যাতনা_আমার (পর্ব- ২৭) #সানজিদা_ইসলাম_সূচনা

0
0

#যাতনা_আমার (পর্ব- ২৭)

#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা

সোহানা মির্জা সহ বাড়ির সবাই এসেছে নিধির সাথে দেখা করতে। সবাই নিধির সাথে যথাযথ চুপচাপ কথা বলছে। বৃথাই আয়েশা মির্জা ব্যতীত। তিনি প্রথমে এসেই নিধিকে জড়িয়ে প্রচুর বিলাপ শুরু করলেন। ইশানের চোখ রাঙানি দেখে একটু ঠান্ডা হলেও, আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদছেন। যেটা নিধির দেখে খুবই খারাপ লাগছে। তার ভেতরটাও গুমরে উঠছে আবারো। সোহানা মির্জা অতি আদুরে মেয়েকে বুকে নিয়ে বসে আছেন। নাহিদ মির্জা আর নওয়াজ মির্জা নিধিকে অনেক কথা জিজ্ঞেস করলেও কোনো উত্তর মিলেনি তাদের। অন্যথা কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে দুজনেই অফিসের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়েন। নিপা অনেক্ক্ষণ ধরে জোড়াজুড়ি করছে নিধিকে খেয়ে নিতে। কিন্তু নিধি অবিচল।

-” একটু খেয়ে দেখ নিধি! খিচুড়ি টা দারুণ হয়েছে। তোর ছোট আব্বুও আজকে রান্নার প্রশংসা করছে।
খেয়ে দেখনা। ”

নিপার এমন ভুলানো কথায় কান দেয় না নিধি। শুধু আস্তে করে মিহি স্বরে বলে,

-” খাবো না ছোট মা। ”

হতাশ হলো প্রত্যেকেই। আয়েশা মির্জা এবার জোরে আওয়াজ তুলে কাঁদতে লাগলেন।

-” আমার এই মাখনের মতো নাতনি টা কে, জানোয়ার গুলো শেষ করে দিলো। কি জানি আছে আমার নাতনির কপালে? কেমনে বিয়ে হবে? কে বিয়ে করবে? ”

এইসব বলে আবারও শুরু করলেন আয়েশা মির্জা। নিধি এবার কেঁদে উঠে মায়ের বুকে পড়ে। সোহানা শত চেষ্টা করেও, দুজনের কাউকেই থামাতে পারে না। নিপা অসহায়ের মতোন দাঁড়িয়ে রইলো এক পাশে। অবশেষে মুখ খোলে ইশান। বাজখাঁই গলায় আয়েশা মির্জা কে বলে ওঠে,

-” এমন লেইম কথাবার্তা, এখন তোমার মাথায় কি করে আসছে গিন্নী? না, তোমাকে এখানে রাখা ঠিক হবে না। ইনফেক্ট, তোমাদের কাউকে না। মা, বড়োমা তোমারা এখন গিন্নী কে নিয়ে বিদেয় হও। ”

ইশানের কথায় এবার থামে আয়েশা মির্জা। নিধি চুপচাপ কেঁদে যাচ্ছে। সোহানা এবার শান্ত স্বরে বলে ওঠে,

-” নিপা, তুমি মাকে নিয়ে চলে যাও। আমি একটু দেরি করে আসবো। ”

নিপা সম্মতি জানিয়ে, আয়েশা মির্জা কে নিয়ে চলে গেলেন। যেতে যেতে আয়েশা মির্জা ইশানকে দু-তিনটে বকাও দিয়ে গেলেন। অনেক্ক্ষণ পর নিধি শান্ত হয়। সোহানা নিধিকে বালিশে শুইয়ে দিয়ে ইশানকে বলে ওঠে,

-” তুমি থাকো এখানে। আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে ওর কন্ডিশন জেনে আসি। নিধি কে তাড়াতাড়ি বাড়িতে নিয়ে গেলেই, বেটার ফিল করবে। ”

ইশান সম্মতি জানায়। সোহানা মির্জা একপলক শান্ত নিধির দিকে তাকিয়ে চোখ বুলায়। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুম থেকে বেড়িয়ে পড়েন। নিধির শিয়রে বসে ইশান। নিধির মাথায় হাত বুলিয়ে দুইবার ডেকে উঠে। নিধি কান্নারত মুখে ইশানের পানে তাকিয়ে আবারও ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠে। ইশান আলতো হাতে নিধিকে টেনে বুকে নেয়। তারপর মৃদু গলায় ব’লে,

-” স্যরি গাধি! সেদিন বেশিই রিয়েক্ট করে ফেলেছিলাম তোর সাথে। কিন্তু কি করবো বল? তুই তো জানিস, আমার রাগ কেমন? সহজে রাগ উঠে না, আর উঠলে মাথা ঠিক থাকেনা। আমার তখন খুব খারাপ লেগেছিল এই ভেবে যে, বাড়ির সবাই কি করে এমন বিশ্রী সিদ্ধান্ত নিতে পারে? যেখানে তোকে আমার আপন বোনের মতো ছোট বেলা থেকে ভেবে আসছি। আরো রাগ হয়েছিল এই ভেবে, তুই বিয়েতে কি করে রাজি হতে পারিস? আমার তখন তোর প্রতি খুব রাগ জমেছিলো। তোর নামে ভুলভাল বকেছিও আমি। মাফ করে দে প্লিজ। আমার ভেতরে কিছুতেই শান্তি লাগছে না। প্লিজ মাফ করে দে। আমি তোকে সত্যিই ভালোবাসি। আমার ছোট বোন হিসেবে। ”

নিধি চুপচাপ হয়ে ইশানের বুকে মাথা পেতে বসে থাকে। পৃথিবীতে এক তরফা সবকিছুই খুব জটিল হয়ে বসে। যেমন তার ভালোবাসা। সে একতরফা ভালোবেসে বড্ড ভুল করেছে। যার মনে তার জন্য বোনের স্নেহ ভালোবাসা আছে। তাকে ভালোবেসে সে বড্ড ভুল করছে। থাক না নিজের ভালোবাসা মনের কোনে। সেটা সে নিজেও জেনো উপলব্ধি করতে না পারুক। আর এই ঘটনার পরে তো আরও না। তার জীবনে আর কোনো পুরুষ কে সে জায়গা দিতে পারবে না। নিধি মলিন মুখে ইশানের দিকে মাথা উঠিয়ে তাকায়।

-” তোমার থেকে প্রথম এতো কড়া কথা শুনে, আমার মন খারাপ হয়েছিলো ঠিকই। কিন্তু পরে তা ভালো হয়ে গেছে। কিন্তু, তুমি গিল্টি ফিল করোনা। আমার তোমার প্রতি কোনো মন খারাপ নেই। ”

ইশান ম্লান হাসলো। সত্যিই সে ভেতরে ভেতরে অনেক কষ্ট পাচ্ছিলো। ইশান শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখে নিধিকে। তার কাছে নিধি বোনের মতোই সর্বদা আছে থাকবে।

,

,

,

,

,

,

ডাক্তারের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সোহানা। কালকেই নিধিকে বাড়িতে নিয়ে যাবে। করিডোরের শেষ প্রান্তে এখন দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। কেবিনে ঢুকতে গিয়েও দাঁড়িয়ে রইলো। ভাইবোনের মান অভিমানের পাল্লাটা যে ভেঙে গেছে সেটা দেখতে ভালোই লাগলো তার। আসলে তারাই তাদের সম্পর্কটা জটিল করে দিয়েছিলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে তাকাতেই, দেখতে পায় নাভান তার দিকে এগিয়ে আসছে। ছেলেটার মুখটা কিছুটা মলিন হয়ে আছে। নাভান সোহানার পাশে এসে ক্লান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়ায়।

-” কি ব্যাপার? সকাল থেকে কই ছিলে তুমি? হসপিটালেও এসে তোমাকে পাইনি। ”

নাভান মুখটা আগের মতোই মলিন করে শান্ত গলায় বললো,

-” ফাহাদের সাথে পুলিসস্টেশনে ছিলাম। নিধির কেসটা নিয়ে কথা বলে এলাম। কোনো সূত্রই মিলছেনা। ”

সোহানা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে আস্বস্ত করলেন,

-” চিন্তা করো না, ঠিক হয়ে যাবে সব। হয়তো একটু সময় নিবে। ”

নাভান নিরব সম্মতি জানিয়ে দেয়। সোহানা এবার সচল গলায় বললেন,

-” চলো বাড়ি যাই। দুপুরের লাঞ্চ একসাথে করা যাবে। ”

নাভান সোহানার দিকে তাকিয়ে আলতো হাতে তার হাতটি ধরে। তারপর সহসাই ব’লে,

-” আমি ইনায়ার সাথে আজকে দেখা করবো। ”

সোহানা থমকানো দৃষ্টিতে নাভানের দিকে তাকালো। চোখ দুটু অশান্ত অনেক। হাত গুলো কেঁপে উঠলো বারংবার। যেটা নাভানও টের পেল। তার হাতের মুঠোয় ভালো করে শক্ত করে দৃঢ় কন্ঠে বলে,

-” কোনো জোর করবো না। শুধু আবদার করবো। এইবার একটা সঠিক সিদ্ধান্তের দরকার। ”

,

,

,

,

,

,

,

,

,

,

,

,

,

,

,

,

,

,

কফি শপের কোনার টেবিলটায় বসে আছে ইনায়া। পড়নে সাদা চুড়িদার। হাতে কফির কাপ। দৃষ্টি আপাতত বাইরে তার। আকাশ টা ভিষন অন্ধকার হয়ে আছে। বৃষ্টি নামবে হয়তো। এ’কইদিন মুষল ধারে বৃষ্টি হয়েই যাচ্ছে। সময় অসময় হুটহাট তার আনাগোনা। শপের এই পাশটা বিশাল বড়ো কাঁচের থাই ফ্লোর পর্যন্ত নামানো। বৃষ্টির ছোট্ট ছোট্ট ফোটা যখন তাতে পড়ছিলো, ইনায়া মন ভালো হয় তখন। গ্লাসের ওপাশে জমা পানির ফোটা গুলো দেখতে তার ভালোই লাগছিলো। ফোনে টাইমটা আবারো দেখে নেয় ইনায়া। ৩:৪০, কিন্তু নাভানের কোনো নাম গন্ধ নেই। ইনায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হঠাৎ করেই ফোন বাজতে ইনায়ার চোখ স্কিনের নাম্বারে যায়। কিছুটা অবাকও হয়। জায়ান ফোন করেছে? এই লোক তো সেদিনের পর থেকে, কোনো রকম যোগাযোগ রাখে না তার সাথে। ইনায়া ফোনটা রিসিভ না করে কেটে দেয়। কিছুক্ষণ পরে একটা মেসেজ আসে ফোনে।

-” পালিয়ে থাকতে চাও? থাকো। তবে, পালিয়ে যাবে কতো দূর? আমার অচেতন মনটা, আমায় বারবার ফিসফিস করে বলে, তোমার গন্তব্য ঠিক আমি নামক দেশেতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। ”

ইনায়া দুইতিন বার পড়ে চুপ করে রইলো। ফিরতি কিছু লিখলো না। হঠাৎ কেউ সামনে আসাতে ইনায়া সেদিকে তাকায়। কালো রঙের শার্ট পরহিত নাভান দাড়িয়ে আছে তার সামনে। ইনায়া শান্ত চোখে তাকালো। গাড়ি থেকে শপ অবদি আসতে আসতে বোধহয় একটু ভিজে গেছে। যার দরুন বৃষ্টির ফোটা গুলো মুক্তোদানার মতো নাভানের মুখে চিক চিক করছে। নাভান ঝটপট ইনায়ার সামনের চেয়ারে বসলো।

-” স্যরি, আমি একটু বেশিই দেরি করে ফেলেছি। ”

একটু শীতল কণ্ঠে বলে ওঠে নাভান। ইনায়া জবাবে কিছুই বললো না। চুপচাপ শান্ত রইলো। নাভান ক্লান্ত চোখে সামনে বসা মায়াবী মুখখানার দিকে তাকালো অজস্র মায়া ভরা মুখটায়, অজস্র বেদনার ছাপ। যা নাভানের দ্বারা হয়েছে। বুকটা মুচড়ে উঠলো তার। রাগ আসলেই ধ্বংসের মূল কারণ। কিছুক্ষণ দু’জন চুপচাপ থাকলো। কোথা থেকে কথা শুরু করবে? হয়তো, তা নিয়ে দুজনেই চিন্তায় ছিল। অনেক্ক্ষণ পর নিরবতা ভেঙে ইনায়া কাঠকাঠ গলায় ব’লে,

-” এনেছেন তো পেপারটা? বের করুন। সাইন টা করে দিচ্ছি। ”

নাভান কিছুটা হকচকিয়ে তাকালো ইনায়ার দিকে। তারপর গম্ভীর ঘন স্বরে জিজ্ঞেস করে ওঠে,

-” এতো তাড়া? কোনো অভিযোগ নেই আমার প্রতি? কিছুই বলবেনা আমাকে? ”

ইনায়া নাভানের চোখের দিকে তাকিয়ে আলতো হাসলো। তারপর দৃষ্টি স্থির রেখে কঠিন গলায় বললো,

-” আমাদের সম্পর্কে কোনো মান অভিমানের জন্ম নেই নাভান। যা আছে, আমার একার সব যাতনা। যেখানে বিপক্ষী মানুষটা তার দার ধারে না। সেখানে, মান অভিমান দেখানো নেহাত বোকামি বরং আর কিছু না৷ দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছি তা। ”

নাভান নিশ্চুপ হয়ে রয়ে যায়। আসলেই সব দোষ তার। কিন্তু সবকিছু ঠিক করার সুযোগ কি হবে তার? হটাৎ করেই নাভান এক বিস্ফোরণ মন্তব্য করে উঠে,

-” আই ওয়ান্ট ইউ ইনায়া! প্লিজ কাম ব্যাক ইনটু মাই লাইফ! ”

ইনায়া স্তম্ভিত হয়ে নাভানের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষন। এই কথা যদি এখন বলা হয়। তাহলে, গত একবছরের কম সময় গুলো কেনো হলো? সেটা কি এতোই সহজ ভুলে যাওয়া? ইনায়া ম্লান হাসে। তার ভিতরটাও উচ্চ স্বরে হেসে যাচ্ছে।

-” আপনার কাছে জীবন মানে কি নাভান? কোনো গল্প বা উপন্যাস? যা নিজের মনের মতো লিখে তৈরি করে ফেললাম। ”

ইনায়ার কথায় নাভান বিচলিত হয়। শান্ত ঘন স্বরে সে ইনায়া কে বোঝানের চেষ্টা করে।

-” আই নো, আমি বড্ড খারাপ কাজ করেছি। বাট? ইনায়া আমি পরিবারের এই বারবার চাপিয়ে দেওয়া জিনিস টা মেনে নিতে পারিনি। রাগের বশবর্তী হয়ে এই পাপটা হয়ে গেছে। এর জন্য আমি মাফ চাইছি তোমার কাছে। চলো এবার একটা সুযোগ দিয়ে দাও আমাকে। আমি বেস্ট লাইফ পার্টনার হয়ে দেখাবো তোমাকে। ”

ইনায়া চোখগুলো ছলছল করে উঠে। সে হিস পিস করে জিজ্ঞেস করে,

-” পরিবারের প্রতি রাগ দেখে, বিয়ে করে চলে গিয়েছিলেন? একবারও কি মনে হয় নি আমি নামক মানুষটা আপনার সাথে জড়িয়ে গেছি? আমার কি হবে? পরিবারের রাগ আপনি আমার সাথে মিটিয়ে ছিলেন নাভান? তাদের থেকে বড়ো শাস্তি আপনি আমাকে দিয়েছিলেন? ”

এতোগুলা প্রশ্নের তোপে পড়ে নাভানের মুখ দিয়ে আর কথা বের হয় না। কথা গুলো যে চরম সত্য। সেদিন তার বিবেক বুদ্ধি সব কোথায় যেন হাড়িয়ে গিয়েছিলো। ইনায়ার চোখ গুলো যেন জলন্ত কয়লার মতোন জ্বলছে। ঠোঁট গুলো তিরতির করে কাপছে। নাভানের সুন্দর মুখশ্রীর ও একই হাল। ইনায়া এবার কিছুটা শান্ত হয়ে আবার ব’লে,

-” জানেন? বুক ভরা স্বপ্ন আমারো ছিলো নাভান। আপনার সাথে সংসার করার। বিয়ে ঠিক হবার প্রথম দিন থেকে স্বপ্ন বুনেছি আপনাকে নিয়ে। বাবা-মায়েরও স্বপ্ন ছিলো আমার বিয়ে নিয়ে। কিন্তু তাদের বধহয় বড্ড বেশি তাড়া ছিলো। যে আমাকে বিদায় দেবার আগে, তারা নিজেরাই চলে গেলো। তারপর ও এতো ভেঙে পড়িনি। যতটা আপনি আমাকে ভেঙে দিয়েছেন। একটা মেয়ের বিয়ে সংসার স্বামী নিয়ে কতো স্বপ্ন থাকে সেটা আপনি বুঝতে পারবেন না নাভান। বাসরঘরে কতো প্রতিক্ষায় বসে ছিলাম আপনার জন্য। কিন্তু আপনি? আমি হয়তো এরপরেও আপনাকে মেনে নিতাম কিন্তু? ”

ইনায়া কথা বলে পাগলের মতো ফোন হাতড়াতে থাকে। নাভান অস্থির হয়ে দেখে শুধু ইনায়া কে। ইনায়া ফোন বের করে বিয়ের দিন অদিতির পাঠানো ভিডিও ছবি নাভানের দিকে ধরে। সব দেখে নাভান বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে ইনায়ার দিকে তাকালো।

-” আচ্ছা নাভান বলুন তো? কোনো সদ্য বিবাহিত নারী। যে স্বামীকে নিজের মুখটাও দেখাতে পারলো না। সে যদি তার স্বামীর আর ফুপাতো বোনের এমন অন্তরঙ্গ মুহূর্ত দেখে, সে কি ঠিক থাকতে পারবে? ”

নাভান থ হয়ে রইলো। অদিতি ইনায়া কে পাঠিয়েছে এইসব? নাভান মুখ খুলে স্তম্ভিত গলায় ব’লে,

-” ইনায়া আমি বিষয়টা এক্সপ্ল্যান করছি। ”

নাভান কে বলতে দেয়না ইনায়া। মুচকি হাসি দিয়ে আবারো বলে ওঠে,

-” এটার দেখার পরেও আপনার প্রতি আমার আশা ছিলো। কারণ এটা তো আপনার অতীত ছিলো হয়তে। বর্তমানে তো আমি আছি। আপনি ঠিক ফিরবেন। আমাকে আপন করবেন। আমি আপনাকে মেনে নিবো। কিন্তু ট্রাস্ট মি নাভান। আমি কখনে বিশ্বাস করিনি আপনি বিয়ের পরেও এই সম্পর্কে থাকবেন। কেমন লাগতো আমার বলেন তো? যখন আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভিনদেশের আপনার আর অদিতি এই বিশ্রী দৃশ্য গুলো দেখাতাম? কেমন লাগতো আমার ভিতর টা। আমার প্রাপ্য টা আপনি অন্য নারী কে দিয়েছেন। আমার ভিতরটা পুরো শেষ হয়ে যেতো। আমার মনে হতো এইসব আদর সোহাগ আমার প্রাপ্য। সেটা অন্য নারী কেনো ভোগ করবে? একটা স্ত্রী হিসেবে আমার কতোটা অপমান হয়েছে তা কি বুঝতে পারবেন আপনি? ”

নাভানের মুখ বন্ধ। জবানটা তার কেউ কেড়ে নিয়েছে। ইনায়ার কথাগুলো তার বুকের ভিতর তীরের মতো বিঁধছে যেন। সে ইনায়ার বিধ্বস্ত চেহারা দিকে তাকালো। কেঁদে কুটে ইনায়ার অবস্থা খুবই খারাপ। নাভানের আফসোস হলো। পাপের রাজ্যে পড়ে সে এই মায়াবী মেয়েটাকে বড্ড কষ্ট দিয়েছে। সে কষ্ট কি লাঘব করতে পারবে নাভান? ইনায়া এবার চোখের পানি ছেড়ে শান্ত স্বরে বলে,

-” নয়টা মাস সমাজের চোখে একটা হাসির পাত্রি ছিলাম নাভান। সবাই আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করতো। তাদের কথা ছিলো, আমিই মনে হয় খারাপ। যার স্বামী বিয়ের দিন ফেলে রেখে গেছে। খুব কষ্ট হতো আমার। আর তা দ্বিগুণ করতো, আপনার আর অদিতির এই মুহূর্ত গুলো। আমাকে যেহেতু স্ত্রীর অধিকার দেবেনই না, তাহলে কবুল বলার কি খুব দরকার ছিলো? ”

নিস্তব্ধ হয়ে থাকে পরিবেশ। কোনো কথাই আর হলো না। বাইরে এবার ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝুম ধারে হয়ে যাচ্ছে। ক্ষনে ক্ষনে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। নাভান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ইনায়া এবার শান্ত হয়ে বসে রইলো। নাভান নিরব মুখে ইনায়ার সামনে রাখা হাতদুটো আঁকড়ে ধরলো। তারপর স্ফুট কন্ঠে বললো,

-” কি চাও তুমি? যা চাইবে তাই হবে। ”

-” বিচ্ছেদ! আপনি বিয়ের আগে যতোই নারী আসক্তি ছিলেন না কেনো,আমি ঠিক মেনে নিতাম। কিন্তু বিয়ের পরের ঘটনা গুলোতে আমি আপনাকে মাফ করতে পারবো না। বউ রেখে পরকীয়ায় জড়িত ছিলেন। একটি বারের জন্যও আমার কথা মনে করেন নি। ”

ইনায়ার থমথমে গলায় বলা কথাটি তে নাভান নিরুত্তর রইলো কিছুক্ষণ। তারপর ধিরে সুস্থে মলিন শান্ত গলায় বলে উঠলো,

-” তুমি বিচ্ছেদ চাইলে সেটাই হবে। আমি তোমাকে আটকাবো বা জোর করবো না। কারণ, তোমাকে রেখে দেবার অধিকার আমি হাড়িয়েছি। তবুও আমার পাপিষ্ঠ মন ঠিক চাইবে, তুমি কাছে থেকে যাও। আমার হয়ে যাও। ”

ইনায়া নাভানের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। জলজল চোখগুলো যেন সত্য কথা বলছে। এই লোকটা তার স্বামী। যাকে সে কবুলের জোরে ভালোবেসে। কিন্তু আজ যেন সম্পর্ক ফিকে। ইনায়া কঠিন মুখে বিরবির করে বলে উঠলো,

-” পেপারটা দিন। আপনাকে চিরতরে মুক্তি করে দিচ্ছি, আমি নামক অভিশাপ থেকে। ”

নাভান চমৎকার হাসলো। বড়ো করুন ঠেকলো ইনায়ার কাছে সেটি। নাভান ডিভোর্স পেপারটি বের করে ইনায়ার সামনে রাখলো। তারপর ছলছল চোখে মলিন গলায় বললো,

-” আমার অন্ধকারময় জীবনে তোমার আগমন হয়তো আলো হয়ে এসেছিলো। অন্ধ পাপী আমি তা দেখতে পারিনি। কি করবো বলো? আমি বড্ড অভাগা যে। ”

ইনায়া কাঁপা কাঁপা হাতে ডিভোর্স পেপারটি নিলো। ব্যাগ থেকে কলম বের করে গটগট করে লিখে দিলো নিজের নামটি। নাভান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ইনায়ার দিকে। ইনায়া সিগনেচার করে কান্নায় ভেঙে পড়লো। সাথে যেনো বজ্রপাতের আওয়াজও বেড়ে চলছে। নাভান নিষ্প্রাণ হাসলো। ঠোঁট কামড়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আবার ইনায়ার দিকে দৃষ্টিপাত করলো।

-” কান্নাদের আটকাও। এখন কান্না শোভা পায়না। জীবন থেকে পাপ মোচন করেছো। এখন তুমি সুখি। আর আমার সিগনেচার টা তোলা থাক। করে দিবো কোনো এক সময়। ”

ইনায়া কাঁপা কাঁপা হাতে নাভানের দিকে পেপার টা এগিয়ে দিলো। নাভান আলতো হেঁসে বললো,

-” এখন তো বন্ধু হতে পারি, কি বলো? তোমার সাথে একটা কথা সেয়ার করি। ”

ইনায়া কিছু বললোনা। নাভান নিজের মতো বলতে লাগলো।

-” আমার আপন মায়ের মৃত্যুর পরে সোহানা মির্জা মানে আমার খালামুনি, তার কাছে কানাডায় আমি শিফট হই। খালামুনির কাছে আমি মায়ের আদরটা পেয়েছিলাম। একদিকে তাকেও আমি ছাড়তে পারছিলাম না। অন্যদিকে নিজেও বাবা দাদি আর বাংলাদেশের স্মৃতিকে ভুলতে পারছিলাম না। সব কিছু যেনো আমার কাছে অসহ্য হতে লাগলো। দাদি নানির কাছে আবদার করলাম খালামুনিকে নিয়ে আমি বাংলাদেশে থাকবো। আমার ছোট কথাটি কে তারা কি ভেবেছিলেন কে জানে? তার পরিপ্রেক্ষিতে বাবা আর খালামুনি আর মাকে নিজেদের অমতে বিয়ে করতে হলো। আর খালামুনি হয়ে গেলো আমার মা। সব ভালোই চলছিলো আমি ছিলাম পরিবারের মধ্যমনি। মা এখানে নিজেকে খুব কষ্ট করে এডজাস্ট করেছেন। তার মনে হয়েছে বাংলাদেশ সন্তানের ভবিষ্যৎ করা অনেক ডিফিকাল্ট হবে। তিনি আমাকে উচ্চ শিক্ষার জন্য কানাডায় জোর করে পাঠালেন। অনেক কষ্ট হয়েছিল আমার। তাদের পায়ে পর্যন্ত পড়েছি আমাকে কানাডায় না দিতে। কিন্তু মা বললো, সেখানে গেলে আমার ফিউচার ব্রাইড হবে। আসলেই জীবন উজ্জ্বল আমার। অনেক অনেক সুনাম টাকা পয়শা অনেক কিছু। তারপরও অন্ধকারে ডুবে আছি যেন। আর এর আগমন হয়েছিল আমি তখন স্টুডেন্ট। বাবা মার সাথে কথা বন্ধ করে একাকিত্ব যখন আমাকে চেপে ধরেছে। নিজেই লক্ষ্য করলাম আমি চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছি বদলে যাচ্ছি। তখন হেল্প চাইলাম নানুর কাছে। তখন সে আমাকে কি সলিউশন দিলো জানো? ”

নাভান ইনায়ার দিকে জিজ্ঞেসা মুখে তাকালো। কিন্তু ইনায়া নিরুত্তর। চুপচাপ তাকিয়ে নাভানের কথা গিলছে। নাভান হেসে বলে ওঠে,

-” তিনি আমাকে বারে নিয়ে গেলেন। ফের দুতিন পেগ খাওয়ার পরে, এক বিদেশিনীর সাথে রুমে ঢুকিয়ে দিলেন। আর বলেছিলেন, এটাই নাকি মন মস্তিষ্ক একাকিত্ব ঘুচার জায়গা। আমার নানাও ছিলেন সেখানের রেগুলার একজন। আর সুন্দর সুন্দর মেয়েদের পছন্দের সুগার ড্যাডি। যা আমি পরে জেনেছিলাম। সেখান থেকেই আমার পাপের রাজ্য আগমন। কয়েক বছর গার্লফ্রেন্ড আর অফিস পার্টি, এসব করেই আমার দিন চলছিলো।
নিজেকে তখন পশ্চিমা সংস্কৃতিতে ভালো করে ডুবিয়ে নিয়েছিলাম। আমার কাছে তখন এটাই সঠিক মনে হয়েছিল। যখন অদিতি আমার লাইফে আসে, তাকে আমার ডিফারেন্ট মনে হয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম ওই হয়তো আমার জন্য সঠিক। তখন আবার ফের মায়ের আমার স্বাধিন জীবনে ঢোকা। সেটা আমি মানতে পারিনি। তার পরে সব বিবেকহীন মানুষের মতো কাজ করেছে আমি। কোনো কিছুই আমার ব্রেন তখন সঠিক বিচার করতো না। আমাকে মাফ করে দিও ইনায়া। ভালো থেকো। ”

ইনায়া নিষ্প্রাণ তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ নাভানের দিকে। একজন নাভান গড়ার কারিগর কি পরিবার?
নাভানের ফর্সা মুখশ্রী ও নাকের ডগা টুকটুকে লাল হয়ে আছে। পেশিবহুল গায়ের জড়ানো কালো শার্ট যেনো আজ তার শোকের বাহক। ইনায়া আস্তে করে উঠে দাঁড়ায়। কোমড় পর্যন্ত ঘন চুল গুলো সাদা চুড়িদারের উপর ভাসছে যেনো। ডাগর আঁখি গুলো পদ্মপাতার জলের মতো টলমলে। নাভান চোখ সড়িয়ে হাসলো। এই নারী টি কে সে হাড়িয়ে ফেলেছে। একবার পাপ করে ফেলেছে। কিন্তু তা শুধরানো সুযোগ সে পেলো না। ইনায়া আর কিছুটা না বলে দৌড়ে শপ থেকে বেড়িয়ে গেলো। পিছন আর ফিরলো না। ফিরলে দেখতে পেতো, এক পুরুষের হৃদয় বিদারক কান্না। যা সহজে দেখা যায় না। ইনায়া বাইরে এসে দেখে বৃষ্টি তুমুল বেগে ঝড়ে যাচ্ছে। কিছু না ভেবে বৃষ্টির মধ্যেই হাটতে থাকে সে। হটাৎ কিছুর সাথে ধাক্কা খেয়ে ঝাপসা চোখে সামনে তাকায় সে। ততক্ষণে অন্য একজন তাকে দুহাতে আগলে নিয়েছে।

-” তাহলে অচেতন মন ঠিক। গন্তব্য আমাতেই সীমাবদ্ধ?

ইনায়া ম্লান হাসে। চোখজোড়া স্পষ্ট করে জায়ানের দিকে তাকালো। জায়ানে চিবুক বেয়ে পানি ইনায়া মুখে পরছে।

-” কি নিষ্ঠুরতম তুমি? তাকে একটিবার সুযোগ দিলে না। কারো কষ্ট উপলব্ধি করার মন কি আছে তোমার হরিণী? কখনো কাউকে সুযোগ দিয়ে দেখতে হয়। ”

ইনায়া কন্ঠ ফিসফিস করে বলে উঠলো,

-” আমার মন, বেদনা কষ্ট যাতানার বিশাল বড়ো পাহাড়ের নিচে চাপা পরে গেছে। সেটা অন্যের কষ্ট বোঝার জায়গায় নেই আর। ”

-” নিষ্ঠুরতম পাহর হরিণী তুমি। ”

ইনায়া আর কিছু বললো না। বৃষ্টিতে ভিজ একাকার দুজনেই। জায়ান সামনে একজনের সাথে দৃষ্টি মেলাল। একজন প্রতিপক্ষ আহত সিংহ অন্যজন এখনো তার বাইরে। হয়তো প্রতিদ্বন্দ্বীর এই সমীকরণ শেষ হলো এখন। যা অন্যজনের বোঝে এসেছে মাত্র।

চলবে………………

( ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here