‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[১২]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)
তুয়া ওর পছন্দের ডায়েরিটা বের করেছে। নীল রংয়ের ডায়েরিটা দেখতে বেশ সুন্দর। এখানে তেমন কিছু লিখা নেই। এটা গত দুই সপ্তাহ আগে তুয়া ডায়েরিটা কিনেছিল। তবে তুয়া এই ডায়েরিটা সব সময় লুকিয়ে রাখে। কারন ডায়েরির কয়েকটা পৃষ্ঠায় বিশেষ কাউকে নিয়ে লিখা আছে।
তুয়া ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠায় হাত বুলালো, সেখানে যত্ন করে লিখা,
প্রথম পৃষ্ঠা,
-“তোমার হাসি দিয়ে আমাকে ঘায়েল করতেই হতো? না করলে বুঝি খুব মন্দ কিছু ঘটত। ”
দ্বিতীয় পৃষ্ঠা,
-” মুগ্ধতা থেকে কবে ঘটবে পূর্ণতা?”
তৃতীয় পৃষ্ঠা,
-” ইস! এভাবে তাকিও না। তোমার ঘায়েল করা
চাহনিতে লজ্জায় আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে।”
চতুর্থ পৃষ্ঠা,
-“এই দুষ্টু! আমাকে এতটা বেতাল করে তবেই বুঝি শান্তি পেলে, হুম?
পঞ্চম পৃষ্ঠা,
-“কবে তুমি নাম ধরে ডাকবে, কবে তুমি হাতে হাত রাখবে?”
ষষ্ঠ পৃষ্ঠা,
-“এত ভদ্র হওয়া মোটেও ভাল নয়, স্যার। একটু একটু অভদ্র হবেন, তবে শুধু আমার কাছে। কি মনে থাকবে তো?”
সপ্তম পৃষ্ঠা,
-“কবে শেষ হবে অপেক্ষার প্রহর? আসবে তুমি? বাসবে ভাল, বলবে ভালবাসি?”
নবম পৃষ্ঠা,
-“আমি এখন ধর্ষিতা কালিমায় অভিশপ্ত, ডক্টর সাহেব। তোমার আমার যাত্রাপথ এখানেই সমাপ্ত।”
পরের পৃষ্ঠা গুলোতে আর কিছু নেই। তুয়ার একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল নবম পৃষ্ঠার লিখাটার উপরে। তুয়া ভেবেছিল ওর ভালবাসার প্রকাশ আর ঘটবে না। ধর্ষিতাকে মানুষ বলেই তো গণ্য করা হয় না, তার ভালবাসার দাম আর কে দিবে? তুয়া ভেবেই নিয়েছিল সে প্রত্যয়কে হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু ভাগ্য প্রত্যয়কে তুয়ার কাছে এনে দিল। হয়ত এটাই তুয়ার মোনাজাতে প্রত্যয়কে শুদ্ধ মনে পবিত্র ভাবে চাওয়া ফল।
পরেরদিন ভোরে প্রত্যয় বাসায় ফিরল। একজন পেশেন্টের জন্য সারারাত জেগে ছিল। প্রত্যয়ের আম্মু নামাজ পড়ার জন্য উঠে প্রত্যয়কে দেখে বললেন, “আব্বু, আজকাল তোর খুব ধকল যাচ্ছে। এভাবে চললে তো তুই অসুস্থ হয়ে পড়বি।” প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, “আমি ঠিক আছি, আম্মু।”
প্রত্যয়ের আম্মু আর কথা বাড়ালেন না, উনি চলে গেলেন। প্রত্যয় ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ল। ডাক্তারী পড়ার প্রথম ধাপ থেকেই রাত জাগাটা ওর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আর কথাতেই আছে মানুষ অভ্যাসের দাস। তাই এখন প্রত্যয়ের খুব একটা সমস্যা হয় না।
প্রত্যয় একটু পরে চোখ খুলে বুকের বা পাশটায় হাত রাখল। কালকে যেখানটাই তুয়া মুখ লুকিয়ে কেঁদেছিল। কালকের কথা ভেবে প্রত্যয় মুচকি হেসে আবার ওর চোখ দু’টো বন্ধ করে নিল।
**!!
“আমাকে ভালবাসলে কি তোর হৃদয়টা পঁচে যাবে?”
চাঁদ কথাটা বলে অঝরে কাঁদতে লাগল। কালকে রাতে চাঁদ জোর করে প্রিয়মকে জড়িয়ে ধরেছিল। কিন্তু ফলস্বরুপ প্রিয়ম ওকে চারটা থাপ্পড় মেরে রুম থেকে বের করে দিয়েছে। চাঁদ এত আঁকুতি করেও প্রিয়মের মন গলাতে সক্ষম হয়নি। শক্ত পুরুষালী হাতের থাপ্পড় খেয়ে চাঁদের জ্বর চলে এসেছে। সে যতই কষ্ট পাক তবুও থামবেনা। সে প্রিয়মের থেকে ভালবাসা আদায় করে তবেই ছাড়বে। চাঁদ তো প্রিয়মকে পাগলের মত ভালবাসে, তাহলে প্রিয়ম কেন ওকে ভালবাসবে না?
চাঁদ বালিশ আঁকড়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলল, “তোমার অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তোমাকে বিয়ে করে, আমার বিন্দুমাত্রও আফসোস নেই। আজ আমাকে কষ্ট দিচ্ছো দাও, কালকে নাহয় ভালবেসে পুষিয়ে দিও।”
চাঁদ এসব মনগড়া কথা বলে নিজেকে শান্তণা দিলে, ওর মনে ভয় এসে বাসা বেঁধেছে। আর ভয়টা হল প্রিয়মকে চিরতরে হারানোর ভয়। চাঁদও বুঝে গেছে প্রিয়ম মারাত্মক জেদি ছেলে। ওকে বশে আনা মোটেও সহজ হবেনা, কিন্তু সেও হাল ছাড়বেনা। প্রিয়মের ভালবাসা পেতে কষ্টকেই সঙ্গী করে সে লড়ে যাবে। তবুও এত সহজে সে প্রিয়মকে কিছুতেই
হারাতে দিবেনা।
প্রিয়মের প্রতি চাঁদের ভালবাসাটা হল কাটাযুক্ত গোলাপ মত। আর এখানে চাঁদও হাজার বার কাঁটার খোঁচায় রক্তাক্ত হতে প্রস্তুত। তবুও প্রিয়মকে এক চুল পরিমাণ ছাড়তেও, সে রাজি নয়।
**!!
আজকে শুক্রবার এজন্য রনিত এখনও ঘুম থেকে উঠেনি। পলক এই নিয়ে চার বার রনিতকে ডেকে গেল। কিন্তু রনিত, “হুম! হুম! উঠছি আর একটু!” এসব বলে আবার ঘুমিয়ে পড়ছে।
ওই দিকে রনিতের মা পলককে বলছেন, “পলক রনিতকে ডেকে বাজারে যেতে বল।” পলক আবার রুমে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “এই! এই লোক উঠছেন না কেন আপনি? মা আপনাকে বাজারে যেতে বলছেন। কি হলো উঠুন!”
রনিত পাশ বালিশটাকে বুকে জড়িয়ে বলল, “তুমি যাও, আমি আসছি।”
বেশ কিছুক্ষণ পর রনিতকে বাজারে যেতে না দেখে রনিতের মা পলককে বলল, “কেমন মেয়ে তুমি যে স্বামীকে ডেকে তুলতে পারছ না? এত গিলেও গলার জোর বাড়েনা?”
পলক মাথা নিচু করে নিল। সে কারো মুখে মুখে তর্ক করতে পারেনা। রনিতের মা নিজের ছেলের দোষ দেখল না, পরের মেয়েকে ঝেড়ে চলে গেলেন।
পলক সয়া সসের বোতলটা নিয়ে রুমে ঢুকে রনিতের বুকের উপর বসল। রনিত এখনও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। পলক শক্ত করে রনিতের নাক চেপে ধরল। নাক চেপে ধরায় রনিত হা করার সঙ্গে সঙ্গে পলক রনিতের মুখে সয়া সস ঢেলে দিল। এমন ঘটনায় রনিত মুখ ভর্তি সস দিয়ে হতভম্ব হয়ে চোখ খুলে তাকাল। পলক রাগে হনহন করতে করতে স্থান ত্যাগ করল।
রনিত দ্রুত উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে বমি করতে লাগল। সকালবেলা সসের গন্ধে ওর বমিও হয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর রনিত ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বলল, “এই মেয়ে মানুষ যে কি দিয়ে তৈরী আল্লাহ মাবুদই জানে। আর আমার রেস্ট করার দিনই মেহমানদের আসতে হবে, উফ! অসহ্য লাগে। ”
**!!
ইচ্ছে তুয়াদের বাসায় সোফায় বসে চানাচুর খাচ্ছে। তুয়া ইচ্ছের পুতুলকে শাড়ি পড়িয়ে দিচ্ছে। তুরাগ এসে ইচ্ছের পাশে বসে বলল, “ইচ্ছেপাখি তুমি একটা কথা শুনেছ? ইচ্ছে মুখ ভর্তি চানাচুর নিয়ে বলল, ” তি কঠা?”
তুরাগ আড়চোখে তুয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ” তুয়া কালকে সারারাত কেঁদেছে।” ইচ্ছে তুয়ার দিকে একবার তাকিয়ে তুরাগকে বলল, “কাঁদছিল ক্যানো?” তুরাগ দাঁত বের করে হেসে বলল, “প্রত্যয়কে বিয়ে করার জন্য।”
তুয়া হাতের পুতুলটা রেখে তুরাগকে দৌড়ানি দিল। তুরাগ দরজা খুলে সিঁড়ির কাছে গিয়ে বলল, “টুপা, আমাকে মারলে আমি সব কথা প্রত্যয়কে বলে দিব।” তুয়া রেগে তুরাগের দিকে তাকিয়ে আছে।
তখনই প্রিয়মকে বের হতে দেখে ইচ্ছে দৌড়ে গিয়ে বলল, “প্রিউুম! প্রিউুম! কালকে তুয়া আপু এত এত কেঁদেছিল।”
প্রিয়ম ইচ্ছের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, “কেন?” ইচ্ছেও তুরাগের মত দাঁত বের করে হেসে বলল, “প্রত্তুয়কে বিয়ে কলাল জন্য।” তুয়া উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। তুরাগ পেটে হাত দিয়ে এখনও হো হো হাসছে। ইচ্ছেও খিলখিল করে হাসছে।
প্রিয়ম উচ্চশব্দে প্রত্যয়কে, “ভাইয়া! ভাইয়া! করে ডাকল। প্রত্যয় কেবল ঘুম উঠে ফ্রেশ হয়ে মুখ মুছছিল। প্রিয়মের ডাক শুনে প্রত্যয় টাওয়াল গলায় ঝুলিয়ে প্রিয়মের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ” প্রিয়ম, কিছু বলবে?” প্রিয়ম বলল, “কালকে সারারাত তুয়া কেঁদেছিল।”
প্রত্যয় তুয়াকে উল্টো ঘুরে দাড়িয়ে থাকতে দেখল, ততক্ষণে দুই পরিবারের সবাই উপস্থিত হয়ে গেছে। প্রত্যয় প্রিয়মের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ” কাঁদছিল কেন?” প্রিয়ম তুরাগ আর ইচ্ছের মত দাঁত বের করে হেসে বলল, “তোমাকে বিয়ে করার জন্য।”
প্রিয়মের কথা শুনে প্রত্যয় বাদে সবাই শব্দ করে হেসে উঠল। প্রত্যয় শব্দ করে না হাসলেও ওর মুখে মুচকি হাসি। এদের কথা শুনে তুয়া যে দৌড়ে পালাবে সেই সুযোগটুকু ওর নেই। ওর আব্বু আম্মু ওদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, “এ তো আমার সৌভাগ্য।”
তুয়া আর দাঁড়াল না। মাথা নিচু করে ওর আব্বু আম্মুকে সরিয়ে দৌড়ে চলে গেল। প্রত্যয়ও হাসতে হাসতে রুমে ডুকে গেল।
প্রত্যয়ের আম্মু হাসতে হাসতে বলল, “প্রিয়ম এই খবর কে ভাইরাল করল?” প্রিয়ম আঙ্গুল দিয়ে ইচ্ছেকে দেখিয়ে দিল। ইচ্ছে তুরাগকে দেখাতে যাবে, তখন দেখে তুরাগ ওখানে নাই। ইচ্ছে বলল, “আমাকে তুলাগ জানপাখি বলেছে।” তুয়ার আব্বু হাসতে হাসতে বললেন, “আজকে তুরাগ আর ইচ্ছের খবর আছে।”
**!!
আজকে শুক্রবার তাই প্রত্যয় দুই ঘন্টার জন্য ওর সার্জারির পেশেন্টদের দেখতে গেল। প্রত্যয় হসপিটাল থেকে ফিরে শাওয়ার নিয়ে নামাজের জন্য রেডি হল। শুক্রবারের অন্যতম মুহূর্ত হল, যখন বাসার সব ছেলেরা একসঙ্গে নামাজের জন্য বের হয়। প্রত্যয়ের আব্বুসহ ওরা দুই ভাই বের হওয়ার সময় দেখল, তুয়ার আব্বু দাঁড়িয়ে আছেন।
প্রত্যয়ের আব্বু বললেন, “ভাই দাঁড়িয়ে আছেন যে?” তুয়ার আব্বু বললেন, “তুরাগের জন্য,ওই যে ভাই বোন মারামারির শুরু করেছে।”
তুরাগ তুয়ার পেছন পেছন ঘুরছে পান্জাবীর বোতাম লাগিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তুয়া চুপ করে বসে নখ কাটছে। যেন সে কিছু শুনতেই পাচ্ছে না।
তুরাগ করুণ সুরে বলল,” মসজিদে জিলাপি দিলে এনে দিব, এবার তো দে বোন আমার।”
তুয়াদের দরজা খোলা থাকায় সবাই ওদের কাহিনী দেখছে। তুয়া নখ কেটে আঙ্গুলে ফু দিতে যাবে তখন দেখল প্রত্যয়রা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। তুয়া ভদ্র ভাবে উঠে তুরাগের পান্জাবীর বোতাম লাগিয়ে দিল। তুরাগ তুয়ার গাল টেনে হেসে প্রত্যয়দের সঙ্গে চলে গেল।
তুয়া পর্দার আড়ালে থেকে নিচে তাকাল। পাঁচজন একসঙ্গে নামাজে যাচ্ছে। প্রত্যয় আর তুয়ার আব্বু সাদা, প্রিয়ম হালকা গোলাপি, তুরাগ মেরুন, আর প্রত্যয় আকাশি আর সাদার সংমিশ্রণের পান্জাবী পরিহিত।
পাঁচজনের মাথায় শুভ্র চওড়া টুপি। তুয়ার কাছে এই মুহূর্তটা দেখতে বেশ ভাল লাগছে। তুয়া ওর ডায়েরি বের করে লিখল, “এক টুকরো আকাশ সেজে তোমাকে দেখতে বেশ ভাল লাগছে। একদম আমার সুদর্শন শঙ্খচিলের মত ।”
To be continue….!!