#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ২৭|
রাহীর সাথে সন্ধ্যের আগ দিয়েই মামার বাসায় চলে এসেছিলাম। আজ আর বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না, এখানে কাজ আছে। আম্মুকে কল দিয়ে বলে দিয়েছি; আজ রাহীর সাথেই থাকব। কেন যেন, মানা করেনি। আমার অনুমান শক্তি বলছে, বাসায় আমাকে দেখতে আসা লোকেরা এখনও আছে বিধায়ই আম্মু বাসায় ফেরার তাগিদ দেখায়নি।
ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই দেখলাম, মণি বিছানায় বসে আছে। রাহী পড়তে বসেছে। মণি আমাকে দেখেই মলিন হেসে বলল, “কতদিন পর এলি!”
আমিও প্রত্যুত্তরে সামান্য হাসলাম। এগিয়ে গিয়ে মনির পাশে বসলাম। মণি আবারও বলল, “ছেলেটাও এমুখো হয় না কত মাস হয়ে গেল!”
আমি হেসে শুধালাম, “তা কেন আসে না?”
মণি আমতা আমতা করতে লাগল, “ওই যে! ভার্সিটিতে কীসব কাজ আছে। আমি বাবা অতসব বুঝি না। তোদের আজকালকার ছেলেপুলেদের কত ব্যস্ততা! মা-বাপকে মনে রাখার সময় কই?”
মণির শেষোক্ত কথাটিতে তীব্র অভিমানের ছাপ। আমি মুচকি হেসে অভয় দিলাম, “সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখে নিয়ো।”
মণি আমার দিক থেকে দৃষ্টি সরাল। মায়েদের নিজের চোখের জল দেখাতে নেই। তাদের লুকোতে শিখতে হয়। সংসারের চরম দুর্ভোগেও তাদের নিরাশ হতে নেই। বরং ঠোঁটে ভরসার হাসি টেনে বলতে জানতে হয়, ‘চিন্তা কোরো না। আল্লাহ চাইলে, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
আমি তাই মণিকে ঘাঁটালাম না। আমার মণি এখনও স্ট্রং হতে পারেনি। স্বান্তনা বাণী শেখেনি। সে তীব্র অভিমান বুকে বসত করতে জানে। স্বল্প অভিমানেই অভিযোগের ঝুলি খুলে ফোঁপাতে জানে। এই যে, মণি এখন এখান থেকে উঠে গিয়ে কুঞ্জ ভাইকে কল দেবে। কল ধরতেই আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদবে।
কুঞ্জ ভাই তখন নরম স্বরে বলবে, “মা! আমি ঠিক আছি। একদম ফিট অ্যান্ড ফাইন। কেঁদো না, মা। আচ্ছা! তোমরা তিনজনেই যদি এভাবে কান্নাকাটি করার অভ্যাস পোষো; তবে যখন তিনজন একসাথে অশ্রুবিলাশে মত্ত হবে, আমি একাকী পুরুষ কাকে রেখে কাকে সামলাব? বোনটার জন্য না হয় পরে কেউ আসবে.. কিন্তু এখন তো আমি ছাড়া কেউ নেই। আর তোমার বর তো বিশাল ব্যস্ত মাপের মানুষ; বউয়ের চোখের জল মোছার তার সময় কই? আচ্ছা, মা! সুখে থাকতে ভূতে কিলিয়েছিল তোমাকে? দুনিয়াতে আমার জন্য আর বাপ খুঁজে পাওনি?”
মণি তখন পুরোপুরি কান্না থামিয়ে কুঞ্জ ভাইকে এক রামধমক দেবে। আমি এটা রাহীর কাছে শুনেছি। আবার কুঞ্জ ভাইকে বলতেও শুনেছি। আমি ডানে মণির দিকে তাকালাম। বললাম, “মেডিসিন নিয়েছ?”
“উঁহু।”
“তোমার রুমের বেডসাইড টেবিলের উপর রেখে এসেছি, গিয়ে খাবে।”
“ঠিক আছে।”
“দশটা বেজে গেছে। এক্ষুনি ঘুমিয়ে যাবে। ঠিক আছে?”
“ওরে, বাবা! আমার মা সাজছেন!”
“হুঁহ! প্রয়োজন পড়লে, তাই-ই।”
“আচ্ছা, আচ্ছা!”
“হুম। মামা কবে আসবে?”
“কালই তো গেল। সামনের সপ্তাহে আসবে।”
“আচ্ছা। তবে যাও এখন। ওষুধ নিয়ে ঘুমাবে।”
মণি ডানে বাঁয়ে মাথা নেড়ে রুমে চলে গেল। আমি চাপা শ্বাস ছেড়ে বাঁয়ে মুড়তেই রাহীকে তীক্ষ্ণ নজরে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম।
রাগ দেখিয়ে বললাম, “এমনিতেই তোর ভাইয়ের কারণে মেজাজ তুঙ্গে উঠে আছে। খুলে বল– কাহিনি কী।”
রাহী বই ভাঁজ করে চেয়ারটা আমার দিকে ঘুরিয়ে বসল। লম্বা একটা শ্বাস টেনে বলতে শুরু করল, “বাবা যখন জানতে পারে, ভাইয়ের বিষয় নিয়ে; তখন একটা ঝামেলা হয়েছিল। মিটেও গিয়েছিল। এরপর তোকে নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। বেশ দূর পর্যন্ত যায়। আমি তোদের বাসায় ছিলাম বিধায় পুরোটা জানি না। কেবল জানি– এই ঝামেলাতেই ভাইয়া বাড়ি ছাড়ে। তবুও বাবা বিজনেস ট্রিপে গেলে, মাঝে মাঝে ভাইয়া বাসায় আসত। লাস্ট টাইম আরও এক ঝামেলা হওয়ায় পুরোপুরি বাসা ত্যাগ করেছে আমার গুণধর ভাই।”
“আরে ভাই! আমাকে নিয়ে কী জন্য ঝগড়া লেগেছিল, সেইটা খুলে বল! ঝামেলা তো অনেক ধরনের হতে পারে। এই ধর, ঘন ঘন তোদের বাসায় যাওয়া আসা নিয়ে হলো! কিন্তু এটা হওয়ার নয়।”
“এরকম না।”
“আবার ধর, মামা বা মণি, কেউ আমার সাথে তোর ভাইয়ের বিয়ে দিতে চাইছে; কিন্তু তোর ভাই সন্যাস ব্রতে আছে, রাজি না।”
“আরে!”
“আরে, শোন! আবার এরকমও হতে পারে, আমি বারবার মণির কাছে জেই অভিযোগগুলো করি, সেগুলো মামা জেনে গেল। তারপর বকা-ঝকা করল। কিন্তু এটাতো সিরিয়াস লেভেলে বাড়ি ছাড়ার মতো না। আচ্ছা! আমি যে এত এত অভিশাপ দিতাম তোর ভাইকে, সেগুলো লেগে যায়নি তো?”
“এএএ ভাই, থাম তুই। সাধে তো আর আমার ভাই তোকে গাঁধী বলে না!”
রাহীর কপাল চাপড়ে বলা শেষ কথাটি বেশ মিনমিনে কণ্ঠে ছিল, তবুও আমার কানে এলো। তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, “কী বললি?”
___________
গভীর রাতে পা টিপে টিপে কুঞ্জ ভাইয়ের রুমের দিকে এগোচ্ছি। নিজ লক্ষ্যের দিকে এগোতে এগোতে আমি বারবার ডানে বাঁয়ে তাকাচ্ছি; পাছে না কেউ দেখে ফেলে। যদিও দেখার মতো কেউ নেই। ঘড়িতে বাজে মধ্যরাতের ১টা। রাহী পড়া রিভাইস করে ঘণ্টা খানেক আগেই ঘুমোল। মণিও ওষুধ খেয়ে ঘুম। উঠবে আযানের শব্দেই। কাজেই ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। তবুও…
রুমে পৌঁছেই আমি আস্তে করে কাঠের দরজাটা সামান্য ঠেলে দিলাম। নিকষ কালো অন্ধকারে নিজের ছায়াটাও চোখে পড়া দায়। আমি এতক্ষণে ফোনের টর্চ অন করলাম। খুঁজতে লাগলাম কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি, সেই ডায়েরিটি।
ডায়েরি! একটা মানুষের আত্মকথন। রহস্যময় কিংবা ইন্ট্রোভার্ট মানব-মানবীদের স্বভাবতই ডায়েরি লেখার অভ্যেস থাকে। তারা দুনিয়ার সামনে নিজেকে উপস্থাপন করে না কিংবা করতে পারে না। গোপন বিষয়াদির সব না হলেও আংশিক নিজের ডায়েরিতে প্রকাশ করে।
কুঞ্জ ভাইয়ের ডায়েরি লেখার অভ্যেস আছে। কিছু না কিছু নিশ্চয়ই সেখানে পাওয়া যেতে পারে। কথায় আছে– ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখিও তাই। পাইলেও পাইতে পারো, অমূল্য রতন।’
আমিও তাই সেই আশাতেই এ-বাড়িতে ডায়েরির সন্ধ্যানে থেকে গেলাম।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে ডায়েরিটা খুঁজে চলেছি। গতবার যেখানে দেখেছিলাম, সেখানে পাচ্ছি না। অনেকটা সময় এই পুরোনো নীল ডায়েরি খোঁজার পেছনে ব্যয় করে, অবশেষে বুকশেলফের একদম নিচে পেলাম। জায়গা চেঞ্জ হওয়া স্বাভাবিকই বটে। লাস্ট টাইম, ডায়েরিটা জায়গামতো রাখার পর কুঞ্জ ভাই আরও দু’বার এসেছিলেন।
ডায়েরিটা নিয়ে টেবিলে রেখে, চেয়ার টেনে বসলাম। টর্চ বন্ধ করে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালালাম। ডায়েরি খুলতেই প্রথম পেইজে কুঞ্জ ভাইয়ের পরিষ্কার হাতের লেখায় সেই মেয়েকে নিয়ে লেখা দেখলাম। আরও একবার পড়লাম।
– “আমার হৃদয়হরণী, কোমল এক রমণী সে। তাকে দেখলেই শুধু দেখে যেতে ইচ্ছে হয় এই দু’চোখ ভরে। তার চোখের উপচে পড়া মায়ায় আমি তলিয়ে পাচ্ছি না কুল। বড্ড অদ্ভুত নারী সে। তার আশেপাশে না থাকলে নিজেকে ছন্নছাড়া লাগে, দিন-দুনিয়া হারিয়ে ফেলি। অথচ, সেই নারীটি পাশে থাকলে আমি গোটা নিজেকেই হারিয়ে ফেলি। প্রখর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন আমিটা তার সান্নিধ্যে পালটে যাই, পুরোই বিপরীতধর্মী এক সত্তা আমাকে কাবু করতে থাকে। আমার সবচেয়ে প্রিয়! সবচেয়ে প্রিয়– তার কোমল শরীরের মিষ্টি সেই পদ্ম পাপড়ির সুবাস। পাগল করে দেয়। কখনও কোনো নারীর প্রতি আমার এমন অনুভূতি আসেনি। তবে তার প্রতি কেন? কারণ একটাই– সে যে ভিন্ন, আমার কঙ্কাবতী ভিন্ন। তাকে আমি নিজের অস্তিত্বের সাথেই মিশিয়ে ফেলেছি। এখন সে ছাড়া আমার আর গতি নেই। পুরো পৃথিবীর সবকিছুর বিনিময়ে হলেও আমার তাকে চাই। মোহময়ী কঙ্কা আমার, তোমাকে চাই।”
এখানে কঙ্কা ও কঙ্কাবতী সম্বোধনে আমার মাথায় তড়িৎ বেগে খেলল– আজ সকালে পাওয়া সেই চিরকুটেও আমাকে কঙ্কা সম্বোধন করা হয়েছে। কুঞ্জ ভাইয়ের মতিগতি বুঝতে আমার সময় লাগল না। মনটা কেমন আনচান করতে লাগল কেবল। ব্যাপারটি নিয়ে আর না ঘাটিয়ে দুটো শ্বাস ছাড়লাম। এরপর ডায়েরির পরের পেইজ উলটালাম। উপরে তারিখে দেওয়া।
-“০৩-০৪-২০১৬
আমার ১৭তম জন্মদিন। জন্মদিনের ব্যাপারে আমি কোনোকালেই ইন্টারেস্টেড ছিলাম না, হবও না। তবে, আজ দারুণ একটা ঘটনা ঘটল। পিচ্চিটা টিফিনের টাকা জমিয়ে আমার জন্য গিফট এনেছে। এখন রাত ১টা। ঠিক রাত ১০টায় সে হলদেটে হাঁটু লম্বা ফ্রক পড়ে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে আমাদের বাসায় চলে আসে। ঘনকালো চুলগুলো দুই বেনুনি করা। একদম হলুদ পাখি বেশে সে দাঁড়িয়েছিল বটে। তবে, চাঞ্চল্যের ছিটেফোঁটাও ছিল না। কেমন যেন ইতস্তত করছিল। ব্যাপারটা সচরাচর দেখা যায় না। আনমনেই ভ্রু-কুঁচকে এলো।
আমাকে এভাবে তাকাতে দেখে পেছনে লুকোনো গিফটটি আমার সামনে এগিয়ে চটপটে ভঙ্গিতে বলল, ‘কুঞ্জ ভাই! একদম ভুলে গেছিলাম। কাল সকালেও মনে ছিল। কিন্তু আজ! সে যাক-গে! সন্ধ্যের পর মনে পড়ায় আব্বুর চোখ এড়িয়ে বাসা থেকে বেড়িয়েছিলাম। জানেনই তো, আব্বু একা বেরোতে দেয় না। এই নিন। আশে-পাশে পছন্দ মতো কিছুই পাচ্ছিলাম না। তাই ওই স্টেশনারি থেকে এই ডায়েরিটা নিয়েছি। এরপর এতক্ষণ ধরে ডিজাইন করলাম। ঘুম পাচ্ছে, কুঞ্জ ভাই! এটা ধরুন। গেলাম আমি। ঘুমাব।’
পিচ্চিটা এখন নিশ্চয়ই ঘুমোচ্ছে! আমি র্যাপিং পেপার খুলে এই ডায়েরিটি পেলাম। কী সুন্দর ভাবে বাচ্চা হাতে সাজিয়েছে! রাতে ডায়েরিটা হাতে দিয়ে যখন চলে যেতে নিচ্ছিল, পিছু পিছু আমিও গেলাম। ওকে বাসা অবধি এগিয়ে দেওয়ার জন্য। তা দেখে পিচ্চিটা কী চমৎকার হাসল!
এরপর বলল, ‘কুঞ্জ ভাই, শুনুন। আপনি বড্ড কম কথা বলেন। আর আমার এই ব্যাপারটা জোস লাগে। কিন্তু, আপনি কি জানেন, আপনার চোখ কখনই নির্বাক থাকে না; প্রচুর বকবক করে। সারাটাক্ষণ কীভাবে কীভাবে যেন আমায় শাসিয়ে যায়। দেখুন, মেইন টপিকে আসি। চোখে চোখে কথপোকথন কমিয়ে এই যে ডায়েরি, এতে লিখুন। আমিও শান্তি পাব। আর, হ্যাঁ! ২য় পেইজ থেকে লিখবেন। প্রথম পেইজে সবচেয়ে দামী কিছু লিখবেন। এই এই এই! দামী মানে কিন্তু মুহূর্ত বোঝাচ্ছি। আপনার এসব ব্র্যান্ডেড জিনিসাদি নয়! জীবনের সেরা অব্যক্ত অনুভূতি এখানে লিখবেন। বাসা চলে এসেছে। আচ্ছা, গেলাম আমি।’
আমি তার কথা ভুলিনি, ভুলব না। ভেবেছিলাম– প্রথম পেইজে পিচ্চির দেওয়া এই প্রথম উপহারের কথাই লিখব। কেন যেন এই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, ‘এর চেয়ে সেরা অনুভূতি আমার জিবনে দ্বিতীয়টি নেই।’
পরক্ষণেই আমি থামলাম। দ্বিতীয় পেইজ থেকে লেখা শুরু করলাম।”
এই পেইজে এটুকুই লেখা। আমি পরের পেইজে যাওয়ার আগে ভালোভাবে ডায়েরিটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলাম। তখন আমার বয়স মনে করার চেষ্টা করলাম। উমম.. ভালোই ছোটো ছিলাম। পুরোনো সেসব দিনের কথা মনে পড়তেই মুচকি হাসি যেন ঠোঁটে আঁটে না। তখনই আমার ফোনে কল এলো। ভাইব্রেট করে উঠল ফোনটি। হাতে তুলে দেখলাম– কুঞ্জ ভাইয়ের কল।
চলবে..