#নিবেদিতা
#পর্ব_৩৪
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____________
স্বপ্ন যখন সত্যি হয় কিংবা সত্যের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছায় তখন অনেক কিছুই অবাস্তব লাগতে শুরু করে। স্বপ্ন মনে হয়। কখনো কখনো মনে হয় হাওয়ায় উড়ছে পুরো শরীর। আনন্দগুলোকে লাগে হাওয়াই মিঠাইর মতো। নির্ণয়েরও এখন সেই দশা। সে আনন্দের স্রোতে ভাসছে। অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়ে কাঙ্ক্ষিত সময়টি চলে এসেছে। নিবেদিতাকে নিজের করে পাওয়ার সময়। কতগুলো দিন, সময় পার করতে হয়েছে শুধুমাত্র এই দিনটা দেখার জন্য। কত খারাপ সময়ের সাথে লড়াই করতে হয়েছিল! পুরনো কিছু অতীত ঘাঁটতেই নির্ণয়ের বুকচিরে তীক্ষ্ণ দীর্ঘশ্বাসের সুর ভেসে এলো। পরক্ষণেই আবার চোখে-মুখে ফুটে উঠল হাসির ঝিলিক।
পরিবার, কাজিন ও বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সে বিয়ের শপিং করতে এসেছে। নিবেদিতার জন্য ঘুরেঘুরে বিয়ের শাড়ি, লেহেঙ্গা দেখছে সে। নির্ণয় অনেকবার করে নিবেদিতাকে সাথে আসতে বলেছিল, নিজের পছন্দমতো সবকিছু কিনতে বলেছিল। কিন্তু নিবেদিতার একরোখা জবাব ছিল,
“বউ যখন আপনার, পছন্দও আপনারই করতে হবে।”
জবাবে নির্ণয় হেসেছে। মাথা পেতে নিয়েছে নিবেদিতার আবদার। সেই আবদার মেটাতেই আজ নিজে মেয়েদের জামা-কাপড়, সবকিছু পছন্দ করার মতো কঠিন কাজ কাঁধে তুলে নিয়েছে। অবশ্য বিউটি বেগমও তাকে টুকটাক সাহায্য করছিল। নির্ণয় মন দিয়ে লেহেঙ্গা দেখছিল। একটা লেহেঙ্গায় তার নজর আটকে গেছে। সে তার মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
“মা, নিবেদিতাকে এই লেহেঙ্গায় সুন্দর লাগবে না বলো?”
বিউটি বেগম সহাস্যে বললেন,
“ওকে সব লেহেঙ্গাতেই সুন্দর লাগবে। তোর চোখে কোনটা ভালো লাগছে বল?”
নির্ণয় মেরুন লেহেঙ্গার ওড়নাটা হাতে তুলে নিয়ে বলল,
“এটাই।”
“বাহ্! আসলেই এটা অনেক সুন্দর। নিবেদিতাকে ভীষণ মানাবে।” বিউটি বেগমের কণ্ঠে মুগ্ধতার আভাষ।
নির্ণয় বলল,
“তাহলে এটাই দেখি বরং?”
“হ্যাঁ।”
নির্ণয় তবুও কনফার্ম হওয়ার আগে লেহেঙ্গার ছবি তুলে নিবেদিতাকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে লিখল,
“এটা পছন্দ হয়?”
নির্ণয়ের পুরো বিশ্বাস, নিবেদিতা জবাবে লিখবে, ‘হ্যাঁ।’
.
.
নিবেদিতার বাড়িতে মানুষ গিজগিজ করছে। আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে গ্রামের অনেক মানুষের আনাগোনা বাড়িতে। তারা কেউই বসে নেই। সবাই হাতে হাতে কাজ করছে। নিবেদিতা সাহায্য করতে চাইলে কেউ তাকে আসতে দিল না। নতুন বউকে দিয়ে আবার কেউ কাজ করায় নাকি? তাকে ঘিরে মেয়ে কাজিনরা সবাই বসে আছে। অপেক্ষা করছে কখন রাত হবে আর কখন গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে।
পার্লার থেকে চারজন মেয়ে আনা হয়েছে সবাইকে মেহেদি দিয়ে দেওয়ার জন্য। বিকেলের দিকে নিবেদিতা গোসল সেরে হাতে মেহেদি পরতে বসেছে। তাকে ঘিরে চতুর্দিকে বসে আছে তার সমবয়সী ও উঠতি বয়সী মেয়েরা। বাচ্চারাও সবাই হইহই করছে। খেলছে, দৌঁড়াচ্ছে। সাউন্ড বক্সে বিয়ের হিন্দি গান ‘তেরে ঘার আয়া, ম্যায়নে আয়া তুঝকো লেনে’ বাজছে। মেহেদি আর্টিস্ট মেয়েটি নিবেদিতার হাতে নাম লিখে দেওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করল,
“আপু, বরের নাম কী?”
বাইরে থেকে তখন নিবেদিতার ছোটো ভাই রাকিব চিৎকার করতে করতে রুমে এসে বলল,
“ইয়ে! মিদহাদ ভাইয়া আসছে, মিদহাদ ভাইয়া আসছে।”
সবাই ওর চিৎকার শুনে দরজার দিকে তাকাল। মিদহাদের সাথে এবার ওর পরিবারের সবাই এসেছে। নয়নের দুই হাতে ওদের দুইটা লাগেজ। সবার আগে মৌটুসী রুমে ঢুকে নিবেদিতার কাছে দৌঁড়ে গেল। পাশে বসে আলতো করে গলা জড়িয়ে ধরল যাতে মেহেদি আবার নষ্ট না হয়। নয়ন লাগেজ নিয়ে ঢোকার পরই ভেতরে ঢুকল মিদহাদ। সবার আগেই তার দৃষ্টি পড়ল নিবেদিতার হাসিমাখা মুখের ওপর। মেয়েটা এমনিই সুন্দর। বিয়ে বলে হয়তো আজ আরো বেশি সুন্দর লাগছে। সে এক ঝলক দেখেই দৃষ্টি সরিয়ে নিল। ঐ মুখের দিকে মুগ্ধতায় তাকিয়ে থাকার অধিকার তার নেই।
আর্টিস্ট মেয়েটিও এতক্ষণ মেহমানদের জন্য নিশ্চুপ ছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতেই তাই আবার সে জিজ্ঞেস করল,
“আপু, নাম কী বরের?”
পাশ থেকে মৌটুসী বলল,
“আপুর বরের নাম, নির্ণয়।”
পাশ দিয়ে অন্য রুমে যাওয়ার সময় মিদহাদের কানে নামটি খুব সহজেই পৌঁছাল। মৌটুসীর কণ্ঠে যেন আরো একবার প্রতিধ্বনিত হলো, ‘আপুর বরের নাম, নির্ণয়!’
মিদহাদের বাবা-মা টুকটাক কথা বলে আগে ফ্রেশ হতে গেলেন। অনেক রাস্তা জার্নি করে এসেছেন তারা। তাদের সাথে সুবর্ণলতাকে দেখে মুচকি হাসল নিবেদিতা। সুবর্ণলতা জিজ্ঞেস করল,
“কেমন আছো নিবেদিতা?”
“আলহামদুলিল্লাহ্ আপু, ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?”
সুবর্ণলতা ম্লান হেসে বলল,
“আছি।”
“থ্যাঙ্কিউ আমার কথা রাখার জন্য, আমার বিয়েতে আসার জন্য।”
সুবর্ণলতা এবার নিবেদিতার গাল ছুঁয়ে চুমু খেয়ে বলল,
“তোমার মতো মিষ্টি মেয়ের কথা উপেক্ষা করার ক্ষমতা বোধ হয় সৃষ্টিকর্তা কাউকেই দেননি। সেখানে আমি আর এমন কী!”
নয়নের ডাক পড়ল তখন,
“আপু, আসুন আগে ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নিন। মৌ তুইও আয়।”
নিবেদিতাও ভাইয়ের কথায় সায় দিয়ে দুজনকে ফ্রেশ হতে পাঠিয়ে দিল। সকলের মেহেদি দেওয়া শেষ হতে হতে প্রায় রাত হয়ে গেছে। নিবেদিতাকে পার্লারের মেয়েগুলো বাড়িতেই সাজিয়ে দিয়েছে। গায়ে হলুদে শাড়ি পরেনি। হলুদ রঙের একটা লেহেঙ্গা পরেছে। নির্ণয়ের পছন্দে। গায়ে সব কাচা ফুলের গয়না। দেখতে এত সুন্দর ও মিষ্টি লাগছে যে কেউই একবার তাকানোর পর দ্বিতীয়বার না তাকিয়ে আর পারেনি।
নাসিমা বেগম বিয়ের কাজকর্ম নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। কী একটা দরকারে তিনি নিবেদিতার রুমে এলেন। মাকে দেখে নিবেদিতা জিজ্ঞেস করল,
“আমাকে কেমন লাগছে মা?”
নাসিমা বেগম তৎক্ষণাৎ কোনো জবাব দিতে পারলেন না। তার চোখে অশ্রু জড়ো হয়েছে। এই বুঝি কেঁদে ফেলবেন। নিবেদিতা আবারও জিজ্ঞেস করল,
“বলো না, কেমন লাগছে আমায়?”
নাসিমা বেগম ধরে আসা কণ্ঠে বললেন,
“ভালো।”
“কী? ভালো? শুধু ভালো?”
পাশ থেকে সুবর্ণলতা হেসে বলল,
“মায়েরা কখনো সন্তানদের প্রশংসা করেন না। নজর লাগে নাকি!”
“কীহ! এসব সত্যি নাকি?”
“তা তো জানিনা, সোনা। তবে আমার মা-ও এমন।”
নিবেদিতা হঠাৎ করেই নাসিমা বেগমকে জড়িয়ে ধরল। এতক্ষণ ধরে আটকে রাখা কান্না আর আটকে রাখতে পারলেন না নাসিমা বেগম। তিনি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। চোখে পানি টলমল করছিল নিবেদিতারও। মৌটুসী আহাজারি করে বলে উঠল,
“ও আন্টি, কেঁদো না গো! নিবেদিতা আপুর মেকাপ তো নষ্ট হয়ে যাবে। কী বাজে হবে তখন ভাবো একবার!”
না চাইতেও মৌটুসীর কথায় সবাই হেসে উঠল। মা-মেয়ের আবেগঘন মুহূর্ত আপাতত স্থগিত রাখা হলো। নাসিমা বেগম মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
“কারো নজর না লাগুক আমার মেয়ের।”
সবার সাজগোজ শেষ হলে নিবেদিতাকে উঠানে নেওয়া হলো, যেখানে গায়ে হলুদের প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে। নিবেদিতাকে নয়ন কোলে তুলে নিয়েছে। নিবেদিতা লজ্জায় কোলে উঠতে চায়নি অবশ্য। কিন্তু নয়ন শোনেনি। আদরের বোন বলে কথা তার। প্যান্ডেলে নিয়ে বসানোর পর মিদহাদ ছবি তুলছিল। তুবা গিয়ে বসল নিবেদিতার পাশে। দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমাদের ছবি তুলে দেন তো ভাইয়া।”
মিদহাদ হেসে বলল,
“তুমি যেভাবে ধরেছ ওকে, মেয়েটা তো ভর্তা হয়ে যাবে।”
তুবা এবার নিবেদিতার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই কি ভর্তা হয়ে যাচ্ছিস?”
“হইনি এখনো। তবে বেশিক্ষণ এভাবে ধরে রাখলে সত্যিই হয়ে যাব।” বলল নিবেদিতা।
তুবা অভিমানে ছেড়ে দিল। নিবেদিতা হাসল ওর বাচ্চামো দেখে। এবার নিজেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুলুন ছবি।”
মিদহাদ একসঙ্গে অনেকগুলো ছবি তুলল। কিছুক্ষণ বাদে সাবিহা এলো ওর পরিবার নিয়ে। সাবিহা এসেই পারছে না নিবেদিতাকে টুপ করে গিলে খেতে। নয়ন ও মিদহাদ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল। এই দৃশ্য দেখে নয়ন বলল,
“মেয়েদের এই লাফালাফির কারণ এত বছরেও আমি বুঝতে পারলাম না। দেখ কেমন করতেছে। আরে ভাই, বুঝলাম অনেকদিন পর দেখা হইছে, অনেক সুন্দর লাগছে আমার বোনকে। তাই বলে এমন লুতুপুতু করবি? মনে হচ্ছে এটা আমার বোন না, একটা মিষ্টির হাড়ি। গিলে খেতে পারলেই বাঁচে।”
মিদহাদ মুচকি হেসে বলল,
“তোর বোন কি মিষ্টির চেয়ে কম নাকি? তাছাড়া ওরা খুব ভালো বন্ধু। এক বন্ধুর বিয়েতে আরেক বন্ধু খুশিতে এমন আত্মহারা হয়ই।”
“এটাও অবশ্য ঠিক বলেছিস। এবার সাদা মূলাটাকে মিস করতেছি সত্যিই।”
“সাদা মূলা কে আবার?”
“আরে ঐযে পল।”
“ওহ হ্যাঁ! ভালো কথা। এবার পল আসেনি?”
“না। এবার নাকি কী একটা কাজ আছে। তাই আসতে পারেনি। একটু আগে ভিডিয়ো কলে কথা হয়েছে। নিবেদিতাকে দেখল। মনে হচ্ছিল ওকে দেখে ফোনের ভেতরই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল শালা!”
“ব্যাপার কী? তুই আজ এত জেলাস কেন সবাইকে নিয়ে?”
“জেলাস না। সেনসিটিভ। একটা মাত্র বোন আমার! ভয় লাগে। যদি কারো নজর লাগে আবার? অন্যের কথা কী বলব রে ভাই, আমার নিজের নজর নিয়েই ভয় লাগছে। আমিই তো চোখ সরাতে পারছি না। আজ আমার বোনটাকে এত সুন্দর লাগছে কেন বল তো? ইচ্ছে করতেছে বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখি। কাউকে দেখতে দেবো না। জানিস, নিবেদিতা যখন হয় তখন একদম একটা পুতুলের মতো ছিল দেখতে। আমি কাউকে ধরতে দিতাম না ওকে। কারো কোলেও দিতে চাইতাম না। স্কুল, প্রাইভেট পালিয়ে বাড়িতে চলে আসতাম যাতে ওর সাথে বেশি সময় থাকতে পারি।”
কথাগুলো বলতে বলতে নয়নের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। কণ্ঠস্বর রোধ হয়ে এলো। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে সে। মিদহাদ বুঝতে পেরে নয়নকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“শান্ত হ দোস্ত!”
নয়ন রুদ্ধ কণ্ঠে বলল,
“বোনটা আমার একেবারে চলে যাবে…”
“আহা! বাচ্চাদের মতো করলে হবে? এটাই তো নিয়ম। তাছাড়া নিবেদিতা দূরে থেকেও তোদের কাছেই থাকবে। এটা কিন্তু একটা প্লাস পয়েন্ট। তাছাড়া নির্ণয়কে তো তুই ভালো করেই চিনিস। ও তোর বোনকে ভালো রাখবে।”
নয়ন পাঞ্জাবির হাতায় চোখ মুছল। ক্যামেরাম্যান এবার ছবি তুলছে। সবাই একে একে গিয়ে নিবেদিতাকে হলুদ দিচ্ছে আর ছবি তুলছে। সবার হলুদ দেওয়া শুরু হলে নাচের অনুষ্ঠান শুরু হলো। মৌটুসী আর তুবা মিলে নাচছে এখন। নাচের মাঝখানে মৌটুসী এসে নিবেদিতাকে টেনে মাঝখানে নিয়ে যায় নাচার জন্য। তখন তার লেহেঙ্গার একটা সেফটিপিন খুলে যায়। সে কোনো রকম মৌটুসীর সাথে একটু তাল মিলিয়ে নাসিমা বেগমকে বলে বাড়ির ভেতর চলে গেল। নিজের রুমে গিয়ে সেফটিপিন লাগিয়ে লেহেঙ্গাটা ঠিক করে আয়নায় একবার দেখে নিল সব ঠিকঠাক আছে কিনা। সব ঠিক আছে দেখে বাইরে যাওয়ার আগে ফ্রিজের পানি খাবে বলে রান্নাঘরে যাচ্ছিল। তখন নয়নের রুম থেকে চিৎকার ও কান্নার শব্দ পেয়ে সে থমকে গেল। একবার ভাবল মনের ভুল। পরক্ষণে স্পষ্ট আবার সে কান্নার শব্দ পেল। পুরো বাড়িই তো ফাঁকা। সবাই বাইরে অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত। তাহল কাঁদে কে? তার হঠাৎ একটু ভয়ও লাগছে এখন। তবুও সে কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে নয়নের রুমের দরজার সামনে দাঁড়াল। নয়নের রুমটা একদম শেষের দিকে। বাড়ির পেছনের দরজার সাথে। নয়নের রুমেও দরজা দুটো। পেছনের দরজা দিয়ে নয়নের রুমে সহজেই আসা যায়। এই দরজাটা নয়নই দিতে বলেছিল। গভীর রাতে দরজা খুলে বসে থাকলে দমকা বাতাস আসে। গরমের দিনে আর এসি লাগে না। প্রায়ই রাত জেগে বসে থাকে নয়ন। আজও দরজাটি খোলা। পুরোপুরি নয়। অর্ধেক চাপানো। হালকা খোলা অংশ দিয়েই তিরতির করে বাতাস প্রবেশ করছিল রুমে।
নিবেদিতা অবাক হয়ে দেখল মিদহাদ ফ্লোরে হাঁটু মুড়ে বসে কাঁদছে। দরজার সামনে হলুদ লেহেঙ্গার অংশটুকু দেখে থমকে গেল মিদহাদ। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল নিবেদিতাকে। দ্রুত উঠে চোখ-মুখ মুছে বলল,
“তুমি এখানে?”
নিবেদিতা কোনো জবাব দিল না। মিদহাদ একটু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তোমার কি কিছু লাগবে?”
নিবেদিতার সরু, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল মিদহাদ। নিজেকে স্বাভাবিক রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। ইচ্ছে করছিল নিবেদিতাকে একটাবার জড়িয়ে ধরে মনের লুকানো কথাটা বলে দিতে। কিন্তু এটা সম্ভব নয়। সে এমন কাজ কখনোই করবে না। মনকে শক্ত করার চেষ্টা করল সে। ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল,
“ওহহো! নয়ন আমাকে একটু বাজারে যেতে বলেছিল। তুমি বাইরে যাও। আমি আসছি।”
মিদহাদ পেছনের দরজা দিয়েই যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। তিন কদম আগানোর পর বাধ্য হয়েই তাকে থেমে যেতে হলো। তার শক্ত পুরুষালী হাতটি একটা কোমল হাতের মুঠোয় এখন। সে বিস্ময় নিয়ে পেছনে তাকাল। একবার নিবেদিতার মুখের দিকে তাকাল, আরেকবার তাকাল ধরে রাখা হাতের দিকে। এই বিস্ময়ের ঘোর শেষ হওয়ার পূর্বেই তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল নিবেদিতা। মিদহাদ এই ঘটনায় এতটাই অবাক হলো যে মুহূর্তেই সে পাথুরে মূর্তি বনে গেল। নিবেদিতার থুঁতনি মিদহাদের কাঁধে। দুহাতে জড়িয়ে ধরেছে মিদহাদের পেশিবহুল বাহু। কণ্ঠে তার সরলতা। সে ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বলতে লাগল,
“আর কতবার পালাবেন? প্রতিটা মেয়ের যে তৃতীয় চোখ থাকে আপনি জানেন না সেটা? আপনি একটা ছেলে হয়েও, আমার চোখের ভাষা পড়তে পারেন। আর আমি একটা মেয়ে হয়ে আপনার চোখের ভাষা বুঝতে পারব না এটা কীভাবে ভাবলেন আপনি? আপনি আমাকে ভালোবাসেন এটা আমি জানি। তখন থেকেই জানি, যখন আমি স্কুলে পড়ি। আপনি যে নানান বাহানায় ভাইয়ার সাথে গ্রামে আসতেন শুধুমাত্র আমাকে দেখার জন্য আমি বুঝতাম সব। দেশের বাইরে গিয়েও আপনি যে ভাইয়ার কাছে সবসময় আমাদের খোঁজ-খবর নিতেন আমি জানতাম। মূলত এখানে আমাদের খোঁজ-খবরের মাধ্যমে আপনি আমার খোঁজ-খবর নিতেন। আপনি ভেবেছিলেন, ছোটোবেলায় আপনাকে দেখার কথা হয়তো আমার মনে নেই তাই না? সব মনে আছে। মামার বিয়েতে আপনাকে দেখেই আমি চিনতে পেরেছিলাম। আপনার অনুভূতি সম্পর্কে আমি অবগত ছিলাম। আপনি আমাকে বুঝতে দেননি কারণ আমি নির্ণয়কে ভালোবাসতাম। আর আমি আপনাকে বুঝতে দেইনি কারণ আমি চাইনি কখনো আপনি আমার সামনে মাথা নত করে থাকেন। নিজেকে ছোটো মনে করেন। আপনার অনুভূতিকে সম্মান জানিয়েই আমি সব জেনে-বুঝেও না জানার অভিনয় করতাম। আপনাকে ভালোবাসার মতো অনুভূতি কখনো আমার মনে তৈরি না হলেও, আপনাকে সম্মান করার অনুভূতি আমার মনে তৈরি হয়েছিল। ঠিক এই কারণেই সব জেনে-বুঝে অন্ধ সেজে থাকতাম। সম্মানের জায়গাটা নষ্ট করতে চাইনি। কথাগুলো হয়তো আজও স্বীকার করতাম না। কিন্তু আজ যেহেতু সত্যটার মুখোমুখি দুজনই হয়ে গেছি তাই এড়িয়ে যাওয়ার দুঃসাহস করলাম না। কারণ আমি চাই না, আপনি কখনো এটা ভাবেন যে আমি আপনাকে ঘৃণা করি কিংবা অসম্মান করি। দেখুন, ভালোবাসাটা কোনো ভুল কিংবা অন্যায় নয়। দোষের নয়। বরং অন্যায়টা আমরা তখন করি তাও আবার নিজের প্রতিই করি যখন আমরা জানিই যে এই ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে না। আমি খুব করে চাইতাম, আপনি নতুন করে কাউকে ভালোবাসেন। নতুন করে সব শুরু করেন। তখন বলার সুযোগ ছিল না। কিন্তু আজ বলছি, আমার জন্য এভাবে নিজের জীবনটাকে থমকে রাখবেন না। জীবনের সুন্দর সময়গুলোকে নষ্ট করবেন না। যেই সময় একবার হারিয়ে যায়, তা আর ফিরে আসে না। অধিকারবোধের বাইরে গিয়েই বলছি, নতুন করে ভালোবাসুন, নতুন করে বাঁচুন। সুবর্ণলতা আপু আপনার জন্য পার্ফেক্ট। ভীষণ ভালো একটা মেয়ে সে।”
এটুকু বলে মিদহাদকে ছেড়ে দিল নিবেদিতা। মিদহাদ তখনো নিরুত্তর। নিবেদিতা ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তাকে নিজের করে নিন।”
এরপর সে এক চিলতে হাসি মিদহাদকে উপহার দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। পেছনে ফিরে তাকালে হয়তো মিদহাদের সাথে সাথে নয়নের রুমের বাইরে সুবর্ণলতা এবং তুবাকেও দেখতে পেত।
মিদহাদের মনে হচ্ছে সে এখনো একটা ঘোরের মাঝেই আছে। তার দুচোখ থেকে দুফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে পেছনে ঘুরতেই দমকা বাতাসে দরজার পর্দাটা উড়তে লাগল। পর্দার আড়ালে দেখতে পেল নির্ণয়কে। নির্ণয় এগিয়ে এলো দুকদম। মিদহাদ হকচকিয়ে গেল ওকে দেখে। কিছু বলতে যাওয়ার পূর্বেই নির্ণয় হাত উঁচু করে মিদহাদকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“নিবেদিতাকে সারপ্রাইজ দিতে এসেছিলাম।”
চলবে…
[কপি করা নিষেধ।]