিকানায় আসতে হয়েছিল। মেট্রো থেকে নামার পর কাকতালীয়ভাবে তুবার সাথে দেখা হয়ে গেল ওর। দুজনই দুজনকে দেখে সারপ্রাইজড্। মিদহাদ শুনেছিল যে, তুবা বিয়ের পর লন্ডনে চলে আসবে। কিন্তু এভাবে যে দুজনের দেখা হয়ে যাবে ভাবতেই পারেনি। সাথে তুবার হাজবেন্ডও আছে এখানে।
তুবা খুশিতে প্রায় ফাঁকা চিৎকার দিয়ে বলল,
“আরে মিদহাদ ভাইয়া! আমি ভাবতেই পারছি না, আমাদের দেখা হয়ে গেছে।”
মিদহাদ হেসে বলল,
“আমিও। কিন্তু তুমি চাইলে আরো আগেই দেখা হতো। আমার ফোন নাম্বার তো ছিল তোমার সাথে।”
“তা ঠিক। কিন্তু বোঝেনই তো, বিয়ে হয়ে গেলে সংসার নিয়ে কত ব্যস্ত সময় কাটে।”
“ওয়েট, ওয়েট, ওয়েট! বোঝেনই তো মানে? আমি কীভাবে বুঝব? আমি কি বিয়ে করেছি নাকি?”
তুবা ও ওর স্বামী রাদিন হেসে বলল। তুবা হেসে বলল,
“আপনি আগের মতোই দুষ্টু আছেন।”
মিদহাদও হাসল। এরপর রাদিনের সাথে কুশলাদি বিনিময় করে তিনজনে একটা কফিশপে বসল। কফি অর্ডার দিয়ে মিদহাদ বলল,
“তারপর বলো, তুমি এখানেই থাকো?”
“হ্যাঁ। আপনিও কি এখানেই থাকেন?”
“না। আমি এসেছিলাম অফিসের একটা কাজে।”
“তাহলে কাজ রেখে…সমস্যা হবে না কোনো?”
“না, আমার কাজ শেষ।”
“যাক। তাহলে ভালোই হলো। আপনার বাসার সবাই ভালো আছে তো? মৌটুসীর কী খবর? ওকে ভীষণ মিস করি।”
“হ্যাঁ, সবাই ভালো আছে। এখানে আসার পর আর দেশে যাওনি?”
“না, এবার যাব। নিবেদিতা দেশে যাচ্ছে কাল। কয়েকদিনের ভেতর আমরাও যাব। বিয়ে হবে বলে কথা নিবেদিতার।”
মিদহাদ অবাক হয়ে বলে,
“নিবেদিতার বিয়ে?”
“হু। নিবু অবশ্য এখনো জানে না। ওদের দুই পরিবার সব ঠিক করে রেখেছে। দেশে গেলেই বিয়ে। সারপ্রাইজ এটা। আপনি আবার বলে দিয়েন না ওকে।”
মিদহাদের কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। নিজেকে বোঝাল সে, এটা আজ হোক বা কাল হওয়ারই ছিল। নিয়তি তাকে মেনে নিতেই হবে। কিছু করার নেই। বুকে ব্যথা ও মুখে হাসি নিয়ে প্রাণবন্তভাবে মিদহাদ বলল,
“আরে না, না! সারপ্রাইজ নষ্ট করব না। চিন্তা কোরো না।”
তুবা সন্তুষ্টচিত্তে হাসল।
.
.
নির্ণয়ের বুক ধুকপুক করছে। মনে হচ্ছে কেউ জোরেশোরে ঢোল পেটাচ্ছে তার বুকে। কিঞ্চিৎ ভয়ও হচ্ছে, কেউ আবার এই শব্দ শুনতে পায় কিনা! হঠাৎ করে এত নার্ভাস লাগার কারণ সে না জানলেও; কেন হচ্ছে এটা জানে। নিবেদিতা আসছে আজ। তাই সে এয়ারপোর্টে এসেছে ওকে রিসিভ করতে। এটা নিবেদিতা জানে না। ওর বাড়ির লোকজন ছাড়া কেউই জানে না ওর আসার কথা। নিবেদিতাই নিষেধ করেছিল অন্য কাউকে জানাতে। তার প্ল্যানিং ছিল এয়ারপোর্ট থেকে সোজা নির্ণয়ের বাসায় গিয়ে সারপ্রাইজ দেবে সে। তার প্ল্যানমাফিকই সব হতো। যদি তুবাটা নির্ণয়কে এসব বলে না দিত। নির্ণয় অবশ্য তুবার নাম বলবে না নিবেদিতাকে।
নিবেদিতার পছন্দের ফুল ও গিফ্ট নিয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে আড়ালে অপেক্ষা করছিল সে। একটু পরপর ঘড়ির কাটায় সময় দেখছিল। তার অপেক্ষার প্রহর ফুরোয়। সিম্পল একটা সফট্ গাউন পরে হাতে লাগেজ নিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বের হচ্ছে নিবেদিতা। ওর একেকটা কদম নির্ণয়ের বুকে ঝড় তুলে দিচ্ছিল। সে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে দেখছিল তার নিবেদিতাকে। মুগ্ধতায় তার দৃষ্টি, মন-প্রাণ ভরে যাচ্ছিল। নিবেদিতার স্নিগ্ধতায় স্নিগ্ধ হচ্ছিল সে। অভিভূত হয়ে সে এবার এক পা এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছে আড়াল থেকে। নিবেদিতা তাকে পাস করে গেছে এতক্ষণে। নির্ণয় পেছন থেকে মোহগ্রস্ত হয়ে আগাচ্ছিল। নিবেদিতা বাড়ির কাউকেই আসতে নিষেধ করেছিল বিধায় কেউ আসেনি। তবে নয়ন গাড়ি বুকড করে নিবেদিতার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিল। নিবেদিতা ফোনে কথা বলতে বলতে সেই গাড়িটার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে পেছনে তাকাল নিবেদিতা।
নির্ণয়কে দেখে অন্তরআত্মা কেঁপে উঠল তার। অবিশ্বাস্য ব্যাপার! নির্ণয় এখানে কী করছে? নিবেদিতার বিস্মিত মুখাবয়ব দেখে হেসে ফেলল নির্ণয়। ফুলগুলো এগিয়ে দিয়ে বলল,
“সারপ্রাইজ!”
যদিও সারপ্রাইজ দেওয়ার কথা ছিল নিবেদিতার। তবুও সেখানে নিজে সারপ্রাইজ পেয়ে তার খারাপ লাগছে না। বরং এতদিন পর নির্ণয়কে কাছ থেকে দেখতে পেরে খুশিতে আত্মহারা সে। তার নির্ণয় এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। আবার আগের মতো হাঁটতে পারে। নির্ণয়কে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পরখ করল নিবেদিতা। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না নির্ণয় তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আবার খুশিতে তার চোখে পানিও চলে এসেছে। সকল বিস্ময়, দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে নির্ণয়কে জড়িয়ে ধরল সে। পরম ভালোবাসার বন্ধনে নির্ণয়ও আবদ্ধ করে নিল তার নিবেদিতাকে।
চলবে…
[কপি করা নিষেধ।]