#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ২৮|
একের পর এক লাগাতার কল এসেই যাচ্ছে। বুঝে উঠতে পারছি না, কল রিসিভ করব না কি করব না। কুঞ্জ ভাই এমন অসময়ে কল কেন দিচ্ছেন? দিচ্ছেন তো দিচ্ছেন, দেখছেন– কল রিসিভ করছি না; তবুও কেন বারবার দিয়েই যাচ্ছেন? হুট করেই আমার মস্তিষ্ক সচেতন হলো।
চতুর্থ বার কল আসতেই আমি রিসিভ করে বসলাম। কিছু বলতে যাব, তার আগেই ওপাশ থেকে কুঞ্জ ভাই বলে উঠলেন, “জেগে আছিস?”
আজিব! জেগে থাকি বা না থাকি– সেটা পরের বিষয়। রাতের ২টায়, টানা চারবার কল দিয়ে একটা লোক কী করে বলতে পারে, ‘জেগে আছিস?’
বলি– মাথায় ঘিলু আছে? সারাদিনের ধকল শেষে এতক্ষণ সেই ডায়েরিটা পড়ে কী সুন্দর মনটা নিয়ে আকাশে উড়িয়ে বেড়াচ্ছিলাম! নাহ! লোকটার তা সহ্য হলো না। চলে এলো শান্তি হারাম করতে।
আমি তাঁর ‘জেগে আছিস’-এর মতো অহেতুক প্রশ্নের উত্তর দিলাম না। উনি অপেক্ষাও করলেন না। আবারও বললেন, “নিচে আয়।”
আশ্চর্য! রাত-বিরেতে ‘নিচে আয়’ বললেই হবে! উনি কি জানেন– আমি ওঁর বাসায়, ওঁরই রুমে আছি না কি আমার বাসার নিচেই দাঁড়িয়ে থেকে বলছেন, ‘নিচে আয়’!
এবার প্রত্যুত্তর করলাম। স্বাভাবিক কণ্ঠে বললাম, “আমি আপনার বাসায়।”
“জানি। তবে ওটা আমার না, তোর মামার বাসা।”
“ওই একই হলো।”
“একই না।”
“উফ!”
“নিচে আয়।”
আমি এতক্ষণে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি। কুঞ্জ ভাই নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলোয় অফ হোয়াইট কালারের হুডি পরিহিত কুঞ্জ ভাইকে দেখে এই তীব্র শীতেও আমার শরীরের রক্ত গরম হতে লাগল। মন মহাশয় ছলাৎ করে লাফিয়ে উঠল। এই মরার ঢং দেখেই মরব আমি। মুহূর্তেই সকালের বিষয় মনে এলো। নাহ! এত সবের পরেও এরকম ছ্যাঁচড়ামি আমাকে সাজে না। নিজেকে সামলে নিলাম। ততক্ষণে কুঞ্জ ভাই ঘুরে দাঁড়ালেন। আমাকে দেখে হাত নাড়িয়ে ইশারা করলেন– নিচে যেতে। উফফ! আবারও! আমার যেন কী হলো, আমি দৌড়ে সদর দরজার কাছে চলে গেলাম। বড্ড সাবধানে দরজা খুলে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত গতিতে নিচে নেমে এলাম।
কুঞ্জ ভাই বাইকে হেলান দিয়ে মনোযোগী দৃষ্টিতে ফোন দেখে যাচ্ছেন। এক হাত পকেটে পুরে রাখা। উপরের পাটির দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে রেখেছেন। আশ্চর্য! আমাকে এখানে আসতে বলে এখন ভাব ধরা হচ্ছে! মেজাজ সপ্তম আকাশে উঠল। ওঁকে পাত্তা দিচ্ছি কেন– মস্তিষ্কের এই প্রশ্নে আমার রাগ আরও বেড়ে গেল। এক পা পিছিয়ে চলে যেতে নিয়েও গেলাম না। বরং তীব্র বেগে ঝাঁপিয়ে পড়লাম কুঞ্জ ভাইয়ের উপর। দু’হাতে শক্ত করে কর্লার চেপে ধরলাম। অসাবধানতার বদৌলতে উনি খানিকটা পিছিয়ে গেলেন। পরপরই পুরুষালি শক্তপোক্ত রোমশ হাতটি আলগোছে আমার কোমর জড়িয়ে ধরল। আগলে রাখার চিন্তা কি? হু নৌ’জ!
কাল-বেলা অতিক্রম না করে অসহনীয় রাগটা ঝাড়তেই উঁচু গলায় বলে উঠলাম, “চুপ! কোনো ঢং না। একদম আজাইরা ঢং করবি তো একেবারে জানে মেরে দেব। খুব মজা লাগে– আমাকে টেনশনে ফেলতে পারলে, হ্যাঁ? খুব মজা লাগে? আজ তোর মজা আমি বের করছি। আমার কৈফিয়ত চাই। নতুবা মুখ ফিরিয়ে নিতে দ্বিধা করব না আর..”
তাই কি? কথাগুলো যেন নিজেরই কানে বিঁধল! যার সাথে অভিমান তো হয় কিন্তু দূরত্বটা মন ঠিক মানতে চায় না, তার থেকে মুখ ফেরানো যায় কি? এই যে, সারাদিনের তীব্র অভিমানটা, যা প্রিয়তমের সামান্য এক ডাকে মূর্ছা গেল, তা কি এমনি এমনি? মুখ কি আদতে ফেরানো সম্ভব? তবুও লাগামহীন মুখটা কী কী যে বলে ফেলল! নিজের চেয়ে বছর ছয়েকের বড়ো একটা পুরুষ মানুষকে কী করে এক পলকেই ‘তুই’ সম্বোধন করে ফেললাম? বিষয়টা মাথায় খেলল না।
অগ্নি ঝলসানো চোখ তুলে আরও একবার কুঞ্জ ভাইকে দেখে নিলাম। দু’চোখ ভর্তি বিস্ময়ভাবটা যেন জলের মতো টইটম্বুর করছে! আমি কর্লারটা আরও শক্ত করে চেপে ধরে বাক্য সম্পূর্ণ করতে যাব, তখনই কুঞ্জ ভাই ওঁর হাতের জোর বাড়িয়ে দিয়েছেন। ঘাবড়ে গেলাম আমি। এদিক-ওদিক ব্যস্ত ভঙ্গিতে চোখ বুলালাম। সঙ্গে সঙ্গে টের পেলাম– কোমরের বলিষ্ঠ হাতের প্রয়োগে আগের চেয়ে বেশি মাত্রার চাপটি। নিজের দিকে টানলেন বোধহয়!
কর্লার চেপে রাখা হাতদুটো ঢিলা হয়ে গেল। আপাতত হাতজোড়া তাঁর বুকে অবস্থান করছে। আমার চোখে এখন রাগ নেই, আছে ওঁর পরবর্তী পদক্ষেপটা জানার আকাঙ্ক্ষা আর কারো চোখে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা।
কুঞ্জ ভাই আরও কিছুটা ঝুঁকলেন। আমি ওঁর নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি, যা আমার ভেতরটায় তোলপাড় চালিয়ে দিল। চোখ দুটো বন্ধ করে এই প্রহরটা অনুভবের চেষ্টা করছি, যদিও মনোযোগ তো কেবলই মহাশয়ের চালচলন লক্ষ করতেই ব্যস্ত। আপাতত মধ্যবর্তী দূরত্ব ইঞ্চিখানেক! চোখ তুললাম আবার। চোখে চোখ মিলল। মিলল অন্তরের গভীরতম অনুভূতিদের সাক্ষাৎ! তারা ভারি খুশি! আরও এগিয়ে ঠোঁট ছুঁইছুঁই হবার আগেই আমি মুখ ঘুরিয়ে ফেললাম। ওঁর ঠোঁট গিয়ে ঠেকল আমার গালের শেষাংশে। সামান্য হাসলেন কি? নতুবা গালে ছোঁয়ানো ঠোঁটের এই নড়চড়ে ভাবটা কেন?
“মুখ ফিরিয়ে নিতে চাও? এই কি তবে ট্রেইলার? লাভ নেই, প্রাণ। লাভ নেই। আমি ছাড়া তোমার আর গতি নেই। তোমার জন্য তো বাবার বাধ্য ছেলে আমিটা, তাঁর বিরুদ্ধেও গিয়েছি। সেখানে তুমি কী!”
কুঞ্জ ভাইয়ের ফিসসিয়ে বলা কথাগুলো আমার মনে এলোমেলো ভাবে আঘাত করলেও, শেষোক্ত কথাটি.. ‘বাবার বিরুদ্ধে গিয়েছি’–কথাটিতে মস্তিষ্কে টনক নড়ল। এতক্ষণের আকর্ষণ, কামনা সব কৌতুহলে রূপ নিল।
কুঞ্জ ভাই আমাকে ছেড়ে সরে দাঁড়ালেন। দু’হাত পকেটে গোঁজা। আমাকে দেখে হাসছেন। আশ্চর্য লোক!
আমি ভারি কণ্ঠে শুধালাম, “মামার সাথে কী হয়েছিল?”
কুঞ্জ ভাই মিটমিটিয়ে হাসছেন। আমার রাগ লাগছে আবার। চোখমুখ শক্ত করে বললাম, “আমাকে রাগাবেন না। যা জিজ্ঞেস করছি– বলুন।”
উনি ডান হাতের তর্জনী দিয়ে ঠোঁট চেপে হাসতে হাসতে বললেন, “যথা আজ্ঞা, মহারানি। প্রশ্ন পেশ করুন।”
“আমার চেহারায় কি লেখা আছে– আমি জোকার?”
“কই দেখি! না তো। লেখা নেই তো।”
“তবে হাসছেন কেন? এত বেয়াদব হয়েছেন কেন?”
“স্যরি, আপু। উক্ত প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নাই। কৃপা করিয়া কি আপনি পরবর্তী প্রশ্ন করিবেন?”
“চুপ চুপ চুপ! আমি আপনার কোন জন্মের আপু লাগি?”
“এই যে সারাক্ষণ ভাই ডাকতে ডাকতে আমার সেদ্ধ করা জীবনটা ভেজে খাচ্ছেন, কিছু কি বলেছি? তাহলে আপনি কেন বকছেন? আপনারও উচিত আমার মতো উদার মনের হওয়া। আর আপু তো সম্মানের ডাক। আমি আপনাকে সম্মান দিচ্ছি। আমি আপনাকে উঠতে বসতে এমন সম্মান দিতে চাই।”
“ওমা.. তাই?”
“জি, আপু।”
“চুপ, বেয়াদব লোক! আমি তোর কোন জন্মের আপু লাগি রে? বউ ডাক, বউ। বউকে আপু ডাকলে পাপ লাগে।”
আমার রণচণ্ডী রূপ দেখে মাঝ রাতের ফাঁকা রাস্তায় কুঞ্জ ভাই হো হো করে হেসে উঠলেন। কী মোহাচ্ছন্ন সেই হাসির স্নিগ্ধতা। হঠাৎ আমি এই হাসিতে ডুবে যেতে গিয়েও গেলাম না, নিজেকে সামলে নিলাম। দু-কদম এগিয়ে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালাম।
সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, “কথা ঘোরানো হচ্ছে?”
উনি হাসি থামালেন। গম্ভীর মুখে বললেন, “কী খাচ্ছিস দিন দিন?”
আমি আবারও অবাক হয়ে মুখ হা করে ফেললাম। আবার কী? জিজ্ঞেস করার অবসরও পেলাম না। উনি সেই ফাঁকে পুনরায় বললেন, “তুই একটা উন্নত মানের গাঁধি ছিলিস, এখন গোরু হচ্ছিস। তোর ইম্প্রুভমেন্ট হচ্ছে, নবু। এভাবেই এগিয়ে যা। একদিন মানুষ হয়ে পুরো বিশ্বকে চমকে দিবি। আমরা খুব আশাবাদী।”
“আপনি ভারি অসভ্য লোক তো! কথা ঘোরাবেন না, বলছি। সত্যি বলুন। কি? বলবেন না?”
কুঞ্জ ভাই কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। এরপর বাইকে উঠে বললেন, “বলব। ওঠ।”
আমি উঠলাম না। মাটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি তাগিদ দিয়ে বললেন, “দেরি হচ্ছে। সকালে একটা মিটিং আছে। আয়।”
মুখ খুললাম আমি, “কই যাব?”
“গন্তব্য না থাকলে কি রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়? চলা যায় না?”
“যায়। তবে স্বার্থপর মনুষ্যজাতি গন্তব্য ছাড়া এমনি এমনি চলে না।”
“যেখানে স্বয়ং গন্তব্য নিজেই আমার পাশে। সেখানে কার পিছে ছুটব? চল, আমরা বরং উদ্দেশ্যহীন পথ পাড়ি দিই।”
আমি বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম ওঁর দিকে। তারপর বিনা শব্দে পিছে উঠে বসলাম। কুঞ্জ ভাই মুচকি হেসে বাইক স্টার্ট দিলেন।
__________
“কুঞ্জ, ভাই! ধীরে চালান না! ভয় হচ্ছে।”
“কীসের ভয়? জাস্ট ইনজয় ইট, নবু। চোখ বন্ধ কর আর আমাকে আরেকটু শক্ত করে ধর।”
আমি ওঁকে শক্ত করে ধরলাম। চোখও বন্ধ করলাম। তবে ভয় দমল না। আবারও চিৎকার করে উঠলাম, “দোহায় লাগে, কুঞ্জ ভাই। থামান আপনি। আমার খুব ভয় করছে।”
কুঞ্জ ভাই বাইক থামালেন না। শুধু বললেন, “আমি আছি না?”
হ্যাঁ, উনি আছেন। মনের ভেতর কেমন করে ভালো লাগারা নাচতে লাগল! ঠোঁটে হানা দিলো হাসির ঝলক। তখনই তীব্র আলোকরশ্মি চোখে বিঁধল। সামনে ট্রাক! সজোরে প্রিয় পুরুষটির নাম নিয়ে চিৎকার করে উঠলাম…
চলবে..