প্রেমাসুখ #পর্ব_১১ (হৃৎপিণ্ডের ডাক্তারের হৃৎপিণ্ডের মালিকানা!) #লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

0
3

#প্রেমাসুখ
#পর্ব_১১ (হৃৎপিণ্ডের ডাক্তারের হৃৎপিণ্ডের মালিকানা!)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

“সাঁঝ! তোর চোখদুটো এমন লালচে দেখাচ্ছে কেন?”

সাঁঝ তৎক্ষণাৎ চোখজোড়া বন্ধ করে নিল। পরপর কয়েকবার চোখের পাপড়ি ঝাপটাল। এরপর ওষ্ঠকোণে হাসি ছুঁইয়ে উপমাকে বলল,“তেমন কিছু না।”

উপমা পুনরায় জানতে চাইল, “কী হয়েছে? বল।”

“এভাবেই, ঘুম হয়নি তো!”

উপমা সাঁঝের এমন সহজ স্বীকারোক্তিতে কিছু লুকোনোর আভাস পেল। সাঁঝ তখন আবার বলল,“এক কাপ চা দিতে পারবি? মাথা ধরেছে ভীষণ!”

উপমা অস্থির ভঙ্গিতে বলল,“আনছি, একটু ওয়েট!”

উপমা প্রস্থান ঘটাল। সাঁঝ খোলা মস্তিষ্কের। কোনো কথা কাউকে বলতে দ্বিধাবোধ করে না। তবে এ’কথা এড়িয়ে গেল।
ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁয়েছে। কাল রাতের সেই মেসেজটা সাঁঝের ঘুম কেড়ে নেওয়ার একমাত্র কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলাবাহুল্য, কাল সারারাত ঘুমোতে পারেনি বলেই চক্ষুদ্বয় এমন লাল; রক্তলাল হয়ে আছে। সে বরাবরই টেনশন ফ্রি থাকতে পছন্দ করে। নয়ত তার সকল কাজে বিঘ্ন ঘটে। কিন্তু এবার না চাইতেও এই চিন্তা নিয়ে সারাটা রাত দুচোখের পাতা খোলা রাখতে হয়েছে। ভাবনা,বড্ড অদ্ভুত! ভাবতে ভাবতেই পেরিয়ে গেল তিনটে প্রহর। অথচ, ঘুম! সে যে বিদায় নিয়েছে মেসেজটা পড়ার পরই। ভুলবশত পাঠানো মেসেজ হিসেবে ধরে নিতেও তার মনটা দ্বিমত পোষণ করছে। মন কেন এরূপ করছে! সেটা মন নিজেও জানে না।

সাঁঝ চটজলদি ওঠে ফ্রেশ হয়ে নিল। উপমা চা নিয়ে হাজির। সাঁঝের দিকে চায়ের ট্রেটা এগিয়ে দিয়ে বিছানার সামনে দু পা ঝুলিয়ে বসে পড়ল। সকালের সে-সব কথা ভুলে কোচিং বিষয়ক আলোচনা শুরু হলো দুজনের মাঝে।
তখনই উপমার ফোনে কল এলো। স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করছে একটা লেখা। “সুখ”নামটা দেখে মুচকি হাসল উপমা। অর্ণবের অগোচরে তার নম্বরটি তো এই নামেই সেভ করেছে। হুট করেই তার খেয়ালে এলো, সাঁঝ এখানেই। চোখ তুলে দেখল, তার ঠিক পাশেই সাঁঝ দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি ফোনের দিকেই। সাঁঝ কপালটা টানটান করে যেই না উপমার ফোনটা ধরার জন্য হাত বাড়াল, উপমা খপ করে নিজের ফোনটা হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল।

সাঁঝ সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করল,“ওটা কে রে?”

উপমা অধরকোণে জোরপূর্বক হাসির রেখা টেনে বলল,“কই? কেউ না তো!”

সাঁঝ কড়া চোখে তাকাল উপমার দিলে। খানিক সময় ভাবনাতে ব্যয় করে বলে উঠল,“সুখটা কী? মানে কে?”

“আরে কেউ না, বাদ দে।”

“বাদ দেওয়ার মতো টপিক তো না এটা! ফটাফট বলে ফেল।”

ততক্ষণে অর্ণবের কলও থেমে গিয়েছে। উপমা প্রসঙ্গ এড়াতে বলল,“তোর তো মাথা ব্যাথা ছিল? এই-যা! ভুলে গেছিলাম। চা এনেছি, ঠান্ডা হয়ে যাবে। নে, ধর!”

সাঁঝ চায়ের কাপ হাতে তুলে উপমাকে বলল,“কিন্তু তার আগে তুই…”

“সাঁঝ! এই! ভুলে গেছিলাম। আম্মু একটা কাজ দিয়েছিল, যাই আমি। হ্যাঁ?”

সাঁঝ আর কিছু বলার আগেই উপমা দ্রুত পা চালিয়ে প্রস্থান করল। রুম থেকে বের হতেই হাফ ছেড়ে বাঁচল! একটুর জন্য সাঁঝের হাত থেকে রেহাই পেয়েছে! কল ব্যাক করল উপমা। অর্ণব রিসিভ করতেই বলল,“এই যে মিস্টার অর্ণব হাওলাদার! সকালে কতবার কল দিয়েছি, ধরলে তো না-ই! যেই না তোমার বোনের কাছে এলাম, ওমনিই কল দিলে!”

অর্ণব খানিক হেসে বলল,“সামলালে কী করে?”

“সেসব বাদ দাও। আগে এটা বলো, ওকে সবটা জানাব কবে?”

“বিয়ের সময়। এখন জানালে জেরির ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক দোটানায় পড়ে যাবে।”

____________
উপমার যাওয়ার পর সাঁঝ কিছু ভাবল না আর, কেননা ইদানিং সাঁঝের চিন্তা করার জন্য রেডিমেট অসংখ্য বিষয় রয়েছে। এখন ভাবছে, কী করবে? ভাবার মতো অনেক কিছু থাকলেও করার মতো কিছুই নেই। এদিক সেদিক তাকাতেই দেখতে পেল, বিছানার উপর তার ফোন জ্বলজ্বল করছে।

কিছু মনে হতেই জিভে কামড় দিয়ে ফোন তুলল। আরিফ সাহেব কল দিয়েছেন। দীর্ঘক্ষণ তাদের কথোপকথন চলল। কথা শেষ হতেই সাঁঝের মনে এলো, তার ভার্চুয়াল জামাইটার সাথে কথা হয় না কতদিন হলো!

সাঁঝ ওয়াইফাই কানেক্ট করে কিছু অ্যাপস্ ইনস্টল করে নিল। এরপর মেসেঞ্জারে লগ ইন করেই সরাসরি হৃদের ইনবক্সে ঢুকল। লাস্ট মেসেজ সাঁঝের, সেদিন সন্ধ্যার। হৃদ সিন ঠিকই করেছে, কিন্তু রিপ্লাই দেয়নি।

সাঁঝ একটু অবাক হলো, কিন্তু নিজের অবাক ভঙ্গি পরিবর্তন করে রিপ্লাই দিল,“ওরে মোর জামাই! কোন সতীনের কাছে গেছে রে!”

সাথে একটা কান্নার ইমোজিও দিল। কিন্তু বাস্তবে তার ঠোঁটে ছেঁয়ে আছে সুবিশাল এক হাসির রেখা। যার অর্থ তার নিজেরও জানা নেই।

নোটিফিকেশন বক্স চেক করতেই সেখানে দেখল,কালকের ঘুম হারাম করা নাম্বার থেকে কিছু মেসেজ এসেছে।সাঁঝ মনে মনে নিজেকে বলল,“একদম মেসেজটা ওপেন করবি না। না মানে না। এক্কেবারে ন আকার না।”
কিন্তু কৌতূহল যে বড্ড বেশি! দমাতে না পেরে দেখল, সেখানে তিনটে মেসেজ। সময় লক্ষ্য করে দেখতে পেল প্রথম মেসেজ রাত তিনটায়, দ্বিতীয় মেসেজ ভোর পাঁচটায় ও সর্বশেষ মেসেজ কিছুক্ষণ আগের।

সাঁঝ ঐ ক্যাটাগরির মানুষ; যাকে মারো, বকো, যাচ্ছে তাই করো, তুলে নিয়ে চাঁদে ফেলে আসো, এরা তবুও নিজের ফোন সাইলেন্ট মোডেই রাখবে। এজন্য জাগ্রত থাকা অবস্থায়ও কোনো মেসেজের শব্দ সাঁঝের কানে যায়নি।

সাঁঝ সময় অপচয় না করে মেসেজ গুলো পড়া শুরু করল। রাত তিনটার মেসেজটি পড়ল, লেখা ছিল,“শোনো হে নিশীথিনী! আমার সমস্ত নির্ঘুম নিশী আমি তোমার নামে লিখে দিলাম।”

সাঁঝের হাত-পা অসাড় হয়ে উঠল। দ্বিতীয় মেসেজটিও পড়ল, ভোরের দিকে এসেছিল, “পদ্মবতী! কোনো রাজার রাণী নও, কোনো উপন্যাসের মূল চরিত্র নও, তুমি হলে সেই ভোরের পদ্মাবতী! প্রথম দেখায় যে আমার নয়নজুড়ে শ্যামরূপসী কন্যা হয়ে গেঁথে ছিল। তুমি হলে সেই মোহিনী পদ্মবতী! শীতল যার চাহনি! স্নিগ্ধ যার ওষ্ঠ বাঁকানো হাসি! সমগ্র অঙ্গের ভাঁজে ভাঁজে যার বিষ! সেই মোহময়ী কিশোরীকে ভোরের সদ্য ফোঁটা পদ্মপাপড়ি দিয়ে জানাই, সুপ্রভাত! এভাবেই আলোর ন্যায় বিষ ছড়িয়ে যাও আমার জীবনে।”

শেষ মেসেজটা পড়তে চাচ্ছে না। কিন্তু তার কম্পনরত হাতটা আপনাআপনিই মেসেজ স্ক্রল করছে। আপাতত এটুকু পড়েই সে হাসছে, অজান্তেই কাঁপছে!

সাহস যুগিয়ে শেষ মেসেজ পড়ল,“যদি প্রিয়তমার ঘুম না ভাঙে, তবে এই প্রেমিক হৃদয় আবারও কৈশোরে ফিরে যাবে! দেখা পাওয়ার জন্য ছটফটাবে! একটুখানি আদুরে আবদার করবে! প্রেয়সীকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখার জন্য যে কত প্রেমিক মরিয়া হয়ে বসে, তার খেয়াল কি আছে?”

কেমন যেন হাঁসফাঁস লাগছে সাঁঝের! এমন গহীন প্রেম তো কেবল তার ছিল! তার ডায়েরির পাতায় বদ্ধ ছিল! তার নিজস্ব সকল ভাবনা ছিল! তবে এ কোন প্রেমিক? যে সাঁঝের মতোই প্রেমানলে দগ্ধ হচ্ছে!

সাঁঝের অবশ ভাব কেটে গেল। নিজের হতবিহ্বল অবস্থাকে লম্বা একটা শ্বাস টেনে দূরে সরাল। অতঃপর সেই অচেনা নাম্বারে মেসেজ করে বসল।

____________
মাত্র একটা সার্জারি শেষে নিজের চেম্বারে এসে বসল হৃদ। সকাল সকাল ইমারজেন্সি ওটি ছিল। খানিকক্ষণ চেম্বারে বিশ্রাম নেওয়ার পরই ফোন চেক করল। দেখল, রিপ্লাই এসেছে। মুচকি হাসল।
চোখ দুটো বন্ধ করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল হৃদ। ভাবনায় প্রবেশ করল সেই ভোর! পুষ্পিতা ও আকাশের বিয়ে ছিল সে বছর! বিয়ে উপলক্ষ্যে টাঙ্গাইলের একটা মফস্বল শহরে গিয়েছিল। পুষ্পিতার দাদার বাড়ি ওটা। দাদার বড্ড ইচ্ছে ছিল, নিজের নাতিনের বিয়েটা এই ভিটেতেই হবে। সে হিসেবেই যাওয়া! বরাবরের মতোই ভোরে ঘুম ভাঙল হৃদের। বাড়ি থেকে সকাল বেলা বাসি পেটে বেরোনোর নিয়ম না থাকায় হৃদ নিজ কক্ষেই অবস্থান করল। খোলা বাতাসের প্রয়োজন ছিল, জানালা খুলে দিল। সে দিনে, সে ভোরে, সে সড়কে, সে মুহূর্তে তার হৃদয়হরণীর সাক্ষাৎ পেল। সময়টা ছিল বৃষ্টিস্নাত এক ভোরের!

ষোড়শী কিশোরী আপনমনে এই সময়কে উপভোগ করছিল। কখনো কাঁদা মাখানো রাস্তায় খালি পায়ে নেচে বেড়িয়ে, তো কখনো পদ্ম তুলে তা দেখে সুখ মাখানো হাসি ছড়িয়ে। আর হৃদ! সে তো মেয়েটির কাজ পর্যবেক্ষণ করছিল, এবং হাসছিল!

দু’দুটো বছরের শান্তি উজাড় করে ফেলেছিল সেই ষোড়শী মেয়েটি। সময় এগোল, বয়স বাড়ল; অষ্টাদশী যুবতীতে পরিণত হলো। আশে-পাশের সব মেয়ের প্রতি, একটা বোন ক্যাটাগরির নজর আশা শুরু করল। সবশেষে বিয়ের প্রতি জন্মাল এক কঠিন অনীহা। নিজের ভেতরে এক অন্যরকম অসুখের কিছু লক্ষণ পেল। যেই সেই অসুখ না! প্রেমাসুখ ছিল সেটা!

এভাবেই চলছিল দিন। সময়গুলো বহমান। বহমান সময়ের সাথে পিষে চলে যায়, অনেক নিজের মানুষ; না হওয়া মানুষও যায়। হৃদ ধরে নিল, সেই না হওয়া মানুষটা সময়ের সাথে পিষে গিয়েছে। ধীরে ধীরে তার ধরে নেওয়া কথাটা মেনে নিতে শুরু করল। যখনই এই মেনে নেওয়ার ধাপটা শেষ হতে যাচ্ছিল, তখনই আবার তার আঙিনায় সেই অসুখ পুনরায় এলো। চমক ও বিস্ময়ের দরুন তার বুদ্ধি লোপ পেয়েছিল। অবশেষে আবারও শুরু হলো নির্ঘুম রাত কাটানো, কোনো এক যুবতীর নামে। সেই যুবতীকে সবাই ডাকে সাঁঝ! আর হৃদ, সন্ধ্যাবতী!

হৃদ চোখ দুটো খুলে ফেলল। ঠোঁট চেপে হালকা হাসল। ধীর কন্ঠে বলে উঠল,“অনেক জ্বালিয়েছ সন্ধ্যাবতী! জ্বালিয়ে পুড়িয়ে অঙ্গার বানিয়েছ। এখন আমার পালা! হৃৎপিণ্ডের ডাক্তারের নিজের হৃৎপিণ্ডের মালিকানা তুমি পেয়ে গিয়েছ নিজের অজান্তেই! এখন সামলাও!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here