রিদ-মায়ার প্রেমগাঁথা #লেখিকাঃ_রিক্তা ইসলাম মায়া ৩৬

0
136

রিদ-মায়ার প্রেমগাঁথা
#লেখিকাঃ_রিক্তা ইসলাম মায়া

৩৬
ভোর ৫ঃ০৫। একটা সুন্দর স্নিগ্ধ সকালের সূচনা হলো ধরুনী জোরে। পশ্চিম আকাশে লাল সূর্যের চটার আবির্ভাব এখনো ঘটেনি। তবে উজ্জ্বল আকাশে, উজ্জ্বল পৃথিবী। প্রকৃতি জোরে শীতল হাওয়ার উত্তাপ। এমন একটা সুন্দর সকালে সকলে যাচ্ছে কলেজ ট্যুরে রাঙ্গামাটিতে। এই ট্যুর যাত্রীতে মায়াও আছে। প্রথম সারি, দ্বিতীয় সারি মিলিয়ে মোট চারটা বাসের ট্যুর যাত্রা এটি। মায়াদের সিট পরেছে চতুর্থ বাসে। সকল শিক্ষার্থী ছেলে-মেয়েদের আলাদা আলাদা বাসে বসার ব্যবস্থা করা হলেও সিনিয়র ছেলে-মেয়েরা প্রায় সকল বাসেই উপস্থিত আছে ভলেন্টিয়াররা হিসাবে। শিক্ষক- শিক্ষিকাদের পাশাপাশি এই ট্যুরে একদল সিনিয়র ছেলে-মেয়েদেরকেও নেওয়া হচ্ছে জুনিয়র স্টুডেন্টদের সুষ্ঠু শিক্ষা সফর নিশ্চিত করার লক্ষে। কঠোর নিষেধাজ্ঞা আর নজরদারিতে এই ট্যুরের যাত্রা শুরু হলেও বাসের ছেলে-মেয়েরা ডিজে গানে তালে হৈ হুল্লোড় আর আনন্দে মেতে উঠলো একটা সময় পর। কিন্তু মায়া সবার দলে নেই। সে মূলত মন খারাপে নিশ্চুপ বসে আছে। কি জন্য মায়ার মন খারাপ জানা নেই। শুধু উদাস আর অস্থির মনে ভিতর জ্বলছে ওর।

উদাস মায়া জ্বানালা ধরে বাহিরের দিকে তাকিয়ে। দৃষ্টি ঐ দূর সীমান্তে পাহাড়ের চৌড়ায়। সকালের মিষ্টি ফুরফুরে বাতাসের তেজে মায়ার মুখ ছুঁয়ে মাথার হিজাব উড়ছে সাঁ সাঁ শব্দে। জুই মায়ার পাশেই বসে। শ্রেয়া, নাদিয়া বসেছে পিছনের দুই সিট পরে। কিন্তু বাকি সবার মতো শ্রেয়া, নাদিয়াও ডিজে গানে তালে খৈ হারিয়ে নিজেদের সিট ছেড়ে সামনে মেয়েদের সাথে তাল মিলিয়ে মেতে আছে নাচ গানে। জুই সেটা ভিডিও করছে আর হাসছে। মোট কথা সবাই এনজয় মুডেই আছে। কিন্তু মায়া এসব নাচ গানে নেই। মায়ার স্বামী এসব পছন্দ করে না বলে মায়া ভদ্রতা বজায় রাখল। সিট ছেড়ে উঠলো না পযন্ত। এমনই মায়া রিদকে না বলে চুরি করে এই ট্যুরে যাচ্ছে। সেজন্য মায়ার ভিতরটা হাসফাস করছে অপরাধ বোধে। রিদ মায়ার ট্যুরে যাওয়ার বিষয়টা জানলে কি হবে মায়া জানে না। হয়তো রিদের অবাধ্য হওয়ায় সে মায়ার উপর রেগে যেতে পারে। কিন্তু কতটুকু রাগ করতে পারে তার ধারণা মায়ার আপাতত নেই। সেজন্য মায়া মন খারাপে সেই তখন থেকেই বাসে চুপ করে বসে। মায়ার মনে হচ্ছে এই ট্যুরে সে রিদের অবাধ্য হয়ে না গেলেও পারতো। মায়া উচিত হয়নি রিদের কথা অমান্য করে এই ট্যুরে যাওয়ার। মায়াদের একই বাসে আরিফকে দেখা যায় রাকিবের সাথে পিছনের সিটে ভলেন্টিয়ার হয়ে বসে আছে সিনিয়র হিসাবে। মাঝে মধ্যে এদিকটায় তাকিয়ে নিজের বোনদের খেয়ালও রাখছে সে। সবার হৈচৈ মাঝে জুই হঠাৎ মায়ার হাত টেনে নিজের দিকে ফেরাল। অতি গানের শব্দের একহাতে কান চেপে মায়ার দিকে ঝুকে চিল্লিয়ে বলল…

‘ কি হয়েছে তোর? সকাল থেকে দেখছি কেমন জানি ভয়ে সিটিয়ে আছিস। কোনো সমস্যা?

জুইয়ের কথায় মায়া মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি দিতে দিতে একই গলায় চিল্লিয়ে বলল…

‘ জুই আমার কেমন জানি অস্থির আর ভয় করছে। মনে হচ্ছে এই ট্যুরে উনার অনুমতি ছাড়া আমার আসাটা ঠিক হয়নি।

মায়ার মন খারাপের কারণ রিদ সেটা বুঝতে পেরে জুই খানিকটা অসন্তুষ্ট গলায় একই ভাবে বলল…

‘ তাহলে আসলি কেন স্বামীর কথা অমান্য করে? তোকে কে বলেছিল আসতে? নিজেই তো লাফিয়ে লাফিয়ে আসলি। এখন আবার ঢং করিস। এতোই যদি জামাই ভক্ত হতি তাহলে তাঁকে অমান্য করে লুকিয়ে এই ট্যুরে যেতি না বেয়াদব।

জুইয়ের কথায় মায়ার গলার স্বর খানিকটা কমে আসল অপরাধ বোধে…

‘ তোরা সবাই যাচ্ছিস বলে আমি নিজের মনকে বুঝাতে পারিনি। এজন্য উনাকে না বলেই চুপিচুপি তোদের সাথে যাচ্ছি। কিন্তু এখন কেমন জানি অস্থির আর ভয় করছে ভিতর ভিতর। মনে হচ্ছে আমি ভুল করেছি। সত্যি আমি ভুল করেছি জুই? কি করবো বলনা তুই?

মায়া অপরাধ বোধের বিষয়টা বুঝে জুই মায়াকে আশ্বস্ত দিয়ে বলল…

‘ এখন আর কিছু করার নেই। যা হওয়ার হয়ে গেছে। অলরেডি বাস ছেড়ে দিয়েছে। তাই এই সফরটা এনজয় কর। একটা দিনেরই ব্যাপার মাত্র। রাতে বাসায় ফিরে ভাইয়ার সাথে যোগাযোগ করে নিস। তাহলে দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। এখন আর মন খারাপ করিস না কেমন।

মায়া হাসফাস করতে করতে বলল…

‘ জুই আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আমি এই ট্যুর শেষ করে হয়তো আর ফিরতে পারব না।

মায়ার কথায় জুই তেমন গুরুত্ব দিল না। বরং বিরক্ত হয়ে মায়ার কপালে গুঁতো দিয়ে শাসন করে বলল…

‘ বাজে চিন্তা না করে ট্যুর এনজয় কর বলদ। আরিফ ভাইয়া আছে আমাদের সাথে। কিচ্ছু হবে না কারও।

জুইয়ের কথায় মায়া খানিকটা আশ্বস্ত হলো। আরিফ যে ওদের সাথে ট্যুরে যাচ্ছে সেটা মায়া ভুলে বসেছিল এতক্ষণে। কিন্তু জুইয়ের কথায় সেটা পুনরায় মনে পরতেই মায়ার মনের ভয়, সংশয়, অস্থিরতা খানিকটা কমে গেল। সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পিছনে তাকাল আরিফের খোঁজে। দেখলো আরিফ রাকিবের সাথে বসে খুবই আস্তে ধীরে কথা বলছে কিছু নিয়ে। মায়ার পিছনে তাকাতে আরিফও হঠাৎ এইদিকটায় তাকাল। বোনকে উঠে দাঁড়াতে দেখে আরিফ নিজের সিট ছেড়ে এগিয়ে আসতেই রাকিবও আরিফের পিছন পিছন এইদিকটায় এগিয়ে আসল। চলন্ত বাসে আরিফ মায়াদের সিটের কাছাকাছি আসতেই জিগ্যেসা করলো, ওদের কিছু প্রয়োজন কিনা? জুই মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানাতেই মায়া আরিফের দিকে তাকিয়ে হাসফাস করে বলল…

‘ ভাই আমার ভয় করছে।

‘ কিসের ভয় বোকা? ভাই আছি না।

‘ তারপরও ভাই আমার কেমন জানি অস্থির অস্থির লাগছে।

মায়ার কথায় আরিফ এগিয়ে এসে জুইয়ের উপর দিয়ে মায়ার কপালে একটা হাত ছুঁয়ে দেখল মায়ার কোনো অসুস্থতা আছে কিনা। মায়ার শরীরে তাপমাত্রা ঠিক দেখে আরিফ মায়াকে আশ্বস্ত করতে করতে বলল…

‘ কখনো লং বাস জার্নি করিসনি তো তাই হয়তো এমন অস্থির অস্থির লাগছে। আর কিছুক্ষণ পর দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। তোরও ভালো লাগবে। আচ্ছা তোদের ব্যাগে দেখ খাবার রাখা আছে, ঐগুলো খেয়ে নে। আর কিছু দরকার পড়লে ভাইকে ডাকিস কেমন। ভাই পিছনেই আছি।

মায়া ঘাড় কাত করে সম্মতি দিতেই আরিফ, রাকিব দুজনই জায়গা ছেড়ে নিজেদের সিটে গিয়ে বসল। মন খারাপের কারণে মায়া ব্যাগে খোলে খাবার পেতেই নিজের মন খারাপের কারণও ভুলে বসল। পুরো ট্যুর যাত্রায় হৈচৈ আর আনন্দে কাটালো সবার সাথে। শিক্ষক, সিনিয়রদের কঠোর নজরদারি আর গাইডলাইনে পুরো ট্যুর যাত্রায় কোনো স্টুডেন্টের কারও কোনো সমস্যা হলো না বিন্দুমাত্র। মূলত শিক্ষার সফর ট্যুরটি ছিল রাঙ্গামাটি ঝুলন্ত ব্রিজ, রাজবন বিহার, আর শুভলং ঝর্ণা পরিদর্শনে।
দর্শনীয় তিনটি স্থান পরিদর্শনের ট্যুর যাত্রা শেষ করে সন্ধ্যা ৭ঃ০০ নাগাদ পুনরায় চারটি বাস ছাড়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। ছাত্র-ছাত্রীরা সারাদিনের ঘুরাঘুরি আর ক্লান্তিতে সিটে ঝিমিয়ে বসে রইল। মায়া জুই সিটে হেলিয়ে ঘুমিয়ে। শ্রেয়া, নাদিয়ার অবস্থাও সেইম। বাসের মধ্যে যে-সকল ছাত্র- ছাত্রীরা জেগে আছে, তাঁরা মূলত ফোনে ব্যস্ত হয়ে আছে তাদের সারাদিনের তুলা ছবিগুলো দেখায় । রাত তখন ৪ঃ৪৫ ঘরে। বাস চারটে পুনরায় থামে একটা পাহাড়ি খাবার হোটেলের সামনে। রাতের খাবারটা সবাই এখানেই সারতে চাই। কারণ রাঙ্গামাটি পাহাড়িয়ান এলাকায় এরথেকে সামনে গেলে হয়তো ভালো মানের খাবার হোটেল পাওয়া যাবে না বলেই দলবল বেঁধে সকল স্টুডেন্টদের নিয়ে শিক্ষকরা এই রেস্তোরাঁয় নামলো খেতে। খুবই সর্তক আর গাইডলাইনের সাথে স্টুডেন্টের রেস্তোরাঁয় ভিতরে বসাল। দেড়শো স্টুডেন্টদের খাওয়া-দাওয়া আর ফ্রেশ হতে হতে প্রায় দেড় ঘন্টার উপর সময় লাগলো। রাত তখন ৪ঃ৪৫ থেকে প্রায় ১০ঃ২০ ঘড়ির কাঁটায় গিয়ে ঠেকেছে। এই খাওয়া দাওয়া পুরো সময়টাতে মায়া, জুই, নাদিয়া, শ্রেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছিল। এরমাঝে চারজনে ওয়াশরুমের কাজ সেড়ে পুনরায় আরিফের নির্দেশ অনুযায়ী বাসে গিয়েও বসেও পড়লো। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস গুলো ছেড়ে দিবে। ইতিমধ্যে সকল স্টুডেন্টের বাসে উঠা শেষ। ক্লান্ত মায়া পুনরায় জ্বালানা দিয়ে তাকিয়ে বাকি স্টুডেন্টদের দলবেঁধে গাড়ি উঠতে দেখার মধ্যে বেখেয়ালি হঠাৎ চোখ যায় রেস্তোরাঁ অদূরে কিছু ঝাপসা দৃশ্যের দিকে। কৌতূহল মায়া মাথা বের করে সেইদিকে উঁকি মেরে তাকাতেই আরও ঝাপসা কিছু দৃশ্য দেখলো সে। অতো দূর থেকে মায়া সেই দৃশ্য গুলো ঠিকঠাক বুঝতে পারলো না। তবে এতোটা বুঝতে পারলো সেখানে কিছু একটা হচ্ছে। মায়া সেইদিকে তাকিয়ে থেকে পাশের বসা জুইকে ডাকল উঁচু গলায়, মায়ার দেখা অদূরের সেই ঝাপসা দৃশ্যটা কি সেটা দেখানোর জন্য জুইকে ডেকে মায়া বলল..

‘ জুই! জুই! দেখতো রেস্তোরাঁর পিছনে কি? ঐখানে কি কিছু হচ্ছে নাকি? আচ্ছা ঐখানে আমাদের ক্লাসমেট রাফা না ওটা? কিন্তু ওহ ঐখানে কি করছে দেখতো?

অমনোযোগী জুই ফোন চালানোতে ব্যস্ত ছিল বলে, মূলত ওহ মায়ার কথায় তেমন মনোযোগ দিতে পারলো না। ওদের সারাদিনের তুলা ছবি গুলো দেখছিল জুই। তাই মায়ার কথায় অমনোযোগী ভাবে হালকা উঁকি দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে অদেখার মতোন করে পুনরায় জায়গায় বসে ফোন চালাতে চালাতে বলল…

‘ কই কিছুই তো নেই। যদিও কিছু থাকে তাহলে তোর এতো কিছু দেখা লাগবে কেন? চুপচাপ বসে থাক।

জুইয়ের কথায় মায়া তেমন পাত্তা না দিয়ে পুনরায় সেইদিকে তাকিয়ে রইল। মায়ার মন খসখস করছে রেস্তোরাঁর পিছনে ঘোর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে। পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় রেস্তোরাঁটাও পাহাড়ের সীমান্তে অবস্থিত। মায়া রেস্তোরাঁর পিছনে পাহাড়ি জঙ্গলের দিকটায় তাকিয়ে রইল। আবছায়া অন্ধকারে মায়ার মনে হচ্ছে সেখানে কিছু একটা হচ্ছে। কারা যেন রাফার সাথে জোরাজোরি করছে। মায়া অতো দূরে থেকে বেশ একটা বুঝতে পারছে না কিন্তু এতো দূর থেকে দেখে মায়ার কেন জানি তাই মনে হলো। যদিও মায়া সিউর না। কিন্তু তারপরও মায়া চোখের সামনের দৃশ্য গুলো হেলাফেলা করতে পারলো না। বরং মায়া পুনরায় জুইকে ডেকে সেই দৃশ্য দেখাতে চেয়ে একই ভাবে বাহিরের দিকে তাকিয়ে বলল…

‘ জুই একটু ভালো করে দেখেনা প্লিজ। রাফাকে মনে হয় কারা যেন তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আমি অন্ধকারে ঠিকঠাক বুঝে উঠে উঠতে পারছি না। আমার মনের ভুলও হতে পারে তাই তুই একটু দেখে বলনা আমি যা দেখছি তুই কি তাই দেখছিস নাকি? জুই!

মায়া পরপর কথায় উত্তর না আসার মায়া বিরক্ত নিয়ে পাশ ফিরে তাকাতে দেখলো জুই পাশের সিটে নেই। শ্রেয়া, নাদিয়ার সঙ্গে পিছনের সিটে বসে ফোনে কিছু একটা দেখছে তিনজন মিলে। অস্থির মায়া জুইকে না পেয়ে পুনরায় গাড়ির জ্বানালা দিয়ে বাহিরে তাকাল, দেখলো এবার আর রাফা নামক মেয়েটাকে আশেপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। মায়ার মন খসখসে গাড়ির সিট থেকে উঠে দাঁড়াল। উদ্দেশ্য একবার হোটেলের পিছনে গিয়ে রাফা মেয়েটার খোঁজ করে আসবে বাহিরে আছে কিনা সে, যদি রাফাকে না পায় তাহলে ভাববে মেয়েটা অবশ্যই কোনো না কোনো বিপদে আছে। তখন মায়া নাহয় কলেজের স্যারদের বিষয়টা জানাতে পারবে। কিন্তু মায়া আগে নিশ্চিত না হয়ে হুট করে যদি রাফা মেয়েটা বিপদে আছে এমন কথা রটায় তাহলে দেখা গেল পরে রাফা মেয়েটাকে সুস্থসবল দেখে মায়া লজ্জা পরে যাবে সবার সামনে বিভ্রান্তকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করার দায়ে। মায়া কোলের ব্যাগটা সিটের উপর রাখতে রাখতে কয়েক সিট পিছনে জুইকে উদ্দেশ্য করে পুনরায় ডেকে বলল….

‘ জুই আমি একটু নিচে যাচ্ছি আরিফ ভাইয়ার কাছে। এক্ষুনি চলে আসব।

মায়া কথায় জুই,শ্রেয়া, নাদিয়া তিনজনই এইদিকে তাকাল। মায়ার মুখে আরিফের নামটা শুনে জুই বিষয়টা তেমন গুরুত্ব দিল না বরং অল্প আপত্তি জানিয়ে বলল…

‘ ভাইতো আসবেই! তুই এখন নিচে নেমে কি করবি? গাড়ি তো এক্ষুনি ছেড়ে দিবে।

‘ গাড়ি ছাড়ার আগেই চলে আসব! একটু কাজ আছে নিচে।

‘ আচ্ছা যাহ। তাড়াতাড়ি আসিস।
‘ আচ্ছা!

মায়া ব্যাগ-ট্যাগ ফেলে খালি হাতে বাস থেকে নামল। আরিফ, রাকিব টিচার্সদের সাথে সামনের বাস গুলোতে স্টুডেন্টদের উঠানো কাজে ব্যস্ত। মায়া বসেছিল লাস্ট বাসটিতে। ওদের বাসে সবার কাজ শেষ বলে এই দিকে তেমন কারও হেয়াল নেই। মায়া বাস থেকে নেমে একবার ভাবল আরিফের কাছে যাবে। আরিফকে জানাবে মায়া ঐদিকে হোটেলের পিছনে রাফাকে দেখেছিল ওর সাথে কারা যেন ছিল। পর মূহুর্তে মায়া ভাবলো ওর মনের ভুলও হতে পারে সেজন্য মায়া আগে সেইদিকটায় একবার উঁকি মেরে দেখতে চাইল আসলে সেইদিকে কেউ আছে কিনা। ভাবনা অনুযায়ী মায়া সত্যি সত্যি বাসের উল্টো পথে হাঁটল। অল্পসল্প চিপা রাস্তা ধরে হোটেলের পিছনে এসে তেমন কাউকে দেখল না। বেশ অন্ধকার হওয়ায় আশেপাশে তাকাতেই মায়ার গা চমচম করে উঠলো ভয়ে। হোটেলের পিছনের দিকটায় বেশ উঁচু পাহাড় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। পাহাড়ি গাছ-গাছালিতে ঘেরা জঙ্গলের মতোন হয়ে আছে। মায়ার গা শিরশির করে উঠলো ভয়ে। অন্ধকারে আশেপাশের কাউকে দেখতে না পেয়ে মায়া ফিরতে গিয়েই কারও গোঙানির শব্দে কানে আসল। চমকে উঠার মতোন দ্রুত আশেপাশে তাকাল। তেমন কাউকে দেখতে না পেয়ে মায়া গোঙ্গানির শব্দ অনুসরণ করতে চাইল। থেমে থেমে অল্প শব্দ কানে আসতেই মায়া সেই শব্দ উৎস অনুসরণ করে একপা দুপা সামনে এগোতে এগোতে হোটেল থেকে বেশ খানিকটা দূরে পাহাড়ি চৌড়ায় উঠতে উঠতে দেখলো বেশ কিছু ছেলে একত্রে একটা মেয়ের হাত-পা, মুখ বেঁধে মেয়েটিকে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে তাড়াহুড়ো করে। আতকে উঠার মতোন মায়া থমকে গেল অন্ধকারের মধ্যে ওদের কলেজের সাদা ড্রেস পরিহিত মেয়েটিকে দেখে। তারমানে মায়া তখন গাড়িতে বসে ঠিক দেখেছিল। এই মেয়েটিই রাফা ছিল। আর এই ছেলে গুলো তখন রাফাকেই জোর-জবরদস্তি করে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল। অনেক দূর হওয়ায় মায়া তখন সেটা বুঝতে পারেনি। এজন্যই মায়া জুইকে এতোবার বলেছিস এইদিকটায় তাকাতে। বেখেয়ালি জুই তখন যদি মায়ার কথা গুলো একবার মনোযোগ দিয়ে শুনতো বা দেখতে চাইতো মায়া আসলে কি দেখাতে চাইছে ওকে তাহলে আজ রাফা মেয়েটা বিপদে পড়তো না। তার আগেই মায়া সবাইকে জানিয়ে রাফা মেয়েটাকে এইছেলে গুলোর হাত থেকে বাচিয়ে নিতো। আতঙ্কিত মায়া কি করবে চট করে বুঝতে পারলো না। এখন যদি মায়া দৌড়াদৌড়ি করে পুনরায় বাসের কাছে ফিরে যায় সবাইকে এটা জানাতে ওদের কলেজের রাফা নামের একজন শিক্ষার্থী বিপদে পরেছে কারা যেন মেয়েটাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে সেটা বলতে, তাহলে সবাইকে নিয়ে মায়া ফিরে আসতে আসতে রাফা মেয়েটাকে হারিয়ে ফেলবে ওহ। আবার এই মূহুর্তে মায়া একা রাফার পিছনে গিয়েও কোনো লাভ নেই, ওর দ্বারা এতো গুলা ছেলের থেকে মেয়েটাকে একা বাঁচানো সম্ভব না। অস্থির মায়া কি করবে বুঝতে না পেরে ঐ পাহাড়ি নেশাখোর ছেলে গুলোর পিছনে হাঁটল। অন্তত কোথায় নিয়ে যায় রাফাকে সেই লোকেশন দেখে নাহয় মায়া পুনরায় ফিরে এসে সবাইকে জানাবে সেটা। ভাবনা অনুযায়ী মায়া তাই করলো। হোটেল থেকে বেশ অনেকটা দূরে নিয়ে যায় রাফাকে ছেলে গুলো। পাহাড়ের শিষ্য চৌড়ায় এনে রাখল মেয়েটিকে হাত পা, মুখ বাঁধা অবস্থায়। তার কিছুটা সামনেই আগুন জ্বালিয়ে হৈচৈয়ে নেশা করা বুদ হলো একেকজন। এই সবকিছুর মাঝে মায়া ছেলে গুলোর পিছন ছুটতে ছুটতে অন্ধকারের মাঝে নিজেদের হোটেলের রাস্তা ভুলে বসল। এই অচেনা অজানা পাহাড়ি এলাকায় মায়া নতুন। কোন দিকে মূল রাস্তা আর কোন দিকে বিপদ সংকেত তাও জানা নেই মায়ার। আতঙ্কিত মায়া রাফার খোঁজে নিজের জীবনও বিপদের ফেলল। পাহাড়ের চৌড়ায় উঠতে উঠতে অসংখ্য বার উঁচু নিচু গর্তে হুঁচট খেয়ে পরায় গায়ের সাদা ড্রেস লাল মাটিতে ময়লা ময়লা করে ফেলেছে ততক্ষণে, তারপরও হাল ছাড়েনি। নিশ্চুপের ছেলে গুলোর পিছনে ছুটতে ছুটতে নিদিষ্ট গন্তব্য পযন্ত পৌঁছাল। পাহাড়ি গাছের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে দেখল প্রায় আট থেকে দশজনের মতো পাহাড়িয়ান নেশাখোর ছেলেপেলে হবে। আর এদের বসবাস মূলত পাহাড়ের চৌড়ায় হয়ে থাকে। মায়া আশেপাশের গা ছমছম করা পরিবেশটা দেখল। পাহাড়ী গাছের ডালপালা কেটে বসার মতোন একটা টুল বেঁধে রেখেছে। এর পাশেই একটা বাঁশের চৌকি দেখা গেল। আর মাঝের খালি জায়গাটাতে ছেলেগুলো গোল করে বসে মধ্যস্থতায় আগুন জ্বালিয়ে হাতের তালুতে কিছু একটা ঘঁষে ঘঁষে বার বার সেটা মুখে দিয়ে নেশা করছে তাঁরা। মূলত বোকা মায়ার ধারণা নেই পাহাড়ীয়ান নেশাখোর ছেলেগুলোর ভয়ংকরতা সম্পর্কে। যদি থাকতো তাহলে কখনোই নিজের জীবন বিপদে ফেলে একা মেয়ে হয়ে অন্য মেয়েকে বাঁচাতে আসতো না এই মধ্যরাতে। বরং দ্রুত নিজের কলেজের কর্তৃপক্ষদের জানাতো বিষয়টি। মায়ার বোকামিতে সে নিজেই ফেঁসে গেল। আর এই বিষয়টা সম্পর্কে ওর নিজেরও জ্ঞান ছিল না। মূলত পাহাড়ীয়ান নেশাখোর ছেলেদের কোন জাত বংশ হয়না। তাঁরা বেনামি পাহাড়ি জঙ্গি বলে মানুষের কাছে পরিচিত। এদের দিয়ে অন্ধকার জগতের সকল কাজ করায় দুনিয়ার ক্ষমতাশীল মানুষরা। চুরি, ছিনতায়, ডাকাতি, ধর্ষণ, অপহরণ, নারী পাচার, অস্ত্র পাচার, কিডন্যাপিং, জঙ্গি আর দুনিয়ার সকল অরাজগতা কাজ করানো হয় এসব পাহাড়িয়ান নেশাখোর ছেলেপেলেদের দিয়ে। এমন ভয়ংকর জঙ্গিদের হাতে কোনো ছেলে মানুষ পড়লেই তার জীবন নিয়ে ফিরতে পারে না সেখানে মায়া একা মেয়ে হয়ে এসেছে আরেকজন মেয়েকে বাঁচাতে। নিরস্ত্র মায়ার হাতে একটা ফোন পযন্ত নেই যে কারও কাছে সাহায্য চাইবে। খালি হাতে বান্ধবীকে বাঁচাতে এসে সে নিজের জীবনও রিস্কে টানল। কিছুসময় পার হতেই পরিস্থিতি অল্প শিথিল হলো। ছেলেগুলোকে নেশায় মেতে থাকতে দেখে মায়া গাছের আড়াল হতে অল্প উঁকি মেরে দেখল রাফাকে। মায়ার থেকে কিছুটা দূরে রাফাকে ছেলেগুলোর ওর হাত,পা মুখ বাঁধা অবস্থায় ফেলে রেখেছে মাটিতে। হয়তো নেশা করার পরপরই ঝাপিয়ে পরার চিন্তা ভাবনা। মায়া আর কিছুই ভাবলো না, নিজের ক্লাসমেটকে বাঁচাতে হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে বসল রাফার পিছনে। রাফা তখন নিজের হাতে পায়ের বাঁধন ছাড়ানোর চেষ্টায় আর্তনাদের চিৎকার করার মতোন গোঙ্গাচ্ছিল ছাড়া পাওয়ার জন্য। মাটিতে পরে ছটফট করার সময় হঠাৎ পায়ের কাছে যখন কারও উপস্থিত বুঝতে পারল তখন আতঙ্কিত রাফা প্রাণ বাঁচাতে প্রহার করে বসল মায়াকে। নিজের দুপা একত্রে বাঁধা অবস্থায় লাথি মারল মায়াকে। আঘাত পেয়ে ছিটকে পরার মতোন উল্টে পরলো মায়া। রাফা মনে করেছিল নেশাখোর ছেলে গুলোর মধ্যে কেউ একজন হবে ওকে ছুঁয়ার চেষ্টা করছে। সেজন্য গোঙ্গানি অবস্থায় মাথা তুলে পায়ের কাছটায় তাকাতেই দেখল মায়াকে পুনরায় দৌড়ে গাছের পিছনে লুকাতে। মায়াকে দেখেই আতঙ্কিত রাফা সুস্হির হলো। শেষ ভরসার আশ্রয় খোঁজে মায়াকে উদ্দেশ্য করে গাছের পিছনে তাকিয়ে আরও জোরে জোরে গোঙ্গাতে লাগাল ওকে বাঁচাতে। অথচ মায়া রাফাকে বাঁচাতে এসেও ওহ কেন পুনরায় পালিয়ে গেল সেটা বুঝতে রাফার আরও কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল যখন দেখল একটা নেশাখোর ছেলে এইদিকটায় এগিয়ে আসছে রাফার উদ্দেশ্যে। মূলত রাফার তখন মায়াকে দেখে হঠাৎ চিৎকারের শব্দে এই ছেলেটিকে পাঠিয়েছে দেখতে বাকি ছেলে গুলো। পাহাড়ি এলাকায় বনপ্রাণী বেশি থাকে। এরা একা মানুষ পেলে আক্রমণ করে বসে। সেজন্য রাফার চিৎকারে দেখতে আসল কোনো বনপ্রাণী আক্রমণ করেছে কিনা। কিন্তু আশেপাশে তেমন কিছু দেখতে না পেয়ে রাফার সামনে ছেলেটি বসতে বসতে ওর গাল আকড়ে ধরে ঝরঝরে চট্টগ্রামের ভাষায় নেশাক্ত গলায় বলল…

‘ শালী হুদাই না চিল্লায়া শরীরে শক্তি ধরে রাখ। দশটা পুরুষ মানুষের সারারাত মনোরঞ্জন করতে তোর অনেক শক্তির প্রয়োজন হবে। নেশা করবি? তাহলে তোরও আমাদের মতোন বহুত শক্তি হইব শরীরে। তখন আমাদের মজা দিতে পারবি, তুইও মজা লইতে পারবি। দাঁড়া আনতেছি তোর জন্য নেশা।

কথা গুলো বলেই আবারও ছেলেখোর ছেলেটা হেলতে দুলতে হাঁটল বাকি ছেলেদের উদ্দেশ্যে। হয়তো নেশা নিয়ে ফিরবে আবার। ছেলেটিকে চলে যেতে দেখে মায়া পুনরায় গাছের পিছন হতে বের হলো। এবার মায়াকে দেখে রাফা তেমন একটা হৈচৈ করলো না। বরং চুপ রইলো। তাড়াহুড়োর মায়া দ্রুত হাতে রাফার পিঠে ওর হাতের বাধন খোলে দিতেই রাফা উঠে বসল। মায়া ওর পায়ের বাঁধন খুলতে খুলতে রাফা নিজে ওর হাতে বাঁধন খোলে আতঙ্কিত গলায় খানিকটা উঁচু স্বরে মায়াকে শুধালো…

‘ তুই এখানে কিভাবে এসেছিস মায়া?

রাফার উঁচু গলায় আতঙ্কিত হলো মায়া। তাড়াহুড়োয় তৎক্ষনাৎ রাফার মুখ চেপে মায়া সর্তক করতে করতে ফিসফিস গলায় বলতে চাইল..

‘ আস্তে কথা বল রাফা! নয়তো ধরা পড়ে যাব আমরা।

মায়ার সর্তকতায়ও তেমন কাজ হলো না। রাফার বোকামিতে ততক্ষণে চলে যাওয়া ছেলেটিও পিছন ঘুরে তাকাল মেয়েলি কন্ঠ শুনে। দেখল ওদের ধরে আনা মেয়েটিকে অন্য নতুন আরেকটা মেয়ে মুখ চেপে ধরে আছে ছাড়া পাওয়া অবস্থায়। নতুন মেয়ে মায়াকে দেখেই নেশাখোর ছেলেটি চিল্লিয়ে উঠে বাকিদের উদ্দেশ্যে, পুনরায় চট্টগ্রামের ভাষায় ডেকে বলল…

‘ কিরে কই তোরা? দেখ এইখানে আরও একটা নতুন মাইয়া আইছে। আমাদের পুরাতন মাইয়াডারে তো ছাড়াই নিইয়া যাইতেছে। তোরা কই তাড়াতাড়ি আয়। ধর শালীদের।

বগল থাবার মতোন রাফার এক চেপে আতঙ্কিত মায়া তৎক্ষনাৎ দৌড়াল পাহাড়ি এলোমেলো রাস্তা ধরে। কোথায় যাচ্ছে? কোন রাস্তা ধরে দৌড়ালে হোটেলে পৌঁছাতে পারবে তার কিছু জানা নেই মায়ার। শুধু জানে এই ছেলেগুলোর হাত থেকে নিজেকে এবং রাফাকে বাঁচাতে হবে। হয়তো রাফার তখন ঐভাবে চিল্লিয়ে কথা গুলো না বললে দুজন নিশ্চুপে পালিয়ে আসতে সক্ষম হতো। কিন্তু ভয়ার্ত রাফার বোকামিতে ওর সাথে সাথে মায়াও ফেঁসে গেল জঙ্গিদের হাতে। আতঙ্কিত দুজন প্রাণের ভয়ে যেইদিকে দু’চোখ যাচ্ছে সেই দিকেই দৌড়াচ্ছে। অথচ অচেনা পথে দৌড়ানোতে দুইজন আবারও নতুন করে বিপদের সক্ষমহীন হবে কিনা জানা নেই কারও। পিছনের পাহাড়িয়ান জঙ্গি গুলোর খাক ছেড়ে চিল্লানোর শব্দ শুনা যাচ্ছে অনবরত। আতঙ্কিত দুই বান্ধবী পিছনে না তাকিয়ে বুঝতে পারছে ছেলেগুলো ওদের উদ্দেশ্যেই ঝড়ের বেগে দৌড়ে আসছে। প্রাণপূর্ণ দৌড় আর হুঁচট খেতে খেতে পাহাড়ের চৌড়ায় থেকে দেখল সারিবদ্ধ ভাবে মায়াদের কলেজের বাস চারটে চলে যাচ্ছে পাহাড়ের বুক ঘেঁষে রাস্তা দিয়ে। বাসের উজ্জ্বল আলোয় মায়াদের মোটেও চিনতে ভুল হলো না নিজেদের কলেজ বাসগুলোকে। আতঙ্কিত মায়া আরও আতঙ্কিত হলো নিজের আপনজনদের ওদের রেখে চলে যেতে দেখে। মায়াদের বাসগুলো ওদের খোঁজ না করেই চলে যেতে দেখে পাহাড়ের চৌড়ায় থেকেই মায়া রাফার হাত চেপে সেদিকে দৌড়াতে দৌড়াতে চিল্লাতে চাইল বাস গুলোকে থামাতে। কিন্তু পরমূহুর্তে সর্তকতায় আর চিল্লাল না। পিছনের পরে থাকা ছেলে গুলো যদি ওদের খোজ পেয়ে যায় সেজন্য। দিনের আলোয়ই পাহাড়ি উঁচু নিচু রাস্তায় চলা মুসকিল। হুচট খেয়ে পাহাড়ের উপর থেকে তলদেশে পড়ার সম্ভবনা বেশ। এমতবস্থায় রাতের এগারো-টায় চাঁদ বিহীন অন্ধকারে পাহাড়ের রাস্তায় দৌড়ানোটা আরও ভয়ংকর। জানাশুনা ট্রেনিং প্রাপ্ত ট্রেনারও এমন রাতে পাহাড়ের বুকে নামে না পাহাড়ি জঙ্গি বিষাক্ত জীব বস্তু বা বিষধর সাপের তাড়নায়। সেখানে দুটো মেয়ে হয়ে ওদের চারদিক থেকে বিপদ আর বিপদ জড়িয়ে। ভয় পেয়ে থেমে গেলে নেশাখোর ছেলেদের হাতে ইজ্জত খইয়ে মরতে হবে। আর নয়তো প্রাণের তাগিদে দৌড়াতে চাইলে যেকোনো সময় পাহাড়ি হিংস্র প্রাণী বা বিষাক্ত সাপের কবলে পরে মরতে হবে। মোট কথা নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে মায়া প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে রাফার হাত চেপে দৌড়াচ্ছে চলে যাওয়া বাস গুলোকে ধরতে। বেখেয়ালি দৌড়ানোতে একটা সময় অন্ধকারের ছোট গর্তে হুঁচট খেয়ে দুজনই উল্টে পরলো পাহাড়ের উঁচু থেকে নিচে। আর এই উল্টে পরা দুজনের বেশ কাজে দিল। পাহাড়ের উপর থেকে সোজা রাস্তায় এসে পরলো। মায়া থেকে বেশ কিছুটা দূরে ছিটকে পরলো রাফা। হাতে পায়ে, শরীরের জায়গা জায়গা ব্যথা পেল দুজনই এতো উঁচু থেকে পরায়। আতঙ্কিত মায়া ব্যথায় গোঙ্গিয়ে উঠে বসতে বসতে নিজেদের বাসের খোঁজ করলো। দেখল মায়াদের থেকে বেশ খানিকটা দূরে বাস চারটে চলে যাচ্ছে। বসে থেকেই মায়া চেঁচাল বাস গুলোর উদ্দেশ্যে। মায়ার দেখাদেখি রাফাও সেইম কাজ করলো। কিন্তু বাস গুলোকে থামতে না দেখে মায়া নিজের শরীরে ব্যথা ভুলে পুনরায় রাফার হাত চেপে টেনে তুলে দৌড়াল বাসের পিছন পিছন। এমনই দীর্ঘ সময় ধরে পাহাড়ের উঁচু-নিচু রাস্তা ধরে দৌড়াচ্ছে দুজন। এখন আবার চলন্ত বাসের পিছন পিছন দৌড়াতে হচ্ছে ওদের জন্য থামতে। কিন্তু চলন্ত বাস গুলোতে মায়াদের ডাক পৌঁছাল না। আর না মিউজিকের জন্য কেউ শুনতে পেল বুক ফাটা দুই কন্যার আর্তনাদের চিৎকার।

‘ বাস থামাও কেউ। আমাদের নিয়ে যাও। আরিফ ভাই! আরিফ ভাই! আমরা বিপদের পড়েছি আমাদের বাঁচাও। জুই! জুই! এই জুইইইইই!

মায়া, রাফার পরপর চিৎকারের শব্দে দুপাশের পাহাড়ের প্রতিধ্বনি হয়ে পুনরায় সেটা ফিরত আসছে তারপরও চলন্ত বাসের কেউ শুনলো না ওদের আর্তনাদের চিৎকার। দৌড়াতে দৌড়াতে বাস গুলো চোখের সামনে থেকে বহুদূর চলে যেতে দেখে থামে দুজন। দীর্ঘ সময় ধরে বাসে পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে নিশ্বাস ফুলে আসে দুজনের হাঁপাতে হাঁপাতে। গলা শুকিয়ে দুজনের কাশি উঠলো অনবরত। কাশতে কাশতে নিশ্বাসের অভাবে দুজনই মাঝ রাস্তায় বমিও করে বসলো। ক্লান্তিতে হাঁটু গেড়ে রাস্তায় বসতেই ওদের কানে আসলো ছেলেগুলোর হুংকারের শব্দ। ভয়ার্ত মুখে দুজনই তৎক্ষনাৎ পিছন ফিরে তাকাতেই দেখল বাকি ছেলেগুলোর একজন ওদের ঠিক কাছাকাছি চলে এসেছে। মায়ারা এতক্ষণ বাসের পিছনে দৌড়ানোর ফলে পিছনে পরে থাকা গুন্ডা গুলোর কথা প্রায় ভুলে বসেছিল দুজন। কিন্তু এখন আতঙ্কিত দুই বান্ধবী পিছন ফিরে তাকাতেই দেখল মোটা লাঠি হাতে একজন ছেলে দৌড়ে আসছে মায়াদের দিকে। বাকি ছেলে গুলো হৈচৈ করে পাহাড়ের চৌড়া থেকে নিচে নামছে চিল্লাতে চিল্লাতে। আতঙ্কিত দুই বান্ধবী তৎক্ষনাৎ প্রাণের ভয়ে উঠে দাঁড়াল। পুনরায় রাফার হাত চেপে মায়া একই ভাবে দৌড়াতে গেলে পিছনে দৌড়ে আসা ছেলেটা হাতের মোটা লাঠিটা ছুড়ে মারলো মায়ার উদ্দেশ্যে। দক্ষ হাতের ঢিলে মায়া পায়ে আঘাত পেতেই মুখ থুবড়ে পরলো পিচ ঢালা রাস্তায়। এক ভাবে রাফাও পরলো মায়ার সঙ্গে। সেই সুযোগে এগিয়ে আসা ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে আটকাল মায়াদের। মায়ার উপর ক্ষোভ থেকেই প্রথম প্রহার করলো মায়াকে ছেলেটি। মায়ার হিজাবের উপর দিয়ে মায়ার চুলের মুঠি চেপে ধরে বিশ্রী ভাষায় গালি দিতে দিতে বলল…

‘ শালী অনেক দৌড় করিয়েছিস। আজকে দেখব তোর শরীরে কতো তেজ।

একহাতে মায়ার চুলের মুঠি চেপে অন্যহাতে রাফাকেও আটকাল। নিজের বাকি সঙ্গীদের ডেকে চট্টগ্রামের ভাষায় চিল্লিয়ে বলল ছেলেটি…

‘ এই তোরা কই? এদিকে আয়! শালীদের ধরেছি তাড়াতাড়ি আয়। আমা…. আহ!!

বাকি কথা গুলো শেষ করার আগেই ভাঙ্গা রাস্তার ভাঙ্গা ইট তুলে এলোমেলো ভাবে নেশাখোর ছেলেটির চোখ আর কপাল মিলিয়ে আঘাত করলো মায়া। আঘাতের তাড়নায় চিৎকার করে তৎক্ষনাৎ মায়ার চুল ছেড়ে নিজের চোখে হাত দিতেই উঠে দাঁড়াল মায়া। রাস্তায় পরে থাকা রাফা হাত টেনে তুলে পুনরায় পাহাড়ি রাস্তা ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে আতঙ্কিত মায়া রাফার উদ্দেশ্যে বলল…

‘ আমাদের বাঁচানোর মতো আর কেউ নেই রাফা। নিজের প্রাণের লড়াই এবার আমাদেরই করতে হবে। আমাদের আপনজন গুলো আমাদের ছেড়ে চলে গেছে রাফা। এখন আল্লাহ ভরসা। তিনি আমাদের সহায় হবেন ইনশাআল্লাহ। শুধু পা থামাস না তাহলেই হবে।

দীর্ঘ সময় দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্তিতে হাঁপিয়ে উঠেছে দুজনই। শ্বাস ফুলে যাচ্ছে শরীর ছেড়ে দিচ্ছে আঘাতে আঘাতে। মায়া অনুভব করলো ওর ডানপায়ে ভিষণ ব্যথা আর ভিজা অনুভব করছে। হয়তো তখনকার ছেলেটি মায়াকে লাঠি ছুড়ে মারায় ওর পা কেটে রক্ত ঝড়ছে। কিন্তু তারপরও নিজের দৌড় কমাল না। মায়ার সঙ্গ ধরে রাফাও দৌড়াতে দৌড়াতে কান্না মিশ্রিত গলায় বলল…

‘ আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে মায়া, যেকোনো সময় জ্ঞান হারাব মনে হয়। আজ আমাদের মৃত্যু নিশ্চিত। ওরা আমাদের ধরতে পারলে জানে মেরে ফেলবে।

শরীরের ব্যথা, আঘাতে, ভয়ে চোখ দিয়ে পানি মায়াও পরছে। কিন্তু তারপরও হাল না ছেড়ে দৌড়াতে দৌড়াতে রাফাকে সাহস দিয়ে বলল…

‘ আল্লাহ ভরসা রাফা। হাল ছাড়িস না। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করবেন ইনশাআল্লাহ। তারপরও আজ যদি মরতে হয় তাহলে ইজ্জত সম্মানে মরবো। কিন্তু তারপরও এসব নোংরা জঙ্গিদের হাতে ইজ্জত খুয়াব না। আয়।

সারি সারি পাহাড়ের বুক ঘেঁষে তৈরি করা যানবাহনের রাস্তা। রাস্তার দুই পাশে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একেকটি পাহাড়। আবার সেই পাহাড়ের গায়ে হেলিয়ে উঠে আছে যেন অন্য একটি পাহাড়। ছোট-বড় উঁচু নিচু অসংখ্য পাহাড়ের মেলা দেখা যায় দিনের আলোয় এইদিকটায়। কিন্তু রাতের আলোয় সেই পাহাড় গুলো ভয়ংকর কালো ছায়া ছাড়া তেমন কিছুই দেখা বা বুঝা যায় না। এমন অন্ধকার রাতে দুই পাহাড়ের বুক ঘেঁষে মায়া রাফার হাত চেপে দৌড়াচ্ছে উদ্দেশ্য বিহীন গন্তব্যে। আশেপাশে বাড়িঘর, মানুষজনের চিহ্ন পযন্ত নেই যে কারও কাছে সাহায্য চাইবে। আছে শুধু নিস্তব্ধ পাহাড়ের হাহাকার আর ঝিঁঝি পোকার শব্দ, অসংখ্য বনশেয়ালের খাক ছাড়া হুংকারের ডাকও শুনা যাচ্ছে। এই অচেনা জায়গার নাম, ঠিকানা, লোকেশন কিচ্ছু জানা নেই মায়ার। এমন কি ওরা কোথায় আছে তাও জানে না। মায়া দৌড়াতে দৌড়াতে পিছন ফিরে দেখল ছেলে গুলোর অবস্থা কোথায়? আহত ছেলেটাকে ঘিরে বেশ কয়েকজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। বাকি ছেলে গুলো এইদিকটাই এগিয়ে আসছে মায়াদের ধরতে। এইখান থেকেও মায়া ওদের চিৎকারের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। সেজন্য মায়া বুদ্ধি খাঁটিয়ে আর সোজা রাস্তা ধরে দৌড়াল না। কারণ সোজা রাস্তা ধরে দৌড়ানো মানেই একটা সময় ছেলেগুলো হাতে সহজেই ধরা পড়ে যাওয়া হবে। পিচ ঢালা রাস্তায় মায়াদের সরাসরি দেখতে পারবে সেজন্য ওদের ধরাও সহজ হবে। কিন্তু পাহাড়ী রাস্তা ধরে দৌড়ালে ওদের খোঁজ পাওয়াই মুশকিল হবে। মায়াদের দেখতে না পারলে খোঁজ মুশকিল হবে বলেই মায়া সোজা রাস্তা থেকে পাহাড়ি রাস্তা ধরল রাফাকে নিয়ে। অচেনা অজানা পাহাড়ের বুকে উঠতে লাগল অন্ধকারের মাঝে। কোথায় যাচ্ছে জানা নেই কিন্তু এই রাতে পাহাড়ের মাঝেই কোথাও একটা আশ্রয় নিতে হবে ওদের। নয়তো বেশিক্ষণ দৌড়া ওদের দ্বারা আর সম্ভব হবে না। অলরেডি দুজনের শরীর ছেড়ে দিচ্ছে আঘাতে আঘাতে। মায়ার আঘাত প্রাপ্ত পায়ে আরও আঘাত পাচ্ছে পাহাড়ের উঁচু নিচু গর্তে আর গাছের ডাল পালায় হুঁচট খেতে খেতে। দৌড়াতে দৌড়াতে পাহাড়ের মধ্যস্থতায় ছোট গোহায় সন্ধান পেতেই মায়া সেটাতে ঢুকে পরলো রাফাকে নিয়ে। চেপে চেপে দুই বান্ধবী একত্রে বসতেই মায়া দ্রুত ছোট ছোট গাছপালা টেনে গোহার মূখ ডেকে দিল। ভয়, অস্থিরতা, আতঙ্কে দুজনই সিঁটিয়ে বসল।

দীর্ঘ সময়ের দৌড়াদৌড়িতে শ্বাস ফুলে বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে দুজনই। এর মাঝে ছেলেগুলো দৌড়াদৌড়ি আর খাক ছেড়ে হুংকারের শব্দ শুনা গেল গুহার সামনেই। আতঙ্কে রাফা কেঁদে উঠতেই মায়া দ্রুত ওর মুখ চেপে ধরল ভয়ে। অন্ধকার মাঝেই রাফার মুখ চেপে মায়া ওকে আটকাল শব্দ করা থেকে। একবার যদি কোনো কারণে ছেলেগুলো হাতে ধরা পরে তাহলে এবার আর প্রাণের রক্ষা হবে না। আতঙ্কিত মায়া ততক্ষণ পর্যন্ত রাফার মুখ চেপে রইল যতক্ষণ পযন্ত ছেলেগুলো ওদের গুহা হতে দূর না যাচ্ছে। এর মাঝেই দেখতে পেল ছেলেগুলো হাতে ফোনে আলোয় ওদের সন্ধান করতে। রাগান্বিত ছেলেগুলো মায়াদের খোঁজতে খোঁজতে গুহার সামনে দাঁড়াতে দাঁড়াতে গালি দিয়ে বলল…

‘ শালী দুইটা জীবনের দৌড় করাচ্ছে আজ। একবার শুধু পাইয়ানেই দুইডারে কুবাইয়া মারুম শালীগো। নতুন মাইয়াডা আছে না যেটা আমাদের তুইলা আনা মাইয়াডারে ছাড়াইয়া লইয়া গেল? ঐ মাইয়াডা বেশ চতুর। এই শালীই আমাদের এতো দৌড় করাচ্ছে। একবার খালি এই শালী ধরতে পারলে সবার আগে কুবাইয়া মারুম এইডারে। তারপর শালীর কাঁচা মাংস সিদ্ধ ছাড়াই কাঁচা খামু। এই শালী আমার শরীরে জিদ উঠায় দিসে। এইডা না ধরা পযন্ত শান্তি নাই। এই সবাই একত্রে দৌড়ানোর দরকার নাই। সবাই আলাদা আলাদা হইয়া দৌড়া। মাইডা দুইডা আশেপাশেই হইব। এই পাহাড়ের বেশিক্ষণ দৌড়াইতে পারব না। এর থেকে সামনে গেলেই ডাকাতে হাতে পরবো। এর আগেই আমাদের মাইয়া দুইডারে ধরতে হইব।

ছেলেটির কথা হৈচৈয়ের বাকি ছেলেগুলো সম্মতি দিয়ে সবাই আলাদা আলাদা হয়ে ছড়িয়ে পরলো মায়াদের খোঁজতে। গুহার সামনে কারও উপস্থিত ঠাহর না পেয়েই রাফার মুখ ছাড়ল মায়া। বুকে হাত বেঁধে মায়া সুস্থির নিশ্বাস নেওয়ার মধ্যেই রাফা ভয়ার্ত গলায় মায়াকে উদ্দেশ্য করে বলল…

‘ মায়া ওরা সবাই তো তোর উপর ভিষণ রেগে আছে আমাকে ছাড়িয়ে এসেছিস বলে। আমার জন্য তুই তোর নিজের জীবনও বিপদে ফেলে দিলি। আজকে তুই না থাকলে এতক্ষণে হয়তো আমার সবশেষ হয়ে যেতো ছেলেগুলোর হাতে। তোর ঋণ আমি কোনোদিন শেষ করতে পারবো না। তুই আমার জন্য ফেরেশতা হয়ে এসেছিস।

‘ আর তুই আমার জন্য রিনা খান হয়ে এসেছিস এই ফাটা বাশ গলা নিয়ে। বারবার সর্তক করছি উচু গলায় কথা না বলতে তারপরও ফাটা বাঁশের মতোন চিল্লিয়ে কথা বলছিস। তোর এই বাঁশ গলার জন্য আজ এই অবস্থা আমাদের। নয়তো সেই কখন তোকে নিয়ে চুপিসারে পালিয়ে যেতাম। গলার এতো জোর থাকলে তখন রাস্তায় পরে চিল্লালি না কেন? অন্তত তোর গলার জোরে আমাদের বাস থেমে যেতো। আমরাও নিরাপদে থাকতাম।

পুনরায় রাফার উঁচু গলায় মায়া খানিকটা রাগ নিয়ে উক্ত কথা গুলো ফিসফিসিয়ে শুধাল রাফাকে। মায়ার কথায় রাফা চুপ করে গেল। সত্যি তখন রাফা মায়াকে দেখে বোকামি করে না চিল্লালে হয়তো এখন ওদের এতো দৌড়াদৌড়ি করতে হতো না। নিশ্চুপে পালিয়ে আসতে পারতো। রাফা নিজের ভুল বুঝতে পেরে মায়ার সঙ্গে আরও চেপে বসল। মায়া উদ্দেশ্য করে নরম গলায় ফিসফিসিয়ে বলল…

‘ তুই অনেক সাহসী মায়া। তোকে দেখে এতো সাহসী মনে হয়না। মনে হয় তুই ভিষণ বোকা আর সহজ সরল মেয়ে হবি। আচ্ছা তোর ভয় করছে না? ছেলেগুলোর হাতে ধরা পরলে কি হবে আমাদের সেটা ভেবে?

রাফার কথায় মায়া মাটির দেয়ালে হেলিয়ে বসল। ডানপায়ে ভিষণ ব্যথা করছে ওর। অন্ধকারে মায়া নিজের ডানপাটা ছুঁতেই চোখ খিঁচে গেল ব্যথায়। বুঝতে পারলো পা কেটে জখম হয়ে গেছে পুরোটা পা। মায়া দু’হাতে ডানপাটাকে কাছে টানতে টানতে রাফার কথার উত্তরের বলল…

‘ ভয় পেলে কি হবে? আমাদের কে বাঁচাতে আসবে এখানে? আশেপাশে দেখছিস কাউকে তুই ? তাহলে ভয় পেয়ে নিজেকে গুন্ডাদের হাতে তুলে দিব কেন বল আমাকে?

অন্ধকারে মায়ার পায়ের আঘাতটা ঠাহর করতে পারলো রাফা। সেজন্য একই ভাবে বলল…

‘ আমি তা বলিনি। আসলে আমি বলতে চাচ্ছিলাম এমন একটা পরিস্থিতির মাঝে তুই এতো সাহস কোথায় থেকে পাচ্ছিস? আমার তো ভয়ে জান বের হয়ে যাচ্ছে।

‘ আমি জানি না রাফা এতো সাহস কোথায় থেকে পাচ্ছি। তবে আজ আমার মনের জোর এমনই আসছে বলেই নিজেকে ভিষণ সাহসী মনে হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে আজ লড়াই করে হলেও নিজেকে বাঁচাতে হবে কারণ আমি অন্য কারও আমানত। আমাকে না পেলে সে পাগল হয়ে যাবে। আমার তাঁর জন্য হলেও নিজেকে হেফাজতে রাখতে হবে রাফা।

মায়ার কথার মানে বুঝতে পারলো না রাফা। সেজন্য রাফা মায়াকে কিছু প্রশ্ন করবে তার আগেই মায়া বলল…

‘ তোর কাছে কোনো ফোন-টোন হবে রাফা? থাকলে বের কর। কারও সাথে যোগাযোগ করা দরকার। নয়তো এখান থেকে আমরা বের হতে পারব না।

মায়ার কথায় টনক নড়লো রাফার। ওহ দুটো ফোন সঙ্গে নিয়ে এসেছিল এই ট্যুরে। একটা টাচ্ ফোন অন্যটা বাটন ফোন ছিল। টাচ ফোনটাতে সারাদিনের ছবি তুলায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে ওর বান্ধবী নদীর কাছে সেটা জমা রেখেছিল। সেই জন্য এখন ওর কাছে সেই টাচ ফোনটা এখন নেই। বাকি বাটন ফোনটা ওর ব্যাগেই ছিল। আর সেই ব্যাগটা ওর কাঁধ জড়িয়ে কোমরে ছিল। কিন্তু নেশাখোর ছেলেগুলো ওকে তুলে আনায় সময় হয়তো ব্যাগটা কোথাও না কোথাও পরে গিয়েছে। এতক্ষণ পযন্ত ওর গায়ে থাকবে না সেটা। রাফা নিজের গা চেক না করেই মায়াকে বলল…

‘ আমার কাছে কোনো ফোন নেই মায়া। একটা ফোন বাসে ফেলে এসেছি অন্যটা ব্যাগে ছিল। ছেলেগুলো আমাকে তুলে আনার সময় হয়তো ব্যাগটা কোথাও পরে গিয়েছে।

রাফার কথায় মায়ার তৎক্ষনাৎ উত্তর আসল। মায়া বলল…

‘ তোর কোমরে যে ব্যাগটা ঝুলছে ঐটাতে ফোন-টোন নেই?

‘ আমার কোমরে ব্যাগ মানে?

কথা গুলো বলতে বলতে রাফা নিজের শরীরে হাত বুলিয়ে দেখল সত্যি সত্যি ওর কাঁধে ব্যাগটা এখনো রয়েছে। দীর্ঘ সময়ের আতঙ্কের দৌড়াদৌড়িতে রাফার মনে হয়েছিল ওর ব্যাগটা নাও থাকতে পারে। তবে এই মূহুর্তে ব্যাগটা পেয়েই রাফা খুশিতে আত্মহারা হয়ে তৎক্ষনাৎ ব্যাগটা হাতে নিতে নিতে মায়ার উদ্দেশ্য বলল…

‘ হ্যাঁ হ্যাঁ এই ব্যাগটাতে আছে একটা ফোন। দাঁড়া! দাঁড়া দিচ্ছি।

ছোট ব্যাগটা থেকে একটা বাটন ফোন বের করে সেটাতে আলো জ্বালিয়ে মায়ার হাতে দিল রাফা। ফোনটা পেয়ে মায়া খুশিতে আত্মহারা হয়ে রাফাকে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ দিল। এই অসময়ের এই ছোট ফোনটা আজ জীবন বাঁচাবে ওদের। পরিবারের মানুষ জনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে বলেই মায়া ভিষণ খুশি হলো। রাফা থেকে ফোনটা হাতে নিতেই মায়া আগে নিজের পায়ে ফোনের আলো ফেলে দেখল ওর পায়ের কি অবস্থা। অল্প আলোয় মায়ার পায়ের দিকে তাকাতেই রাফা আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠার মতোন মায়ার পা দু’হাতে ধরতে চেয়ে ফিসফিসিয়ে বলল…

‘ হায় হায় মায়া তোর পা তো পুরো শেষ। রক্তাক্ত হয়ে আছে। এই পায়ে এতক্ষণ দৌড়িয়েছিস?

মায়া রাফার হাত থেকে নিজের পা ছাড়িয়ে হাতের ফোনটা রাফার হাতে দিল ওর পায়ে আলো দিতে। পায়ের ব্যথায় মায়ার মাথা পযন্ত টনটন করছে ব্যথায়। লাল রক্তে রক্তাক্ত হয়ে আছে মায়ার পুরো ডান পা। এমনকি মায়ার পরিহিত সাদা সেলোয়ারের নিচটা রক্তের ছিটায় লাল লাল হয়ে আছে। মায়া পা বাড়িয়ে ডানপায়ের সেলোয়ারটা একটু টেনে উপরে তুলল। পায়ের রক্ত পরা বন্ধ করতে নিজের গায়ের সাদা ক্রসিং বেল্ট টেনে খোলে শক্ত করে বাঁধল নিজের পায়ে। তারপর রাফার হাত থেকে ফোনটা নিতে নিতে সেটাতে নাম্বার টাইপিং করে কল মিলাল আরিফকে। কিন্তু নেটওয়ার্ক সমস্যা হওয়ায় মায়ার সেই কল কেটে যাচ্ছে বারবার। মায়া বুঝতে পারলো গুহায় ভিতরে নেটওয়ার্ক সমস্যা জনিত কল করা যাচ্ছে না। তাই মায়া এগিয়ে বসল গুহার সামনে। অল্প উঁকি মেরে মাথা বের করে গাছপালার আড়াল হতে দেখল বাহিরে কেউ আছে কিনা। আশেপাশে তেমন কাউকে দেখা না গেলেও ছেলেগুলোর খাক ছেড়ে ডাকাডাকির শব্দ কানে আসছে মায়ার। আতঙ্কিত মায়া খুবই সর্তকতার সহিত গায়ের হিজাবটা দিয়ে ফোনের আলো আটকে কল মিলাল আরিফকে। আরিফের ফোনে চার্জ না থাকায় বন্ধ পেতেই মায়া ভিষণ অসহায় বোধ করলো। বিপদের সময় ভাইকে না পেয়ে সাহসী মায়া নিঃশব্দে ঝরঝরে করে কেঁদে উঠলো। মায়ার এতো বিপদের সময় যদি আরিফকে না পায় তাহলে মায়ার মৃত্যু নিশ্চিত। কারণ একমাত্র আরিফই মায়ার আশেপাশে আছে। আর আরিফ পারবে বাস গুলো পুনরায় ফিরত এনে মায়াদের বাঁচাতে। অসহায় মায়া আর সাহস ধরে রাখতে না পেরে যখন নাক টেনে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল তক্ষুনি রাফা এগিয়ে এসে মায়াকে সাহস দিয়ে বলল…

‘ তোর ভাইয়ের নাম্বারে কল না গেলে অন্য কাউকে কল দে-না মায়া। স্যারদের কারও নাম্বার মুখস্থ পারিসতুই? পারলে দ্রুত কল দে। বেশিক্ষণ এখানে বসে থাকতে পারব না আমরা। এখান থেকে উঠতে হবে আমাদের নয়তো ছেলেগুলোর হাতে ধরা পরে যাব যেকোনো সময়।

রাফার কথায় মায়া ওকে জানাল কোনো স্যারদের নাম্বার ওর মুখস্থ নেই। এমনকি নিজের ফোনটাতেও কল দিতে পারছে না জুইয়ের কাছে। কারণ মায়া নিজেই সেই ফোনের সিম খোলে রেখেছিল যাতে রিদ কল দিতে না পারে। এই অবস্থায় মায়া নিজের পরিবারের কারও কাছেও কল দিতে পারবে না, তাহলে সমস্যা আরও বাড়বে। স্যারদের কারও নাম্বারও মায়া মুখস্থ জানে না। মায়া শুধু আরিফ, জুই আর বাড়ির কয়েকটা ফোন নাম্বার মুখস্হ জানে। আর ওর স্বামীর নাম্বারটাও মুখস্থ জানে। এক মিনিট মায়া ওর স্বামী থেকে তো এই মূহুর্তে সাহায্য চাইতে পারে ওকে বাঁচাতে? মায়ার বিশ্বাস আরিফের থেকেও দ্রুত ওর স্বামী ওকে বাঁচাতে সাহায্য করবে। আজ যদি এখানে মায়ার শেষ যাত্রা হয় তাহলে ওর শেষ কথা হবে স্বামী সাথে। মায়ার ওর স্বামীর কাছ থেকেও তো ক্ষমা চাওয়া উচিত। মায়া তাঁকে অমান্য করে আজ বিপদের মুখে পরেছে। নিজেকে আর কতক্ষণ বাচাতে পারবে জানা নেই মায়ার। তবে এতোটা বুঝতে পেরেছে মায়ার মৃত্যু আজ নিশ্চিত। হয়তো আর নাও ফিরা হতে পারে আপনজনদের মাঝে। চারপাশে জঙ্গি আর পাহাড়ি ডাকাতের উৎপাত। যেকোনো সময় মায়ারা ধরা পরে যাবে। এর আগে মায়াদের এখান থেকে বের হতে হবে। আর এখান থেকে বের হওয়ার আগে মায়া শেষবারের মতোন নিজের স্বামী সাথে একটু কথা বলতে চাই। ঠোঁট চেপে কান্না আটকিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে রিদের নাম্বারে কল লাগাল মায়া। অল্প সময় নিয়ে রিদের ফোনে রিং হতেই মায়া মুখে হাত চেপে ঝরঝর করে কেঁদে উঠলো। রাত তখন ১১ঃ৫০ ঘরে। রিদ কফি হাতে ফাইল চেক করছিল কাপে চুমুক দিতে দিতে। সে মূলত রাত একটা ফ্লাইটে যাবে দুবাই ব্যবসায়ী কাজে। সেজন্য একদম পরিপাটি রেডি হয়ে হাতে কাজগুলো সারছিল। রিদের উপস্থিতি তার রুমেই ছিল। বিগত দিনে মায়ার খোঁজ খবর রিদের কাছে ছিল। রিদ জানতো তার বউ বাড়ি থেকে চট্টগ্রাম গিয়েছে আজ দশদিন হলো। রিদের সাথে মায়ার যোগাযোগ না থাকলেও সেখানকার ছেলেপেলে গুলো রিদকে তার বউয়ের খবরাখবর দিয়ে থাকতো। কিন্তু বিগত তিনদিন ধরে রিদের কাছে মায়ার খবর তেমন একটা ছিল না তার কারণ রিদ আজ সন্ধ্যায় ইন্ডিয়া থেকে বাংলাদেশ এসেছিল। এখন আবার দুবাই যাবে। সে মূলত ইন্ডিয়া থেকেই দুবাই চলে যেত কিন্তু তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফাইল রি-চেকের জন্য বাংলাদেশ থেকে দুবাইয়ে টিকেট করতে হয়। সেই সন্ধ্যার পর থেকে রিদ ফ্রেশ হয়ে নিজের ফাইল গুলোই রি-চেক করছিল। এরমাঝে আননোন নাম্বার থেকে কল আসায় রিদ ফাইল থেকে এক পলক দৃষ্টি উঠিয়ে ফোনে চোখ বুলিয়ে পুনরায় নিজের কাছে মনোযোগ হলো। অপরিচিত নাম্বার তার কখনো রিসিভ করা হয়না। তাই মায়ার কলটিও স্বাভাবিক নেয় রিসিভ করার হলো না। কিন্তু পরপর একই ভাবে একই নাম্বার থেকে অনবরত কল আসার রিদ বিরক্ত হয়ে হাতের ফাইল আর কফিটা রেখে দিল টেবিলে, বিরক্ত হয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে রিসিভ করে কানে তুলতেই মায়ার ফুপানোর শব্দে রিদের মস্তিষ্ক টনক নড়ে উঠলো। সে বুঝতে পারলো এই অসময়ে তার বউ কল করেছে। বৈদ্যুতিক শকট লাগার মতোন রিদের শরীরে রক্ত টগবগিয়ে উঠলো মায়ার ভয়ার্ত কান্নায়।৷ রিদ অস্থির গলায় মায়াকে শুধালো…

‘ জান! জান কি হয়েছে কান্না করছো কেন? কোনো সমস্যা?

রিদের আদুরে গলায় ঝরঝরে কেঁদে উঠলো আতঙ্কিত মায়া। এতক্ষণ সাহসী নারী হয়ে থাকলেও রিদের আদুরে গলায় ভিষন দূর্বল হয়ে উঠল মায়া। নারী তার শখের পুরুষের কাছে এমনই দূর্বল হয়। প্রমাণ মায়া নিজেই..

‘ আমাকে বাঁচান নেতা সাহেব! আমি মনে হয় আর আপনার কাছে ফিরতে পারব না। আমি আপনার কথা শুনেনি, অবাধ্য হয়েছি, সেজন্য ভাগ্যও আজ আমাকে আপনার কাছে ফিরতে দিচ্ছে না। আপনার সাথে আমার আর এক জনমের বেঁচে থাকার ইচ্ছাটা অপূর্ণ রয়ে গেল। আমি মরে যাব নেতা সাহেব। ওরা আমাদের বাঁচতে দিবে না।

মায়ার হিচকি তোলা কান্নার দারুণ খুবই ফিসফিসে কানে বাটন ফোনটি চেপে রিদকে উক্ত কথা গুলো বলল মায়া। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিস্তব্ধতায় মায়া অল্প স্বরে কথা গুলোও যেন প্রতিধ্বনি হচ্ছে বারবার। আতঙ্কিত মায়া ফোনের আলোটাও গায়ের হিজাবটা দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে ভয়ে যাতে আলোটা বাহিরে না যায়। রিদ মায়ার আতঙ্কিত স্বর আর ভাঙ্গা গলার কথায় বুঝতে পারলো পরিস্থিতি ঠিক নেই। তার বউ ভালো নেই। রাত তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা ঘরে। রিদের উপস্থিতি ঢাকা আর মায়া চট্টগ্রামে। মায়ার কি হয়েছে সেটাও জানে না সে। রিদ কিছু বলবে তার আগেই মায়া আবারও একই ভঙ্গিতে ফুপিয়ে উঠে কান্নায়। রিদ খৈ হারায়। মন মেজাজ দুটোই হারিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। মায়া শুনতে পায় ফোনের অপাশের রিদের স্ব-চিৎকার। সেই সাথে ভাংচুরের তান্ডব। মায়া আতঙ্কিত হতেই রিদের চিৎকার ভেসে আসে ফোনের অপাশ থেকে…

‘ রিত! এই রিত? কই আছিস তুই? লোকেশন বল?

মায়া ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে হিচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে মুখে কাপড় চেপে বলতে চাইলল…

‘ আমি জানি না কোথায় আছি! আশেপাশে কিচ্ছু চিনি না। ওরা আমাদের খোঁজছে! ওরা! ওরা পাহাড়ি জঙ্গি! আমাদের মেরে ফেলতে চাই প্লিজ আপনি আমাদের বাঁচান! আমি মরতে চাই না। আমার আপনার সাথে এখনো সংসার করা হয়নি! আপনার জন্য বউ সাজা হয়নি। আপনাকে নিয়ে এক জনমের স্বপ্ন বুনা বাকি। আমাদের বাঁচান নেতা সাহেব প্লিজ। আমি আপনাকে ছেড়ে মরতে চাই না। প্লিজ আমাদের সাহায্য করুন!

[ এই পার্টটা লেখতে আমার প্রায় দুইদিন সময় লেগেছে। একবার পার্টটা লেখি তো অন্যবার ডিলিট করি। মূলত এই পার্টটা আমি গুছিয়ে লেখতে পারছিলাম না। আবার এই পার্টটা আরও বড়ো করে লেখতে চেয়েছিলাম কিন্তু বেশ রাত হয়ে যাওয়ায় আর বড়ো করিনি। তারপর আবার এতো রাত পযন্ত মিম আপুকেও কষ্ট দিয়ে বসিয়ে রেখেছিলাম এই পার্টটি রি-চেক করে দেওয়ার জন্য। এই পার্টের লেখা গুলো অগোছালো হতে পারে। আসলে আমি অনেক চেষ্টা করেও গুছিয়ে লেখতে সক্ষম হয়নি। সবাই ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ সবাইকে ]

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here