রিদ-মায়ার প্রেমগাঁথা #লেখিকাঃ_রিক্তা ইসলাম মায়া ৩৫

0
14

রিদ-মায়ার প্রেমগাঁথা
#লেখিকাঃ_রিক্তা ইসলাম মায়া

৩৫
বসার ঘরে বিশাল বৈঠক। পাত্র পাত্রী দেখাদেখির পাঠ চুকিয়ে উপস্থিত মেহমাদের খাওয়া দাওয়া পূর্ব ইতিমধ্যে শেষ করে আলোচনা বসলো দুই পরিবার। উপস্থিত সদস্যদের গমগমে পরিবেশে মায়া অবস্থা দেখার মতো। লম্বা ঘোমটায় লাল শাড়ী পরিহিত মায়া থমথমে আর হৃদয় ভাঙ্গুনে সিটিয়ে বসে। ঘোমটার আড়ালে থেমে থেমে নাক টানার শব্দ আসছে হয়তো কান্না আটকে রাখার চেষ্টায় নাক টানছে। তবে কিছুক্ষণ পরপর হাতের টিস্যুটা চোখে লাগাতেও দেখা যাচ্ছে। মায়াকে ঘিরে বসার ঘরে চেয়ারম্যান পরিবারের সবাই রয়েছে। চেয়ারম্যান সাহেবের দুই ভাই, দুইবোন, উনাদের ছেলে-মেয়ে, ছেলের বউ, তাদের বাচ্চাকাচ্চা, আবার চেয়ারম্যান সাহেবের নিজের তিন মেয়ে, তাদের জামাতা, নাতিনাতনি, সবমিলিয়ে প্রায় বিশের ঊর্ধ্বে
সদস্য উপস্থিত মায়াকে পাত্রী হিসাবে দেখতে। মুক্তা ফাহাদের বিয়েটা শেষ হয়েছে আজ প্রায় পাঁচদিন হলো। ফি-যাত্রীতে মুক্তা ফাহাদকে নিয়ে নিজ বাড়িতে এসে চলে গেল আজ দুদিন হলো। সে এখন নিজের শশুর বাড়িতেই আছে ফাহাদের সাথে। আজ মায়াকে দেখতে আসার ব্যাপারটাও হুট করেই ছিল। মায়ার পরিবার যদিও এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। তবে উনারা জানতো মুক্তার বিয়ের পরপরই মায়ার বিয়ের আলোচনা চলবে চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলের সাথে। পূর্ব কথা অনুযায়ী মুক্তা বিয়ের সাপ্তাহ খানিক পরই মায়ার বিয়েটা পারিবারিক ভাবে হবার কথা ছিল। সবকিছু ঠিকঠাকও ছিল। কিন্তু হুট করে নাদিমের স্কলারশিপের কাগজপত্রে কমপ্লিকেশন দেখা দেওয়ায় সে ঢাকা থেকে বাড়িতে আসছে না টেনশনে। বরং দৌড়াদৌড়ি করে কাগজ পত্রের ঝামেলা মিটিয়ে নিচ্ছে। সেজন্য নাদিম মায়াকে দেখতে আজ ওর পরিবারের সাথে উপস্থিত হতে পারেনি। বরং এম্বাসিতে বসে ভিডিও কলে জয়েন হয়েছে নিজের এনগেজমেন্টের রিং বদলে। এই আলোচনায় যতদিন পযন্ত নাদিমের ভিসার প্রসেসিংয়ে ঝামেলা শেষ না হচ্ছে ততদিন পযন্ত আপাতত মায়া- নাদিমের বিয়েটা পিছিয়ে যাবে। নাদিমের কাগজের ঝামেলাটা মিটিয়ে গেলেই পারিবারিক ভাবে দুজনের বিয়েটা দেওয়া হবে। তবে আজ দুই পরিবারের সম্মতিতে নাদিমের সাথে মায়ার পারিবারিক ভাবে আংটি বদল হয়ে থাকবে। আলোচনা অনুযায়ী তাই হলো। মায়ার বিয়েটা সৌভাগ্য ক্রমে পিছিয়ে গেলেও নাদিমের বাবা চেয়ারম্যান সাহেব তিনি নিজের হাতে মায়াকে গোল্ডের মধ্যে চকচকে একটা ডায়মন্ড রিং পরিয়ে দিলেন। মায়া হাতে রিং পড়ানোর সময় মায়া কান্না আটকাতে না পেয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল কষ্টে। এতে চেয়ারম্যান সাহেবসহ উপস্থিত সবাই মনে করলো মায়া ছোট মানুষ বলে ইমোশনে ভয়ে কান্না করছে। চেয়ারম্যান সাহেব অল্প হেঁসে মায়াকে আশ্বস্ত করে একটা ভরসার হাত মায়ার মাথায় বুলিয়ে দেয় কান্না না করতে। নাদিমের সপরিবারেও মায়াকে সাদরে গ্রহণ করে ভরসা দেয় কান্না না করতে। সবার এতো এতো আন্তরিকতায় মায়া আরও ফুপিয়ে উঠে অপরাধবোধে। মায়া এই বিয়েটার সম্পর্কে কিছুই জানতো না। হুট করে আজ সকালের জানতে পারলো মায়ার বিয়ে তাও চেয়ারম্যানের ছোট ছেলে নাদিমের সঙ্গে। এটা নাকি আগে ঠিক করা ছিল নাকি। কই মায়াতো এই সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জানতো না। কিন্তু যখন মায়া এই সম্পর্কে জানতে পারে তখন ঘোর আপত্তি জানিয়ে ছিল এই বিয়েটা করবে না বলে কিন্তু কেউ মায়ার কথা বিশেষ একটা গুরুত্ব বা পাত্তা দেয়নি। কারণ বিয়েটা পূর্ব থেকে ঠিক করা ছিল বলে। তাছাড়া মায়ার কথা গুরুত্ব দেওয়ার মতোন কেউ মায়াকে তেমন সিরিয়াস নেয়ও নি। মোট কথা মায়া পরিস্থিতির এমন একটা ফ্যাসাদে পরেছে যে এই মূহুর্তে নিজের পরিবার বা রিদকে বলতে পারছে না একে অপরের সম্পর্কের কথা। মায়া বিবাহিত সেটা কখনোই মায়া নিজের পরিবারকে বলতে পারবে না। তার কারণ মায়া বড়ো বোন। মুক্তা বিয়েটা মাত্র হলো ঐ বাড়ির ছেলের সাথে। এখন যদি মায়া নিজের বিয়ের বিষয়টা জানাজানি করে তাহলে মুক্তার শশুর বাড়িতে মায়াকে নিয়ে অশান্তি হতে পারে। এমনিই সেদিন মায়াকে রিদ ফাহাদের বাসায় ড্রপ করার সময় সেটা ঐ বাড়ির কেউ সেটা ভালো চোখে দেখেনি। এই বিষয়টা মায়া বেশ বুঝতে পেরেছিল ফাহাদের মা মনোভাবে। যদিও আসিফ সবাইকে আগেই বলে রেখেছিল রিদের মা সুফিয়া বেগম মায়াকে দেখতে চেয়েছিল সেজন্য আসিফ মায়াকে পরদিন সকালে সবার ঘুম থেকে উঠার আগে নিয়ে গিয়েছিল সুফিয়া বেগমের সাথে দেখা করাতে। কিন্তু তারপরও ঐ পরিবারের অনেকেই মায়ার উপর অসন্তুষ্ট ছিল মায়াকে রিদের সঙ্গে গাড়ি করে ফিরতে দেখে। জোর মুখে অনেক প্রশ্নও তুলেছিল রিদের মা সুফিয়া বেগমের মতোন শক্ত মানুষ কেন মায়াকে দেখতে চাইবে? এর কি কারণ হতে পারে? সবার মতে সুফিয়া বেগম তো ফাহাদের শালীকে চিনার কথা না। যেখানে তিনি ফাহাদের বউকেই চিনেন না সেখানে আসিফকে বলে মায়াকে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি ছিল সবার দৃষ্টিকুটুরের কারণ। হেনা খান অবশ্য মায়াকে কৌতূহল নিয়ে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই এই নিয়ে প্রশ্ন করছিল, সুফিয়া বেগম মায়াকে ডেকে নিয়ে কি বলেছিল সেটা জানতে চেয়েছিলেন? মায়া তখন উত্তরে তেমন কিছুই বলেনি। শুধু বলেছিল মায়াকে সকালে নাস্তাতে দাওয়াত দিয়েছিল তিনি ব্যস এতটুকুই। মায়া সহজ সরল উত্তরটা যদিও তেমন কেউ বিশ্বাস করেনি তারপরও সবাই সুফিয়া বেগমের হঠাৎ তলবে মায়াকে সন্দেহের তালিকায় রেখেছিল। ঐ বাড়ি থেকে মায়ারা ফিরে এসেছে আজ গোটা ছয়দিন হলো। এখন যদি মায়া কোনো ভাবে রিদের সাথে মায়ার বিয়ের কথাটা কোনো ভাবে প্রকাশ করে তাহলে এই মূহুর্তে তান্ডবের ঝড় বয়ে যাবে মায়ার উপর দিয়ে। আবার এই বিয়েটা নিয়ে যদি মায়া এখন রিদকেও কিছু বলতে যায় তাহলেও একই তান্ডবের ঝড় দ্বিগুণ হবে মায়ার উপর। মায়া পরিবার কিছু দয়া মায়া দেখালেও রিদ নিশ্চয়ই মায়াকে আস্ত রাখবে না কেন সে সেজেগুজে অন্যের নামের রিং পড়লো তার বউ হয়ে। মায়া অনেক রিকুয়েষ্ট করে রিদ থেকে সময় চেয়েছিল নিজের জন্য। এখন সেই রিদের অগোচরে মায়া অন্যের পাত্রী হয়ে আংটি পযন্ত পরে নিয়েছে, এটা শুনলে অবশ্যই মায়াকে আস্ত রাখার কথা না? এই লোক এমনই যে ভয়ংকর। তারপর মায়া এনগেজমেন্টের কথাটা শুনলে কি হবে সেই ভয়েও মায়া জড়সড়। ভয় আর ভিষণ অপরাধ বোধে ঠোঁট কামড়িয়ে কান্না আটকাতে চেয়ে আস্তে আস্তে ফুপাতে লাগলো মায়া। নাদিমের বড় বোন শেহনাজ নিজের হাতের ফোনটা মায়ার হাতে ধরিয়ে দিল। ভিডিও কলে নাদিমকে দেখা যাচ্ছে ক্লান্তিতে বসে। গলার ট্রাইটা ঢিলে করে ফোনের দিকে তাকিয়ে। নাদিম দেখতে সুন্দর পুরুষ বটে, পাত্র হিসাবে চমৎকার। খারাপ নয়। তবে মায়ার দিকটা ভিন্ন। সে বিবাহিত! আর এই বিষয়টি ভয়ে মায়া কাউকে বলতে পারছে না আর না সহ্য করতে পারছে। পরিস্থিতির দায়ে পরে মায়া ভিষণ আতঙ্কিত। কোলের উপর মায়ার কম্পনরত দু’হাতে ভাঁজে নাদিমের ফোনটি চেপে। অতি কষ্টে চেপে মায়া ফোনের স্ক্রিনে দিকে তাকাচ্ছে না পযন্ত, শুধু মাথা নিচু করে ধীরে ফুপাচ্ছে। নাদিম মায়া কান্না মিশ্রিত মুখটা দেখে সুন্দর হাসলো। তার এই ক্লান্তির মুখের হাসিটা বলে দিচ্ছে তার প্রাপ্তির সুখ কতোটা। নাদিম হাতের ফাইলটা পাশের চেয়ারে রেখে মায়া মুখটার দিকে তাকিয়ে বামহাতে নিজের চুল গুলো পিছন টেলে দিতে দিতে বলল…

‘ টেক এ ব্রেথ রিতু। আমার মনে হয় তোমার একটু পানি খাওয়া উচিত।

মায়া নাদিমের কথা অনাগ্রহ করে সেইভাবেই মাথা নিচু করে বসে রইল। চোখে জল কিন্তু মুখে কোনো শব্দ নেই। নাদিম মায়ার কান্নায় মনোযোগ হতে হতে আবেগ ঢেলে সাজানো কথায় বলল…

‘ তোমার কান্নাটা ব্যাখ্যা করছে রিতু আমার প্রাপ্তি সুখ কতোটা। আমার অনেক বছরের নিশ্চুপ অপেক্ষার ফল তুমি। তোমাকে এতো সহজে পেয়ে যাব ভাবিনি। দুঃখের শেষ কান্নাটা করে নাও রিতু। এরপর থেকে তোমার সুখের দায়িত্ব আমার প্রিয়।

নাদিমের ভালোবাসা আবেগময় কথায় মায়ার অপরাধ বোধ আরও বাড়িয়ে দিল। সহ্য করতে না তক্ষুনি ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। নাদিমকে ভিডিও কলে দেখা গেল সেই এক দৃষ্টিতে মায়ার কান্না মিশ্রিত মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকতে। সবার খাওয়া দাওয়া কথাবার্তা শেষে চেয়ারম্যান পরিবার বিদায় নিতেই মায়া ছুটে নিজ ঘরে। রাগে তেজে মাথার ঘোমটা ফেলে হাতের চুড়ি গুলো এলোপাতাড়ি ফেলল কক্ষে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বামহাতের উল্টো পিঠে তেজে ঠোঁটের লিপস্টিক ঘষেমেজে লেপ্টে দিল চারপাশে। গোছানো চুল গুলো টেনে এলোমেলো করতে করতে ধুপ করে বসে পরলো ফ্লোরে। বাঁধ ভাঙ্গা কান্নায় ভেঙে পরে ফুপিয়ে চিৎকার করে উঠলো বিছানার চাদর মুখে চেপে। দু’পা ভেঙ্গে কাতর হয়ে ফ্লোরে বসে বিছানায় মুখ গুঁজে হাউমাউ করে চিৎকার করে উঠলো বুক ফাটা আর্তনাদে। মায়ার কান্না দেয়াল বেঁধ করে বাহিরে গেলেও নিচ তলায় পৌঁছাল না আপনজনদের কানে। আপাতত মায়ার পরিবারের সবাই ছোট মেয়ের বিয়ে ঠিক হবার খুশিতে নিচ তলায় বৈঠক ঘরে বসে। যার জন্য হৃদয় ভঙ্গুর মায়ার আর্তনাদের চিৎকার কারও কান বেঁধ করতে পারছে না। এমনকি জুইয়েরও না। সবার ধারণা মায়া ছোট মানুষ হওয়াতে এই বিয়েটাকে সে স্বাভাবিক নেয় মেনে নিতে পারছে না তবে দুইদিন গেলে এমনই ঠিক হয়ে যাবে। মায়াও বিয়েটা হাসিখুশি মেনে নিবে। এমনটা জুইয়েরও ধারণা ছিল। সেজন্য উদাস জুই মায়ার মনের খবর রাখে না প্রায় বেশ কয়েকদিন হলো। যেখানে জুইয়ের নিজের মন মানসিকতায় ঠিক নেই সেখানে অন্যের মনের খবর কিভাবে রাখবে সে? সেদিন রাতে আয়নের সাথে ঝামেলা হওয়ার পর থেকেই জুই আর আয়নের সাথে যোগাযোগ করে না। যদিও আয়ন ফোন দেয় তাহলে জুই সেটা রিসিভ করে না। মেসেজ পাঠালে না পড়েই ডিলিট করে দেয়। মূল কথা জুই কোনো ভাবে আয়নের সাথে যোগাযোগ রাখতে চাচ্ছে না। আয়নকে জুইয়ের বেঈমান প্রতারক মনে হয়। তাছাড়া জুইয়ের ভালো লাগা আয়নের প্রতি নয় রাদিফের প্রতি ছিল। যেখানে মানুষটায় ভুল, সেখানে জুই কেন আয়নের সঙ্গে কথা বলে ভুল বুঝাবুঝি ভাঙবে? কিসের জন্য? আয়নের সাথে তো জুই যোজন-বিয়োজ কোনো কিছুই চাই না তাহলে? মন ভাঙ্গুনে উদাস জুই নিজের পরিবারের হৈচৈ দেখলো মায়ার বিয়েটা নিয়ে। তারপর কয়েক সেকেন্ড সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে হাঁটল সিঁড়িঘরে দিকে। উদ্দেশ্য দোতলায় নিজেদের ঘরে যাবে। সিঁড়ি বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে উদাস জুইয়ের চোখ একবার নিজের গায়ের নতুন জামাটার দিকে পরলো। মা -চাচার কর্ডা আদেশে জুইকেও আজ নতুন জামা পরে সেজেগুজে মেহমানদের সামনে থাকতে হয়েছিল। মায়ার হঠাৎ এনগেজমেন্টের বিষয়টা সকালে দিকে শুনে জুইও কম অবাক হয়নি। আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতোন জুইও শকট হয়েছিল। কিন্তু মেহমান বাড়িতে আসবে বলে কাজে চাপে আর মানুষের হৈচৈ জুই মায়ার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাইনি। মায়ার তো বিবাহিত। যদিও স্বামীর সন্ধান এখনো পাইনি মায়া। কিন্তু তারপরও মায়া বিবাহিত। বিবাহিত মেয়ের তালাক না হওয়া পযন্ত আরেকটা বিয়ে করা জায়েজ না। এই অবস্থায় অবশ্য ওদের পরিবারের বড়দের সঙ্গে কথা বলা উচিত। কিন্তু তার আগে জুই মায়ার সঙ্গে একবার কথা বলতে চাই। জুই মায়াকে বুঝাবে অজানা স্বামীর পিছনে পরে না থেকে এই বিয়েটাকে মেনে নিতে। নাদিম ভালো ছেলে। দেখতে শুনতেও কতো সুন্দর। মায়ার সাথে মানাবে ভালো। জুইয়ের মনস্তাত্ত্বিক চিন্তা ভাবনার মাঝেই ফ্ল্যাটের দরজা খোলে ভিতরে প্রবেশ করতেই কারও তীব্র চিৎকারের ফুঁপানি শুনতে পেয়ে মূহুর্তে চমকে উঠে জুই। বুদ্ধিমতি জুই তীব্র ফুঁপানির শব্দে বুঝে গেল মায়ার হৃদয় ভাঙ্গুনের শব্দটা। তৎক্ষনাৎ ভিতর থেকে ফ্ল্যাটের দরজা আঁটকে দিল যাতে বাড়ির অন্যরা কেউ আসতে না পারে বা তাদের কানে মায়ার কান্নার শব্দ না পৌঁছায়। দরজা আটকে দৌড়ে গেল নিজেদের রুমে দিকে। দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করতেই আঁতকে উঠল মায়াকে বিধস্ত অবস্থায় দেখে। এলোমেলো শাড়ি, চুলে ফ্লোরে বসে বিছানায় চাদর খামচে ধরে মুখে চেপে কাঁদছে। জুই মায়া অবস্থা দেখে মায়ার দিকে ছুটে যেতে যেতে ব্যস্ত গলায় ডাকল….

‘ মায়া! এই মায়া! কি হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন?

জুইয়ের কন্ঠে তৎক্ষনাৎ মুখ তুলে তাকাল মায়া। জুই মায়ার সামনে হাঁটু গেড়ে বসার আগেই ঝাপিয়ে পড়লো মায়া। আকস্মিক ঘটনায় জুই তাল সামলাতে না পেরে মায়াকে নিয়ে পরে গেল ফ্লোরে। জুইয়ের পিঠ ঠেকল খাটের কোণায়। কিন্তু তারপরও জুই একহাতে মায়ার পিঠ আঁকড়ে অন্য হাত ফ্লোরে রাখল নিজের শরীরে ব্যালেন্স বজায় রাখতে। মায়া জুইকে দু’হাতে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ চিৎকার করতে করতে বলল…

‘ জুই! জুই! আমি ভুল করেছি! আমি উনার সাথে বেঈমানী করতে চাইনি। তারপরও করে ফেললাম। উনি আমাকে কক্ষুনো ক্ষমা করবে না জুই। আমি কি করবো জুই? আমি কি করবো?

মায়ার হাউমাউ চিৎকারে ভয় পেয়ে যায় জুই। মায়া চিৎকারের শব্দ নিশ্চয়ই নিচে বসার ঘর অবধি চলে যেতে পারে। ভয়ার্ত জুই তৎক্ষনাৎ মায়াকে নিজের বুক থেকে উঠিয়ে মায়ার মুখটা একহাতে আঁকড়ে ধরে তাড়াহুড়োয় আশ্বস্ত দিতে দিতে বলল…

‘ শিশশশ! এইভাবে চিৎকার করিস না মায়ু। বাড়িতে অনেক লোকজন আছে। কেউ শুনলে আস্ত রাখবে না আমাদের। কান্না থামা বোন। কি হয়েছে বল আমাকে। এইভাবে কাঁদছিস কেন তুই? কার সাথে বেঈমানী করেছিস? কি হয়েছে?

জুইয়ের কথায় সত্যি সত্যি মায়ার কান্নার আওয়াজ কিছুটা কমে আসলো। তবে কান্নার বেগ কমেনি। বরং একই ভাবে হিচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে মায়া বলল…

‘ জুই! জুই! আমি সত্যি বুঝিনি পরিস্থিতি এমন হয়ে যাবে। হুট করে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে যাবে। আমিতো উনার কাছে সময় চেয়েছিলাম সবকিছুর জন্য। এখন আমি কি করবো জুই? কিভাবে সবটা সামলাবো? উনি আমাকে বিশ্বাস করবে না জুই। বলবে আমি প্রতারণা করেছি।

মায়ার কোনো কথার অর্থ বোধগম্য হলো না জুইয়ের। মূলত জুই বুঝতেই পারছে মায়া কার জন্য কিসের সময় চেয়েছিল? জুই বলল..

‘ কার কথা বলছিস তুই? কিসের প্রতারণা হবে?

‘ আমি উনার কথা বলছি!
‘ উনি কে আবার?

মায়া বউ হয়ে রিদের নামটা সরাসরি নিতে চাইছে না বলে জুইকে বুঝানোর জন্য ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলল…

‘ আপুর ভাসুর।
‘ কোন আপুর ভাসুরের কথা বলছিস তুই?
‘ মুক্তা আপুর!

মায়ার কথায় কপাল কুঁচকে আসে জুইয়ের। ওর জানা মতে ফাহাদের নিজের কোনো বড় ভাই নেই। সে নিজেই বাড়ির বড় ছেলে। তাহলে মায়া ফাহাদের কোনো ভাইয়ের কথা বলছে? জুই পুনরায় জানতে চেয়ে একই ভাবে বলল…

‘ তুই কার কথা বলছিস একটু খোলে বলবি মায়ু?

হৃদয় ভাঙ্গুর মায়া এটা মাথায় নেই যে সে নিখোঁজ স্বামী রিদকে খোঁজে পাওয়ার বিষয়টা এখনো পযন্ত জুইকে বলা হয়নি। তাই স্বাভাবিক নেয় জুই এখনো পযন্ত জানে না মায়ার নিখোঁজ স্বামীকে খোঁজে পাওয়ার বিষয়টি। সেজন্য জুইয়ের পরপর প্রশ্ন গুলো খুবই ধারাবাহিক ভাবেই আসছিল। যেহেতু সে অক্ষত মায়ার নিখোঁজ স্বামীকে খোঁজে পাওয়া নিয়ে তাই মায়ার উনি সম্পর্কে প্রশ্ন গুলোও স্বাভাবিক নেয় ছিল জুইয়ের পক্ষ থেকে। কিন্তু মায়ার জুইয়ের পরপর প্রশ্ন গুলো অহেতুক মনে হওয়ায় অনেকটা বিরক্ত হয়েই জুইকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিতে দিতে বলল…

‘ তুই যাতো জুই। আমার কষ্ট আর বাড়াস না। ভালো লাগছে না।

মায়া জুইকে দূরে ঠেলে দিতে চাইলেও জুই মায়ার হাত ধরে থামিয়ে কাছে টেনে একই ভাবে মায়াকে জড়িয়ে ধরে বুঝিয়ে বলতে চেয়ে বলল…

‘ এমন করছিস কেন জান? তুই তো আমার কলিজা। তুই আমাকে বুঝিয়ে না বললে আমি বুঝবো কিভাবে তুই কার কথা বলছিস? বল?

জুইয়ের কথায় মাথায় নরম হলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো…

‘ আপুর ভাসুর রিদ খানের কথা বলছি আমি।

মায়ার কথা শেষ হতে হতে তৎক্ষনাৎ পরবর্তী প্রশ্ন আসলো জুইয়ের হতে স্বাভাবিক নেয়…

‘ আপুর ভাসুর রিদ খানের সাথে তোর কি সম্পর্ক বইন? তুই উনার কথা কেন বলছিস? কি করেছে উনি? আবারও বাজে ব্যবহার করেছে তোর সাথে? এজন্য কাঁদছিস?

জুইয়ের পরপর প্রশ্নে মায়ার মনে পড়লো মায়া ওর নিখোঁজ স্বামীকে খোঁজে পাওয়ার বিষয়টা এখনো জুইকে জানানো হয়নি। একদিকে মায়া মন ভালো নেই। কতো ঝড়-ঝাপটা যাচ্ছে ওর উপর দিয়ে। এই পরিস্থিতিতে মায়ার মোটেও ইচ্ছা করছে না জুইকে সবকিছু খোলে বলতে। কিন্তু এই মূহুর্তে জুইকে কিছু না বললে মায়া সমাধান পাবে না। সেজন্য মায়া রিদকে খোঁজে পাওয়ার বিষয়টি সংক্ষিপ্তে জানিয়ে বলল…

‘ আমার যার সাথে বিয়ে হয়েছিল সে রিদ খান ছিল জুই। মানে আমার নিখোঁজ স্বামী ঐলোকটা রিদ খান ছিল।

মায়ার কথায় আকাশ সমান শকট হলো জুই। অতি শকটে বোবা বনে জুই মায়ার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল কয়েক পলক। জুইয়ের মস্তিষ্ক মায়ার কথাটা টনক নড়তে জুই শংসিত গলায় মায়াকে শুধিয়ে আবারও জানতে চেয়ে বলল।

‘ মানে কে তোর স্বামী?

‘ রিদ খান!

আতঙ্কিত জুই হতভম্ব হয়ে তাড়াহুড়োয় মায়াকে পুনরায় শুধিয়ে জানতে চাইল…

‘ রিদ খান? মানে খান বাড়ির বড়ো ছেলে রিদ খান? ফাহাদ জিজুর কাজিন বড়ভাই রিদ খানের কথা বলছিস তুই?

জুইয়ের হতভম্ব মুখটার দিকে তাকিয়ে মায়া মাথা কাত করে সম্মতি দিল। যার অর্থ হ্যাঁ এই রিদ খানই।
মায়ার সম্মতি পেতেই জুই তব্দা খেয়ে বসল।

‘ এই লোকের সাথে তোর বিয়ে হয়েছিল জান?

মায়া আবারও ঘাড় কাত করে সম্মতি দেয় জুইকে।জুই একই ভঙ্গিতে আবারও বলল…

‘ জান তুই জানলি কিভাবে রিদ খান তোর নিখোঁজ স্বামী হয়। রিদ খান নিজে বলেছে তোকে?

মায়া মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানাতে জানতে বলল…

‘ উনি বলেনি। আমি নিজে নিজে জেনেছি আপুর গায়ের হলুদের রাতে। যেদিন আমরা ফাহাদ ভাইয়ার বাড়িতে গিয়েছিলাম হলুদ নিয়ে সেদিন আমি বুঝতে পারি রিদ খানই ঐ লোকটা ছিল।

সংক্ষিপ্তে মায়া জুইকে অল্প সল্প বিস্তারিত বলে ফেলল রিদকে খোঁজে পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে। সব শুনে জুই তব্দা খেয়ে বসে রইল। এবার মায়ার মতো জুইয়েরও মনে হচ্ছে রিদ পূর্ব থেকেই মায়ার সম্পর্কে জানতো। আর সবকিছু জেনেশুনেই সে মায়াকে এতোদিন নাকে দড়ি দিয়ে তার চারপাশে ঘুরাত। কিন্তু এখন বড় কথা হলো, মায়া নিজের স্বামীকে চিনার চেয়ে বড়ো বিপদ হলো রিদ খান মায়ার স্বামী হয় সেটা। সেদিন মায়া সুফিয়া বেগমের ডাকে উনার বাসায় গিয়েছিল সেই বিষয়টা ফাহাদের বাসার কেউ পছন্দ করেনি। এমনকি এটা নিয়ে মায়ার অগোচরে কথাও হয়েছিল বেশ। বড়বোন হিসাবে মুক্তাকেও এই নিয়ে টুকটাক বেশ কিছু কথা শুনতে হয়েছিল ঐ বাড়ির আত্মীয়দের থেকে। এখন যদি সবাই জানাজানি হয় মায়া-রিদের সম্পর্কে কথা তাহলে সবচেয়ে বেশি ইফেক্ট পড়বে মুক্তা- ফাহাদের সম্পর্কের উপর। মায়ার জন্য মুক্তার বিয়েটা ভাঙতে বসে তাহলে? জুই সেসব কথা ভেবেই আতঙ্কে মায়াকে প্রশ্ন করে বলল…

‘ এজন্য সেদিন রিদ খানের মা তোকে ডেকে পাঠিয়েছিল দেখা করতে? উনি জানেন তোদের সম্পর্কের কথা?

মায়া ঘাড় কাত করে সম্মতি দিতে দিতে নাক টেনে বলল…
‘ হুমম!
‘ উনি মেনে নিয়েছেন তোকে?
‘ হুম!
‘ এতো সহজে মেনে নিলো? ঝামেলা করেনি?
‘ না!

মায়া কথায় জুই টেনশনে চিন্তিত গলায় বলল…

‘ মায়া আমার অনেক টেনশন হচ্ছে সবকিছু নিয়ে। তোর সামান্য রিদ ভাইয়ের আম্মুর সাথে দেখা করাটা নিয়ে ঐ বাড়ির সবাই কেমন বাঁকা চোখে তোকে দেখলো। তারপর মুক্তা আপুকেও আকারে-ইঙ্গিতে অনেক কথা শুনতে হয়েছিল তোকে নিয়ে। তোকে খোলামেলা একা কোথাও না ছাড়তে। যুগ ভালো না হেনতেন। এখন যদি জানাজানি হয় তোর সাথে রিদ ভাইয়ের বৈবাহিক সম্পর্ক আছে তাহলে কেউ সেটা ভালো ভাবে মানবে না মায়া। এমনকি তোর বিয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি সাফার মুক্তা আপুকেই করতে হবে। আমি দেখেছি মায়া ঐ বাড়ির মানুষজন সুবিধার নয়। তাছাড়া আমি যতটুকু জানি রিদ খানের সাথে ঐবাড়ির মেয়ে শশী আপুর বিয়ে ঠিক করে রেখেছে সবাই। এই অবস্থায় তোকে কেউ গ্রহণ করতে চাইবে না মায়া। তার চেয়ে বড়ো ব্যাপার হলো তোর বিয়ে ইতিমধ্যে ঠিক হয়ে গেছে। তুই অলরেডি এঙ্গেস্ট। এখন যদি তোর আর রিদ খানের সম্পর্কের কথা পরিবারের জানাস তাহলে কিয়ামত নেমে আসবে মায়ু। আমার বাবা, তোর বাবা মিলে কিয়ামতের আলামত দেখাই দিবে সবাইকে। এতে মুক্তা আপু শশুর বাড়ি, চেয়ারম্যানের পরিবার, আমাদের পরিবার, এই তিনটা পরিবারের মধ্যে সবসম্পর্ক একেবারে শেষ হয়ে যেতে পারে মায়া। এমন একটা পরিস্থিতিতে তুই দাঁড়িয়ে আছিস যেদিকে যাবি সেইদিকে তুই মরবি। আমিতো কোনো পথ খোলা দেখছি না মায়ু। কি করবি তুই?

জুইয়ের সাথে বার্তাচালনে মায়ার কান্না অনেকটা কমে এসেছিল। কিন্তু জুইয়ের লাস্ট কথা গুলোই মায়ার হিচকি তুলা কান্নাটা আবারও দ্বিগুণ হয়। জুই সত্যি বলছে মায়ার আসলেই কিছু করার নেই। সত্যিটা এই মূহুর্তে নিজের পরিবারকে জানালে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। মাত্র মুক্তার বিয়েটা হয়েছে ঐ পরিবারের সাথে। মায়া চাই না ওর জন্য কোনো ঝামেলা হোক। আবার রিদকেও সত্যিটা বলতে পারবে না। রিদকে সত্যিটা বলা মানে দুই পরিবারের ওদের বৈবাহিক সম্পর্কটা এমনই জেনে যাওয়া। মায়ার ছোট মস্তিষ্ক বুদ্ধি খেলিয়ে বুঝতে পারলো না আসলে এমন পরিস্থিতিতে ওর কি করা উচিত। জুই মায়াকে পুনরায় ডুকরে কেঁদে উঠতে দেখে মায়ার দু’হাত চেপে আশ্বস্ত দিয়ে বলল…

‘ রিদ ভাই তোকে বউ হিসাবে গ্রহণ করেছে মায়ু?

মায়া কাঁদতে কাঁদতে সম্মতি দিতেই জুই পুনরায় বলল…

‘ কি বলে গ্রহণ করেছে? তোকে নিয়ে সংসার করতে চাই এমন কিছু বলেছেন উনি?

মায়া কাঁদতে কাঁদতে নাতে মাথা নাড়িয়ে বলল…

‘ এমনটা বলেনি। তবে আমি বুঝি উনি আমাকে পছন্দ করে।

মায়ার কথায় জুই অসন্তুষ্ট গলা ঝেড়ে বলল…

‘ বেশি বুঝিস তুই। অল্প বয়সে পেঁকে গেছিস। পুরুষ মানুষ মুখে বলে ওয়াদা করেও একটা সময়ে সেই ওয়াদা রক্ষা করে না ক্ষেলাপ হয়ে যায়। আর রিদ খান তোকে পছন্দ অপছন্দের ব্যাপারে কিছু বলেনি অথচ তুই দুই লাইন বেশি বুঝে বসে আছিস। উনি তোকে পছন্দ করলে অবশ্যই মুখে বলতো মায়া।

জুইয়ের কথায় মায়া রিদের হয়ে সাফাই দিতে দিতে বলল….

‘ উনিতো উনার মার সাথে আমাকে বউয়ের পরিচয় দিয়ে দেখা করিয়ে দিয়েছে জুই। উনার মা চাচ্ছিল আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা আমার পরিবারের জানাতে কিন্তু আমিই উনাদের থেকে সময় চেয়ে, অন্য ছেলের সাথে এঙ্গেস্ট হয়ে গেছি। তাহলে বেঈমানীটা তো আমিই করছি জুই তাইনা?

মায়ার কথায় জুই আপাতত আর কিছুই ভাবতে পারলো না। পরিস্থিতি এখন অনেক গরম। এই অবস্থায় কিছুতেই মায়ার বিয়ের সম্পর্কে পরিবারের জানানো যাবে না। বরং আর কয়েকদিন গেলে পরিস্থিতি বুঝে না-হয় এই বিষয় নিয়ে আরিফের সাথে কথা বলবে ওরা দুজন। আপাতত ওরা দুজন এখান থেকে ভালোই ভালোই চট্টগ্রাম পৌছাতে পারলেও হলো। তখন না-হয় বুঝে শুনে সবাইকে জানানো যাবে এই বিষয়ে। মায়াও না-হয় তখন রিদকে এসব বিষয়ে বলবে, আপাতত এখন কিছু না বলে। জুইয়ের যুক্তিটা মায়ারও পছন্দ হলো। মায়া ভাবলো পরিবারের মাঝে থেকে যদি এখন কিছু বলে তাহলে সবাই মায়াকে ঘরবন্দি করে ফেলতে পারে। তখন মায়া চাইলেও রিদের সাথে আর যোগাযোগ করতে পারবে না। তারচেয়ে বরং মায়া সুযোগের সন্ধানে থেকে সবকিছু আপাতত গোপন করে গেলে শেষটা ভালোই হবে। আর মায়ার এমন চিন্তাটায় ছিল মায়ার পক্ষের বিপরিত। পরিস্থিতি যেমনই হোক সেটা মানিয়ে বা লড়াই করে হলেও সামনে বাড়তে হয়। যেকোনো পরিস্থিতিতে চুপ থাকা মানে তুমি ভীতু। আর মায়ার এই চুপ থাকাটা যেটা অল্পতে শেষ হতে পারতো সেটা আরও বড়ো হওয়ার সুযোগ করে দিল নিজের অজান্তেই। মায়া নিজেই নিজের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আর দুষ্কর করে তুললো। অদেখা ভবিষ্যত কার কি হবে কারও জানা নেই। তবে বর্তমানের কর্মফল মানুষকে ভবিষ্যতেই দিতে হয়। আর এটাই প্রকৃতিক নিয়ম। মানুষ সেই নিয়মের বর্তীময়ী। এতো কিছুর মাঝে মায়া আরও একটা নতুন ভুল করলো রিদের সাথে হুট করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে। মায়া মূলত নিজের অপরাধ বোধ থেকে এমনটা করেছে। মায়া ধারণা সে একেবার চট্টগ্রামে গিয়েই রিদের সাথে নাহয় যোগাযোগ করবে। আজকাল মায়ার অতিরিক্ত ধারণাই মায়ার বিপদের কারণ হয়েছে।
~~

সকাল ৪ঃ০০! কলেজের জন্য রেডি হয়েও মায়া রুমে ভিতরে তন্ন তন্ন করে কিছু একটা খোঁজে চলছে। একবার কাঠের আলমিরা খোলে সেটা ভিতর উলট পালট করছে তো আবার খাটের নিচে উঁকি মেরে দেখছে মায়ার হারিয়ে যাওয়া জিনিসটা কোথায়। ক্লান্ত মায়ার অবিরাম নিজের জিনিসটা খোঁজায় ব্যস্ত। মায়ার বিচিলিত ভাব দেখেই বুঝা যাচ্ছে হারিয়ে যাওয়া জিনিস কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল ওর জন্য। জুই টিফিন বক্স রেডি করে রুমে ঢুকতে দেখলো মায়াকে পুরো রুম এলোমেলো করে খাটের নিচে উঁকি মেরে কিছু একটা খুজতে। জুই বিরক্ত হয়ে দেয়াল ঘড়িটা দেখল। অলরেডি আটটা বাজে দশ মিনিট হয়ে গেছে। নয়টা থেকে ওদের কলেজের ক্লাস। অথচ মায়া কলেজ ড্রেস পড়ে যতটুকু রেডি হয়েছিল ওর খোজাখুজিতে এখন সেটাও নষ্ট করে ফেলেছে। মাথায় এখনো হিজাব করেনি। লম্বা চুলের বেনিটা এলো হয়ে পিঠ বেয়ে ফ্লোরে পরে আছে মায়া খাটের নিচে উঁকি দেওয়ার ফলে। শরীরে ক্রসিং বেল্ড দুটো খসে আছে। জুইয়ের মেজাজ খারাপ হলো। এমনই আজ ওরা দুজন লেট। তারপর আবার মায়ার এমন তালবাহানা ওদের আরও লেট করবে। জুই এগিয়ে এসে মায়ার চুলের বেনি টেনে মায়াকে খাটের নিচে উঁকি মারা থেকে বের করলো। চুলে টান পড়ায় মায়ার একটা হাত অটু নিজের ঘাড়ের চুল আঁকড়ে ধরে আহাজারি করে খাটের তলায় থেকে বের হতে হতে বলল…

‘ জুই চুল ছাড়! ব্যথা পাচ্ছি আমি।

‘ খাটের নিচে কি করছিস তুই? কি খুঁজিস?

মায়া উঠে বসতে বসতে বিরক্তি নিয়ে বলল…

‘ একটা চাবি খুঁজি। তুই দেখেছিস কোথাও কোনো চাবি-টাবি?

জুই মায়ার চুল ছেড়ে পড়ার টেবিলে দিকে এগোল। মায়ার ব্যাগে প্রয়োজনীয় বই খাতা নিতে নিতে বলল…

‘ হুম দেখেছি! কিন্তু তোর কিসের চাবি দরকার সেটা বল?

জুইয়ের কথায় মায়া এক লাফে উঠে দাঁড়াল। গায়ের সাদা কলেজ ড্রেসটা ঝাড়তে ঝাড়তে জুইয়ের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে খুশি মনে বলল…

‘ একটা ফ্ল্যাটের চাবি দরকার আমার। বলনা কোথায় দেখেছিস?

‘ চুড়ির বক্সের ভিতরে চেক দেখ। ঐটা কিনা।

জুইয়ের কথায় মায়া এক দৌড়ে ড্রেসিংটেবিল উপর থেকে চুড়ি বক্সটা খোলে নিজের নিখোঁজ চাবিটার খোঁজ করলো। অল্প সময়ে পেয়েও গেল। রিদের ফ্ল্যাটের চাবি এটা। সেদিন রিদ দিয়েছিল মায়াকে। এই চাবিটা দেওয়ার সময় রিদ মায়াকে বলেছিল ‘ এই চাবিটার গুরুত্ব বা দেওয়ার কারণ মায়া একদিন বুঝবে। সত্যি মায়া আজ বুঝতে পারছে রিদ কেন সেদিন মায়াকে নিজের বাসার এই চাবিটা দিয়েছিল। মায়া সেদিন এই চাবিটা অবহেলা অযত্ন করে ফেলে দিয়েছিল গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু জুই সেটা যত্ন করে সামলিয়ে রাখাতে আজ মায়া অল্পতে ওর মূল্যবান জিনিসটা খোঁজে পেয়ে গেল। চাবিটা হাতে নিয়ে মায়াকে খুশিতে চকচক করতে দেখে জুই সেদিকে তাকিয়ে মায়ার ব্যাগের চেইনটা লাগাতে লাগাতে বলল…

‘ কিসের চাবি এটা?

‘ উনার ফ্ল্যাটের চাবি। আমাকে গিফট করেছিল অনেক আগে। আমি তখন এরমানে বুঝিনি এজন্য ফেলে দিয়েছিলাম।

‘ তাহলে আজ খোঁজ করছিস কেন?

‘ আমাকে দেওয়া প্রথম উপহার উনার যত্ন করে রাখব না আমি আজব।

মায়ার খুশি মুখটার দিকে তাকিয়ে জুই বলল…

‘ মায়া তোর মনে হয় এখন রিদ ভাইয়ের সাথে কথা বলা উচিত। আমরা তো চট্টগ্রামে এসেছি আজ এক সাপ্তাহ হলো।

জুইয়ের কথায় মায়ার মন খারাপ হলো তীব্র অপরাধ বোধে। কিভাবে রিদকে সত্যি বলবে জানা নেই মায়ার। তারউপর আজ থেকে পনেরো দিন ধরে রিদের সাথে মায়ার কথা হয়না। সেই সুফিয়া বেগমের বাসা থেকে আসার পথে দুজনের কথা হয়েছিল এরপর আর হয়নি। মূলত মায়াই যোগাযোগ করেনি রিদের ভয়ে আর অপরাধ বোধে। রিদ যে কল করবে সেই উপায় নেই। মায়া ওদের হাতের ফোনটার সিম খোলে রেখেছে যাতে রিদ কল দিতে না পারে। বাসায় আপাতত ওরা আরিফের ফোন থেকে কথা বলে। জুইয়ের ও ফোনের প্রয়োজন হয়না আজকাল। কারণ ওর ও কথা হয় না আয়নের সাথে। জুইয়ের কথায় মায়ার ভয়টা আরও বাড়লো। হাতের চাবিটা মুঠোয় চেপে নিতে নিতে মিনমিন গলায় বলল…

‘ পরশু তো আমাদের কলেজ ট্যুর আছে। সেখান থেকে ফিরে না-হয় কথা বলবো উনার সাথে।

মায়ার কথা জুই আপোষে সম্মতি দিতে দিতে বলল…

‘ তোর ইচ্ছা। এবার চল আমাদের দেরি হচ্ছে।

জুই মায়ার ব্যাগটা ছেড়ে নিজের ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিতে মায়া মাথায় সাদা হিজাব বেঁধে নিলো। জুই টিফিনবক্স হাতে নিতে মায়াও নিজের কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে জুইয়ের পিছনে এগোতে এগোতে বলল…

‘ তুই তো পরে আর কিছুই বললি না জুই।
‘ কোন বিষয়ে?
‘ আয়ন ভাইয়া ব্যাপারে।
‘ বলার মতো কিছু থাকলে অবশ্যই বলতাম।
‘ কিন্তু আমিতো জানি তুই আয়ন ভাইকে পছন্দ করতি।

জুই নিজের ফ্ল্যাটের দরজায় তালা লাগাতে লাগাতে মায়ার কথার উত্তরে বলল…

‘ আয়ন ভাইয়া কখনোই আমার পছন্দের লিস্টে ছিল না মায়ু। রাদিফ ভাইকে মনে করে আয়ন ভাইয়ার সাথে এতোদিন কথা হতো। এটা জাস্ট একটা ভুল বুঝাবুঝি ছিল। এখন দুজনের ভুল বুঝাবুঝি ভেঙ্গে গেছে তাই কেউ কারও সাথে কথা বলার প্রশ্নই উঠে না।

জুইয়ের কথায় মায়া অসন্তুষ্টি হয়ে বলল…

‘ ভুল বুঝাবুঝি শুধু তোর তরফ থেকে ছিল জুই। আয়ন ভাইয়া শুরু থেকে জানতো ফোনের ওপাশের মেয়েটা তুই ছিলি। তোকে জেনেশুনেই কথা বলে গেছেন তিনি। এখানে উনার অপরাধ নেই। তুই অন্তত একবার উনার সাথে কথা বলে দেখতে পারিস কি বলে উনি। আর নয়তো উনার করা মেসেজ গুলো অন্তত একবার পড়ে ডিলিট করিস তাহলে বুঝতে পারবি দোষটা কার।

‘ আমি আদালত নয় যে ন্যায় অন্যায় দেখতে যাব। যেটা চলে গেছে সেটা চলে গেছে। আমি এখন কারও দোষগুণ দেখতে চাইনা। তুই চল!

‘ কিন্তু জুই আয়ন ভাইতো তোকে।

জুই অনেকটা ধমক স্বরেই মায়াকে থামিয়ে দিতে দিতে বলল…

‘ মায়া আমাদের দেরি হচ্ছে। চল।

[ গল্পটা লেখা শেষ হয়েছিল কাল রাতেই। কিন্তু ফোন হাতে ঘুমিয়ে যাওয়ার কারণে আর দিতে পারিনি। সকাল থেকে ব্যস্ত। ফোনটা হাতে নেওয়ার সময় পাচ্ছি না। স্যরি রাতে দিতে না পেরে। আর ঈদ মোবারক সবাইকে।]

#চলিত….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here