চিত্তসন্ধি পর্ব ৩৮ লেখা: #Azyah

0
15

#চিত্তসন্ধি
পর্ব ৩৮
লেখা: #Azyah

দেশে ডেঙ্গুর প্রভাব বেড়েছে।বিশেষ করে ঢাকা শহরে।এবার অন্যান্য জায়গার তুলনায় ঢাকায় প্রকোপ বেশি। রোগীর সংখ্যা অনেক।সরকারি, বেসরকারি সকল হসপিটালগুলো হিমশিম খাচ্ছে রোগী সামলাতে।গ্রামে ঠিকঠাক মতন চিকিৎসা না পেয়ে অনেকে পারি জমাচ্ছে শহরে। সু- চিকিৎসার জন্য। স্বল্প বয়সী থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ অনেকেই আক্রান্ত।হয়রান, পেরেশান ডাক্টার নামক প্রাণীরা।দিনরাত এক করে ফেলেছে।কিভাবে দিনের পর দিন না ঘুমিয়ে কাটছে সেখানে খেয়াল নেই। শুধুই কি ডেঙ্গু। মানুষ ভুগছে আরো অনেক রোগে।

তিনদিন যাবৎ নাইট ডিউটিতে মেহতাব।আদর আসে কাজে।কিন্তু তাকে দেখার সুযোগ অব্দি হয়নি।কাজের চাপে দেখার ইচ্ছেটুকুকে মাটিচাপা নিয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করছে।মিশা খাবার নিয়ে আসে রায়হান আর মেহতাবের জন্য।আজও এসেছে। ক্যাবিনে ঢুকে আদরকে দেখে বিশাল এক হাসি দিল।আদর তাকে দেখে নিচ্ছে।প্রথমে চিনতে পারেনি।মনে হচ্ছিলো আগেও কোথাও দেখেছে তাকে। মস্তিষ্কে জোর দিলে মনে পড়লো সেই রেস্টুরেন্ট এর মেয়েটা। মানে মেহতাবের বোন। অবাক মুখের ভঙ্গি পাল্টে হাসি টানলো ঠোঁটে।

মিশা এসে বললো, “আসসালামু আলাইকুম আপু”

“ওয়ালাইকুম আসসালাম।”

“কেমন আছেন?”

“আমি ভালো আছি।আপনি?”

মিশা খাবারের ব্যাগ টেবিলে রাখতে রাখতে বললো, “আমিও ভীষণ ভালো আছি”

মিশা আদরের সামনে চেয়ার টেনে বসেছে।আদরকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,

“আরেহ বসুন দাড়িয়ে আছেন কেনো?”

আদর বিনয়ী হাসি দিয়ে বসে পড়লো।মিশা হুট করে প্রশ্ন করে বসে,

“আপনার নাম আদর না?”

“জ্বি।আপনি কিভাবে জানেন?”

“ওমা আমি জানবো না?রায়হান বলেছে আমাকে আপনার কথা”

“রায়হান স্যার?” বিস্মিত সুরে আদর শুধালো।

“হ্যা রায়হান। মানে আমার…কাজিন আরকি।”

“ওহ আচ্ছা”

“আমাকে চেনেন আপনি?”

“উম!আপনি স্যারের বোন হন তাই না?”

মিশা দুষ্টুমির স্বরে বলল, “কোন স্যারের হুম?”

“মানে আপনার ভাইয়ার কথা বলছি”

“আচ্ছা আচ্ছা বুঝেছি।আপনি খেয়েছেন আপু?”

“না আমি পড়ে খাবো।আপনা…. মানে আমি একটু পর খাবো”

আদর বলতেই বসেছিল আপনার ভাই আসলে খাবো।কিন্তু কথাটি কেমন দেখাবে?তাই মুখ পর্যন্ত এনেও গিলে ফেললো বাক্যটি।

“আমি কিন্তু আপনার জন্যেও খাবার এনেছি। চারজন একসাথে বসে খাবো।”

মিশার আবদার ফেললো না আদর।সম্মতি জানিয়েছেন সে তার জন্য আনা খাবার খাবে।নতুন বউয়ের মতন মাথা ঝুকে আছে।যেনো লজ্জা পাচ্ছে।আসলে কি বলবে নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না।মনে প্রশ্ন।খুব ইচ্ছে হচ্ছে জিজ্ঞেস করতে।কেনো রায়হান তার ব্যাপারে মিশাকে বললো?আদরের সম্পর্কে তাদের মধ্যে কথা বলার কোনো যুক্তি দাড়ায় না।আদরের দ্বিধাবোধ তাকে আটকে দিলো।

মিশা আদরের সাথে নানান গল্প করছে।একদিক ওদিকের কথা।ঠিক তখনই মেহতাব আর রায়হান ক্যাবিনে এসেছে। মিশা আগেই তাদের জানিয়ে দিয়েছিল সে খাবার নিয়ে আসবে। প্রথমে লক্ষ না করলেই মিশাকে আদরের সামনে বসে হেসে কথা বলতে দেখলো পরক্ষনেই।এতখন দুজন আলাপ করছিলো।মেহতাব আর রায়হানকে আসতে দেখে তাদের দিকে তাকালো।মিশা উঠে বললো,

“দ্রুত হাত,মুখ ধুয়ে নাও।আমি খাবার দিচ্ছি”

মেহতাব আদরকে এড়িয়ে ফ্রেশ হতে গেছে।রায়হানও ঠিক নাই।ততক্ষনে মিশা টেবিলে প্লেট সেট করছে।আদর হেল্প করতে চাইলে তাকে কোনোভাবে কিছু করতে দেয়নি।রায়হান,আর মেহতাবকে খাবার বেড়ে দিয়ে বললো,

“আপু আসেন?”

“আপনারা খেয়ে নিন না?আমি নাহয় পরেই”

থমথমে কণ্ঠে মেহতাব বলে উঠলো, “পড়ে খাওয়ার সুযোগ নেই।বসে পড়ুন”

খাওয়া দাওয়ার পর্ব চলছে।মিশা বললো আজ নাকি সব সেই রান্না করেছে।বেশ স্বাদের।খাওয়ার মাঝে মেহতাবের দিকে দৃষ্টি দিচ্ছে আদর বারবার।এমন দেখাচ্ছে কেনো তাকে? চেহারার ভাব বলছে কোনো কারণে রাগ। প্যাঁচার মতন মুখ। এমনিতেও খাবারের সময় চুপ থাকে।তবে আজ আরো একটু ভিন্ন রূপ।খাওয়ার মাঝে মাথা নত থাকলেও আদরের এই বারবার তাকানো মেহতাবের দৃষ্টির আড়াল হয়নি।তার মনেও জিজ্ঞাসা?হয়তো কিছু বলতে চাচ্ছে বোকা মেয়েটি।
মিশা বেশিক্ষণ থাকে নি।ভাইকে খাইয়ে চলে গেছে। মেহতাবের হাতেও বেশি সময় নেই। দশ মিনিটের মধ্যেই বের হবে আবার রাউন্ডে।সেখান থেকে ফিরে এসে রোগী দেখতে হবে।রায়হান মিশাকে এগিয়ে দিয়ে নিজের ক্যাবিনে চলে গেছে।আদরকে কাজ বুঝিয়ে দিয়েছে।যেনো তার অনুপস্থিতিতে কোনো কাজ আটকে না থাকে।

মেহতাব এর চেহারায় বারবার চোখ বুলিয়ে আদর বললো,

“চা খাবেন?দিবো?”

“দাও!তোমার ইচ্ছে”

চা বানাতে গিয়ে আবার ফিরে এলো।সামান্য উকি দিয়ে দেখলো মেহতাব কি করছে।আজ আসলেই অনেকটা ভিন্ন দেখাচ্ছে।আদরের মনে পরে না সে কোনো ভুল করেছে।তাহলে?মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো। নাহ! কি হয়েছে সেটা জিজ্ঞেস করতেই হবে।চায়ের কাপ সামনে রেখে সামনে বসেছে আদর।সিদ্ধান্ত নিলেও প্রশ্ন করতে কাতরাচ্ছে। মেহতাব আদরের দিকে না তাকিয়েই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,

“এমন করছো কেনো?কি জানতে চাও বলে ফেলো”

“এই প্রশ্নটা আমার করার কথা।আপনি এমন করছেন কেনো?রেগে আছেন?”

মেহতাব ভ্রু কুঁচকে সামান্য হেসে প্রশ্ন করলো, “রাগ করবো কেনো?”

“তাহলে মুখ এমন গোমড়া করে আছেন যে?”

“সেটা নতুন কি?তুমিতো মনে মনে আমাকে গোমড়া মুখো বলে ডাকো”

“হয়েছেটা কি আপনার?আজ অন্যান্য দিনের চেয়ে ভিন্ন মেজাজ।আমি কিন্তু বুঝতে পারছি”

“একটা মানুষ তিনদিন যাবৎ ঘরের মুখ দেখে না।বসা ছাড়া আর কোনো সুযোগ পাচ্ছে না।রাত জাগতে হচ্ছে।নন স্টপ।এত এত মানুষ অসুস্থ।এমন কি তিন চার মাস বয়সী বাচ্চাগুলোও।মেজাজ খারাপ থাকা স্বাভাবিক না?”

এই প্রথম মেহতাব কোনো প্রশ্নের উত্তর দিলো।স্পষ্ট না ঘুরিয়ে পেচিয়ে।তারপরও বোঝার মতন।তিনদিন না ঘুমিয়ে মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে।উত্তরে খুশি আদর।আবার অন্যদিকে পীড়িত।খুব কষ্ট হচ্ছে তার।মানুষগুলোর জন্যও খারাপ লাগছে।

আদর মলিন কণ্ঠে বলল,

“একটু রেস্ট নেন।ঠিক হয়ে যাবে”

“হবে না”

“আগেওতো তিন চারদিনের মতন থেকেছেন রাতে ডিউটিতে।”

“কবের কথা বলছো?”

“ঐযে ডিউটি করে অসুস্থ হয়ে পড়লেন যে?আপনাকে সেলাইন দিতে হলো”

মেহতাব অল্পসময়ের বিরতি নিলো।সেদিনের একটা স্মৃতিচারণ করেও নিয়েছে ইতিমধ্যে।আদরকে প্রথম নিজের কাছে টেনে নেওয়া।আর এই নির্বোধ মেয়েটি ভাবছে ডিউটি করে সে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।এখনও বোঝার বুদ্ধিটুকু হয়নি।নিজেই সারাক্ষণ দ্বিধায় থাকে।এই বোকা মেয়ে নাকি মেহতাবের কাছে স্বীকারোক্তি চায়।তাকে অনুভব করে।অনুভব করা কাকে বলে সেটা কি জানে?আসল অনুভব করলে এতদিনে হয়তো বুঝে যেত সেদিন মেহতাব কেনো অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।

“সেদিন আমি কেনো অসুস্থ হয়েছিলাম জানো?”

“নাহ.. মানে হ্যাঁ তিনদিন ডিউটি করেছেন।বাড়ি ফেরেননি।খাবার খাননি ঠিক মতন তাই। দেলাওয়ার চাচাতো তাইলে বলেছিলেন আমাকে”

“নাহ”

“তাহলে?”

“সেটা বোঝার মতন বুঝদার তুমি না।আপাদত তোমার এই ছোট মস্তিষ্কে এসব নিয়ে ঝামেলা না পাকালেও চলবে।কাজে মনোযোগ দাও”

উঠে দাড়িয়ে এপ্রোন পড়তে পড়তে মেহতাব বললো, “আজ আমার সাথে সাথে তোমারও নাইট ডিউটি”

“মানে!”

“আমার কথা মনযোগ দিয়ে শোনো।আমার হাতে সময় নেই।যেতে হবে।প্রথম কাজ সন্ধ্যা হচ্ছে পুরো ক্যাবিনে স্প্রে করো।একটা মশা যেনো না থাকে।আর যথাসম্ভব হাত পা ঢেকে রাখো।বাসায় কল করে জানাও তোমার আজ নাইট ডিউটি। রাত তিনটে, চারটার আগে আমি ক্যাবিনে আসবো না।সব পেশেন্ট উপরেই দেখবো। সার্জারীও আছে আমার। মোট আটটা ফাইল তোমার ডেস্কে।কাজগুলো শেষ করে রাখো।রেস্ট নিতে পারো চাইলে।ভালো না লাগলে তিনতলায় মহিলা স্টাফদের কমন রুম আছে সেখানে যেতে পারো।আমার তোমাকে দরকার পড়লে আমি ডাকবো।ঠিক আছে?”

এত এত ইনস্ট্রাকশন শুনে মুখ নেতিয়ে গেলো আদরের।নিচু স্বরে বলে উঠলো, “ঠিক আছে”

আদরের কাজ করতে মোটেও ভালো লাগে না।এটা মেহতাব জানে।এত এত আদেশের ভার নিতে পারছে না তার দুর্বল কাধ সেটাও বুঝেছে।কিচ্ছুটি করার নেই। মাথায় হাত রেখে এলোমেলো হয়ে থাকা চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে বললো,

“দেলাওয়ার চাচা রাত ৯টায় খাবার দিয়ে যাবে।খেয়ে নিও”

আদরও চট জলদি প্রশ্ন করে বসে, “আপনি খাবেন না?”

“যদি সুযোগ পাই। সাবধানে থেকো।কোনো সমস্যা হলে আমাকে সরাসরি ফোন দিবে।”

___

রাত দশটায় আদরের ডাক পড়েছে।উপর তলায় মেহতাব ডাকছে।কাজ আছে। ক্যাবিন লক করে চাবি দিয়ে গেলো দেলাওয়ার চাচার কাছে।উপরেই ওয়ার্ডের সামনে রুক্ষ মুখে দাড়িয়ে আছে আদর।মুখ দেখে মনে পড়লো সেতো এখনও কিছুই খায়নি।খুদা পেয়েছে নিশ্চয়ই।নিজের প্রতি রাগও হচ্ছে।কিভাবে একা একা খেয়ে নিল।তাকে ফেলে রেখেই।আদর মেহতাবের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।এখন আলাদা করে কথা বলার সুযোগ নেই।সামনে অনেক মানুষ।আদরকে দেখা মাত্র মেহতাব ইশারা করলো তার পিছু আসতে।মোটামুটি কাজ পারে আদর এখন।পেশেন্টের যে সকল কাজ আদর করতে পারবে সেগুলো আদরের হাতে ন্যাস্ত হয়ে এক এক করে সব পেশেন্টকে আরেকদফা চেক আপ করছে।এভাবেই পাড় হচ্ছে সময়। ঘন্টাখানেক পর আদরও ক্লান্ত। মেহতাবের দিকে চেয়ে ভাবছে মানুষটা কিভাবে সহ্য করে এতকিছু? সেতো অল্পতেই নেতিয়ে যায়।আর মেহতাব মুখে যতই থাকুক ক্লান্তির ছাপ।শরীর এখনো চলছে।

আদরকে ডেকে বললো,

“গিয়ে ঘুমিয়ে পরো ঘন্টাখানেক এর জন্য।আমি আসার আগে কল করবো।তখন বেরিয়ে কমন রুমে চলে যেও।রোজিনা আপা থাকবে সেখানে।কোনো সমস্যা হবে না”

“আমার একটা কথা রাখবেন?”

আদরের কণ্ঠে আবদার।এত আকুতি নিয়ে বলছে ফেলে দেওয়া অসম্ভব।মেহতাব চোখের পলক ঝাপটিয়ে বললো,

“বলো”

“এখানে সব পেশেন্টের চেক আপ শেষ। দশ মিনিটের ব্রেক নেন।ক্যান্টিন থেকে কিছু খেয়ে নেন।প্লিজ!”

যখন ছোটখাটো কোনো আবদার করে?তখন তার চোখের দিকে তাকানো যায় না। নেত্রজোড়া গোলগোল করে রাখে, ঠোট উল্টে ফেলে।ভ্রম লাগিয়ে দেয়। ইচ্ছেদল অবাধ্য হয়ে তার হাতে আত্মসমর্পণ করতে ইচ্ছে করে।আজ নিজেকে শক্ত রেখেও আবদার মেনে নিলো।তার আগেই শর্ত জুড়ে দিয়েছে।ফোন রেখে গিয়ে ঘুমোতে হবে। নাহয় সেও যাবে না না খেতে।আদর মেনে নিলো।দ্রুত পা বাড়িয়েছে ক্যাবিনের দিকে। মাঝপথ গিয়ে আবার ফিরে তাকালো।

বললো, “খেয়ে নিয়েন কিন্তু” বলে আবার ঘুরে চলে গেছে।

তার এসব ছোটখাটো বিষয় মেহতাবের মনে কত গাঢ় দাগ কাটে সে জানে?জানে না হয়তো।জানলে ফয়দা লুটতো।ইচ্ছে করে তার সামনে এসে হুটহাট কান্ড ঘটিয়ে বসতো। মেহতাবকে অসংযত করে তুলতো।এমনেতেই নিজেকে ধীরেধীরে ভেস্তে যেতে দেখছে। ক্ষণেক্ষণে ঝড় তোলে মনে।এই তুফান কি থামবে?কিভাবে থামবে?যেখানে মেহতাব আদরকে বলেছিলো তার পালানোর পথ বন্ধ।সেখানে নিজেই সে বন্দী।

স্যান্ডুইচে কামড় বসিয়ে ভাবছে, “আজ তুমি না বললে আমার খাওয়া হতো না। সত্যিই হতো না!”

_____

মায়ের সাথে কথা বলে নিলো আদর মাত্রই।ভীষণ চিন্তা করছেন।টেনশন মায়েদের রোগ। ছোটোখাটো বিষয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়েন।মাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঘুমোতে পাঠিয়েছে আদর।নাহয় আজ রাতটা না ঘুমিয়েই পার করে দিত জোহরা খাতুন।

রাত বাড়ছে,সাথে আদরের চিন্তা।কি করছে মেহতাব? খেয়েছেতো?নাকি আদরকে পাঠিয়ে দিয়ে আবার কাজে লেগে পড়েছে।একটা ফোন দিলে কেমন হয়?নাহ! বিরক্ত হতে পারে। ঘুমোলো না সে।ফোন স্ক্রল করতে করতে রাত পার করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

রাত তিনটে,

ঘুমে টলমল করছে আদরের চোখ।নিজের সাথে একপ্রকার যুদ্ধ করে জেগে আছে।এই পর্যন্ত মেহতাবের কল,মেসেজ কিছু আসেনি।রাত বারোটায় শুধু মেসেজ করে জিজ্ঞেস করেছিল ঘুমিয়েছে কিনা।এর উত্তর দেয়নি আদর। রিপ্লাই দিলেই ধমকাবে।কেনো ঘুমায়নি জানতে চাইবে। চতুরতার সাথে এড়িয়ে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আদর ভাবলো,নাহ!এবার থাকা যাচ্ছে না।চোখে মুখে পানির ছিটা দিয়েই জেগে থাকার যুদ্ধে বনে থাকতে হবে।উঠে গেলো।যাওয়ার আগে সামান্য হোচটও খেয়েছে।সবই ঘুমের প্রভাব। ওয়াশরুমে গিয়ে ভালো মতন সারা চেহারায় পানি ছিটালো।অল্প সময়েই বেরিয়ে এসেছে।ভেজা মুখে দরজা খুলে বেরিয়ে আতকে উঠেছে। আরেকটু হলে পরানটা বেরিয়ে যেতো।সামনে মেহতাব দাড়িয়ে। চোঁখদুটো লাল হয়ে আছে। বিধ্বস্ত চেহারা।দেখে মনে হচ্ছে একফোঁটা শক্তি নেই শরীরে।তারপরও সামান্য পাশে টেনে নিলো।আদর গিয়ে ঠেকেছে পাশের টেবিলে।

অত্যন্ত ভারী কণ্ঠে শুধালো, “ঘুমাওনি কেনো?”

“আমার ঘুম আসছিলো না।আপনি হটাৎ না জানিয়ে এলেন যে?”

কোনো উত্তর না দিয়ে হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে আদরের চেহারায় জমে থাকা পানির বিন্দুগুলো মুছে দিচ্ছে।চোখের পাপড়ি, ভ্রু,গাল। সবশেষে অগ্রসর হয়েছে ঠোঁটে।মেহতাবের চাহনি দেখে দেখে শ্বাস আটকে এলো।নেশাকাতুর দৃষ্টি। মাদকতায় পূর্ণ।নজর তুলে আদরের দিকে দৃষ্টি ফেলেছে মেহতাব।

ঢোক গিলে বললো,
“ক্লান্ত লাগছিলো।ভাবলাম একটু প্রশান্ত হয়ে আসি।”

“মানে?”

এবারও বিনা বাক্যে আদরের ভেজা ঠোঁটে শক্ত চুমু বসিয়েছে। আচমকা আক্রমনে বিমূঢ় আদর।এখনই লজ্জায় কাবু হয়ে যাবে।এড়ানোর সুযোগ খুঁজছে।পাচ্ছে না।মাথা ঘুরিয়ে নিল একপাশে।পারলে দুহাতে মুখ ঢেকে নিত।সেই সুযোগ নেই। দুটো হাতই মেহতাবের দখলে।আদরের ঘুরে থাকা গালে তার খোঁচা খোঁচা দাড়ি ঘষে দিয়ে বললো,

“ইউ আর ড্রাইভিং মী ক্রেজি ডে বাই ডে।ছুটে আসতে বাধ্য হয়েছি।বাধ্য করেছো তুমি! লাগামহীন ঘোড়ার মতন দ্রুত বেগে ছুটে যাওয়া হৃদপিণ্ডকে শান্ত করতে এসেছি।কারো চোখের মাদকতায় মস্তিষ্ককে শীতল করতে এসেছি”

আদরের কি হলো?সে কেদে উঠেছে।চোখের কোণ বেয়ে নোনাজ্বল গড়িয়ে পড়ছে।এত দ্রুত কাদতে পারে মানুষ?আদর পারে।তারপরও এই লোকটা স্বীকার করবে না! আলগোছে কত কথা বলে ফেলে। স্পষ্ট ভাষায় নিজের অনুভূতি তুলে ধরলে কি হয়?

“কেনো এসেছেন?আমি কোনো বাধ্য টাদ্ধ করিনি।আমার জন্য আপনার নূন্যতম মায়া নেই।কি আছে আমাদের মধ্যে? যার জন্য ছুটে চলে এলেন।কিছুই নেই!অহেতুক এসেছেন।আপনার সময় নষ্ট হচ্ছে”

আদরের চোখের পানি নিজের ওষ্ঠের সাহায্যে শুষে নিয়েছে।উত্তরে ভারী নিঃশ্বাস ছেড়ে গভীর গলায় বললো,

“আমাদের মধ্যে যা আছে তার কোনো নাম নেই,পরিচয় নেই।কিন্তু যা আছে? তা অসীম,অশেষ।”

আদর চুপচাপ মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে।তার বলা প্রত্যেকটা কথার অর্থ গভীর হয়।বোঝার ক্ষমতা আছে আদরের।আদর চায় স্পষ্টতা।এত ঘোরানো পেঁচানো বাক্য তার অপছন্দনীয়।তারপরও কেনো জেনো এসব কথা শুনতেই বেশ ভালো লাগে।

“শুনো?একঘন্টার জন্য রেস্ট নেওয়ার সুযোগ পেয়েছি। মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে সেদিনের মতন?একটু ঘুমাবো আমি।”

কথার প্রতিক্রিয়া দেওয়ার আগেই পাজাকোলে তুলে দিয়েছে আদরকে। আরেকদফা ঠোঁটে প্রগাঢ় চুমু বসিয়ে দিলো। বেডের মধ্যিখানে আদরকে বসিয়ে।নিজে শুয়ে পড়লো।আদরের কোলে মাথা রেখে।চোখ বুঁজে নিলো। একহাত টেনে বুকে চেপেছে।মুখ দিয়ে “উম” শব্দ করে বোঝালো মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে।আদর সামান্য সাহস দেখিয়ে দাড়ি টেনে দিলো।এই দুঃসাহস দেখিয়েও ভয় পেয়েছে পরক্ষনেই।হাত সরিয়ে পেছনে সরে গেছে।মেহতাব চোখ খুলে তাকালো। ঠোঁটের কোণে সরু হাসির রেখা।আদরের হাত টেনে,হাতের তালুতে চুমু খেয়ে বললো,

“কিছু বলবো না।ভয় নেই।”

“সত্যিই?”

“এত বোকা কেনো তুমি বলোতো?”

“আমি বোকা?”

“হুম তো? কিছুইতো বোঝো না।শুধু জেদ করো।নিজের যেটা ইচ্ছে করে সেটাই চাও।তোমার আশপাশে যা হচ্ছে, ঘটছে?কখনো উপলব্ধি করেছো?তোমার পাগলামোগুলো তোমাকেই কষ্ট দেয় শুধু।মুখের শব্দের উপর নির্ভর করে নিজে মনগড়া কাহিনী রটানো বন্ধ করো।”

“আপনিই বলে দেন কি করা দরকার আমার?”

আদরের কণ্ঠে অভিমান স্পষ্ট।ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটেছে।নিজের স্বভাবের বাইরে। দুষ্টু মুখে বললো,

“মিস আদর আপাদত এখন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দরকার আপনার।”

“দিচ্ছি।চোখ বন্ধ করুন”

“কেনো?চোখ বন্ধ করবো কেনো?চোখ খোলা রাখলে তোমার কোনো সমস্যা?”

“নাহ ঠিক আছে!চোখ খোলা রেখেই ঘুমোন”

“ওহ আচ্ছা।নাও করলাম চোখ বন্ধ”

এক হাত বুকে চেপে আরামে ঘুমিয়ে পড়েছে মেহতাব। কতটা ধকল গেছে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।চোখের পলকে ঘোর তন্দ্রায় চলে গেলো।সাথে বুকের ওঠানামার গতি।বাচ্চাদের মতন ঠোঁট চেপে শুয়ে আছে।পা মুড়িয়ে অন্যপাশে ঘুরে।আদরের ঘুম যেনো হাওয়া হয়ে গেলো। মেহতাবকে ঘুমোতে দেখে নিজের ঘুমের তোয়াক্কাই করলো না।এখনও তার চুলে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। মেহতাবকে এভাবে তার কোলে মাথা গুঁজে শুয়ে থাকতে দেখে আদরের মন বারবার একটা কথা ড্রাম বাজিয়ে বলে যাচ্ছে।

“এই মানুষটা একান্ত তোর।”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here