এই_জোছনা_ধারায় #পর্ব-৪

0
8

#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-৪

অতি সুখের আশা এশা কোনোদিন করেনি। নিরুপায় মানুষের সমস্ত কিছু ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিতে হয়। এশাও তাই করেছে। তবে ফুয়াদের সঙ্গে প্রথম দিন দেখা হওয়ার পর ওর মনে যে রঙিন প্রজাপতি ডানা মেলেছিলো সেটি বিবর্ণ হয়ে গেছে। কষ্ট কেবল এইটুকুই।

এশা রাতে কিছুক্ষণ কেঁদে কেটে চোখ মুখ ফুলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। এত দুঃখ করতে ভালো লাগছে না। সকালে সূর্যের নরম আলো চোখে পড়তেই উঠে বসে। আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে ধাতস্থ হয়। ওর বিয়ে হয়েছে, শ্বশুর বাড়িতে এসেছে, বর ফুল সজ্জার রাতে লাপাত্তা হয়ে গেছে.. ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে এসব কিছু নতুন করে খেয়াল হলো।

–শুভ সকাল এশা।

কেউ হঠাৎ রুমে ঢুকে বলল। শুনতে মিষ্টি শোনালো। ফুয়াদ এসেছে। এশা তার দিকে তাকায়। তাকে দেখতে কিছুটা উদভ্রান্তের মত দেখাচ্ছে।

–এগুলো ফুলদানিতে রাখো তো। তাজা ফুলের ঘ্রাণ আমার খুব পছন্দের।

ফুয়াদ এশার হাতে অনেক গুলো তাজা ফুল ধরিয়ে দিলো। সে এগুলো বাইরে থেকে নিয়ে এসেছে। এশা কোনো প্রশ্ন না করে স্বাভাবিক ভাবেই সেগুলো ফুলদানিতে রাখতে লাগলো।

–আমি তোমাকে অনেক গুলো ফুলগাছের টব এনে দিবো। ব্যালকনিতে লাগাবে। বাতাসের সঙ্গে রুমে ঘ্রাণ আসবে।

এশা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে। এই মুহুর্তে ফুয়াদের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে ওদের দীর্ঘ দিনের সংসারে নিত্যনৈমিত্তিক আলাপ চলছে। এশা চূড়ান্ত বিস্মিত হলেও প্রকাশ করে না। এই লোক পাগল নয়, অত্যন্ত সুচতুর এবং বুদ্ধিমান। যা করছে নিশ্চয়ই সজ্ঞানেই করছে।

–আমি অনুমতি ছাড়াই তোমাকে তুমি বলে সম্বোধন করছি। বউকে তুমি বলতে কি অনুমতির প্রয়োজন হয়? আমার জানা নেই। এর আগে কখনো বিয়ে করিনি তো।

–না অনুমতির প্রয়োজন হয় না।

–রাতে আমি বাসায় ছিলাম না এ কথা কেউ জানে? কাউকে বলেছো?

ফুয়াদ গায়ের শার্টটা খুলতে খুলতে প্রশ্ন করলো। এশা বলল,

–না জানে না।

ফুয়াদের উন্মুক্ত সুগঠিত পুরুষালি শরীর। চওড়া কাঁধ, প্রশস্ত লোমশ বুক.. এশা এক নজর তাকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে নেয়। কেমন একটা অনুভূতি হয় ওর!

ফুয়াদ এসে এশার সামনে দাঁড়ালো। যন্ত্রণায় কপাল কুঁচকে বলল,

–আমার প্রচণ্ড মাথা ধরে আছে। চুল গুলো একটু টেনে দাও।

ফুয়াদের নিঃসংকোচ চাওয়া। সদ্য বিবাহিত বউকে রেখে সারা রাত বাইরে থাকা যেন সাধারণ ব্যাপার।

এশা ফুয়াদের মাথার চুল টেনে দিতে গিয়ে স্বল্প পরিচিত এক পুরুষের বেশ কাছাকাছি আবিষ্কার করলো নিজেকে। তার গায়ের ঘ্রাণ নাকে আসছে। এশার মনের সেই বিবর্ণ হওয়া প্রজাতিটা আবার রঙিন হতে চাইলো। ওর হৃৎস্পন্দন কিছুটা বাড়ে, বুকের কাছটায় ভীষণ সুন্দর এক অনুভূতি হয়।

এই সুন্দর অনুভূতির সাথে পাল্লা দিয়ে দুশ্চিন্তাও বাড়ে। কাল সারাদিন ফুয়াদ কোনো একটি কথাও বলেনি ওর সাথে? সারা রাত কেন ফিরলো না? এই জঘন্য নাটকীয় আচরণের প্রতিবাদ করার সাহস হয় না এশার! হয়ত নিজের পায়ের নিচের মাটি শক্ত নয় বলে।

–আপনি কাল সারা রাত ফিরলেন না কেন? কোথায় ছিলেন?

এশা আস্তে করে জিজ্ঞেস করল। ফুয়াদ বলল,

–এমনি। ভালো লাগছিলো না।

ও আর কিছু জিজ্ঞেস না করে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে।

দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ করছে কেউ। বেলা তেমন বেশি হয়নি। ফুয়াদ তীব্র বিরক্তিতে চোখ-মুখ ঘুচিয়ে ফেলল। এই ধরণের অসভ্য কাজকর্ম এই বাড়িতেই সম্ভব! বাড়ি নয় যেন নরক একটা!

এশা দরজা খুললো। মারুফা ওকে ডাকতে এসেছে। এশা তার পিছনে পিছনে গেল। পলি বেগম আয়েশ করে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। এশাকে দেখে বসতে আদেশ করলো।

–এই বাড়িতে এত বেলা করে ঘুমানোর নিয়ম নেই। সকালে উঠে নামাজ-কালাম আদায় করে রান্নার কাজে হাত লাগাবা। রান্নার জন্য আমাদের বাড়িতে কাজের মানুষ রাখিনা। কাজের মানুষের হাতের রান্না খেতে অপছন্দ করি।

এশা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো।

–নতুন এসেছো। বাড়ির সকল নিয়ম-কানুন মারুফা আর শম্পার কাছ থেকে জেনে নিবা। নিয়মের বাইরে কিছু আমি বরদাস্ত করি না।

এশা আবারও মাথা নাড়ালো। পলি বেগম চায়ের কাপে কয়েকটা চুমুক দিয়ে আবার শক্ত মুখে বলল,

–কালকে রাতে তুমি অর্পিকে ওর মায়ের কাছে দিয়ে গিয়েছো। ব্যাপারটা আমি মোটেও পছন্দ করিনি। এ বাড়িতে কীভাবে চলতে হয় চোখ-কান খোলা রেখে দেখে দেখে শেখার চেষ্টা করো।

এশা কোনো প্রত্যুত্তর না করে মাথা নুইয়ে রাখলো। পলি বেগম বললেন,

–যাও নাশতা তৈরি করো ওদের সাথে।

–জি আচ্ছা।

এশা ওখান থেকে উঠে এসে জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে। পলি বেগমকে ওর বাঘ-ভাল্লুক কিসিমের মনে হয়। যেকোন মুহুর্তে থাবা মারতে পারে এমন।

ফুয়াদের মেজো ভাবী শম্পা এশাকে রান্না ঘরের সমস্ত কিছু দেখিয়ে দিতে লাগলো। নাস্তায় কি কি পদ তৈরি করতে হবে তাও বলে দিলো। মারুফা ওকে জিজ্ঞেস করলো,

–পারবে তো সব ভালো ভাবে করতে?

–হ্যাঁ পারবো।

–ঠিক আছে। করো দেখি তাহলে।

এশা ভেবেছিল ওরা তিন জনে মিলে নাস্তা তৈরি করবে। কিন্তু মারুফা আর শম্পা কোনো কাজে হাতে লাগালো না। তারা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে গল্প করছে আর ওকে ফরমাশ দিচ্ছে। এশা ব্যাপারটা সহজেই ধরতে পারলো না। এ বাড়িতে শুধু পলি বেগম নয়, তার বড় দুই ছেলের বউও কর্তৃত্ব ফলাবে ওর উপর।
__

রাত হতেই এশার মাথায় চিন্তা আসে ফুয়াদ আজও কি বাসার বাইরে থাকবে? কাল সারা রাত কোথায় ছিলো সে? অন্য কোনো সম্পর্ক আছে তার?

ফুয়াদ রুমের ব্যালকনির রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার আঙুলের ফাঁকে সিগারেট। ঠোঁট দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে। একটানা কয়েকটা সিগারেট শেষ করে রুমে এসে এশাকে বলল,

–তোমার বিয়ের শাড়িটা ভালো হয়নি। তোমার জন্য সাদা একটা জামদানি এনেছি। আলমারিতে রাখা। ওটা পরো। তোমার তো সাদা রঙ পছন্দ। বাসী ফুল সজ্জা সেরে ফেলি আজ।

এশা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকায়। আলমারি খুলে সত্যি একটা জামদানি শাড়ি পেল। সাদা জমিনে সোনালী জরির কাজ। অসম্ভব সুন্দর দেখতে।

ফুয়াদের মনে চেয়েছে বলে আজ জামদানি এনে আহ্লাদ করছে। কাল মন পরিবর্তন হলে আবার নিশ্চয়ই কথা বলবে না। কোন মানুষটা আসলে সে? গতকালের নাকি আজকের? এশা শাড়িটি হাতে উন্মনা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

এরপর ও ভীষণ যত্ন করে শাড়িটি গায়ে জড়ালো। খুশিতে ওর মন পুলকিত হয় চঞ্চল ঝর্ণার মত। আবার ফুয়াদের মন পরিবর্তন হবে, আবার সে কিরকম আচরণ করবে—এই মুহুর্তে ওসব আর ভাবতে ইচ্ছে করলো না।

ও শাড়ি পরে ফুয়াদের সামনে এসে দাঁড়ালো। ফুয়াদ বলল,

–গহনা পরো। সাদা জামদানির সঙ্গে স্বর্ণের গহনায় তোমাকে শরৎ এর শুভ্র মেঘের মত দেখাবে।

–গহনা তো মায়ের কাছে।

ফুয়াদের মুখের অভিব্যক্তি পরিবর্তন হয়ে গেল।

–তোমার গহনা মায়ের কাছে কেন?

এ বাড়ির নিয়মকানুন কি ফুয়াদ জানে না? গয়নাগাটি সবকিছু পলি বেগমের তত্ত্বাবধানে থাকে। ওকে কেন জিজ্ঞেস করছে!

–তুমি কি তোমার গহনা সামলে রাখতে পারো না? নাকি এই রুমে রাখার জায়গা নেই? মায়ের কাছে কেন দিয়েছো?

–বড় ভাবী খুলে নিয়েছে।

–বড় ভাবী খুলে নিয়েছে মানে? তার সাহস হয় কীভাবে তোমার গা থেকে গহনা খুলে নেওয়ার!

ফুয়াদ রেগেমেগে আগুন হয়ে আবার বলল,

–এটা যে অপমান সেটা কি তুমি বুঝতে পারছো না? তোমার কি বোধ শক্তি কম নাকি তুমি বোবা?

–আমি তাদের কি বলবো..।

–মিনমিনে আচরণ করবে না। যাও গহনা নিয়ে আসো। আমি এই মুহূর্তে তোমাকে গহনা পরা দেখতে চাই।

পলি বেগমের কাছে যাবে ও গহনা চাইতে! জেনেশুনে বাঘের মুখে পড়বে? এটা ভাবতেই তো ওর হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।
(চলবে)

#ইসরাত_জাহান_তানজিলা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here