#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-৭
মিনারা বেগমের মাথায় কয়েকটা সেলাই লেগেছে। তার এখনো হুঁশ ফিরেনি। এশা তার পাশে বসে নিঃশব্দে কাঁদছে। এই কান্না কেবল মিনারা বেগম আহত হয়েছে সেই শোকে নয়।
ফুয়াদ অত সহজে ওর গায়ে হাত তুলতে পারলো? ওর প্রতি ফুয়াদের তেমন টান নেই, সে নিজের মর্জি মত যা খুশি করে। শুধু শরীরের টানে মাঝে মাঝে ওকে কাছে টেনে নেয়। এশা এগুলো মেনে নিয়েছে। মেনে না নিয়েও উপায় নেই! কিন্তু যত যা ই হোক! ফুয়াদ এই যুগের শিক্ষিত ছেলে। সে কীভাবে অকারণে বউয়ের গায়ে হাত তোলার মত বর্বর আচরণ করতে পারে!
শুধু গায়ে হাত তোলার দুঃখ তো নয়! সে দুই দিনের জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে একটা মেয়েকে নিয়ে বাইকে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে! পৃথিবীর কোনো স্ত্রী এই দৃশ্য সহ্য করতে পারে? কিন্তু ওর মত হতভাগ্য মানুষের এটাও সহ্য করতে হচ্ছে।
ওদিকে পলি বেগম তো আছেন ই! তার কথা ভাবলে এশার মন আরো বিষিয়ে যায়। এই মহিলা ছেলের বউদের সঙ্গে দাসী বান্দির মত আচরণ করেন। সবার উপরে কর্তৃত্ব ফলানোর ভয়াবহ রকমের অসুখ তার! এর চেয়ে নাদিম আর সূবর্ণার সংসারে ও ভালো ছিলো। আজ এশা তার মুখের উপর ওভাবে বেড়িয়ে এসেছে সেজন্য কি শাস্তি হবে ওর কে জানে! এমনও হতে পারে তিনি আর ওকে ওই বাড়িতে ঢুকতে দিলেন না। এরপর ও কোথায় যাবে?
–আরে এত কাঁদছিস কেন? কিছুক্ষণের মধ্যেই তোর মায়ের জ্ঞান আসবে।
মেজো মামা এশাকে কান্না থামাতে বললেন। কিন্তু ওর কান্না থামলো না। ও কী শুধু মিনারা বেগমের জন্য কাঁদছে?
মিনারা বেগমের জ্ঞান ফিরেছে। চোখ মেলে তিনি এশাকে দেখে মাথার আঘাতের কথা ভুলে গেলেন। বেড ছেড়ে উঠে ওকে জড়িয়ে ধরতে চাইলো। কিন্তু শক্তিতে কুলালো না।
এশা তার হাত ধরে বলল,
–তুমি চুপচাপ শুয়ে থাকো। আমি আছি এখানে।
এশার ম্লান দৃষ্টি, বিমর্ষ চেহারা! প্রায় অচেতন অবস্থায়ও মিনারা বেগমের মনে কু ডাক দেয়। ওই বড়লোক বাড়িতে বোধ হয় তার মেয়েটা ভালো নেই।
__
পলি বেগমের শেষ কবে এত মাথা গরম হয়েছে তার মনে নেই। এ বাড়িতে এর আগে কেউই তার কথা এভাবে অমান্য করার সাহস করেনি। তাই এমন আক্কেল-গুড়ুম আগে কখনোই হয়নি।
ফয়সাল আর রাহাত…পলি বেগমের বড় দুই ছেলে—বিরক্ত মুখে পলি বেগমের একটু তফাতেই বসে আছে। মারুফা আর শম্পা যার যার রুমে। এশার কাণ্ডে ওদেরও চোখ কপালে!
ফয়সাল গম্ভীর স্বরে পলি বেগমের উদ্দেশ্যে বলল,
–ফুয়াদের বউ কাল এসে আজই এমন কাণ্ড করছে! মারুফা আর শম্পা তো কখনো এমন করার সাহস করেনি।
রাহাত বিদ্রুপ করে বলল,
–এখন আপনার নিয়মকানুন কোথায় মা? এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে মারুফা আর শম্পাও নিজেদের খেয়াল খুশি মত চলতে শুরু করবে। তখন আমাদের বলতে আসবেন না।
ক্রোধে পলি বেগমের দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে। শুধু এশার কারণে তার ছেলেরা তাকে এধরণের কথা বলার সাহস করছে! ওই মেয়েটা তার বাড়ির শৃঙ্খলা নষ্ট করছে! এরকম হতে থাকলে বাড়ির বাকি সদস্যরাও তার কথার বাইরে চলার সাহস করবে। তার বাপের টাকার এই বাড়িতে তার কর্তৃত্বর বিনাশ হবে।
বাড়ির সকলে তার অনুমতি ছাড়া যার যেরকম খুশি চলছে—এই দৃশ্য কল্পনা করতেই পলি বেগমের মাথায় চক্কর দিলো। এটা তিনি কখনোই হতে দিবেন না।
ফয়সাল বলল,
–ফুয়াদ চার লাখ টাকার লোকসান করেছে সেটা নিয়ে কোনো টু শব্দ নেই। ফুয়াদের বউ যা খুশি তাই করছে। এরকম যদি আমরা করতাম বাড়িতে আগুন জ্বলতো। আপনি বরাবরই দুই চোখ করেছেন মা।
রাহাত বলল,
–চার লাখ টাকা লোকসান হয়েছে নাকি ও সরিয়েছে তা কে জানে! আবার দুই দিনের জন্য সে লাপাত্তা হয়েছে। ও যদি এভাবে নিজের মর্জি মত চলতে পারে আমরা কেন পারবো না?
পলি বেগম এই পর্যায়ে উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন,
–তোমরা আমার চোখের সামনে থেকে যাও। কাকে কি করতে হবে সেটা আমি বুঝবো। নিজেদের মর্জি মতো চলতে চাও তাই না? এই বিশাল সম্পত্তির এক কানা কড়ি ও পাবে না।
ফয়সাল আর রাহাত ওখান থেকে উঠে গেল।
পলি বেগম নিজের মাথায় বরফ দিলেন। ওই ইতর, তুচ্ছ মেয়েটার কারণে তার সংসারে অশান্তি হবে! সেটা তিনি কখনোই হতে দিবেন না। এশার জন্য এই বাড়ির দরজা বন্ধ। পলি বেগম দেখবেন ও কোথায় যায়!
__
ফুয়াদ এ্যানির সঙ্গে একটা কফিশপে বসে আছে। এ্যানি ওর কলেজের বন্ধু। থাকে দুবাই। তিন বছর পর দেশে এসেছে। খুব ভালো বন্ধুত্ব ওদের। এই মেয়েটা ওকে বোঝে! তাই ওর সাথে সময় কাটাতে ফুয়াদের ভালো লাগে। তবে ওদের ভিতর বন্ধুত্ব ছাড়া অন্য কোনো অনুভূতি নেই।
এ্যানি কফির মগে চুমুক দিতে দিতে ফুয়াদকে জিজ্ঞেস করল,
–তোর প্ল্যান কি এখন? ব্যবসায়ই থাকবি?
–ব্যবসা বাণিজ্য এসব আমাকে দিয়ে হবে না।
আমি কখনো এরকম সাধারণ জীবন কল্পনা করিনি। সুইডেনের স্কলারশিপটা হাত ছাড়া হয়েছে। এবার কানাডা বা ইউ কে যাওয়ার চেষ্টা করবো।
–তোর মা তো তোকে এক পয়সাও দিবে না। তাছাড়া যাওয়ার অনুমতিও দিবে না।
–না জানিয়ে গেলে তো অনুমতির দরকার হবে না। টাকা আমি গোছাচ্ছি।
–তোর বউকে বাড়ি রেখে যাবি?
এশার প্রসঙ্গ আসতেই ফুয়াদের মুখে বিরক্তি দেখা গেল।
–ও গোল্লায় যাক। সারাদিন বাংলা সিনেমার দুঃখী নায়িকাদের মত মুখ করে ঘুরে বেড়ায়। এ ধরণের মেয়ে আমি পছন্দ করি না।
–তোর ফ্যামিলির সঙ্গে তুই ই তো পারিস না। ও কী করবে?
–পারি না কে বলছে! আমি শুধু টাকার জন্য আটকে আছি।
–মেয়েটা দেখতে অসম্ভব সুন্দর। গরীব ঘরের মেয়ে তো তাই সাহস থাকলেও প্রতিবাদ করতে পারে না। বিদেশ যা, যা খুশি কর। কিন্তু ওর প্রতিও একটু মনোযোগ দে। মেয়েটা তো খারাপ না।
ফুয়াদ হতাশ গলায় বলল,
–চেষ্টা করছি মনোযোগ দেওয়ার কিন্তু পারছি না। ওকে একটা থাপ্পড় দিয়েছি। গিল্টি ফিল হচ্ছে এখন।
এ্যানি আশ্চর্য হয়ে বলল,
–ছিঃ! বউয়ের গায়ে হাত তুলিস তুই। তুই তো তাহলে তোর পরিবারের বাকিদের কাতারেই পড়লি।
ফুয়াদ অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলল,
–কি করবো! ক্যারিয়ার নিয়ে এত ফ্রাস্টেটেড আমি। মাথা কাজ করে না!
কফি শেষ। এর ভিতর এ্যানির ফোন বেজে উঠেছে। ওর মা ফোন করেছে। তার শরীরটা অসুস্থ। ওকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে। নয়ত ফুয়াদের সঙ্গে আরো কিছুক্ষণ থাকতো।
এ্যানি ব্যস্ত গলায় বলল,
–আমি উঠি তাহলে। তুই তো আজ বাসায় ফিরবি না।
–না। দুই দিন আমার ফ্ল্যাটে থাকবো।
–ওকে। দিনের বেলা তোর ফ্ল্যাটে সবাই মিলে আড্ডা দিতে যাবো একদিন।
এ্যানি চলে গেল। ফুয়াদ একা একা আরো কিছুক্ষণ বসে রইল।
__
রাতটা হাসপাতালে থাকার পর সকালে মিনারা বেগমকে হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে যাচ্ছে। তিনি এশাকে বলল,
–তুই আমার সঙ্গে ভাই জানের বাসায় চল।
এশা মায়ের সঙ্গে দুই একটা দিন থাকতে চাচ্ছে। কিন্তু কীভাবে থাকবে? মেজো মামা ওকে একবারও সাধলো না। উল্টা বলল,
–তুই চিন্তা করিস না। জামাইকে ফোন করে আসতে বল। তুই বাসায় চলে যা।
এরকম বলার পর কি কারো বাসায় যাওয়া সম্ভব! মেজো মামাও নিরুপায়। এশা শুনেছে মিনারা বেগমের ওখানে থাকা মামী বাড়তি ঝামেলা মনে করছেন। এখন যদি ও গিয়ে ঝামেলা আরেকটু বাড়ায় তাহলে আবার কী বলে ফেলেন— এই ভয়েই মামা ওকে সাধছে না।
ভাইয়ের সঙ্গে মিনারা বেগম বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। মেয়ের জন্য তার পরাণ পুড়ছে। তিনি বার বার চোখ মুছছেন। তার যে কেন এত দূর্ভাগ্য হলো!
এশা তাদের বলল,
–তোমাদের জামাই আমাকে একটু পর নিতে আসবে। তোমার যাও। আমি তার সঙ্গে যাবো।
তারা চলে গেল। এশা অসহায়ের মত হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে রইল। ফুয়াদের সাথে তো ওর কোনো যোগাযোগ নেই। ওদিকে পলি বেগমের অবাধ্য হয়ে বাসা থেকে বের হয়ে আসায় এখন বাসায় ফিরতেও ওর ভয় করছে। কি করবে এখন ও? কোথায় যাবে?
(চলবে)
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
(গল্প অনেক রাতে দেই বলে যারা রাতে পড়তে পারেন না। তারা সকালে পড়বেন। সহজ ব্যাপার। আমার বাপ-মা দুইজনেই অসুস্থ হওয়ায় সারাদিন তাদের দেখাশোনা করে রাত ছাড়া লেখার সময় হয় না।)