চিত্তসন্ধি পর্ব ১৮ লেখা: #Azyah

0
2

#চিত্তসন্ধি
পর্ব ১৮
লেখা: #Azyah

বাস নড়ছে। নিস্তব্ধ,স্থির পরিবেশ ছাড়া ঘুম হয় না তার।পাশেই বন্ধুমহলের হট্টগোল।এত চেচিয়ে কথা বলছে বাসের বাহিরে দুর দূরান্তের মানুষ শুনতে পাবে। চিল্লাফাল্লা করে ক্লান্ত হলো অবশেষে।হলুদ আবছা লাইটে বাসের সিটে যে যার মতো হেলে পড়েছে।মেহতাব একই ভঙ্গিতে। এতক্ষন যাবৎ জানালার দিকে মুখ করে বসেই ছিলো।বন্ধুদের আষাঢ়ে গল্প যোগদান করেনি।আনমনে বাহিরে চেয়ে।ভাবছে,কি ভাবছে নিজেও জানে না।নিজের কল্পনা জগতে দিব্যি ডুবে।

সবাইকে ঘুমোতে দেখে রনিকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো পেছনের সিটে। সিটটা খালি। পিচঢালা রাস্তা হওয়ায় ঝাকি খাওয়ার সুযোগ নেই।পেছনের সিটে পা তুলে শুয়ে পড়লো।ঘুম আসবে না।ফোন হাতে নিয়ে চোখ গেলো তার স্টোরির দিকে। বিরক্তির “চ” উচ্চারণ করে ভাবলো ডিলেট করে দিবে।ডিলেট করতে গিয়ে দেখলো আদরের রিয়েক্ট। ওয়াও রিয়েক্ট দিয়ে রেখেছে।আপনাআপনি মেহতাবের মুখে হাসি ফুটলো।অবশ্যই মেয়েটা জেগে আছে! হাজারবার বলা সত্বেও এই রাত জাগা অভ্যাসটা পরিবর্তন করা গেলো না।

“ঘুমান না কেনো আপনি?”

আদরের মন বলে উঠলো,”রাতে পর্যন্ত শান্তি দেয়না আমাকে। আবার চলে এসেছে যন্ত্রণা করতে”

“কিছু জিজ্ঞেস করেছে?”

“পড়ে ঘুমাবো”

“এখন ঘুমোতে হবে”

“আপনি বললেই হয়ে গেলো বুঝি। আপনি জেগে আছেন কেনো?কাউকে এডভাইস দেওয়ার আগে নিজে করতে হয় সেই কাজটা।”

“কথার ধরনে একটু নজর দেন নিজের।সাহস দেখলে অবাক হই আপনার?”

“ইউ নো হোয়াট?আপনি চান সবাই আপনাকে ভয় পাক।ভয় পেলেই আরো পেয়ে বসবেন।কিন্তু একটা সত্যি শুনেন আপনাকে আমি ভয় পাই না।যা করি সেটা বয়সে বড় মানুষকে সম্মান”

আদরের কথায় মেহতাবের রাগ হচ্ছে না।উল্টো ফোনের অন্যপাশে থেকে হাসছে।

“থ্যাংকস ফর ইউর ইনফরমেশন।এবার ঘুমোন”

“আমার ঘুম আসছে না”

“কেনো আসছে না?”

“আরেহ এমনেতেই আসছে না।”

“আচ্ছা আপনি ভাবেন আমি অনেক খারাপ,রাগী, মুডি তাইতো”

“এতে ভাবার কি আছে?”

“তাহলে একটু ভালো হওয়ার প্রেকটিস করতে হবে”

“সেটা কিভাবে?”

“জাস্ট কিপ ইউর মাউথ ক্লোজ অ্যান্ড লিসেন”

গীটারের আওয়াজ ভেসে আসছে কানে। তীব্র থেকে তীব্রতর হলো,

কতদূর যেতে চাও বলো
কতোটা সীমানা পেরিয়ে?
জানো কি (তুমি)… মনের কাছে
দূরত্ব কিছু নয়।

আমায় আর কতোটা বোঝাবে ?
জানি আজো কথা হেসেই ওড়াবে।
তবু কেন জানি অপারগ আমি,
পড়ে থাকি……।(তোমার মাঝে)

তুমি যে ব্যবধান বলো
আমার কাছে তা বড্ড ঠুনকো লাগে।
হয়তো অন্ধ বলতে পারো
আমি…. (তুমি) ছাড়া কিছু দেখছি না যে।
মনের চিলেকোঠায়…..(প্রেমের) ঝাঁক
মেঘের গায়ে চোখ বোনে বৃষ্টির আবাদ।
নেই আর কিছু বলা বাকি
এখন নগদে যা আসে চেপে রাখি।

পড়ে প্রশ্নরা ঝাঁক বেঁধে ঝুঁকে
উত্তরে বোবা।
আমি রোজ বলি… (তুমি) মুখ ফেরাও
মনে হয় এড়িয়ে যেতে চাও।
তবু কেন যে পারি না সরে যেতে
নামে না স্থবিরতা।

কেটে গেছে সব যেমন শীতের কুয়াশা
হারিয়ে গেছে চাদরে মোড়া দিন।
রাতের কালো দিনের চেয়েও প্রখর ভীষণ লাগে
এক একটা দিন বছর যেমন….।(তুমিহীন)

(অ্যাডভার্ব)

ঘুমের ঘোরে আদর কিছু একটা বলে ঘুমিয়ে পড়েছে। মেহতাব স্পস্ট শুনেছে তার কথাগুলো।

“আপনি গানের অনেকগুলো লাইন,অনেকগুলো শব্দ এড়িয়ে গেছেন ডাক্তার সাহেব”

কিছু শব্দ এড়িয়ে গেছে আদরের সামনে।অথচ সে ধরে ফেললো।অবশ্যই এই গানটা তার আগের থেকে শোনা।না অসস্তিবোধ করলো নাই ধরা পড়ে যাওয়ায় লজ্জাবোধ করলো। বাসের জানালা ভেদ করে শুভ্র চেহারায় চাঁদের আলো পড়ছে।ঠোঁটে লেগে থাকা সূক্ষ হাসির ছাপ মেহতাবের চেহারার সৌন্দর্য দ্বিগুণ করে তুলছে।

___

বুড়ো বয়সে ভীমরতি।সামনে ব্যাঙের মতন লাফালাফি করা বন্ধুদের দেখে এই প্রবাদের সত্যতা যাচাই হয়ে গেলো।তাদের এসব কাজে বাসের লোকটা বেশ রাগান্বিত।কখন সবাইকে একজোটে বাইরে ফেলে দেয় বলা মুশকিল।একেক জনের বয়স ঊনত্রিশ থেকে বত্রিশ এর মধ্যে।অথচ এদের কর্মকাণ্ড!রং মাখাচ্ছে একে অপরকে।আজ তারা যারযার বাড়ি ফিরছে।মেহতাবের দিকে এগোলে তার চোখ রাঙানি শিকার হয়।

তাই সামান্তা তার ছোট্ট মেয়েকে শিখিয়ে দেয়,

“আম্মু ঐযে আংকেলটা বসে আছে। ওনাকে গিয়ে এই রংটা লাগিয়ে দিয়ে এসো”

মেয়েটি বেশ পাকনা। প্রথমেই উঠে বসলো মেহতাবের কোলে।বাচ্চা মানুষ ভেবে খুব যত্ন করেই কোলে তুলে আদর করছে। বাচ্চাটির হাতের ছোট্ট একটা আঙ্গুল গিয়ে ঠেকেছে মেহতাবের ঘাড়ে।মেয়েটি খিলখিল করে বলে উঠলো,

“দেখো আংকেল আম্মু আমাকে কপালে কালো টিপ দেয়।আমি তোমার ঘাড়ে লাল টিপ লাগিয়ে দিয়েছি।”

তৎক্ষনাৎ হাত গেছে ঘাড়ে।ঘষে রং তোলার চেষ্টায়। তুলতে গিয়ে আরো লেপ্টে গেলো। বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে বন্ধুদের রাগী দৃষ্টি ছুঁড়ে দিলে তারা হেসে উঠে।কেউ না পারুক বাচ্চাটি ঠিকই জব্দ করে ফেললো তাকে।

এদের কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়ে আদরকে মেসেজ করলো আধ ঘন্টায় রেডি থাকতে।বাড়ি যাবে না।বাস থেকে নেমেই ক্লিনিকে যাবে।বাধ্য মেয়ের মতন আদরও রেডি হয়ে গেলো দ্রুত।
ঠিক গুনে গুনে আধ ঘন্টা পর কল এসেছে। রিসিভ
করতেই মেহতাব বললো,

“আমি আপনার বাড়ির কাছ দিয়েই যাচ্ছি।বেরিয়ে আসুন”

বিশ মিনিট অপেক্ষা করিয়ে গাড়ি নিয়ে এসেছে।পেছনের সিটে বসতে গিয়ে আবারো ধমক খেয়েছে।আদর তার কথা বুঝে না।একবার সামনে বসায় আরেকবার পেছনে। এদিক থেকে ওদিক ফুটবলের মতন ছোড়াছুড়ি করে।সামনের দরজা খুলতেই দেখলো একটা পলি ব্যাগ রাখা।আদর দাড়িয়ে প্রশ্ন করলো,

“আমি বসবো কোথায়?”

“গাড়িতে এত জায়গা আপনার চোখে পড়ে না?”

“এই ব্যাগ?”

“ওহ এটা আমার ভেজা কাপড়” ব্যাগটি সরিয়ে পেছনের সিটে ছুঁড়ে বললো মেহতাব।

গাড়ি চলছে।আজ একটু দ্রুত গতিতেই চালাচ্ছেন। ক্লিনিকে যাওয়ার তাড়া তাই।গাড়িতে পিনপিনে নিস্তব্ধতা।যেটা আদরের একদম অপছন্দের।আশপাশ ঘাড় আঁকিয়ে বেঁকিয়ে দেখছে।হুট করে চোখ গেলো মেহতাবের ঘাড়ে জ্বলজ্বল করতে থাকা লাল দাগে।চোখদুটো রসগোল্লার ন্যায় হয়ে গেলো।মাথায় ভুলভাল চিন্তা ঘুরতে লাগলো।শুকনো ঢোক গিলে নিলো আদর।সে যা ভাবছে এটা কি তাই?ওহ গড!মানুষ দেখলে কি বলবে!এসব লুকিয়ে আসতে পারে না?ছেহ ছেহ!এই লোক আসলেই একটা ক্যারেকটারলেস।শুধু উপর উপর দিয়ে সাধু সাজে।

আদর নিজেই নিজের মনে খিচুড়ি পাকাচ্ছে।তাকে এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে মেহতাব সামনে তাকিয়েই বললো,

“কি সমস্যা?”

“কোনো সমস্যা না খুবই লজ্জাজনক একটা ব্যাপার!”

“মানে?”

“দেখেন আপনাকে এখন আমি একটা কথা বলতে যাচ্ছি।হয়তো আমার উপর অনেক রেগে যাবেন। লজ্জায়ও পড়তে পারেন।কিন্তু ইটস ইম্পর্ট্যান্ট।নাহয় মনে করেন আজকে আপনার মান ইজ্জত সব শেষ।আপনার সাথে থাকার দায়ে আমার গায়েও কলঙ্ক লাগতে পারে।তাই আগেভাগে বলে দিচ্ছি এসব লুকিয়ে নেন।আমি আবার স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড মেয়ে।কিছু বলতে মুখে বাজে না”

“আপনি সুযোগ পেলেই আপনার নন স্টপ রেডিও কেনো চালিয়ে দেন!হয়েছে কি সেটা বলেন”

“আপনার গলায়”

“কি হয়েছে আমার গলায়?”

“লিপস্টিকের দাগ লেগে আছে”

এবার শুধু কপাল না পুরো মুখ কুচকে মেহতাব উচ্চস্বরে বললো,

“হোয়াট!!”

বলে সঙ্গেসঙ্গে একহাতে স্ট্যারিং চেপে অন্য হাতে ঘাড় ঘষছে।এমনভাবে তার ঘষাঘষির কার্যক্রম চলছে যে চামড়াই তুলে ফেলবে। ফ্রন্ট মিররে নিজেকে অনবরত দেখেই যাচ্ছে।পড়ে মনে হলো রঙের কথা। সামান্তার মেয়ে তার ঘাড়ে এসে রং লাগিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।

“স্যার এত ঘষামাজার পরও উঠছে না।এরমানে এটা অন্য…”

আদরের কথার মানে বুঝতে পেরে শক্ত ব্রেক চেপেছে মেহতাব।এই মেয়ের মাথায় এসব আসে কথা থেকে। বিস্ময়ের সাথে আদরের দিকে তাকাতে যাবে তার সেই ধাক্কা সামলাতে না পেরে সামনে ঝুঁকে মাথায় ব্যথা পেল। মেহতাব বিচলিত হাতে আদরের কপালে হাত দিয়ে মালিশ করতে করতে বলল,

“সরি সরি আমি ইচ্ছে করে ব্যথা দেইনি।কই লেগেছে দেখি?”

আদর সরে গিয়ে বললো,

“আপনি নিজের কথা ভাবেন।এসব দেখলে বাকি ডাক্টাররা কি বলবে”

“এটা লিপস্টিক বা অন্য কোনোকিছুর দাগ না ইডিয়ট”

ধমক খেয়ে আবার জানালার দিকে মুখ করে নিলো আদর। জাতীয় কাজ ইতিমধ্যে শুরু করেছে।বিড়বিড় করা।বলছে,

“নিজে ফালতু কাজ করবে আর আমাকে ধমকাবে!মানুষের ভালো করতে নেই। ক্যারেকটারেই ঝামেলা আছে !”

“আমাকে বলছেন এই কথাগুলো?”

“নাতো”

“তাহলে কার ক্যারেকটারে সমস্যা মিস আদর?”

কোনো উপায় না পেয়ে বলে উঠলো,

“আমার।”

“এটা রঙের দাগ। আপনি যেহেতু ট্যাগ দিয়েছেন আমার ক্যারেকটারে সমস্যা।সাবধানে আর একশো হাত দূরে থাকবেন!নিজের মুখকে সামলে রাখবেন।যদি দেখেছি নন স্টপ রেডিও আবার চালিয়েছেন!”

ঠান্ডা হুমকিতে দমে গেছে আদর।পণ নিলো মনে মনে একদম মেপে মেপে কথা বলবে।এমনেতে সে বেশি কথা বলে না।কি যে হয় মাঝেমধ্যে।মুখ চললে আর থামতেই চায় না।

___

একটার পর একটা পেশেন্ট আসছে।আজকে রাশ বেশি।আদর কখনো দাড়িয়ে কখনো বসে। হরেক রকমের মানুষ হরেক রকমের সমস্যা আর হরেক রকমের তাদের আচার আচরণ।অনেকে খুব সাবলীলতার সাথে কথা বলে আবার অনেকের কথার ছিরী খুবই বাজে।এরা ডাক্তার মানে না।কথা শুনলে মনে হয় ডাক্টার তাদের রোগ নিবারনে ব্যর্থ হলে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত।এসব দেখে আদরের রাগ হলেও মেহতাব খুব ভালো করে হ্যান্ডেল করছে।একজন ডাক্তারের মুখের এক্সপ্রেশন নাকি অনেক ম্যাটার করে।

সব পেশেন্টের মধ্যে এক জোড়াকে কেবিনে ঢুকতে দেখে আদর থমকে দাড়ালো।সেই চেনা পরিচিত মুখ!বছর চারেক আগের কিছু স্মৃতি মস্তিষ্কের নিউরনে নাড়াচাড়া দিয়ে উঠলো।সামনে যে ব্যক্তিটিকে এক সময় খুব করে চাইতো আদর।পছন্দ করতো।কিন্তু সেটা ছিলো একপাক্ষিক।নিজের অনুভূতি প্রকাশের আগেই সে হয় অন্য কারো। সহসটুকু ছিলো না যে তার।বড্ড সময় নিয়ে ফেলেছিল।আদর এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে।পাশে বসা নারীটি অবশ্যই তার স্ত্রী।মেহতাব আদরকে ডাকছে।কিন্তু সেখানে কোনো হেলদোল নেই।হারিয়ে আছে পুরনো জগতে আদর।

হুট করে আদর বললো,

“আমি কি অল্পসময়ের জন্য বাহিরে যেতে পারি?”

“এখন পেশেন্ট আছে পড়ে যান”

“প্লিজ স্যার!”

আদরের ব্যাকুলতা ভরা কন্ঠ মেহতাবকে ভাবাচ্ছে।তার চোখ সামনে বসা পেশেন্টের দিকে। লোকটিও তার দিকে চেয়ে আছে।তাদের চাহনি দেখেই লাগছে এটা পূর্ব পরিচিত। মেহতাব এর জবাবের অপেক্ষা না করে ছুটে চলে গেলো আদর।পুরো ক্লিনিকে হাঁটছে। কোথাও একটু শান্তিতে বসে নিজের মনকে সামলে নেওয়ার জায়গা নেই।সবখানে মানুষ গিজগিজ করছে।হাটতে হাটতে চোখ গেলো সামনের সিড়িঘরে।সাদা কাচের দরজায় ভেড়ানো।না ভেবে হেঁটে চলে গেলো সেখানে।বসে পড়লো পাচতম সিড়িতে।মাথা হাঁটুর উপর ভর করে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here