#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩৫
আকাশ আজ মেঘলা। মাঝে মাঝেই থেমে থেমে বৃষ্টি। না বেশি, না কম৷ ইলশেগুঁড়ি যাকে বলে আরকি। এই মুহুর্তে বেশ ঠান্ডা ও লাগছে পৌষ’র। গরম গরম খিচুড়ি খাওয়া ই যায় কিন্তু না। তৌসিফ তাকে শান্তি দিচ্ছে না। এখনই রেডি হতে বলছে ওকে। পৌষ এত করে বলছে কোথায় যাবে উত্তর নেই এর। শেষে হাল ছাড়লো পৌষ। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে আড়চোখে একবার তৌসিফ’কে দেখে নিলো। তৌসিফ সাহেব আজ খুবই ব্যস্ত। আপ টু টো সে আজ ফিটফাট হচ্ছে যদিও এটা সে বরাবরই থাকে। হঠাৎ ই সে ওয়াশরুম ঢুকলো। মিনিট এক যেতেই ওখান থেকেই চেঁচিয়ে উঠলো,
— হানিই?
আচমকা ডাকে পৌষ ভয় পেয়ে গেলেও নিজেকে সামলালো। বুঝে উঠার আগেই তৌসিফ পুণরায় ডাক দিলো,
— পৌষরাত?
রুম থেকেই উত্তর দিলো পৌষ,
— কি হয়েছে? কি চাইছেন আপনি?
তৌসিফ হাতে কিছু একটা নিয়ে বেরিয়ে এলো। পৌষ অবুঝ দৃষ্টি ফেলতেই তৌসিফ অল্প গরম হওয়া স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
— এটা কি?
পৌষ উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো। তৌসিফে’র হাতে তার স্কিন কেয়ার করার কিছু একটা। পৌষ ছোট্ট একটা ঢোক গিললো। লোকটা কি রেগে যাবে। তৌসিফ ওর উত্তর না পেয়ে ছোট্ট করে ধমক দিলো,
— কথা বলো!
পৌষ দুই পা পিছিয়ে গেলো। তৌসিফ বরাবরই তার স্কিন নিয়ে সেনসেটিভ। তার স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট গুলো ডারমাটোলজিস্ট দিয়ে কনসাল্ট করা। এটা একদমই নতুন একটা মসচুরাইজার। নতুন এটার প্যাকেট অবদি খোলা হয় নি অথচ এখন খুলতেই দেখলো সাইড থেকে একটু নেই। এই কাজ করার সাহস এই বাড়ীতে কারো নেই তাহলে এর অর্থ কি দাঁড়ায়? কে ধরেছে এটা? ধরেছে বললে ভুল হবে রিতীমত ছিনিমিনি খেলা হয়েছে। পৌষ একটু কাঁচুমাচু মুখ করে তাকালো। তৌসিফ হাতের কাঁচের কৌটাটা পাশে রেখে এগিয়ে এলো। অল্প রাগের সহিত জিজ্ঞেস করলো,
— সত্যি করে বলো কি করেছো?
পৌষ চুপ রইলো না। মুখ খুলে বলে উঠলো,
— একটু টেস্ট করেছিলাম।
তৌসিফ ফাটা চোখে তাকালো। অসহায় দৃষ্টি ফেলে বলে উঠলো,
— এটা টেস্ট করার কিছু?
— ঐ একটু মন চাইলো। আপনার কম পরলো কি? একদিন একটু কম লাগালে কি ই বা হবে? আসলে স্মেলটা এত সুন্দর সাথে ফ্লেবারও ভালো তাই সহ্য করতে পারলাম না। একটু খেয়ে নিলাম। ভালোই ছিলো। বিশ্বাস না হলে আপনি ট্রাই করে দেখুন।
তৌসিফ বড় বড় চোখ দিয়ে তাকিয়ে রইলো। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করলো,
— আগে পরে আরো খেয়েছো?
পৌষ মাথা নাড়লো ভদ্রতার সহিত। একবার ভাবলো তৌসিফ বুঝি রেগেই গেলো কিন্তু কপাল ভালো বলে কথা। তৌসিফ ওর হাত ধরে নিজের কাছে নিলো। পাশে বসিয়ে মাথায় হাত রেখে বললো,
— মেডিসিন গুলো ঠিক মতো নিচ্ছো না?
বড় চোখ দিয়ে তাকিয়ে পৌষ ফটাফট বলে উঠলো,
— রোজ খাই। সকালে দুটো রাতে তিনটা। দুপুরের টা এই তো মাঝে মধ্যে মিস যায়।
মিথ্যা মাঝেমধ্যে শুনলেই বুঝা যায়। পৌষ’র কথার ধরণ ও তাই। তৌসিফ হতাশার শ্বাস ফেলে বললো,
— তুমি তো জানো তোমার আয়োডিন ডেফিসিয়েন্সি আছে। তবুও কথা শুনো না৷ কেন নিচ্ছো না মেডিসিন?
পৌষ চোরের মতো ধরা পরে মুখটা ও চোরের মতো ই করলো। এখন ভাই, ভাব আর কাজের তো মিল দরকার। ক্লাসে “ভাব ও কাজ” বাংলা বইতে পড়েছে পৌষ। ভাবের সাথে অবশ্য ই কাজের মিল দরকার নাহয় বাস্তবায়ন ঘটবে কিভাবে?
এখন তো বড় গলায় ডাকাতের মতো কথা বলা যাবে না।
পৌষ তবুও বললো,
— ওটার জন্য শুধু মাথা ঘুরায় একটু।
— একটু?
যাহ্। গেলো তো ফেঁসে। বসা থেকে সোজা হয়ে দাঁড়ালেই তো মাথা ঘুরান্টি দেয়। তৌসিফ ওর হাতটা ধরলো। মুঠোয় পুরে বললো,
— মাটি, চক এসব জিনিস অনেকের খেতে মন চায়। জানো এর কারণ কি?
পৌষ মাথা নাড়লো। সে জানে না। তৌসিফ বললো,
— এক হয় যখন কোন মেয়ে প্রেগন্যান্ট থাকে। তখন মুডের উপর ডিপেন্ড করে এসব উদ্ভব কিছু খেতে মন চায়। কথা হলো তুমি তো আমার বাবুর আম্মু এখন হচ্ছো না।
— হব একদিন।
একদম মুখের উপর প্রতিবাদ। তৌসিফ এখন যথেষ্ট সিরিয়াস তাই গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
— তোমার কারণ হলো দুই নাম্বারটা। আয়োডিন ডেফিসিয়েন্সি থাকলেও মানুষ এসব খেতে চায়। তোমার স্টেজ হাই পৌষরাত। মেডিসিন গুলো প্লিজ কনজিউম করো। এভাবে সমস্যা বাড়বে। বিশ্বাস করো আমাকে, তুমি কাঁদতে কাঁদতে আধ ম’রা হয়ে গেলেও আমি হসপিটালেই রাখব তোমাকে। তোমাকে আমার সুস্থ চাই একদম। বুঝেছো?
পৌষ মাথা নাড়লো। মানে ও বুঝেছে। না বুঝে উপায় নেই। বুঝতে তাকে হবেই। এসব মাটি জাতীয় কিছু দেখলেই তার খেতে মন চায়। খুব করে মন টানে। তৌসিফ ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে এবার কিছুটা নরম হলো। নরম স্বরে এসব বুঝালে পৌষ কানে তুলবে না কাধা হলো। পৌষ মাথা নেড়ে বুঝালো ও বুঝেছে। তৌসিফ এই দফায় বউ’কে কাছে টেনে নিলো। চুলগুলো হাতড়ে দিতে দিতে৷ বললো,
— তারাতাড়ি তৈরী হও হানি।
পৌষ ঝটাক মে’রে হাত সরালো। নিজেও সরতে সরতে মিনমিন করে বললো,
— এতক্ষণ ভেচকি দিয়ে এখন ঢং। আলগা পিরিত দেখায়।
তৌসিফ শুনলো তবে কিছু বললো না। নিজে যথাসম্ভব সুন্দর ভাবে তৈরী হলো। পারফিউম দিতে দিতে চারদিক মাতোয়ারা করে ফেললো যেন। পৌষ কোনমতে হিজাব বেঁধেই বিছানায় বসে রইলো। আড় চোখে বিরক্ত হয়ে তৌসিফে’র রংঢং দেখলো একটু। বেশ খানিক সময় পর রেডি হলো তৌসিফ। পকেটে মানি ব্যাগ ঢুকাতে ঢুকাতে বললো,
— লেট হচ্ছে তো হানি। তারাতাড়ি করো।
পৌষ’র মন চাইলো তৌসিফে’র ঐ সুন্দর মুখটা খামচে ধরতে। ব্যাটা খ’বিশ বলে কি? পৌষ নাকি লেট করছে। বাটপার কোথাকার! মিনমিন করতে করতে পৌষ উঠে দাঁড়ালো। তৌসিফ জুতা পরতে বসেছে। পৌষ পা ভেঙে বসতেই ওর কোলে পা তুলে দিলো তৌসিফ। এটা যেন তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। জুতা পরাতেই তৌসিফ উঠে দাঁড়ালো। বউয়ের হাত ধরে বললো,
— চলো।
________________________
সোহা বাসায় রাগে ফুঁসছে। বিয়ে ও কিছুতেই করবে না। এতটা বছর এখানে কেন আছে ও? এই তৌসিফে’র জন্য ই তো। সোহা মাথা পেতে বদনাম নিয়েছে। টু শব্দ করে নি। এই সংসার ও নিজ হাতে সামলেছে। দুই দিনের মেয়ে পৌষ। উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। এক থাবায় সংসারটা আঁচলে বেঁধে নিয়েছে। সোহা টু শব্দ করার সুযোগ পায় নি। মানুষ হারালো। সংসার হারালো এখন শেষ এই বাড়ীটাও ছাড়তে হচ্ছে।
মাথা চেপে ধরে গুঙিয়ে উঠে সোহা। মিনু ভয় পেয়ে গেলো। দৌড়ে এসে ভয়ে ভয়ে ডাকলো,
— আপা।
— যা এখান থেকে।
— তোমার কি হয়েছে আপা?
— যাহ বলছি।
মিনু যায় না। এটা তার অভ্যাস। ঠিট প্রকৃতির সে। সোহা নিজের মাথা ঠুকরে দিতে দিতে বললো,
— বিয়েটা আটকাতে পারি নি। তৌসিফ হাত ছাড়া হলো? কেন হলো? আমি কেন পেলাম না ওকে। এত আদর, যত্নে রাখলাম। তবুও পেলাম না৷ কেন পেলাম না? কি নেই আমার? ঐ মেয়ে থেকে হাজার গুন সুন্দর আমি। ও কেন মোহে পরলো না? তৌসিফ!!!
সোহার পা’গলাটে কথায় মিনু চমকে তাকালো। অবাক স্বরে প্রশ্ন করলো,
— মামা’কে তুমি ভালোবাসো আপা?
সোহা চিৎকার করে উঠে,
— ও কেন বুঝে না? কেন না?
মিনু হতবাক হয়ে গেল। সেভাবেই বলে উঠলো,
— তোমাদের না বাবা এক?
সোহা মাথা তুললো। রাগে হিসহিসিয়ে বললো,
— এক না, এক না, এক না। তৌসিফের বাবা আমার বাবা না। কিচ্ছু না সে আমার। আমি আমার মায়ের আগের ঘরের সন্তান। তৌসিফে’র বাবা’কে মা মিথ্যা বলেছে। আমি ঐশি না। ঐশি ছিলো তৌসিফের বোন। ও মা’রা গিয়েছে। মা আমাকেই এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে। শুধু মাত্র সম্পদের জন্য। কিভাবে যে মন দিলাম। সব লোভ ত্যাগ করে তাকে চাইলাম। কিচ্ছু পেলাম না আমি। কিচ্ছু না৷
হঠাৎ ই যেন সোহা পা*গল হলো। কান্নার মাঝেই হেসে উঠলো। মিনু হতবাক বিমূঢ় হয়েই রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। সোহা তখনও বিরবির করছে। ও কিছুতেই বিয়ে করবে না। তৃতীয় বউ হতে তার কোন সমস্যা নেই যদি সামনের পুরুষ তৌসিফ তালুকদার হয়।
.
তৌসিফে’র গাড়ি নিজের বাড়ীতে থামতে দেখেই পৌষ লাফিয়ে উঠলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে এক দৌড়ে গাড়ি থেকে নামতে নিলেই তৌসিফ ওর হাত টেনে ধরলো। অসহায় দৃষ্টি ফেলে তাকায় পৌষ। তৌসিফ সামনে তাকিয়ে বউয়ের হাতে চুমু দিয়ে বলে,
— একসাথে যাব।
হঠাৎ ই পৌষ বলে উঠলো,
— কিছু আনলেন না?
তৌসিফ না বুঝেই বললো,
— কি আনব?
— আজব কথা বলেন মিয়া? প্রথম বার শশুর বাড়ী এলেন কিছু তো আনবেন? এত টাকা অথচ কিপটার কিপটা আপনি। মিষ্টি ই আনতেন। নাক রাখলেন না আমার।
বলেই মুখ কুঁচকালো। তৌসিফ পাত্তা দিলো না। বললো,
— আমাকে চুমু দাও।
পৌষ খিটমিট করে উঠলো,
— হ্যাঁ, এটাই তো আছে। সরুন। বের হতে দিন।
তৌসিফ ছাড়লো। নিজেও বের হলো। এক দৌড়ে বাড়িতে ঢুকলো পৌষ। গেটেই দাঁড়িয়ে সকলে। এক ধাক্কায় চাচির বুকে পরলো পৌষ। চাচি কেঁদে উঠলেন৷ বাড়ীর বড় মেয়ে। এ যে কত আদরের তা সবাই জানে। দায়িত্ব আর কিছু ওয়াদা পালনে মেয়েটাকে জোর করে বিয়ে দেয়া হয়েছে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভুল ছিলো না সিদ্ধান্ত। মায়ের মন সন্তানের চেহারা দেখেই বুঝেছে সে সুখে আছে। ভালো আছে।
দুই চাচা আর হেমন্ত মিলে তৌসিফ’কে এগিয়ে নিয়ে এলো। বাড়ীতে ঢুকেই শ্রেয়া’র কাছে গেলো পৌষ। এরা যেন দুই বোন। পৌষ শ্রেয়ার পেটে হাত রাখলো। ঠোঁট উল্টে বললো,
— নড়ে না?
— নড়ে তো।
— ওকে বলো ফুপি এসেছে ওর।
— তুই বল। তার আগে বল জামাই কই?
পৌষ আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলো,
— তোমারা জানতে?
— ওমা! জানব না? বাড়ী ঘর ডালা দিয়ে ভরিয়ে ফেললো।
চোখ কপালে তুলে পৌষ বললো,
— ডালা?
— ঐ যে।
আঙুল দিয়ে দেখাতেই পৌষ তাকালো। মাথায় যেন বাজ তখনই পরলো। দুই পাটি দাঁত বের করে তৌসিফের পানে তাকালো পৌষ অথচ তৌসিফ তাকাতে পারলো না। তাকে ঘিরে ধরেছে তার শালা শালীরা।
#চলবে……