নিবিদ্রিতা_কাহন—(স্পেশাল পর্ব)

0
151

#নিবিদ্রিতা_কাহন—(স্পেশাল পর্ব)

★সোফায় বসে টিভির দিকে থমথমে মুখ করে বসে আছে আদ্রিতা। মুখয়বে তার রাগ ভাব বিদ্যমান। যেন টিভি সিরিয়ালের দজ্জাল শাশুড়ীর মুডে আছে সে। যে তার বৌমাকে আজ ঝাড়ু পেটা করবে। তার এই গম্ভীর ভাবের মাঝেই হঠাৎ তানহাও ওর পাশে এসে বসলো। রিমোট হাতে নিয়ে চ্যানেল পাল্টাতেই বাজখাঁই নজরে তাকালো আদ্রিতা। যেন অনেক বড়ো অপরাধ করে ফেলেছে সে। আদ্রিতার এভাবে তাকানো দেখে তানহাও কিছুটা থতমত খেয়ে গেল। আদ্রিতা তানহার হাত থেকে ঠাস করে রিমোটটা কেঁড়ে নিয়ে চোখ কুঁচকে তাতান কন্ঠে বলে উঠলো,
“তুই দেখছিস না আমি কিছু দেখছিলাম! ফট করে পাল্টে দেওয়ার আগে একবারও জিজ্ঞেস করার ম্যানারস দেখালিনা! নাকি তুইও দিনদিন তোর ওই লড গভর্নর ভাইয়ের মতো হয়ে যাচ্ছিস! বোনতো ওই বদ লোকেরই। তাইতো তার মতোই রঙ দেখাচ্ছিস। বর্বর ভাইয়ের বর্বর বোন।”
বেচারা তানহা ভেবাচেকা খেয়ে গেল যেন। ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কি যাতা বলছিস! মাথায় গ্যাস জমেছে তোর! আর আমার ভাই একদমই অমন না। ভাইয়ার বদনাম সহ্য করবোনা আমি।”
আদ্রিতা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“উঁউউ..আইছে আমার ভাই দরদী। দুনিয়াতে খারাপের কোনো ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর থাকলে সেটা তোর ভাই। ওই বদ লোকের গুনগান আমার সামনে করলে তোর চুল সব ছিঁড়ে কাকের বাসায় দিয়ে দিবো আমি। তখন অপু ভাইয়ার সামনে ক্যামনে যাস দেখবো।”
“আরেহ! এসবের মাঝে ডক্টর সাহেব কে টানছিস কেন? টিভি সিরিয়ালের ভাবির মতো করছিস কেন? ভাইয়ার রাগ আমার উপর কেন দেখাচ্ছিস! ভাইয়ার সামনেতো ভেজা বিড়াল হয়ে যাস। আর আমাদের সামনে বাঘিনী সাজিস। কত পাড়িস যার রাগ তাকে গিয়ে দেখা।”
আদ্রিতা উঠে দাঁড়িয়ে তেজী সুরে বলল,
“তুই কি বলতে চাচ্ছিস, আমি ভয় পাই তোর ভাইকে! ভয় মাই ফুট। এই অরি কাউকে ভয় পায়না৷ ওটাতো আমার মা বাবার দেওয়া শিক্ষা অনুযায়ী ভদ্র মেয়ে হয়ে চলি আমি। তাই রাগ দেখাই না। নাহলে ওই বদ লোককে কে ভয় পায়! সিলেট থেকে আসতে দে একবার তাকে। এবার সে দেখবে এই অরির রাগ কি জিনিস।”

“আচ্ছা! তাই নাকি!”
নিজের মতো বলতে থাকা আদ্রিতা পেছনের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে থমকে গেল। বুঝতে পারলো তার বদ লোকটাই এসেছে। তবে সে পিছনে ফিরে তাকালোনা তার দিকে। মনের মাঝে জমানো পাহাড় সমান রাগ আর অভিমান ভরে রাখা আদ্রিতা নিবিড়ের দিকে না তাকিয়েই সোজা বড় বড় পা ফেলে তিন্নিদের রুমের দিকে চলে গেল। এই মুহুর্তে সে রুমে যাবে না। নিবিড়ের সামনে যাবেনা কিছুতেই। ওই কঠোর মানবের সাথে কোনো কথা নেই তার। তার কাছে কি অরির কোনো গুরুত্ব আছে! মোটেও না। তাইতো নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী যা খুশি তাই করে। কখনো তাকে জানানোর প্রয়োজনও মনে করেনা। তানা হলে সেদিন কিভাবে তাকে না বলেই সিলেট চলে গেল। আবার যখন ফোন দিলাম বলল আজকের মধ্যেই ফিরবে সে। অথচ আজ পুরো দু সপ্তাহ পার করে আসছেন জনাব। আসুক,তাতে আমার কি! আদ্রিতাতো পাঁচ দিন আগে থেকেই কথা বন্ধ করে দিয়েছে। ভেবেছিল তার অভিমান দেখে হলেও তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে সে৷ কিন্তু না,তার কাছেতো আদ্রিতার গুরুত্বই নেই। তাকে ছাড়া এতদিন থাকতে আদ্রিতার কত কষ্ট হয়েছে তাতেই বা কি যায় আসে তার। সেতো আরামেই ছিলো। কঠোর মানব যে সে। কিন্তু আদ্রিতাতো পারেনা অমন কঠোর হতে। তাইতো এতো পীড়া হয় তার। নিজের কান্না আটকিয়ে দ্রুত পায়ে তিন্নিদের রুমে ঢুকে যায় সে।

তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো নিবিড়। তানহা এগিয়ে এসে বলল,
“থ্যাংক গড,তুমি এসেছ ভাইয়া।আর কয়েকদিন গেলে তোমার বউ নির্ঘাত রানী কটকটি হয়ে যেত।”
নিবিড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে স্মিথ হেঁসে বলল,
“চিন্তা করিসনা। আমি সামলে নিবো। তুই গিয়ে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে আয়।”
“আচ্ছা ভাইয়া। আমি মাকে বলছি তুমি এসেছ।”

আদ্রিতা তিন্নিকে কোলে নিয়ে বিছানায় বসে আছে। তিন্নি কোলে বসেই তার পুতুল দিয়ে খেলছে। জুহি তিন্নির জন্য মিল্কশেক বানাচ্ছে। আদ্রিতা তিন্নির সাথে খেলার উছিলায় বসে আছে। তবে মনে তার বিষন্নতা ছেয়ে আছে। রাগে-অভিমানে ভেতরটা ফেঁপে উঠছে। হঠাৎই তিন্নি উচ্ছ্বসিত কন্ঠে চেচিয়ে উঠে বলল,
“টম চাচ্চু…..
তিন্নির ডাকে চকিত নজরে সামনে তাকালো আদ্রিতা। নিবিড়কে আসতে দেখে আবারও নজর সরিয়ে অন্য দিকে তাকালো সে। নিবিড়কে দেখে জুহি হাসিমুখে বলল,
” আরে নিবিড় এসেছ!”
নিবিড় সৌজন্যমূলক কিঞ্চিৎ হেঁসে বলল,
“হ্যাঁ ভাবি মাত্র এলাম।”
নিবিড় এগিয়ে গিয়ে তিন্নির সামনে এসে বসলো।তারপর কতগুলো চকলেটের প্যাকেট বের করে বলল,
“এগুলো কার জন্য!
তিন্নি তৎক্ষনাৎ লাফিয়ে নিবিড়ের কাছে গিয়ে সেগুলো লুফে নিয়ে বলল,
” আমাল এগুলো। সব চক্কেত আমাল।
জুহি বলল,
“তোমরা বসো, আমি তোমার জন্য কফি নিয়ে আসছি।”
বলেই জুহি বেড়িয়ে গেল। জুহি যেতেই আদ্রিতাও উঠতে নিলেই নিবিড় আদ্রিতার হাত চেপে ধরলো। আদ্রিতা হাত ছাড়ানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি করতে লাগলো। কিন্তু নিবিড়ের শক্ত বাঁধনের হাত থেকে ছাড়া পাওয়া তার জন্য বরাবরই দুষ্কর। তবুও সর্বস্ব চেষ্টা চালাচ্ছে সে। নিবিড় তিন্নির উদ্দেশ্যে বলল,
“মামুনি,যাওতো আম্মুকে গিয়ে বলো চাচ্চু কফি খাবে না জুস খাবে।”
তিন্নি ঘাড় কাত করে বলল,
“আচ্চা।”
বলেই বিছানা থেকে নামতে লাগলো সে। পরিস্থিতি হাতের বাইরে যেতে দেখে আদ্রিতা ফট করে বলে উঠলো,
“তিন্নি, নিচে দেখো কত্তবড় ইদুর!”
ছোট্ট তিন্নি তা শুনে ভয় পেয়ে চিল্লিয়ে উঠল। নিবিড় তখন তিন্নিকে দেখতে গিয়ে তার হাতের বাঁধন হালকা ঢিলা হলো। সেই সুযোগেই আদ্রিতা হাত ছাড়িয়ে দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তখনই রুমে ঢুকলো জুহি। অবস্থা বুঝতে পেরে বলল,
“অরি রেগে আছে বুঝি!”
নিবিড় ফিচেল হেঁসে বলল,
“হ্যাঁ ভাবি,পাগলিটা বোধহয় এবার একটু বেশিই ক্ষেপে আছে।”
“যাও এখন, মেহনত করে অভিমান ভাঙাও বউয়ের।”
নিবিড় মাথা চুলকিয়ে বেড়িয়ে গেল।

আদ্রিতা তিন্নিদের রুম থেকে বেরিয়ে সোজা রান্নাঘরের দিকে গেল। সেখানে তানি রাতের রান্নার আয়োজন করছে। আপাতত এটাই সবচেয়ে সেফ জায়গা যেখানে নিবিড় আসতে পারবেনা। আর আসলেও সোনা মায়ের সামনে কিছু বলতে বা জোড়াজুড়ি করতে পারবেনা। এই ভেবেই রান্নাঘরে আসলো সে। তানি তাকে দেখে বলল,
“কিরে, কিছু লাগবে?”
“নাহ,আমি তোমার হেল্প করতে এসেছি। তোমাকে এভাবে একা একা কষ্ট করতে দেখে আমার মতো ভদ্র মেয়ে কীভাবে বসে থাকতে পারে বলো!”
তানি মাথা নেড়ে হাসলো। সেকি আদ্রিতার এখানে আসার কারণ বুঝেনা! এসময়তো সেও একসময় পার করেছে। তবে মা হয়ে মেয়েকে এব্যাপারে কি’বা বলতে পারে সে। তাই বলল,
“আচ্ছা তাই! তা কি হেল্প করবি শুনি!”
“তুমি যা বলবে তাই।”
“ঠিক আছে আমাকে ডিম ফাটিয়ে দে।
আদ্রিতা প্রফুল্ল মনে ফ্রিজ থেকে ডিম বের করে আনলো। কিচেন সিংকের উপর ডিম রেখে তারপর কাঠের একটা তরকারি নাড়া খুন্তি হাতে নিয়ে কাঠে কুড়াল মারার মতো করে উপর থেকে সজোরে একটা বারি মেরে দিলো ডিমের উপর। সঙ্গে সঙ্গে ডিম ভেঙে ডিমের তরল পদার্থ চারদিকে ছিটকে পড়লো। তা দেখে তানিসহ কাজের মহিলাও হতভম্ব। অথচ আদ্রিতার মুখে বিশ্বজয়ের আভাস। যেন কত্তো মহান একটা কাজ সে এইমাত্র ঘটিয়ে ফেললো। এই অভূতপূর্ব মহান কাজের জন্য তাকে সর্বোচ্চ সম্মাননা পদক প্রদান করা অনিবার্য। তানি হতবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
” এটা কি করলি!”
“কেন,ডিম ফাটালাম। তুমিইতো বললে ডিম ফাটাতে। দেখো কত্তো সুন্দর ফাটিয়ে ফেলেছি। এখন বলো আর কি করতে হবে? ”
তানি অসহায় কন্ঠে বলল,
“মাফ কর আমার মা। আর কিছু করতে হবে না তোর। সব প্রতিভা আজই দেখালে শেষ হয়ে যাবে তো। আবার অন্য সময় দেখাস। এখন বরং গিয়ে আরাম কর হ্যাঁ! ”
আদ্রিতা জেদ ধরে বলল,
“দেখ আমি বলেছি না, আমি হেল্প করবো মানে করবো। আমাকে কাজ করতে না দিলে কিন্তু খাবারও খাবোনা বলে দিলাম। এখন বলো আমাকে আর কি করতে হবে? সবজি কাটবো? আমি তোমাকে সবজি কেটে দিচ্ছি দাঁড়াও।”
বলেই আদ্রিতা সবজি কাটার জন্য একটা করে সবজি চপিং বোর্ডে রাখছে আর ছু,রি দিয়ে আবার কাঠে কুড়াল মারার মতো করে দুই হাত উচু করে উপর থেকে ঠাস ঠাস করে সবজির উপর ফেলছে। যেন সবজি না,সে কাঠ কাটছে। কাজের মহিলা হতভম্ব হয়ে বলল,
“খালাম্মা, এই সবজি কি মাইনষের জন্য রান্দা হইবো নাকি গরু ছাগলের জন্য! ”
তানি বেচারির মাথায় হাত। এদের স্বামী স্ত্রীর মান-অভিমানের দায়ে আজ পুরো পরিবারের ভোগান্তি আছে কপালে।

অন্যদিকে নিবিড় বারবার লিভিং রুম থেকে রান্নাঘরের দিকে উঁকিঝুকি মারছে। তার রেগে থাকা বউটাকে একটু একা পাবার সুযোগ খুঁজছে। কিন্তু আদ্রিতার কাজকর্ম দেখে মনে হচ্ছে না তা খুব একটা সহজ হবে৷ কিছুক্ষণ পর নিবিড় গলার স্বর উঁচু করে বলল,
“অরি, আমার জন্য এক কাপ কফি নিয়ে আয়তো।”
আদ্রিতা তা শুনেও যেন শুনলো না।যেন আজকে তার নিবিড়কানা রোগ হয়েছে। নিবিড়কে না তার চোখে পড়ছে,না তার কথা শুনতে পারছে। তানি কফি বানিয়ে আদ্রিতাকে বলল,
“এই কফি দিয়ে আয়।”
আদ্রিতা সবজি কাটতে কাটতে বলল,
“পারবোনা। তোমার ছেলে, তুমি গিয়ে দাও।”
“আরে তোকেইতো নিয়ে যেতে বলল।”
“তো! দেখ আমি এখন অনেক বিজি। এসব কফি টফি দেওয়ার টাইম নেই আমার। তোমার ইচ্ছে হলে দাও নাহলে, না দাও। তোমার ইচ্ছে।”
তানি অগত্যা না পেরে কাজের মহিলার হাতে কফি পাঠিয়ে দিলো। কাজের মহিলাকে কফি আনতে দেখে নিবিড়েরও রাগ হতে লাগলো। সে কফির কাপটা ঠাস নিচে আছাড় মেরে ফেলে দিয়ে উপরে উঠে গেল। রুমে এসে কতক্ষণ পায়চারী করে নিজেকে একটু শান্ত করে রুম থেকেই উচ্চস্বরে ডাক দিয়ে বলে উঠলো,
“অরিইই…আমার ব্লাক টিশার্টটা কোথায় রেখেছিস। দিয়ে যাতো একটু। ”
একটু পর আবারও কাজের মহিলা এসে বলল,
“ভাইজান,টিশার্ট নাকি কাবার্ডের দ্বিতীয় ড্রয়ারে রাখছে আফা।”
বলেই চলে গেল সে। নিবিড়ের রাগ বাড়লো আরও। সামনের চেয়ারে লাথি মেরে দিলো রাগে।

সন্ধ্যার দিকে এসেছিল নিবিড়। এখন রাত নয়টা বাজে। এখনো পর্যন্ত আদ্রিতা কোনোভাবেই নিবিড়ের সামনে যায়নি, না তার সাথে কথা বলেছে। নিবিড় কতভাবে আদ্রিতাকে আলাদা করে ডাকছে। কিন্তু সে সব উপেক্ষা করে দিচ্ছে কঠোর হাতে। যেমন কঠোরতা নিবিড় করে তার সাথে৷ আজ যেন সেও সেটাই বিপরীতে প্রদান করছে। রাতের খাবার টেবিলেও আদ্রিতা নিবিড়ের পাশে না বসে অন্য জায়গায় বসলো। এতে যে নিবিড়ের রাগ বাড়ছে তাও যেন মালুম করছেনা আদ্রিতা। খাবার সময় তাসানও এসে হাজির হলো সেখানে। তারপর একটু পর অপরাহ্নও এলো। তাকে দেখে তানি ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেল আপ্যায়নে। হবেইনা বা কেন,হবু জামাতা বলে কথা। মাসখানেক আগেই তানহা আর অপরাহ্নের এঙ্গেজমেন্ট হয়েছে। আদ্রিতার সুস্থ হওয়ার প্রায় ছয় সাত মাস কেটে গেছে। এরমাঝেই একদিন অপরাহ্নের বাবা মা অপরাহ্ন আর তানহার প্রস্তাব নিয়ে আসে। তারা যে একজন আরেকজনকে পছন্দ করে সেটাও জানায়। অপরাহ্ন ছেলে হিসেবে তানি আবিরের কাছে অনেক ভালো লাগে। তবে মেয়েকে এই বয়সে এখনই বিয়ের ব্যাপারে মত দেয়না তারা। এমনকি তানহা নিজেও এখনই বিয়ে করতে চায়না।অন্তত স্টাডি কমপ্লিট না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে করতে চায়না সে। তাই অপরাহ্নের মা বাবা আপাতত এঙ্গেজমেন্ট করে রাখতে বলে। সেই মোতাবেক মাসখানেক আগে অপরাহ্ন আর তানহার এঙ্গেজমেন্ট হয়ে যায়।

অপরাহ্ন এসে তানির সামনে একটা বোল এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আন্টি মা আজ পিঠা বানিয়েছিল। এগুলো তানহা আর আপনাদের জন্য পাঠিয়েছে।”
তানি হাসিমুখে বলল,
“ও আচ্ছা, তুমি বসো। ডিনার করো সবার সাথে।”
অপরাহ্ন মাথা নেড়ে এগিয়ে গেল ডাইনিং টেবিলের দিকে। নিবিড়কে দেখে বলল,
“কিরে কখন এলি!”
“এইতো সন্ধ্যার দিকে। আয় বোস।”
জুহি তানহার পাশ থেকে উঠে যেতে যেতে দুষ্টুমি করে বলল,
“বসেন বসেন দুলাভাই। আপনার জনের পাশেই বসুন।”
অপরাহ্ন ফিচেল হেঁসে মাথা চুলকিয়ে আস্তে করে এসে তানহার পাশে বসলো। লজ্জায় কেমন জড়োসড়ো হয়ে গেল তানহা। এঙ্গেজমেন্টের পর থেকে পরিবারের সামনে অপরাহ্নের সামনে থাকতে তার কেমন যেন লজ্জা করে। সে চুপচাপ মাথা নিচু করে খেতে লাগলো।কিন্তু তাও যেন একটু পর দুষ্কর হয়ে গেল। যখন অপরাহ্ন টেবিলের নিচ দিয়ে সবার অগোচরে তানহার অন্য হাতটা নিজের মুঠোয় আবদ্ধ করে নিলো। খাবার যেন গলায় আঁটকে গেল তানহার তখনই। অগোচরেই ছাড়ানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি করেও কোনো সুফল পেলনা। অগত্যা সেভাবেই চুপচাপ বসে খাওয়ার চেষ্টা চালালো।

খাওয়ার মাঝে হঠাৎ আদ্রিতার বিষম উঠে গেল। তৎক্ষনাৎ নিবিড় উদ্বিগ্ন হয়ে দ্রুত পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো তার দিকে। তবে আদ্রিতা সেটা না নিয়ে অন্য একটা গ্লাস হাতে নিয়ে খাওয়া শুরু করলো। তা দেখে নিবিড় চোয়াল শক্ত করে তার হাতের গ্লাসটা ঠাস করে টেবিলের উপর রেখে দিলো। অবস্থার গম্ভীরতা বুঝতে পেরে অপরাহ্ন নিবিড়ের দিকে হালকা ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল,
“কিরে আবহাওয়া প্রচন্ড গরম মনে হচ্ছে।”
নিবিড় হতাশাজনক সুরে বলল,
“প্রচুর।”
“বউরে রাগাইলে এমনই হবে। আল্লাহ তোর উপর রহমত করুক। নাহলে আর গতি নাই।”

খাওয়া দাওয়ার পর সব ইয়াং স্টাররা সোফায় আড্ডা দিতে বসলো। যদিও নিবিড়ের এই আড্ডায় থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। সে শুধু কোনোভাবে আদ্রিতাকে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ খুঁজছে। কিন্তু আদ্রিতার ভাবতাল দেখে তা কেবলই দুষ্কর কাজ মনে হচ্ছে। আদ্রিতা তাসানের সাথে আড্ডায় মেতে গেছে। সে যে ইচ্ছে করে এমন করছে তা খুব ভালো করেই জানে নিবিড়। অপরাহ্ন তাসানের উদ্দেশ্যে বলল,
“কিরে কেমন চলছে দিনকাল তোর!”
তাসান হতাশ সুরে বলল,
“আর দিনকাল! এই জীবন কোনো জীবন হলো! আজ পর্যন্ত একটা গার্লফ্রেন্ড পাইলাম না। হালার এই হট হ্যান্ডসাম ছেলেটার ভরা যৌবনে কবে ঝাপ দিবে কেউ! আমার যৌবনতো পড়ে পড়ে বাসি হয়ে যাচ্ছে।কেউ চেখে দেখে না। কদিন পর মাছি পরা শুরু করবে। আজ সবগুলার জীবন শস্য শ্যামল হয়ে আছে।খালি আমার জমিন অনাবাদি পড়ে রইলো! নিবিড় ভাই বিয়া কইরা নিলো, এই হাতুরি ডাক্তারও ভেজাল ওষুধ খাইয়ে তানুকে পেয়ে গেল। আরে এই পর্যন্ততো তাও মানা যায়। কিন্তু দুদিনের ওই নূরান, যার দুধের দাঁতও এখনো পড়েনি। সেও এখন গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘোরে। আর আমাকে এসব চেয়ে চেয়ে দেখতে হয়। জীবনে কি পেলাম! না একটা হট গার্লফ্রেন্ড পেলাম, না পেলাম কোনো কিস, না ডেট পেলাম আর না পেলাম রুমডেট। আজ পর্যন্ত কেউ বেইজ্জত করলোনা আমাকে। এই বেঁচে থাকা কোনো বেঁচে থাকা হলো! আমি আর এই স্বার্থপর পৃথিবীতে থাকতে চাইনা। জীবন বোঝা হয়ে গেছে আমার কাছে।”
অপরাহ্ন সহমর্মিতা দেখিয়ে বলল,
“ব্যাস এইটুকু। এত্তো ছোট্ট একটা কাঁদছিস তুই! তোর এই ভাই আছে কিসের জন্য! আমি তোর সব সমস্যা দূর করে দিবো।”
তাসান খুশি মুখ করে বলল,
“সত্যি! কিভাবে! ”
“সিম্পল, একটা পয়জন ইনজেকশন দিয়ে দিলেই তুইও খতম, তোর কষ্টও খতম। না থাকবে বাঁশ, আর বাজবে বাঁশি। দেখেছিস কতবড় উপকার করলাম তোর। ধন্যবাদ দেওয়ার দরকার নেই।”
তাসান অসহায় সুরে বলল,
“ক, ক। দিন আমারও আইবো।”
আদ্রিতা বলে উঠলো,
“আর বাদ দাওতো ভাইয়া। এইসব প্রেম ভালোবাসা সব আজাইরা। এসবের মাঝে কিছু নেই।”
আদ্রিতার কথায় তীক্ষ্ণ, কটাক্ষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো নিবিড় তার দিকে। তাসান প্রতিত্তোরে বলল,
“তুইতো কথাই কইসনা। তোরাও ধোঁকা দিছস আমারে।”
আদ্রিতা হালকা অবাক সুরে বলল,
“আরে! আমি আবার কি করলাম!”
“তোরা দুইজনই আমারে ধোঁকা দিছস। এমনডা করতে পারলি আমার সাথে! কলিজার বোইন কইয়া কইয়া জিহবা ছিলে ফেললাম আর তুই এমন করলি। আমার হক মেরে দিলি! কত আশা ছিলো তোর বিয়া হইবো। তোর কিউট কিউট স্টবেরির মতো একগাদা ননদ থাকবো। তারা আইসা আমারে বিয়াই বিয়াই কইয়া শুরশুরি দিবো। কিন্তু তোরাতো আমার সেই হক মাইরা দিলি। ঘরে ঘরে বিয়ে করে নিলি। আরে দুইজন দুই জায়গায় বিয়ে করলে দুই জায়গার বিয়াইন পাইতাম। কত্তো মজা পাইতাম। আহা সেকি মজা! তোরা কাজটা ঠিক করলিনা। এই অসহায়ের হায় লাগবে তোদের।
আদ্রিতা নিবিড়কে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,
“তা যা বলেছ ভাইয়া। কাজটা আসলেই অনেক বড় ভুল হয়েছে। এটা করেতো আমি নিজেও পস্তাচ্ছি। অন্য কোথাও বিয়ে হলে তুমি যেমন বিয়াইন পাইতা তেমনি আমিও একখান সভ্য জামাই পাইতাম। কি আর করার বলো! নসিবে যদি থাকে করল্লা, কেমনে পাবে রসগোল্লা!”

ব্যাস,এই পর্যায়ে নিবিড় প্রতিক্রিয়া দেখালো। হাতের ফোনটা টি টেবিলের উপর ছুঁড়ে মেরে ঠাস করে উঠে দাঁড়াল সে। মুখমণ্ডল দৃঢ় কঠিন করে এগিয়ে যেতে লাগলো আদ্রিতার দিকে। ভাব সুবিধার মনে হলোনা আদ্রিতার। বুঝতে পারলো নিবিড় এখন ছাড়বেনা তাকে। নিবিড়কে আক্রমণাত্মক মনোভাব নিয়ে নিজের দিকে অগ্রসর হতে দেখে ধীরে ধীরে পেছাতে লাগলো আদ্রিতা। তারপর একসময় সে দৌড় লাগালো। পিছে ছুটলো নিবিড়ও৷ রাগী স্বরে বলতে লাগলো,
“অরি, দাঁড়া বলছি। এখন পালাচ্ছিস কেন! দাঁড়া বলছি।”
অরি গোল গোল দৌড়াতে দৌড়াতে তাসানের উদ্দেশ্যে বলল,
“ভাইয়া বাঁচাও। দেখ তোমার বোনের উপর কেমন সহিংসতা হচ্ছে।”
তাসান ন্যাকা স্বরে বলল,
“দুনিয়াতে একাই এসেছ, একাই যেতে হবে।নিজেরটা নিজেই দেখ বোইন। তোরে বাঁচাইতে গিয়া এই অকালে মরতে চাইনা আমি। এখনোতো বেইজ্জত হওয়াও বাকি আছে আমার।”
এদের কান্ড দেখে সব হাসতে লাগলো।

আদ্রিতা নিবিড়ের হাত থেকে বাঁচতে দৌড়াতে দৌড়াতে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে সোজা তানির রুমে গেল। তানি আবির মাত্রই শোবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।আদ্রিতাকে এভাবে আসতে দেখে তানি ভ্রু কুঁচকে বলল,
“অরি! কি হয়েছে!”
আদ্রিতা কিছু একটা ভেবে ফট করে বলে উঠলো,
“কি আবার হবে! কিছুই না। আসলে আমি আজ তোমার সাথে ঘুমাতে এসেছি। আমার আজ তোমার কাছে শুতে ইচ্ছে করছে? দিবেনা শুতে?”
বলতে বলতে আদ্রিতা এগিয়ে গিয়ে বিছানায় তানির পাশে বসে পড়লো। তানি মুচকি হেঁসে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে। আয় আমার কাছে শো।”
বেচারা আবির অসহায় চোখে তানির দিকে তাকিয়ে বলল,
“তাহলে আমি!”
আদ্রিতা বলে দিলো,
“তুমি তোমার ছেলের কাছে গিয়ে শোও চাচ্চু। সে অনেক খুশি বাবাকে পেয়ে।”
আবির বেচারা করুন মুখ করে রুম বেরিয়ে এলো। আবির যেতেই তানি আর আদ্রিতা একসাথে হেঁসে দিলো।

আবির বাইরে এসে দেখলো নিবিড় দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে আবির বলল,
“দেখ তোর জন্য আজ প্রথমবার বউ ছাড়া থাকতে হচ্ছে। নিজেতো বউ হারালি। ফ্রি-তে আমার বউও হারালাম।”
নিবিড় গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“আমার কথা মানলে কেউই বউ হারা হবোনা।শুধু আমার কথা মতো কজ করো।”
নিবিড় আবিরকে একটা বুদ্ধি শিখিয়ে দিলো। সেই মোতাবেক আবির তানিকে ডাক দিয়ে বলল,
“তানি গেস্ট রুমের বিছানাটা একটু ঝেড়ে দিয়ে যাওনা।”
আবিরের ডাক শুনে তানি আদ্রিতাকে রেখে বেড়িয়ে গেস্ট রুমের দিকে গেল। ঠিক তখনই ঝড়ের বেগে নিবিড় রুমে ঢুকে বিছানায় শুয়ে থাকা আদ্রিতাকে এক ঝটকায় কোলে তুলে নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে এলো।আদ্রিতা ছাড়া পাওয়ার হাত পা ছড়াছড়ি করেও সুফল পেলনা। তানি ফিরে এসে আদ্রিতাকে রুমে না দেখে বলল,
“অরি কই গেল!”
আবির ফট করে তানির হাত ধরে রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
“যে যার সঠিক স্থানে পৌঁছে গেছে।”

নিবিড় আদ্রিতাকে কোলে নিয়ে নিজের রুমের ঢুকে বিছানার উপর একপ্রকার ছুড়ে মারল তাকে। তারপর গিয়ে দরজার ছিটকানি লাগিয়ে দিলো। দরজা লাগিয়ে চোয়াল শক্ত করে রাগী চোখে তাকিয়ে তেড়ে গেল আদ্রিতার দিকে। তাকে আসতে দেখেই অভিমানে ক্ষিপ্ত আদ্রিতা উল্টো দিকে ঘুরে ঘাপটি মেরে শুয়ে রইল । নিবিড় প্রথমে রাগের বশে তেড়ে গেলেও, পরে তার পুতুলের অভিমান ভাঙাতে বিছানায় এসে পেছন থেকে কোমড়ে হাত গলিয়ে জড়িয়ে ধরলো আদ্রিতাকে। তার আলিঙ্গনে অভিমানী মনটা আরও ছটফটিয়ে উঠলো। নিবিড়কে সরিয়ে দিতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করলো। কিন্তু বরাবরের মতোই তাতে বিন্দুমাত্র কাজ হলোনা। বরং নিবিড় দু হাতে আদ্রিতাকে ঘুরিয়ে নিজের বক্ষ মাঝে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো শক্ত করে। তাতে আদ্রিতার ছটফটানি বাড়লো যেন।ছাড়া পাওয়ার জন্য খুব করে হাত পা ছড়াছড়ি করছে। কিন্তু নিবিড়ের শক্ত বাঁধন থেকে ছাড়া পাওয়া কোমল আদ্রিতার পক্ষে কবেই বা সম্ভব হয়েছে। নিবিড় শক্ত হাতের বাঁধনে মিশিয়ে নিয়েছে অভিমানী পাখিটাকে। ছুটতে দেবার পথ নেই। আদ্রিতা অনেক চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারলোনা নিজেকে।দুই হাতে নিবিড়ের বুকে প্রহার করতে করতে বলতে লাগলো,
“ছাড়ুন আমাকে।ছাড়ুন বলছি…
নিবিড় ছাড়লোনা তাকে। বরং আরও শক্ত করলো হাতের বাঁধন। যেন হৃদপিণ্ডের মাঝে সামিল করে নেওয়ার প্রচেষ্টা। এবার যেন নিজের আঁটকে রাখা কান্না ধরে রাখতে পারলোনা আদ্রিতা । নিবিড়ের বুকের মাঝেই ফুঁপিয়ে উঠলো সে। কান্নার সুর কম আর ফোঁপানোর কম্পন বেশি হচ্ছে। হাত পায়ের ছটফটানো কমে এলো। বুকের মাঝে মুখ রেখে কাঁদছে সে। কান্নার সাথে কেঁপে কেঁপে উঠছে তার কোমল বদনখানি। খানিক বাদে কান্নার সুর একটু কমে আসলে নিবিড় বলে উঠলো,
” কান্না থামলো জরিনার মায়ের!”

যা একটু নরম হয়েছিল আদ্রিতা, নিবিড়ের কথায় আবারও ক্ষেপে গেল সে৷ দুই হাতে নিবিড়ের বুকে ঠেলে সরে আসতে চাইলো সে৷ কান্না জড়িত গলায় বলল,
“ছাড়ুন আমাকে। খুব পঁচা আপনি। খুব পচা।”
নিবিড় হেঁসে উঠে আরও শক্ত করে বাহুডোরে আটকালো পাখিটাকে। নরম সুরে বলল,
“এই পাগলি সরি তো। আর কতো শাস্তি দিবি! তোর কি মনে হয় আমি মনের খুশিতে তোর থেকে এতদিন দূরে থেকেছি। সেদিন হঠাৎ আমাদের সিলেটের ফ্যাক্টরিতে একটা গুরুতর সমস্যা দেখা দেয় তাই ইমার্জেন্সি যেতে হয়েছিল আমাকে। ভেবেছিলাম ঝামেলা শেষ করে সেদিনই ফিরে আসবো। কিন্তু ওখানে যাওয়ার পর হঠাৎ ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগে যায়।”
আগুন লাগার কথা শুনে আৎকে ওঠে আদ্রিতা।ঝট করে মাথা তুলে ভয়ার্ত চোখে তাকালো নিবিড়ের মুখপানে। কাঁপা কাঁপা হাতে নিবিড়ের মুখটা ধরে আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,
“আ….আগুন! আগুন লেগেছিল! আপনার কিছু হয়নিতো! কোথাও লাগেনিতো আপনার! বলেন না!”
নিবিড় তার মুখে রাখা আদ্রিতার হাতটা নিজের অধরের উপর নিয়ে চুমু খেয়ে, হাতটা নিজের গালে ধরে রেখে বলল,
“কিচ্ছু হয়নি আমার। একদম ঠিক আছি আমি। আর আগুনও তেমন ভয়াবহ ছিলোনা। তাই কোনো স্টাফও তেমন আহত হয়নি। তবে ফ্যাক্টরির মেশিন, মালামাল অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর আগুন ধরা নিয়ে পুলিশেরও ঝামেলা হয়েছিল। তাই সেখানে থেকে এগুলো সলভ করতে করতে এতদিন সময় লেগেছে।”

“তো এসব আমাকে আগে বলেননি কেন? যাওয়ার আগেও আমাকে বলেও যাননি।”
“কারণ আমি তোকে আগে বললে তুইও আমার সাথে যাওয়ার জন্য জিদ করতি। সামনে তোর এইচএসসি পরীক্ষা। এই সময় ওখানে গেলে তোর পড়াশোনার ক্ষতি হতো। তাছাড়া ওখানে আমি সারাদিন ব্যাস্ত থাকতাম। রাতের ১২/১ টা পর্যন্ত বাইরে থাকতে হতো আমাকে। তখন একা একা তুই কিভাবে থাকতি! আর তোকে একা রেখে আমি কিভাবে কাজে মনোযোগ দিতে পারতাম!”
আদ্রিতা অভিমানী সুরে বলল,
“এসব শুধু অজুহাত। আসলে আপনি আমাকে সাথে নিতেই চান না। আমাকে কোনোকিছু জানানো গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না। তাইতো এত কঠোরতা দেখান। এত কঠোর কেন আপনি?”
নিবিড় আদ্রিতার গালে আঙুল বুলিয়ে বলল,
“কারণ তুই যে কোমল পুষ্প। তোকে আগলে রাখতে এই মানবকে লৌহ মানবতো হতেই হবে।”
“আমাকে রেখে এতদিন থাকতে একটুও খারাপ লাগেনি আপনার? একটুও কি মনে পড়েনি আমার কথা? ”
নিবিড় মাথাটা ঝুঁকিয়ে আদ্রিতার মুখের একেবারে কাছাকাছি চলে এলো। নাকে ঠেকলো নাক,নজরে নজর আর কপালে কপাল। চোখের নজরে নেশা ঢেলে নিবিড় বলল,
“মনে তাকে পড়ে যাকে ভোলা যায়। তুইতো সেই প্রাণঘাতী বি,ষ যা আমার সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। তোর নামেই চলে আমার নিঃশ্বাস। ফুরাবে যেদিন নিঃশ্বাস সেদিনও তুই মিশে রবি আমার রুহুতে।”
নিবিড়ের হৃদয় নিংড়ানো মায়াময় কথায় আদ্রিতার সকল অভিমান নিমিষেই গলে পানি হয়ে গেল। থেকে গেল শুধুই মোহনতা। ওই যাদুকরী পুরুষের ঘাতক নজরের তীর হৃদয়ে কম্পন জাগাচ্ছে ক্রমশ। নিঃশ্বাসে মিশছে তার তপ্ত নিঃশ্বাস। নিবিড় অধর ছোঁয়াল আদ্রিতার কপালে। অধরের স্পর্শ পেল আদ্রিতা তার চোখে, নাকে, গালে। গভীর স্পর্শ নেমে এলো তার ওষ্ঠে। ওষ্ঠদ্বয়ের মিলনে দুজনের মাঝে ছড়ালো মধুরতা। খানিক বাদে আদ্রিতার কাঁধে নেমে অধরের মাতাল স্পর্শে শিহরিত করলো নিবিড়। বিমোহিত আদ্রিতা হাতের মাঝে আঁকড়ে ধরলো নিবিড়ের চুল। একে অন্যের ঘ্রাণে মিলেমিশে একাকার হলো দুজন। ভালোবাসার সেই মিলন মেলার মাধুর্য ছড়ালো রুমের দেয়ালে দেয়ালে। রুপালী চাঁদটাও যেন জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখছে তাদের সুখময় মুহূর্ত। ভালোবাসার সাক্ষী হতে তারও যেন খুশি হচ্ছে।
__

রাত তখন দুটো প্রায়।দুজন দুজনাতে লিপ্টে মিশে শান্তির ঘুমে মগ্ন তখন। হঠাৎ ঠাস চোখ খুলে তাকালো নিবিড়। চোখে মুখে তীব্র আতঙ্কের ছাপ। ঘেমে জবজবে মাথা কপাল।চোখ খুলেই ধড়ফড়িয়ে ঝট করে উঠতে নিলেই বাঁধা পেল বক্ষস্থলে ঘুমিয়ে থাকা আদ্রিতার কারণে। আর উঠলনা নিবিড়। প্রাণভোমরাটাকে বুকে দেখে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ার চেষ্টা করল। তবে আদ্রিতার ঘুম ভেঙে গেল নিবিড়ের হঠাৎ এভাবে ধড়ফড়িয়ে নড়ার কারণে।ঘুম ভাঙতেই টের পেল নিবিড় কেমন হাঁপাচ্ছে। শরীরও মৃদু কাঁপছে। আদ্রিতা ঘাবড়ে গেল। মাথা তুলে ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
“কি হয়েছে আপনার?”
আদ্রিতা দ্রুত বিছানার পাশের টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালাল। নিবিড়ের মুখের দিকে তাকাতেই আৎকে উঠল সে। নিবিড়ের মুখে হাত বুলিয়ে আতঙ্কিত কন্ঠে বলল, “কি হয়েছে আপনার এমন করছেন কেন? বলুন না! ”
নিবিড় নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করে বলল,
“কি আবার হবে! এমন ড্রাকুলার মতো নাক ডাকছিস, আরেকটু হলেই হার্টটা ফটাস করে ফেটে যেত আমার।এমনিতেই তোর মতো পেত্নী নিয়ে শুয়ে থাকি। তারওপর এভাবে নাক ডেকে পুরো ভুতুড়ে পরিবেশ করে দিচ্ছিস। মাছুম ছেলেটা ভয় পাবেনা!”
নিবিড়ের কথাগুলো জ্বলানোর উদ্দেশ্যে হলেও আদ্রিতার মুখে কোনো রাগের আভাস এমুহূর্তে ছিটেফোঁটাও নেই। বরং আদ্রিতার দুচোখে নোনাজলে টইটুম্বুর হলো সহসাই। চেহারায় ভেসে উঠল প্রিয়র জন্য মায়াময় বেদনা।আরেকটু ঝুঁকে নিবিড়ের গালে হাত বুলিয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে আদ্রিতা বলল,”মিথ্যে বলছেন কেন? আপনি আবারও আমাকে নিয়ে সেই দুঃস্বপ্ন দেখেছেন তাইনা? আমি জানি আপনি ঠিক নেই।”
নিবিড় আদ্রিতাকে ঘুরিয়ে বালিশে শোয়াল। নিজে এবার ঝুঁকল তার উপরে। বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে আদ্রিতার চোখের অশ্রু মুছে পরম আদরে চুমু এঁকে দিলো কপালে। কপালে কপাল ঠেকিয়ে রেখে বলল, “তুই ঠিক আছিস। তো সব ঠিক আছে। তুই এই বুকে আছিস মানেই নিবিড়ের পৃথিবী ঠিক।”
আদ্রিতা ফুঁপিয়ে উঠে দ্রুত বেগে হামলে পড়লো নিবিড়ের বুকে। দুই হাতে সর্বশক্তি দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো প্রিয়তমকে। যেন একটু হাত ঢিলা হলেও হয়তো পালিয়ে যাবে সে। নিবিড়ের উন্মুক্ত বুকে অধর ছোঁয়াল আদ্রিতা। পরপর চুমুয় চুমুয় ভরিয়ে দিলো নিবিড়ের বুকজমিন।অশ্রুসজল চোখে নিবিড়ের বুকের সাথে খুব নিগূঢ় ভাবে মিশে রইলো।নিজেকে আজ খুবই ছোট মনের মনে হচ্ছে আদ্রিতার। এই লোকটার উপর রেগে ছিলো সে! যার
সূচনা থেকে শেষ শুধুই আদ্রিতাতে। আজ ছয় মাস হয়ে গেছে আদ্রিতার সুস্থ হওয়ার। তার অসুস্থতার প্রভাব আদ্রিতার নিজের কাছ থেকে কবেই কেটে গেছে। কিন্তু নিবিড়ের উপর থেকে এখনো যেন পুরোপুরি কাটেনি সেই আতঙ্ক। এখনো মাঝে মধ্যেই রাতে এভাবে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘাবড়ে ওঠে নিবিড়। যেন সে আবারও আদ্রিতাকে হারিয়ে ফেলার মতো ভয়ানক স্বপ্ন দেখেছে। তখন ঘুম থেকে এভাবেই জেগে ওঠে সে।আদ্রিতা ভেবে পায়না কেউ এতটাও কিভাবে ভালোবাসতে পারে! আদ্রিতা কি কখনো তার ভালোবাসার সমতুল্য করতে পারবে! এক জীবনে হয়তো সম্ভব না তা৷ এসব ভেবে আদ্রিতার চোখের জল নিরবে গড়িয়ে পড়ছে। সে আবারও অধর ছোঁয়াল নিবিড়ের বুকে। নিবিড় বুঝলো তার কোমল হৃদয়ের বউটা হয়তো একটু বেশিই আবেগী হয়ে পড়েছে। তাকে স্বাভাবিক করতে নিবিড় আদ্রিতাকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায়ই মজার সুরে বলল,”মনে হচ্ছে আজ আমাকে সারারাত পরিশ্রম করার ধান্ধা করছিস তুই। দেখ আজ জার্নি করে এসেছি। অনেক টায়ার্ড আমি৷ আজ আর খাটাস না। কাল নতুন উদ্যমে শুরু করবো ঠিক আছে।”
আদ্রিতা নিবিড়ের বুকে আলতো করে কিল মেরে দিলো। হাসলো নিবিড়। হেঁসে বউটাকে আরও শক্ত করে বুকের মাঝে মিলিয়ে নিলো।
___

মধুর রাতের শেষে ভোরের আলো ছড়ালো ঘরে। চোখ খুলে নিজেকে নিবিড়ের বাহুডোরের চাদরে জড়ানো পেল আদ্রিতা। বুক থেকে মাথা তুলে নিবিড়ের মুখের দিকে তাকালো আদ্রিতা। মুগ্ধ নজরে তাকিয়ে রইলো ঘুমন্ত নিবিড়ের মুখপানে। হাত বাড়িয়ে নিবিড়ের খোঁচা দাঁড়িতে বোলালো কতক্ষণ। গত কয়েকদিন এই সকালটা সে মিস করেছে। আজ পেয়ে সব পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে। আদ্রিতা এখন আর নিজের একটুও নেই। তার সবকিছু শুধু এই মানবটাতেই আবদ্ধ। এইযে এখন মানবটা ওর কাছে আছে। এখন আদ্রিতার পৃথিবী রঙিন। সবকিছু এখন মধুময়। সব সুখময়। আদ্রিতা নিবিড়ের উন্মুক্ত বুকের মাঝে গভীর ভাবে চুমু খেয়ে নাক ঘষলো বুকে।নিবিড়ের পিঠে হাত রেখে আরও গভীর ভাবে মিশে গেল তার উষ্ণ বুকে। নিবিড়ও হালকা নড়ে উঠে হাতের বাঁধন আরও শক্ত করে তার পুতুল বউকে মিশিয়ে নিলো তার সাথে। মুখে হাসির রেখা ছড়ালো আদ্রিতার। যার অর্থ আপনি আছেনতো আমার হৃদকুঞ্জে বাহার।

®মেহরুমা নূর

(সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা। আমার পক্ষ আমার পাঠকদের ঈদের সালামি☺️।
স্পেশাল পর্ব নিয়ে কিছু কথা বলে রাখতে চাই।ধারাবাহিক আকারে গল্প শেষ হয়ে গেছে। স্পেশাল পর্ব ধারাবাহিক ভাবে নিয়মিত হবে না। এটা অণুগল্পের মতো মাঝে মধ্যে যখন ইচ্ছে হবে দিবো। তাই নেক্সট কবে দিবো এটা কেউ জিজ্ঞেস করবেন না। আর সবচেয়ে বড়ো কথা স্পেশাল পর্ব পরবর্তীতে আর দিবো কি, না দিবো সেটা আজকের রেসপন্সের উপর নির্ভর করে। রেসপন্স ভালো না এলে আর স্পেশাল পর্ব দিবোনা।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here