#চিত্তসন্ধি
পর্ব ২১
লেখা: #Azyah
ভোর ছয়টায় মায়ের গগন কাপানো চিৎকার।ধড়ফড়িয়ে উঠেছে আদর।হুট করে উঠেছে।মস্তিষ্ক সচল নয়।কানে শুধু ভাসছে মায়ের চিৎকার।এখনই উঠতে হবে।একলাফে বুকে হাত রেখে ঘরের দিকে এগিয়েছে।বাবা পড়ে আছে বিছানায়।মা তাকে ধাক্কা দিয়ে বারবার বলছে
“উঠো,কি হলো তোমার”
বাবার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।কোনো নড়াচড়া করছে না। পৃথিবী এখানেই থমকে গেছে আদরের।পা বাড়ানোর সাহস পাচ্ছে না।মাথায় আজেবাজে চিন্তা ভর করতে শুরু করেছে।মা কাদতে কাদতে বললো,
“আদর দেখ না তোর বাবার কি হলো।হুট করে পরে গেলো।কথা বলছে না।দেখ না কি হলো!”
বাবার কাছে গিয়ে বারবার ডাকছে আদর তার কোনো হেলদোল নেই।বুকে মাথা ঠেকিয়ে দেখলো। নিঃশ্বাস চলছে।কি করবে এখন?ঘরে কোনো পুরুষ মানুষ নেই।এত সকালে কিভাবে ডাক্তারের কাছে নিবে?মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।
মা আবার ডেকে বললেন,
“আদর কিছু কর না!”
মাও অসহায়।মেয়ের কাছে সাহায্য চাইছেন।
দ্রুত রুমে গিয়ে ফোন হাতে নিয়েছে।কল লিস্টের সর্বপ্রথম নাম্বারে ডায়াল করলো।হাত কাপছে।বুকের মধ্যে একরাশ ভয়।
ভোর ছয়টায় আদরের ফোন মেহতাবও ঘাবড়ে উঠলো।দ্রুত রিসিভ করে বললো,
“হ্যালো!”
“স্যার!” বলে কেদে ফেললো আদর।
আদরের কান্না শুনতে পেয়ে বুকে চাপ দিয়ে উঠেছে। বিচলিত কণ্ঠে সুধালো,
“আদর কি হয়েছে?”
“স্যার আমার বাবার কি জেনো হয়েছে স্যার।আমার বাবাকে প্লিজ বাঁচান।তার ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন!”
কথা গলায় আটকে যাচ্ছে তার।তারপরও বলছে। হেছকি তুলছে।
“শুনো শান্ত হও।আমি আসছি।একদম কাদবে না”
টিশার্ট আর ট্রাউজার পরেই বেরিয়েছে মেহতাব।গাড়ীর গতি দ্রুত করে আলী কদম রোডে পৌঁছলো। ভাগ্যিস আদরকে নামিয়ে দেওয়ার পর বাড়িতে ঢুকার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতো।নাহয় বাড়ি খুঁজতেও সময় অপচয় হতো।কলিং বেল বাজাতেই এক দৌড়ে দরজা খুললো।মেহতাব যথাসম্ভব দ্রুত ভেতরে গেছে।দুয়েক মিনিট চেক করে যা বুঝলো মাইনোর হার্ট এ্যাটাক হয়েছে।কিন্তু এখানে জোহরা খাতুন আর আদর উপস্থিত।তারা জানলে ভেঙে পড়বে।তাই বললো না।
“কি হয়েছে আব্বুর?”
“আম! তেমন কিছুই না।কিন্তু হসপিটালে নিতে হবে।”
“হ্যা এখনই চলুন!”
আদর বাহিরে দাড়িয়ে পায়চারি করছে।নিজেকে শান্ত রাখা অন্তত এই মুহূর্তে সম্ভব না।না জানি বাবার কি অবস্থা ভেতরে।মেহতাব ভেতরেই আছে।যেমনটা আন্দাজ করেছিলো হয়েছেও তাই। ছোটখাটো হার্ট অ্যাটাকে এটা।ঝুঁকির কিছু না হলেও বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। ভবিষ্যতে বড় এ্যাটাক আসার সম্ভাবনা থেকে যায়। আপাদত স্বস্তির বিষয় তিনি ঠিক আছেন।
মেহতাবকে আসতে দেখে দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আব্বু কেমন আছে?”
মেহতাব আশ্বাস দিয়ে বললো, “ঠিক আছে।চিন্তার কারণ নেই”
“সত্যি বলছেনতো?”
“একদম সত্যি”
জোহরা খাতুনও ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছেন।সব কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন।মেহতাব বললো,
“ম্যাম স্যারের জন্য যে কেবিন বরাদ্দ করা হয়েছে আপনি সেখানে গিয়ে বিশ্রাম নিন।আর চিন্তা করবেন না বড় কিছুই না।একটু পরে শিফট করা হবে রুমে”
পাশের ওটিতে একটি বডি বের করে আনা হচ্ছে।আদর এমনেতেই ভীষণ ভয় পেয়ে আছে। স্ট্রেচারটা একদম আদরের পাশ ঘেঁষে যেতে নিলে মেহতাব আদরকে বাহু চেপে আড়াল করে নিলো।তার সামনে দেয়ালের মতন দাড়িয়ে গেলো।যেনো কোনোভাবে আচ না পায়।
আদরও মায়ের সাথে কেবিনে গিয়েছে।তাদের নাস্তা দিয়ে গেছে একজন স্টাফ। আধঘন্টার মধ্যে আশরাফ মাহমুদকে রুমে দেওয়া হলো।তিনি সজাগ আছেন।হেসে আশ্বাস দিলেন তিনি সুস্থ।তবে কথা বলছেন না।বাবাকে ঠিক দেখে দু ফোঁটা জ্বল গড়িয়ে পড়লো।
দেলাওয়ার হোসেন এসে আদরকে বললেন, “স্যার আপনাকে ডাকে”
আদর ঘরের কাপড়ে আছে।মায়ের কাছ থেকে বোরকার ওড়না গায়ে জড়িয়ে মেহতাবের কেবিনের দিকে এগিয়ে গেলো।মুখে বিষণ্ণতার চাপ নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে পড়লো সামনে।
মেহতাব বললো,
“বসেন”
“না।”
“দাড়িয়ে থাকবেন?”
“আপনি কিছু লুকাচ্ছেন?”
মেহতাব এসে আদরের মুখ বরাবর দাড়িয়ে বললো,
“শক্ত হন”
“হবো না!আমার আব্বুর কি হয়েছে সত্যি সত্যি বলেন”
“মাইনর হার্ট এ্যাটাক।সীমিত পরিসরে।ভয়ের কোনো কারণ নেই।যত্ন নিতে হবে।মেডিসিন ঠিকঠাক দিতে হবে।”
হার্ট অ্যাটাকের কথা শুনে আদর নিজেকে সামলাতে পারেনি।হার্ট এ্যাটাক মানে হার্ট এ্যাটাক।সেটা হোক সীমিত পরিসরে।পড়ে যেতে নিলে মেহতাব ধরে ফেলে।কেদে নাজেহাল অবস্থা।
আদর মেহতাবের টিশার্ট আকড়ে ধরে জোরেজোরে বলতে লাগলো,
“আমার আব্বুর কিছু হবে নাতো?সত্যি করে বলেন!আপনি ঠিক করে দেন তাকে।আপনি না ডাক্তার।আপনি পারবেন আমি জানি”
সময় ব্যয় করেনি এক মুহূর্ত।আদরকে সেদিনের মতন পূনরায় বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়েছে।শক্ত করে।তার আর্তনাদে বুকের ভেতরে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।হাতুড়ি পেটা করছে যেনো কেউ।মাথার পেছনে হাত রেখে বলল,
“কিছু হবে না।আমি আছি না?”
আদরকে মেহতাব এর টিশার্ট আকড়ে ধরে কেঁদেই চলেছে।মন কোনোভাবে মানতে রাজি না তার বাবা হার্ট এ্যাটাক করেছে।বাবা ছাড়া জীবনের এক মুহূর্ত কল্পনা করা অসম্ভব।ছোটোবেলা থেকেই বাবার অদূরে মেয়ে সে। নিঃস্বার্থভাবে জীবনের প্রত্যেকটা সেকেন্ড দিয়েছেন পরিবারকে আশরাফ মাহমুদ।আজ তারই এই অবস্থা!
“কান্না থামাও!”
“আব্বুকে ঠিক করে দেন পুরোপুরি”
“দেখি তাকাও আমার দিকে!”
বুক থেকে আদরের মাথা তুলে নিলো মেহতাব।নিজের মুখোমুখি এনেছে।দুই গালে নিজের দুইহাত চেপে বৃদ্ধাঙ্গুলের সাহায্যে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
“এত দুর্বল হলে চলবে আদর?”
“আমি কিছু জানি না!”
“তুমিতো আমাকেও ভয় পাও না।মুখে মুখে তর্ক করো।সামান্য একটা হার্ট এ্যাটাককে ভয় পাচ্ছো?”
“আপনিও খারাপ!হার্ট এ্যাটাকও খারাপ!”
মেহতাব স্মিথ হাসলো।হাত ঠেকেছে কোমরে।আদর দূরে সরে যেতে চাইলে টেনে কাছে টেনে আনলো।নিজের সাথে জাপ্টে কপালে কপাল ঠেকিয়ে মাতাল কণ্ঠে বললো,
“আমি খারাপই ভালো”
আদরের দুইহাত আবদ্ধ করে নিলো নিজের আঙ্গুলের ভাজে।আদর লজ্জা পাচ্ছে।বাধন থেকে ছাড়া পাওয়ার ইচ্ছে।কিন্তু মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের হচ্ছে না।আদরের ছটফট দেখে একহাত ছেড়ে পূনরায় কোমড় টেনে ধরেছে।যেনো কোনো ধরনের নড়াচড়া করতে না পারে।
মৃদু ধমকের সুরে বলে উঠলো,
“চুপচাপ দাড়িয়ে থাকো।আমাকে বিরক্ত করলে ভালো হবে না”
তারা একে অপরের চাহনীতে মুগ্ধ। মেহতাবের প্রশস্ত বুকে হাত রেখে তার ঘনঘন শ্বাস নেওয়াকে অনুভব করছে।জড়িয়ে যাচ্ছে তার শীতল চোখের গভীর অতলে।এক সেকেন্ডের জন্যও পলক ফেলছে না মেহতাব।গরম নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে আদরের মুখে।সে এখন শক্তপোক্ত হাতের বাঁধনে আটকা।খুব কাছে থেকে অনুভব করছে মেহতাবকে। সাথে তার হৃদস্পন্দন।এতটা মাদকতা কোথা থেকে আসলো তার চক্ষুদ্বয়ে?হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। হ্যালুসিনেট করছে।সময়টা যেনো এখানে থেমে যায়।এই অদ্ভূত ইচ্ছেটা কেনো জাগছে মনে?
____
“আপনি একদম টেনশন করবেন না।ঠিক আছে সব। কয়েকদিন একটু কেয়ার করুন স্যারের ঠিক হয়ে যাবে”
জোহরা খাতুন মেহতাবের হাত ধরে কৃতজ্ঞতার সুরে বলল,
“তোমাকে অনেক ধন্যবাদ বাবা”
বাবা কথাটা হৃদয়ে গিয়ে গেথেছে।কতকাল এভাবে কেউ ডাকে না!মা থাকলে নিশ্চয়ই দিকে হাজারবার বাবা বলে ডাকতো?
“এটা আমার ডিউটি”
“তারপরও তুমি এতো সকালে নিজের কথা না ভেবে আমাদের বাড়ি এসেছো।আদরের বাবাকে হসপিটালে আনলে।সব কিছু করলে।তোমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শেষ হবে না।আজ তুমি না আসলে কি হতো?”
“কিছু হতো না।ভয় পাবেন না প্লিজ”
আশরাফ মাহমুদকে সেলাইন দিয়ে চলে গেলো মেহতাব।যাওয়ার আগে আদরকে এক নজর দেখে গেছে।নাইট ডিউটি করবে আজ। আশরাফ সাহেবকে একা ছাড়া যাবে না নাই আদরকে।সে সবচেয়ে বড় পেশেন্ট।
দিনের অবসান ঘটে রাত্রি তার রাজত্ব বিস্তার করলো। নীল আকাশ অন্ধকারে তলিয়ে গেছে। চাঁদ আর তারারা আকাশে নিজেদের মতন স্থান দখল করে।সাদা পর্দার আড়ালে কাচ দিয়ে আবৃত এই রুমটি।চারতলা থেকে বাহিরের চলমান যানবাহন।জমিনে কৃত্রিম আর আসমানে প্রাকৃতিক আলোর ছড়াছড়ি।আদর দাড়িয়ে আছে।চোখ সেই কৃত্রিম আলো থেকে হটিয়ে প্রাকৃতিক চাঁদের আলোতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। হাজারটা প্রশ্ন মনে।উত্তর নেই।আকাশের দিকে চেয়ে মেহতাবের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
“আজ আপনার চোখে যা দেখলাম? সত্যিই কি তাই?”
চলবে….
[ভার্সিটির কিছু কাজে বিজি শিডিউল যাচ্ছে।তাই গল্পের পর্বগুলো ছোট হচ্ছে]