কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী লেখনীতে: নবনীতা শেখ |পর্ব ২৯|

0
128

#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ২৯|

“কী সমস্যা আপনার? কী করতে যাচ্ছিলেন, কী? চাচ্ছিলেন কী? মরে যাই? আরে! আমি তো মানসিকভাবে প্রতিদিনই মরছি। আনুষ্ঠানিকভাবে মারার দরকার কী?”

হাঁপাতে হাঁপাতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে তেজী কণ্ঠে কথাগুলো বলছি। কুঞ্জ ভাই অনিমেষনেত্রে তাকিয়ে আছেন। আমার কথা শেষ হতেই বললেন, “ডোন্ট ইউ ট্রাস্ট মি?”

আমি হতাশ হয়ে বললাম, “আই ট্রাস্ট ইউ বাট… এভাবে কেউ বাইকিং করে?”

কুঞ্জ ভাই হাসলেন। বললেন, “তোমার বিশ্বাসের নমুনা দেখলাম। কখনও এমন কোনো সিচুয়েশন এলে, আমায় বিশ্বাস করবে কি না– তা দেখলাম। আচ্ছা, আমাকে এখনও এটুকু চিনতে পারোনি? আমি নিজে মরলেও তোমার ক্ষতি চাইব না, হতে দেবও না।”

“যদি কিছু হয়ে যেত? কী প্রুভ করতে চাইছিলেন?”

ভ্রু-কুঞ্চিত করে কথাটুকু বললাম। বাঁকা হেসে বললেন, “না, কিছু না।”

কথাটি সম্পূর্ণ করেই ধীর পায়ে মেইনরোডের বাঁয়ে থাকা ঝোপের দিকে পা বাড়ালেন। বড্ড অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ। বাজে ক’টা? উম.. তিনটে? কুঞ্জ ভাই ধীরে ধীরে ভেতরের দিকে বিলীন হতে লাগলেন। আমি হাত উঁচিয়ে ডাকলাম, “আরে! আরে! করছেনটা কী? যাচ্ছেন কই?”

কুঞ্জ ভাই ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরে তাকালেন আমার দিকে। সরু রাস্তাটি বরাবর চাইলে, ছোটো খাটো একটা জঙ্গল বলে দিতে দ্বিধা করবে না কেউ। চারোপাশে ঝোপঝাড়, লতাগুল্মে সাজানো বিশালাকৃতির গাছপালা, ভেতরে হয়তোবা অজানা-অচেনা-অদেখা আরও অনেক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ আছে। গাছগাছালির ফাঁকফোকর দিয়ে মোহময়ী চাঁদের অতিরঞ্জিত আলোতে কুঞ্জ ভাইকে অন্য রকম লাগছে। বে-শ অন্যরকম। আমি যতদূর জানি, লোকালয়ে এমন জায়গা পাওয়া দুষ্কর। তবে এটা কী?

কুঞ্জ ভাই আমার থেকে অনেকটা দূরে। আমি রোডে দাঁড়িয়ে আর উনি ভেতরের দিকে। না হলেও ৬০-৭০ মিটার দূরে আছেন! উনি ডাকলেন আমায়, “নবনী!”

নিস্তব্ধ রাতে ওঁর আওয়াজটা বাতাসে বাড়ি খেল, এভারেজ শব্দটা জোরেশোরেই শোনা গেল। পরপর আবার বললেন, “এসো।”

আমি পিছু পিছু গেলাম। উনি দাঁড়িয়ে আছেন। আমি যেতেই উনি আমার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় পুড়ে নিলেন। হাতের আঙ্গুলের ভাঁজে ভাঁজে নিজের আঙ্গুল রাখলেন, বেশ শক্ত করে আটকে নিয়ে পা বাড়ালেন সামনের দিকে।

জ্যোৎস্না রাত, সরু রাস্তার দুপাশ দিয়ে গাছপালা, উপরের দিকটা সামান্য খোলা, আকাশের ঠিক উপরে এক ফালি চাঁদ, তারা-নক্ষত্রের মেলা, বাতাসের রোমাঞ্চিত শব্দগুচ্ছ আর পাশে প্রিয় পুরুষটি! সবে মিলে মনটা এলোমেলো করে দিচ্ছে। যেতে যেতে কুঞ্জ ভাইকে শুধালাম, “কই যাচ্ছি?”

“শান্তির নীড়ে।”

আমি তো ঠিক এই হাতের মুঠোতেই শান্তি খুঁজে পাচ্ছি। আর কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই আমার। এখানেই বেশ আছি। পথ ফুরোলেই যদি হাত ছেড়ে দেন? থাক, যাওয়ার প্রয়োজন নেই! মনে মনে কথাগুলো আওড়ালেও মুখে আনতে পারলাম না। কেমন যেন ঘোরে আচ্ছন্ন আমি। যা দেখছি, তাই ভালো লাগছে। মন ভালো থাকলে বুঝি দূরপাল্লার বাসের হর্নের শব্দও সুরেলা গানের ধ্বনি লাগে?

বেশ এগোতে এগোতে একটা ঝিলের কাছে গেলাম। ছোট্টো গোলাকার একটা ঝিল। ঝিলের সম্পূর্ণ পাড় ৮-১০ হাত জায়গা নিয়ে করা। ফাঁকা জায়গাটুকুতে ছোটো-ছোটো মসৃণ ঘাস জন্মেছে। এছাড়া ঝিলটিকে সম্পূর্ণ ঘিরে রেখেছে পেরিয়ে আসা গাছের দলেরা। দেখে মনে হচ্ছে– কেউ খুব যত্নে এই জায়গাটি বানিয়েছে। কুঞ্জ ভাই হাত ছেড়েছেন কখন– জানা নেই। আমি ঘুরে-ফিরে পুরোটা দেখলাম। কী স্নিগ্ধ লাগছে!

জুতো খুলে এগিয়ে গিয়ে ঝিলের টলটলে জলে পা ভিজিয়ে বসে পড়লাম। পরনে একটা হালকা রঙের স্কার্ট আর সাদা ক্রপটপ ছিল, এর উপরে মোটা শাল জড়ানো। ঝিলের হিমশীতল জলে পুরো শরীর কেঁপে উঠল। সেই সাথে ভালো লাগার আবেশে মন জুড়িয়ে গেল। এতক্ষণে কুঞ্জ ভাইও জুতো খুলে, জিন্স গুটিয়ে এগিয়ে এসে আমার পাশে বসলেন।

আমি ওঁর দিকে আবেগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। উনি তা দেখে বললেন, “শীত করছে?”

মিথ্যে বললাম না, “একটু করছে।”

উনি ব্যস্ত হয়ে হুডিটা খুলতে লাগলেন। বললেন, “এটা নাও, শীত কম করবে। বাইকেও অনেক শীত করেছিল, না?”

“হুম.. কিন্তু লাগবে না।”

“কেন?”

“বেশি শীত করছে না। একটু করছে.. সামান্য।”

“তো, নাও।”

“আপনার শরীর খারাপ করবে। তাপমাত্রা ১২° সেলসিয়াসের কম এখানে।”

উনি আরও কিছু বলতে চাচ্ছিলেন, তার আগেই আমি বলে উঠলাম, “প্লিজ, অযথা জেদ করবেন না। ভালো লাগছে এভাবেই। রাগ করতে চাচ্ছি না।”

অগত্যা উনি আর কথা এগোলেন না। চুপ করে আকাশের দিকে তাকালেন। আমি ওঁর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে একবার আমার নজরে যতটুকু আঁটে, দেখে নিলাম। ডান পাশটা, বাঁ পাশটা, সামনেটা, ঝিলের পানির মাঝে খোলা আকাশের উপরের ওই চাঁদটা… সবটা দেখে নিলাম। আবার কুঞ্জ ভাইয়ের দিকে তাকাতেই উনি সাঁই বেগে ঘাসে পিঠ ঠেকিয়ে শুয়ে পড়লেন। চোখ বুঁজেই বললেন, “জানো– আমি এখানে প্রায়ই আসি?”

অবাক হলাম। সেই সাথে ওঁর এই জায়গাটা খুঁজে পাবার রহস্যও ভেদ করলাম। মস্তিষ্কে বিচলিত হলো একটা কথাই, ‘দুনিয়াতে রহস্য বলে কিছু নেই। যা আমরা জানি না– তাই আমরা রহস্য নামে আখ্যায়িত করি। নতুবা সবেরই এক ব্যাখ্যা আছে।’

আমি মিহি কণ্ঠে বললাম, “জানতাম না।”

উনি বলা শুরু করলেন, “৬-৭ বছর আগে এসেছিলাম।”

“আপনার কলেজ লাইফে? তখন তো বেশ ভদ্র-সদ্র পড়াকু ছেলে ছিলেন। কোথাও তেমন যাওয়া-আসা ছিল না। কীভাবে কী? সাথে কে এসেছিল?”

“একাই এসেছিলাম।”

“মানে? কীভাবে?”

“কলেজ বাঙ্ক দিয়ে।”
আমার চোখ কোটর থেকে বের হওয়ার উপক্রম। শেষমেশ উনি কলেজ বাঙ্ক দিতেন– এটা জানা হলো আমার? উনি আমাকে চমকে যেতে দেখে হাসলেন। বললেন, “বাইক নিয়ে মানিকগঞ্জ যাচ্ছিলাম, একটা স্কুল ফ্রেন্ডকে পিক করতে। মাঝপথে বাইক থেমে যায়, আর স্টার্ট নিচ্ছিল না। আশেপাশে কোনো গ্যারেজও ছিল না। তাই সেই ফ্রেন্ডকে কল দিয়ে প্রবলেমটা শেয়ার করলাম। ও এখান থেকে কিছুটা দূরেই থাকে। মেকানিক নিয়ে ঘন্টা খানেকের মাঝেই আসবে, ওয়েট করতে বলল। আমি ওয়েট করতে করতে হাঁটতে লাগলাম। তখনই এই ঝিলটা দেখেছি। প্রচুর ভালো লেগে যায়। এরপর মাঝেসাঝেই আসা হয়। তখন অবশ্য এত গোছালো ছিল না। এটা এরকমই সতেজ ও সুন্দর যাতে থাকে– সেজন্য পরিচর্যার লোকও রেখেছি। এখানে শরৎকালে এলে বেশি শান্তি লাগে। কাশফুল ফোঁটে ওদিকটায়।”

হাত দিয়ে দেখালেন উনি। তারপর আমার দিকে চাইলেন। আমি ওঁর দিকেই তাকিয়ে আছি। মুচকি হেসে বললেন, “আচ্ছা, তোমার কাছে জীবন মানে কী?”

“বেঁচে থাকার ইচ্ছে।”

“ইচ্ছে ফুরিয়ে গেলেই কি মানুষ মারা যায়?”

“আত্মার মরণ তো তখনই হয়।”

“তবে শারীরিক ভাবে বেঁচে থাকে কেন? পুরোপুরি বিলীন হলেই তো পারে!”

“জানেন? প্রতিটি মানুষের বেঁচে থাকার একটা উদ্দেশ্য থাকে। আপনি হয়তো কোনো একসময় ভাববেন– এই জীবনে আর পাবার কিছুই নেই, সব শেষ। কিন্তু না। সব শেষ হলে, কখনই আপনি বেঁচে থাকতেন না। আপনি জানবেনও না– জীবনের শেষ মুহূর্তে এসেও কীভাবে, কার উপকারে আসছেন। এমনকি মৃত্যুর পরও আপনার দেহটা অন্যের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হবে। উম.. পোকামাকড়ের খাদ্যরূপে, মাটির উর্বতার জন্য সার রূপে!”

“ভালোই কথা শেখা হয়েছে– দেখছি!”

“ও একটু-আধটু আগে থেকেই জানি। কেবল কারও কাছে বলার ইচ্ছেটা ঠিক হয়ে ওঠে না– বলেই কেউ জানে না।”

“তা আজ আমার কাছে কেন হলো?”

“হবে না? আপনার কাছে তো গোটা আমিটাকেই ভেঙেচূরে উপস্থাপন করেছি!”

কুঞ্জ ভাই স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। কিছুটা থমকে থাকা সময় যেতেই বললেন, “ভালোবাসা মানে কী বোঝো?”

আমার অকম্পিত জবাব, “আপনাকে বুঝি।”

উনি চুপ মেরে গেলেন। আমি সামান্য হেসে বললাম, “বলবেন কি?”

লম্বা একটা শ্বাস টেনে বললেন, “আমার চোখের ভাষা কী তোমার জানা নয়? সেই ছোট্টোটি থাকতেই তো শিখে নিয়েছিলে। তবে এখন কেন মুখ ফুটে সব বলতে হবে?”

“যাতে ভবিষ্যতে কোনোদিন অস্বীকার করতে না পারেন আমায়। কোনোদিন বলতে না পারেন– আমার আপনার উপর অধিকার নেই। অব্যক্ত কথার খেলাপ করার জন্য বাহানা না দিতে পারেন যে, আপনি কোনো অঙ্গিকার করেননি।”

“আমাকে বিশ্বাস করো না?”

“করি। সময়কে করি না, সিচুয়েশনকে করি না। একটা কথা জানেন কি? সময় আর পরিস্থিতি যে কোনো মানুষকে বদলে দিতে পারে।”

“অভিজ্ঞতা এত?”

“তা নয়তো কী? এই-যে, যেখানে আপনি আমার সাথে কথা না বলে থাকতেই পারতেন না, আমাকে না জ্বালালে যেন আপনার ঘুমই হতো না; সেখানে সেই আপনিই মাসের পর মাস যোগাযোগ রাখেননি।”

“ব্যস্ত ছিলাম।”

“সে-বাহানা আমায় দেওয়া লাগবে না। আপনি কতটুকু ব্যস্ত হলে কতটুকু সময় আমাকে দেন, তা আমার মুখস্ত।”

“ভুল বুঝছ তুমি।”

“না। তবে এক্সপ্লেনেশন চাচ্ছি। নয়তো আপনার কল আসতেই আপনার কাছে চলে আসতাম না। আপনার সাথে এই মাঝ রাতে এখানে আসতাম না। আমার রাগ সামলাতে পারবেন। কিন্তু অভিমান! সেটা এতটাও ঠুনকো নয়।”

“শুনেই ছাড়বে?”

“বলতে চাইলে, বলুন। নতুবা জোর করার অভ্যেস আমার নেই।”

“আমার উপর কার জোর খাটে– তাও কি বলা লাগবে?”

আমি চুপ রইলাম এবার। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। মানসপটে ভেসে উঠছে পুরোনো সব কান্ডগুলো। এই অসভ্য পাষাণটার প্রেমে কী করে পড়লাম, ভেবে পাচ্ছি না। তাকিয়ে দেখলাম, ওঁর চোখ আমার মাঝেই নিবদ্ধ। আমাকে তাকাতে দেখেই বললেন, “আরে! বলছি তো! মন খারাপ করো কেন? তোমায় বলব না তো কাকে বলব? তুমি হচ্ছ কী এ আমার, কী যেন! উফ! মনে পড়ছে না।”

“তা মনে পড়বে কেন?”

“আসলে বয়স হচ্ছে তো, মনভুলো হয়ে যাচ্ছি।”

এই মুহূর্তে আমার খুব হাসি পেল এবং আমি হেসেও দিলাম। আমার হাসির শব্দ বাতাসে বেজে আমারই কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। হাসি চাপিয়ে রাখার মতো ভয়ঙ্কর কষ্টসাধ্য কাজ দ্বিতীয়টি নেই। লোকটা নেহাতই পাগল!

“মে-বি হুমায়ূন আহমেদ স্যার ঠিকই বলেছেন। বেশিরভাগ রূপবতী মেয়ে নকল হাসি হাসে। হাসার সময় ঢং করার চেষ্টা করে। তখন, তাদের হাসি হায়েনার হাসির মতো হয়ে যায়।”

কথাটা কানে যেতেই আমার হাসি তৎক্ষনাৎ থেমে গেল। ডানে তাকিয়ে দেখলাম– উনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। আচ্ছা, উনি কী বললেন এটা?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here