#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ২৬|
লোকে বলে– প্রেম করবে আর প্রেমে মরবে না.. তা কি হয়? এ তো হলো তেমন– সাঁতার কাটবে, তবে জলে না নামবে!
মরণ তো নিশ্চিত, যদি তুমি কোনো কঠোর-শক্তপোক্ত-একরোখা-জেদী-গম্ভীর-অনমনীয় ব্যক্তিত্বের কোনো পুরুষের মায়ায় আটকে যাও.. তার প্রেমেতে ডুবে যাও।
নবনী! হুমায়ূন আহমেদের ‘নবনী’ উপন্যাসের মুখ্যচরিত্র ছিল স্বয়ং নবনী নিজেই। সে ছিল পোড়া কপালি। মায়ের কাছে জেনেছি, আমার জন্মের বেশ কিছুদিন আগেই মা এই উপন্যাসটি পড়েছিল। এর রেশটা এতটাই গভীরভাবে ছেয়ে গিয়েছিল তার মাঝে যে, আমার নাম নবনী রেখেই শান্তি পেল। অথচ, মা আমার বুঝল না। বুঝল না, আমার কপালেও ওমন কিছুই আছে।
আবার, হুমায়ূন আহমেদের ‘তেতুঁল বনে জোছনা’ উপন্যাসটিতেও নবনী ছিল। সেখানে নবনী তার ডাক্তার সাহেবকে বলেছিল, ‘ডাক্তার সাহেব, তুমি আমার জন্য দু‘ ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ, তার প্রতিদানে আমি জনম জনম কাঁদিব।’
আচ্ছা! নবনীদের ভাগ্যে কি কেবলই কান্না? এত শোক কেন নবনীদের জন্যই?
টিএসসিতে বসে বসে ভেবে চলেছি, বিগত ঘটনাগুলো। বুকের মাঝে অদ্ভুত এক পীড়া হচ্ছে। সব কিছু কেমন যেন আওলিয়ে যাচ্ছে। বড্ড হাঁসফাঁস লাগছে। অস্থিরতা তীব্র হতে তীব্রতর হচ্ছে। হয়তো চোখের কোণ বেয়ে মাটি স্পর্শ করল বেশ কিছু মুক্তোর মতোন জলকণা। অনুভূতির প্রখরতা দিনকে দিন আমাকে যেন বদ্ধ উন্মাদ করে তুলছে। আলগোছে ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুলের এপিঠ-ওপিঠ দিয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুটুকু মুছে নিলাম। লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিজেকে শেষবারের জন্য আবারও সামলে নিলাম। আমার কৈফিয়ত লাগবে। ওঁকে জবাবদিহিতা করতেই হবে।
এর মাঝে আমার ফোনে লাগাতার কল এসে চলেছে, রাহীর কল। মস্তিষ্কের এই বিশাল দ্বন্দ্বে আমি বারংবার হেরে যাই। এই যে, কল রিসিভ করব কি করব না, এটা ভাবারও ফুরসৎ মিলছে না। পরপর দুই বার লম্বা করে শ্বাস টেনে নিজেকে ধাতস্ত করে কল রিসিভ করব বলে তৎক্ষণাৎ একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। রাহী সচরাচর আমাকে এভাবে কল করে না!
আমি দ্রুত কল রিসিভ করেই ব্যস্ত স্বরে বলে উঠলাম, “হ্যালো!”
“কই তুই?”
ওপাশ থেকে রাহীর রাগী স্বরের স্থির ও গম্ভীর কথাটায় আমি নড়েচড়ে বসলাম। এতক্ষণের মন খারাপ ভাব না কাটলেও, বিরহে কাতর আমার দেবদাসী ভাবটা যেন মুহূর্তেই ওই আকাশে উড়ে গেল। সে-যাক! ওসব গোনার সময় কই? সময় এখন রাহীর এমন আওয়াজের কারণ জানা। কোমল রাহী এমন রণচন্ডী রূপ ধারণ করল কীসের প্রেক্ষিতে? বুঝলাম না। তবুও অপরাধীর মতো মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললাম, “কেন? কী হয়েছে?”
“কই আছিস? টেক দ্যা নেইম অব্ দ্যাট প্লেস।”
রাহীর তীক্ষ্ণ, ধারালো আওয়াজের পরিপ্রেক্ষিতে আমি না ভেবে বলে দিলাম, “টিএসসির মোড়ে…”
ওপাশে রাহী থামল। বেরিয়ে আসা তীব্র রাগ যেন গভীরভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস টেনে দমিয়ে আনল। সে-শব্দ আমি পেলাম।
এরপর নরম গলায় বলে উঠল, “আমি চিত্রা আর নৌশির সাথে আমাদের কলেজ ক্যাম্পাসে আছি। এখানে চলে আয়।”
“কোচিং-এ থাকার কথা ছিল না তোদের?”
“হুম, যাইনি। আর..”
“আর?”
“তোর বাসায় গণ্ডগোল বাঁধল বলে।”
“মানে?”
“ওখানে আর এক সেকেন্ড দাঁড়াবে না, নবনী। জলদি এসো।”
রাহী খুব রেগে গেলে আমাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করে। আমি আর কথা না বাড়িয়ে ‘আসছি’ বলে, ফোন কেটে দিলাম। বিপদ চারদিক দিয়েই আসে। ভাই-বোন, দুটো বোধহয় মিলিত ষড়যন্ত্র করেছে, আমাকে চিন্তার চাপে পিষে মারার।
প্রস্থান ঘটানোর আগেই একটা বাচ্চা মেয়ে আমার কাছে এলো। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। সে ভুবন ভোলানো এক হাসি দিলো। কী স্নিগ্ধ সেই হাসি! আমি একটু এগিয়ে ওর মুখোমুখি হয়ে সামান্য ঝুঁকে নিচু স্বরে শুধালাম, “কিছু বলবে?”
সে উপর-নিচ জোরেশোরে মাথা নাড়ল। খিলখিল করে হাসছে, কখনও বা মুচকি হাসছে। হাসি যেন সরছেই না। সে আমার দিকে একটা কালো গোলাপ এগিয়ে দিয়ে বলল, “আপা, আপনারে দিছে এইটা।”
আমি ফুলটা হাতে নিয়ে বললাম, “কে দিয়েছে?”
সে আবারও হেসে বলল, “ভাইয়ে কইতে না করছে।”
আমি চুপ করে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। বয়স ১০ কি ১২ হবে! এরই মাঝে মেয়েটি আবারও বলল, “আপা, আরেকটা কথা কই?”
“বলো।”
“আপনে দেখতে ম্যালা সুন্দর।”
আমি বিস্মিত চোখে মেয়েটির দিকে তাকালাম। সে আমার বিস্ময় আরও বাড়িয়ে দিতে হাতে একটা কাগজের টুকরো দিয়ে বলল, “এইটাও ভাই কইছে। আপনে কিন্তু আসলেই সুন্দর।”
তারপর এক দৌঁড়ে যেদিক থেকে এসেছিল, সেদিকেই চলে গেল। আমি কিছুক্ষণ হা করে মাত্র ঘটা ঘটনাটি পর্যেক্ষণ করলাম। এরপরই তড়িৎ বেগে হাতে থাকা কাগজটি খুলতেই গুটি গুটি অক্ষরে সামান্য কয়েকটা শব্দ পেলাম। তাতে লেখা আছে, “তোমার জানার পরিসীমা বাড়ছে তবে, প্রিয় কঙ্কা!”
____________
ক্যাম্পাসের পেছনের দিকে রাখা দুটো হাই বেঞ্চে মুখোমুখি বসে আছি আমি-রাহী ও নৌশি-চিত্রা। তিনজনেই উৎসুক নেত্রে আমার পানে চেয়ে আছে, এদিকে আমি নির্বিকার। আধাঘণ্টা ধরে এভাবেই বসে আছি। চোখের সামনে এখনও সকালের ঘটনাটা হুবহু ভেসে উঠছে। এর আগে কুঞ্জ ভাইকে কখনও স্মোক করতে দেখিনি। বাদামি চোখের এমন জ্বলজ্বলে দৃষ্টি চোখে পড়েনি। আচ্ছা! ওটা আমারই কুঞ্জ ভাই তো!
নিরবতা ভেঙে রাহী বলে উঠল, “ওখানে কেন গিয়েছিলি?”
আমি আমার শান্ত দৃষ্টি ডানে ঘুরিয়ে রাহীর পানে নিবদ্ধ করে শীতল কণ্ঠে বললাম, “জানিস না?”
রাহী হতাশা মিশ্রিত শ্বাস ফেলে বলল, “ভাইয়া তোকে ওখানে যেতে মানা করেছিল। করেনি কি?”
আমার ঠোঁটের কোণে তেরছা হাসি ফুটে উঠল। এদিক-সেদিক চোখ ঘুরিয়ে বললাম, “সে তো প্রেমে পড়াতেও তীব্র নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। অবাধ্য মনটা শুনল কই? তাঁর প্রেমেতেই মজল!”
“তবুও..”, রাহী থামল। কিছুক্ষণ ভেবে ইতস্তত করে বলল, “ওখানে কিছু হয়েছে… ঘটেছে? না মানে, ভাইয়াকে দেখেছিস?”
আমি শব্দ করে হেসে উঠলাম। চাপা হাসি ঠোঁট কামড়ে থামিয়ে বললাম, “কী দেখার কথা মিন করছিস? স্পেসিফিক কিছু? তোর ভাইকে না কি তোর ভাইয়ের অন্য রূপকে?”
রাহী আমতা আমতা করতে লাগল। আমি হাসি থামিয়ে ফেললাম। ধরা গলায় বললাম, “তুই জানতিস?”
রাহী মাথা নিচু করে ফেলল। চিত্রা নাক ফুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোরা দু‘জন কী ফুসুরফুসুর করছিস? আরও দু‘জন আছি আমরা এখানে। আমাদেরও বল!”
নৌশি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে আজ বড্ড চুপচাপ। আমি আবারও সামান্য হাসলাম। যে বেঞ্চে বসে আছি, তার দুই পাশে হাতের ভর দিয়ে সামান্য পিছে ঝুঁকলাম।
আকাশের মাঝে ঘুরে বেড়ানো অশান্ত ঢেউয়ের ন্যায় অস্থির হৃদয় আমার শুধিয়ে উঠল, “শালার কোন দুনিয়ায় বাস আমার? হে, প্রকৃতি! তোমরা বলতে পারো, কেন আমি এত অবুঝ? যাকে নিজের গোটা পৃথিবী ভাবি; আমি বাদে তোমাদের পৃথিবীর সবাই জানে, আমার পৃথিবীর আসল পরিচয়। আমিই এত অবুঝ কেন? কোথায় ছিলাম আমি? দর্পণের ওপারে? যা সম্মুখে রাখা থাকবে, তা ছাড়া গোটাটাই আমার অজানা থাকবে!”
আমার মনের অবস্থা বুঝেই চিত্রা আর নৌশি দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন শুধাল না। এরই মাঝে চিত্রার ফোনে কল এলো, ওর মায়ের কল। মাকে কিছু একটা বুঝিয়ে আমাদের বলল, “অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। চল, বাসায় যাই।”
আমি বড্ড ঠান্ডা আওয়াজে বললাম, “যেতে ইচ্ছে করছে না। তোরা যা।”
নৌশি বলল, “আমারও যেতে হবে। তুই রাইয়ের সাথে ফিরিস। এ্যাই, রাই! ওর সাথে থাক।”
চিত্রা আর নৌশি চলে গেল। আমি বেশ কিছুক্ষণ পর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাহীকে বললাম, “বাসায় কী হয়েছে?”
“ফুপার ছোটোবেলার কোন বন্ধু যেন নিজের ছেলের জন্য বিয়ের প্রপোজাল পাঠিয়েছে।”
“ওহ্, আচ্ছা! এরপর? তা তোর ফুপা রাজি?”
“কী যে বলিস না! ফুপা বা ফুপি, কেউ রাজি না।”
“তো ঝামেলা কীসে?”
“তারা না-ও করতে পারছে না। হেসিটেট ফিল করছে। তাই তাদেরকে বলেছে, ‘মেয়েতো ছোটো, এখন ওসব ভাবছি না। তাছাড়া বড়ো মেয়ের আগে ছোটোটাকে কী করে দিই?’ তারা ইন্ডিরেকটলি এই রিফিউজটা বুঝেও না বোঝার ভান করে বলল, ‘সমস্যা নাই। ছেলেও কমবয়সী। অপেক্ষা করবে।’ ফুপা আর কিছু বলতে পারেনি। দুপুরে তোদের বাসায় খাওয়া-দাওয়া করবে। ফুপি তোকে খুঁজছিল সকালে। আমার বাসার কথা বলে এসেছিস, এটা আমাকে জানাবি না? তোর কথা জিজ্ঞেস করতেই, আমি ফুপিকে বলে দিয়েছি, ‘ও নেই’। ভাবতে পারছিস?”
“এরপর?”
“এরপর আবার কী? ম্যানেজ করতে বড্ড কাঠখড় পোহাতে হয়েছে।”
“কীভাবে করলি ম্যানেজ?”
“বলেছি, তুই চিত্রার বাসায়। সকালে আমিই কল দিয়ে ওখানে যেতে বলেছি। এরপর চিত্রাকে ম্যাসেজ করে জানিয়ে দিয়েছিলাম; যাতে ফুপি কল দিয়ে বাহানা দেয়, তুই ওয়াশরুমে। ফুপি ঘণ্টাখানেক পর চিত্রাকে কল দিয়েছিল। ও নার্ভাস ছিল। বলেছে, তুই ঘুমাচ্ছিস। অ্যান্ড আ’ম্ ড্যাম শিউর– ফুপি বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করেনি। তুই বাড়ি যা। গেলেই ধরবে তোকে।”
“বাসায় তোর ভাইয়ের ব্যাপারে জানে?”
“কী? কোনটা?”
“আজ যা দেখলাম!”
“জানে। আবছা জানে।”
“আর আমার সাথে তোর ভাইয়ের ব্যাপারটা?”
“জানে।”
“আপি?”
“সবার আগে জানে।”
“আম্মু-আব্বু?”
“জানে তারা।”
“মামা-মণি?”
“জানে।”
“তুই কবে জানলি?”
“এসবে খেয়াল রাখতাম না। ভাইয়া তোকে পছন্দ করে– এইটা জানতাম। কিন্তু তোর জন্য যে এত পাগলামিও করে, তাও তোর সামনেই! এটা অজানা ছিল। আনএক্সপেকটেড ছিল।”
আমি রাহীর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও কেমন মিইয়ে রয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, “তোর ভাইয়ের সাথে মামার ঝগড়ার কারণ কি এই নিয়েই হয়েছে?”
রাহী আমার দিকে তাকাল। আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, “এটা বলিস না যে, তুই জানিস না।”
“জানি।”
“এটাই কারণ?”
“আংশিক।”
“হুঁ?”
“কিছুটা। বাকিটা তুই।”
“মানে?”
আমি অবাক হয়ে রাহীর দিকে তাকিয়ে রইলাম। রাহী বলল, “বাকিটা পরে বলব। এখন এটা বল, আকিব নামের ছেলেটাকে কী করবি?”
“আকিব কে?”
“ফুপার বন্ধুর ছেলেটা; যার জন্য তোর কাছে বিয়ের প্রপোজাল এলো।”
“ওহ্!”
“ওহ?”
“হুম। তোর ভাইয়ের বিষয়টাকে হজম করে নিতে দে। তারপর, এই নয়া মালটাকে পরে দেখছি।”
রাহী পিটপিট করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি ওর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। কিচ্ছুটি ভালো লাগছে না আমার। কিচ্ছু না। নবনীদের অনেক দুঃখ থাকে.. অনেক দুঃখ। কিন্তু তাদের আশা ছাড়তে নেই।
চলবে…