কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী লেখনীতে: নবনীতা শেখ |পর্ব ২১|

0
146

#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ২১|

প্রাদশা প্রহর। গ্রীষ্মের তপ্ততা যেন আষ্ঠেপৃষ্ঠে ধরে আছে। দিদির হাতে-পায়ে মেহেদী লাগানোর পরপর দিয়া আর সুপ্তির হাতেও লাগিয়ে দিয়েছি। এখন আমার হাতের অর্ধমৃত অবস্থা। বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতের কবজি চেপে ধরে, ছাদের রেলিঙের উপরটায় দু’পা তুলে চেয়ারে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে আছি। ইদে তো দিদি একাই সবটা সামলে নেয়, কিন্তু এখন! ধ্যাৎ! কেমন লাগে! গা’টা ম্যাচ ম্যাচ করছে। খিদেও পেয়েছে। কিন্তু আলস্যতা যে জেঁকে বসেছে আমার উপর! উঠতেই ইচ্ছে হচ্ছে না।

আড্ডা-গান চলছে সমানতালে। এরই মাঝে যোগ হয়েছে আরও কিছু মানুষ— পাশের বাড়ির ভাইয়েরা, আপুরা, দিদির মামার বাড়ির ভাই-বোন, আরও অনেকেই। খানিকক্ষণ আগেই সবাই আলাদা আলাদাভাবে গিয়ে রাতের খাবার সেড়ে এসেছে; আমি, রাহী আর আপি বাদে। ঘণ্টাখানেক হয়েছে, কুঞ্জ ভাই গেছেন। মিনিট পাঁচেক আগেই মেজমা এসে সুপ্তিকে নিয়ে গেলেন।

“নবু, এদিকে ঘোর তো!”

পাশ থেকে পরিচিত কণ্ঠস্বরটা শুনতে পেয়ে রয়ে সয়ে ঠিক করে উঠে বসলাম। তাকিয়ে দেখলাম, হাতে ভাতের থালা নিয়ে কুঞ্জ ভাই বসে আছেন। রাহীকে আমার পাশে এসে বসতে বলে আপিকে বললেন, “অনেক রাত হচ্ছে, রজনী। যাও, খেয়ে এসো। কাকিমণি ডাকছে তোমায়।”

আপি বলল, “মেজমা ডাকছে!”

“হুম। খেতে।”

“আচ্ছা, যাচ্ছি। আসিফ খেয়েছে?”

কুঞ্জ ভাই মাথা দু’দিকে নেড়ে বলল, “মুরুব্বিদের মাঝে ফেঁসে গেছে, গিয়ে উদ্ধার করে একসাথে খেতে বোসো।”

আপি যেন এক প্রকার ছুটেই পালাল। কুঞ্জ ভাই রাহীকে ভাতের লোকমা মুখে পুরে দিয়ে বললেন, “বেশি রাত জাগবি না। এক ঘণ্টা পরেই ঘুমোবি। কাল সকালে উঠতে হবে।”

রাহী চিবাতে চিবাতেই বলল, “আচ্ছা, ভাইয়া।”

এরই মাঝে কুঞ্জ ভাই আমার মুখের সামনে খাবার আনতেই আমি মুখ পিছিয়ে নিলাম, এতে উনি ভ্রু কুঁচকে ফেলে শুধালেন, “কী?”

আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে আড়চোখে তাকিয়েই বললাম, “আমার হাত আছে, আমি একাই খেতে পারি। এত আদিক্ষেতা দেখানোর কিছু নেই।”

কুঞ্জ ভাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “কত খেতে পারবি, জানা আছে। হাতের যে অবস্থা! ফুপি আর ফুপাও ব্যস্ত, তোকে খাইয়ে দিতে পারবে না। চুপচাপ খেয়ে নে।”

আমি পূর্বের ভঙ্গিতেই বললাম, “খাব না।”

“কেন?”

আমার কাছে এই প্রশ্নের একটাই উত্তর, আমি ঈর্ষান্বিত। আমার পুরুষটা যখন আমারই সামনে পরনারীর প্রশংসায় মত্ত থাকে, তখন তার হাতের ছোঁয়াও যেন জ্বলন্ত অগ্নি-কাঠ লাগে। লাগবে না সেই পুরুষ, যে আমার হয়েও আমার না। আংশিক কিছুতে তৃপ্ত না আমি। আর অতৃপ্তির চেয়ে অপ্রাপ্তিই ঢের ভালো।

আমার মুখ থেকে উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলেন না উনি। এরই পূর্বে মুখের সামনে ভাতের লোকমা তুলে এনে বললেন, “পাশের জন তোর বেস্টফ্রেন্ড হলেও, আমার আপন ছোটো বোন। সিন ক্রিয়েট না করে চুপচাপ গিলে ফেল।”

একবার রাহীর দিকে তাকালাম। দু-হাত ভর্তি মেহেদী। ডান হাতে সদ্য লাগানো আর বাঁ হাতেরটা শুকনো, সেই শুকনো হাত দিয়েই ফোন চাপছে, কানে হেডফোন লাগানো। চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে তাকালাম, এই মেয়েটা হেডফোন কখন লাগাল?

কুঞ্জ ভাই আমার অবাক হওয়ার ছোট্ট হা-টাতে ভাত পুড়ে দিলেন। আমি চোখ পাকিয়ে তাকালাম ওঁর দিকে। এতে যেন ওঁর বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। নিজের মতো খাইয়ে দিয়ে যাচ্ছেন।

খাওয়ানোর মাঝেই ওখানে খালামণির আগমন ঘটল। ধীরপায়ে ছাদের কর্ণারের এদিকটায় একদম আমার কাছে এসে দাঁড়াল। আমি বিষয়টা বুঝতে পারার পরপরই বুক ফেটে একটা অশ্রবণীয় চিৎকার বেরিয়ে এলো— “ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।”

খালামণি একটা চেয়ার টেনে আমার কাছে বসতেই বলে উঠল, “বাহ! কুঞ্জ! কী সুন্দর দুই বোনকে খাইয়ে দিচ্ছ!”

কুঞ্জ ভাই কথাটা শুনতেই থালা থেকে মাথা তুলে আমার দিকে তাকালেন বড্ড অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে, ওঁর চাহনিতে বিষয়টা বোধগম্য হলো আমার। ভেতর থেকে ‘নায়ায়ায়ায়ায়া, এএএএ হতেএএএএ পারেএএএ নায়ায়ায়ায়া’ এর সাথে বেরিয়ে এলো বিষম। রাহীর পাশ থেকে পানির বোতলটা দ্রুত আমার দিকে এগিয়ে দিলেন উনি। আমি পানি খেতে খেতে লক্ষ করলাম রাহীর ঠোঁট চেপে হেসে যাচ্ছে।

“কী এত ভাবো, খাবার সময়? একটু শান্তিমতো খাবে না? এখনই তো খাবার গলায় আটকে যাচ্ছিল!”

বিপরীতে কেউ কিছু বলল না। তবে আমার খুউব করে বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘তোমার জন্যই তো হলো! আমার কী দোষ? এভাবে যাকে তাকে ভাই বানিয়ে দেবার কোনো মানে আছে, হু? আমাকে ওঁর বোন নয়, বলো— বউ। বুঝলে?’

কিন্তু বলার সুযোগটা না দিয়েই খালামণি আবারও বলে উঠল, “কুঞ্জ তো খাইয়ে দিচ্ছে তোমাকে। তুমি বরং খেতে খেতে আমায় মেহেদী লাগিয়ে দাও দেখি।”

এই ভয়টাই তো পাচ্ছিলাম। খালামণিকে ‘না’ বলতে পারছিলাম না। তাই তো মেকি হাসি দিলাম তার দিকে তাকিয়ে। ওরপরই কুঞ্জ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে অসহায়ত্ব প্রকাশ করলাম চোখ দ্বারা।
কুঞ্জ ভাই ঝটপট খাওয়ানো শেষ করে বললেন, “না না, মামনি। ও নয়। আজ তো তোমাকে মেহেদী আমি লাগিয়ে দেব।”

খালামণি বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, “তুমি পারো?”

“অবশ্যই। ভুলে গেছ, কুঞ্জ মাল্টিট্যালেন্টেড!”

“বেশ বেশ! দাও তবে। এই যে, হাতের কনুই দেখছ না? এর উপর থেকে শুরু করবে। আর তালুতে মানডালা করবে। আঙুলগুলোর প্রথম কর ফিলআপ করে দেবে। আর এইখানটায় ‘N’ লিখে দেবে। তোমার ফুপার নামের ফার্স্ট লেটার। ঠিকাছে?”

কুঞ্জ ভাই এতসব বুঝলেন কি না— জানা নেই। সামান্য ঘাড় নেড়ে বললেন, “আমি ফ্লাওয়ার অ্যান্ড টাউন ডিজাইনের মাঝে হালকা ন্যাচার মেশাতে বেশ ভালো পারি। দেখতেও ভালো লাগে। দিয়ে দিই?”

এরকম ডিজাইনের নাম আমি বাপের জন্মে শুনিনি, ঠিক তেমনই খালামণিও কোনোদিন শোনেনি। আমি তার মুখভঙ্গি দেখে যতদূর বুঝলাম, তার কাছে এই ডিজাইনটা বড্ড ইউনিক লেগেছে। অ্যান্ড অভ্যিয়েসলি, খালা আমার ইউনিক দেখাতে ভীষণ ভালোবাসে। তাই তো, খুশিতে বাক-বাকুম হয়ে রাজি হয়ে গেল। এদিকে আমি আর রাহীতো বুঝলাম, ওঁর মেহেদী ডিজাইনটা; সেবছর ইদে এক্সামের প্রিপারেশনের জন্য যখন বাড়ি আসতে পারলাম না আমি আর রাহী, তখন কুঞ্জ ভাই এমনই এক ডিজাইন এঁকেছিলেন আমার হাতে। রাহীকে আমিই লাগিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার ডান হাতটায় ওর ভাই লাগিয়ে দিয়েছিল। এঁকেছিল— তিন পাপড়ির ফুল, জোঁকের মতো পাতা, ধানখেত, সূর্য, আকাশ, সাঁইসাঁই করে উড়ে বেরানো সুতোর মতো বাতাস, কয়েকটা দালান, ছয়-সাতটা দাগ দিয়ে বানানো চুলবিশিষ্ট একটা মেয়ের দড়িলাফ খেলার দৃশ্য, একটা মই (কী কাজে যে ধানখেতের মাঝে রাখা হয়েছিল, জানি না), সুতোর মতো প্যাঁচানো কিছু ছিল ( ডিএনএ-র ক্রোমোজম হবে), আর খালি জায়গাগুলোতে ছোট্টো ছোট্টো অসংখ্য ফোঁটা (খুব সম্ভবত এত ইউনিক ডিজাইনে আমার উপর যাতে নজর না লাগে, সেজন্য দেওয়া)। ভাবতেই পেট ফেটে হাসি পেল। কুঞ্জ ভাইয়ের সেই মহান কারুকার্য এখন দ্বিতীয় বারের মতো পরিলক্ষিত হতে যাচ্ছে। আহা! আনন্দ! মহানন্দ! তবে এখানে বেশিক্ষণ থাকা বিপজ্জনক, অতিদ্রুত প্রস্থান ঘটালাম।

___________
রাত বাড়ছে। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। সবাই ছাদেই মাদুর পেতে রয়ে গেছে। কিন্তু আমি! আমি সেই যে নিচে নামলাম! আর উপরে গেলামই না। কেন যেন আর সেখানে যেতে ইচ্ছে হলো না। সর্বাঙ্গে তুমুলভাবে আলস্যতার রাজত্ব চলল।
খুব করে মনে পড়ল, ছোটোবেলার সেসকল কাণ্ড! ইশ্! কী জ্বালাতাম আমি কুঞ্জ ভাইকে! রাহী হচ্ছে ভীতু আর পড়াকু মেয়ে। ওর কাজ সারাটাক্ষণ রুমবন্দি হয়ে নিঃশব্দে পড়াশোনা করা। কিন্তু আমি! একগুঁয়ে হলেও, কিছু মানুষের কাছে খুবই বাচাল, অতি চঞ্চল, দুষ্টুমিতে পারদর্শী আর শ্যেইমলেস একটা মেয়ে। লাস্ট বিশেষণটি কার দেওয়া, এটা নিশ্চয়ই বলে বোঝানোর প্রয়োজন নেই?

ছেলেবেলায় আমি খুব, খু-ব বেশিই অগোছালো ছিলাম। আর কুঞ্জ ভাই ছিলেন একদম আমার বিপরীত। আমি যতবার মণির বাসায় যেতাম, ততবারই আমার পদার্পণ হতো কুঞ্জ ভাইয়ের রুমে। আর সব সময়ই সেই রুমে ঢুকে একটা কাজই করতাম! এলোমেলো!

আমার বের হবার পর যেই রুমে ঢুকত, সেই বিরক্তির শীর্ষে চলে যেত। কুঞ্জ ভাই এই নিয়ে আমাকে কখনই কিছু বলতেন না। খুব আগলে রাখতেন কি না! সেজন্যই তো তার উপর পিছলে গেছি। আর উনি যে কখন অন্য নারীতে মত্ত হলেন, তা ভাবনায় রাখার সময় পাইনি।
ভাবতে ভাবতেই হাসি-খুশি মুখটা উদাস হয়ে গেল।

“উফফ! ভেবেছিলাম অলসরানিটা ঘুমিয়ে গেছে। যাক বাবা! জেগে আছিস।”

আওয়াজটা কর্ণে পৌঁছতেই সর্বাঙ্গে ভালো লাগা ছেয়ে গেল। এই মুহূর্তে ওঁকেই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল। পাশে কুঞ্জ ভাইকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। উনি পা চালিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। বাহুতে ধরে টেনে নিয়ে বসালেন খাটে। উনি হাতের মেহেদীকোণ দিয়ে আমার ডান হাতের তালুতে মেহেদী লাগাতে লাগলেন। আমি জানি, উনি কেমন লাগাবেন। তবুও আজ বাঁধা দিলাম না। এক দৃষ্টিতে কেবল ওঁকে দেখে যেতেই লাগলাম।

বড়ো বড়ো চুলগুলো কপালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সবসময় ক্লিন শেভ করা থাকেন। তবে আজ গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি দেখা যাচ্ছে। এতেও ভালো লাগছে। বাতাসে চুলগুলো খুব জ্বালাচ্ছে ওঁকে। কিছু না ভেবেই অন্য হাতটা দিয়ে এলোমেলো চুলগুলো আরও এলোমেলো করে দিলাম। উনি আমার হাত থেকে দৃষ্টি সরালেন। আমার চোখে চোখ স্থির রেখে অধর প্রসারিত করে সামান্য হাসলেন। আমিও মুচকি হাসলাম।

মিনিট বিশেক যেতেই উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “দেখো তো, কেমন হচ্ছে?”

আমি ওঁর কথা শুনে হাতের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। মুহূর্তেই বিস্ফোরিত নেত্রে ওঁর দিকে তাকিয়ে জোরেসোরেই বলে উঠলাম, “শিখলেন কবে?”

উনি মাথা চুলকে হাসলেন। নত মাথা থেকে দৃষ্টি আমার চোখের মাঝে সীমাবদ্ধ রেখে বললেন, “যাতে তাকে কোনোবার নিজের মেহেদী নিজে লাগাতে না পারার জন্য আফসোস করা না লাগে, এজন্য সেবারই শিখে রেখেছিলাম।”

আবারও হাতের দিকে তাকালাম। কী সুন্দর!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here