বাদশাহ_নামা #পর্বসংখ্যা_২ #আ_মি_না

0
3

#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_২
#আ_মি_না

২. প্রশান্ত মহাসাগরের ঠিক মধ্যখানে সারিবদ্ধ ভাবে অবস্থিত পাঁচ পাঁচটি দ্বীপ। দ্বীপ গুলোর ঠিক মাঝের এবং সবচেয়ে বড়টার আয়তন আশি হাজার বর্গকিলোমিটার, আর এ বড় দ্বীপটার দুপাশে অবস্থিত বাকি চারটির প্রতিটার আয়তন প্রায় পঞ্চাশ হাজার বর্গকিলোমিটার।

এটা সেই জায়গা যেখানে পৃথিবীর অন্য পৃষ্ঠের মানব সম্প্রদায় এখনো পৌছাতে পারেনি, আর পারলেও এই দ্বীপ গুলোর হদিস তারা পায়নি কখনোই। সাধারণ মানুষের দৃষ্টিসীমার পুরোপুরি বাইরে অবস্থিত এই দ্বীপ গুলোর সৌন্দর্য পৃথিবীর অন্যান্য অতীব সুন্দর জায়গা গুলোর থেকে কয়েক গুন বেশি!

অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত এ দ্বিপ গুলোর সবচেয়ে বড় দ্বীপ ‘শিরো মিদোরি’ এর ঠিক কেন্দ্রে বীরদর্পে দাঁড়িয়ে আছে একটি সাদা রঙা মার্বেল পাথরের রাজপ্রাসাদ, যেটা পাখির চোখে দেখলে এক খন্ড হিরকের ন্যায় চমক দেয়। পুরোপুরি তিনশো হেক্টর জায়গা জুড়ে অবস্থিত এ শ্বেত পাথরের প্রাসাদের চারপাশ জুড়ে থাকা প্রাচীরের বাইরের পুরোটাই ঘন জঙ্গল, আর অদ্ভুত সব নাম না জানা লতা পাতা আর ফুল ফলে পরিপূর্ণ। সম্পুর্ন জঙ্গল জুড়ে অদ্ভুত সব প্রাণী আর পোকামাকড়ের বিচরণ। সম্পুর্ন আশি হাজার বর্গ কিলোমিটারের ভেতরে একটা শ্বেত পাথরের রাজপ্রাসাদ ছাড়া আর কোনো মানব বসতির অস্তিত্ব নেই।

থাকার মধ্যে আছে শুধু দশ একর জায়গা নিয়ে, কয়েকশ উদবাস্তু মানুষের অস্থায়ী বাসস্থান। আর তাদের অবস্থান প্রাসাদের অনতিদূরে, রাজ পথের থেকে বেশ খানিকটা পূর্ব দিকের জঙ্গলের ভেতরে, এবং এ জায়গায় অবস্থিত সে মানুষ গুলো দুইভাগে বিভক্ত ; আউটসাইডার্স এবং ওয়ার্কার্স।

আউটসাইডার তারা, যারা বিভিন্ন সময়ে মূল পৃথিবী থেকে বিভিন্ন কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে অথবা দুর্ঘটনার কারণে এই দ্বীপে এসে পৌছেছে৷ আর ওয়ার্কার্স হলো সেই সমস্ত মানুষ যাদের কে বিভিন্ন অপরাধের কারণে নিজেদের দ্বীপ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে এবং শাস্তিস্বরূপ এই শিরো মিদোরির জঙ্গলে লড়াই করে টিকে থাকার জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, এবং তার সাথে দেওয়া হয়েছে কঠোর কিছু নিয়ম নীতি।
আর শাস্তি প্রদানের এ অভিনব পদ্ধতি প্রবর্তন করেছেন স্বয়ং এই পঞ্চদীপের বাদশাহ নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান যিনি বিপুল ক্ষমতার সাথে শাসন করে চলেছেন সাধারণ মানুষের দৃষ্টি সীমার সম্পুর্ন বাইরে থাকা এই পঞ্চদ্বীপ কে৷

বাকি চারটি ছোট দ্বীপ শিরো মিদোরির দুই পাশে অবস্থিত। আর এই পাঁচটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত এ স্বয়ংসম্পূর্ণ রাজ্য টির সূচনা কাল আজ থেকে প্রায় পঁচিশ হাজার বছর আগে। এবং সূচনা কাল থেকেই এই রাজ্যের শাসন সম্পুর্ন ভাবে দেমিয়ান রাজবংশের হাতে। এখনো পর্যন্ত অন্য কোনো জনগোষ্ঠীর নিকট সে শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়নি, এবং হয়তো কখনো হবেও না।

.

হাতের শাবল টা মাটিতে ছুড়ে ফেলে দিলো থিয়োডর, এই মুহুর্তে সে দাঁড়িয়ে আছে ওয়ার্কার্স দের জন্য নির্ধারিত মিটিং জোনে। রাজ প্রাসাদ থেকে বেশ খানিক টা দূরে, জঙ্গলের ভেতরের কিছু গাছপালা কেটে সরিয়ে দিয়ে বেশ খানিকটা খোলা জায়গা বানিয়ে সে জায়গা টা মোটামুটি ছিমছাম করা হয়েছে ওয়ার্কার্স দের মিটিং জোনের জন্য।
মিটিং জোনের উত্তর দিক টাতে, গাছের ছায়া ওয়ালা স্থানে বেশ কয়েকটি মোটা মোটা গাছের গুড়ি কে আড়াআড়ি ভাবে কেটে, ঘষামাজা করে ওয়ার্কার্স দের বসার জন্য জায়গা বানানো হয়েছে, সেগুলো পাশা পাশি গোল করে বসানো।

মিটিং জোনের পূর্ব দিক টার পুরোটা জুড়ে বইয়ের তাকের দেয়াল৷ সেখানে অগণিত বই রাখা৷ সব ওয়ার্কার্স দের বাধ্যতামূলকভাবে রাতের বেলা এক ঘন্টা করে বই পড়ে তারপর ঘুমাতে যেতে হবে। এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে সে ওয়ার্কার এর বেতন থেকে অর্ধেকটা কেটে রাখা হবে৷

মিটিং জোনের পশ্চিম দিকটাতে একটা বিশাল বড় ডাইনিং টেবিল৷ ওয়ার্কার্স দের সবারই দুপুর বেলা এক সাথে বসেই খাবার গ্রহণ করার নিয়ম। কেউ কোনো নিয়ম ভঙ্গ করবে না। করলেই তার জন্য শাস্তি নির্ধারিত। কি শাস্তি নির্ধারিত সেটা কারো জানা নেই, শাস্তির ধরন নির্ভর করবে থিয়োডরের মুডের ওপর। তার মুড ভালো থাকলে শাস্তি হয়তো কমের ওপর দিয়ে যাবে, কিন্তু মুড যদি খারাপ থাকে, তবে তার কপালে কি আছে সেটা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউ জানে না, স্বয়ং থিয়োডর ও না৷

আর মিটিং জোনের দক্ষিণ দিক টা হলো মিটিং জোনের প্রবেশ দ্বার৷ থিয়োডর এখন সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে৷ সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, একটু বাদেই মাগরিবের আজান পড়ে যাবে৷ তাকে এখনি একবার অ্যানা কে দেখতে যেতে হবে। মেয়েটার কি অবস্থা করেছে ওই অসভ্য ক্রিস্টিনা সেটা একবার না দেখলেই নয়।

থিয়োডর লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেলো ডাইনিং টেবিলের পাশে থাকা সিঙ্কের দিকে৷ হাতে তার কাদা মাটি লেগে আছে। পায়েও লেগেছে কিন্তু এখন পায়ের কাদামাটি ধোয়ার সময় নেই। হাতের টা ধুয়েই ওয়ার্কার্স দের রেসিডেন্সিয়াল এরিয়ার ভেতর ঢুকতে হবে, অ্যানা সেখানেই আছে।
ওয়ার্কার্স দের ডিউটি আওয়ারে রেসিডেন্সিয়াল এরিয়াতে থাকার কোনো নিয়ম নেই। আর এই ডিউটি আওয়ার শেষ হবে রাতের দশ টার সময়, আবার শুরু হবে সকাল পাঁচে। তাই থিয়োডর চাইলেও নিজের কামরায় গিয়ে বসতে পারবে না, যতই সে ওয়ার্কার্স দের লিডার হউক না কেন! নিয়ম সবার জন্যই সমান!

হাতের কাদামাটি গুলো রগড়ে রগড়ে ধুয়ে, মুখে দুবার পানির ঝাপটা দিয়ে তোয়ালে দিয়ে নিজের হাত মুখ মুছে নিলো থিয়োডর, তারপর জঙ্গলের উত্তর দিকে হেটে চলল রেসিডেন্সিয়াল এরিয়াতে ঢুকতে।

রেসিডেন্সিয়াল এরিয়ার ভেতরে ওয়ার্কার্স দের থাকার জন্য তৈরি করা হয়েছে ছোট্ট ছোট্ট কুড়েঘর৷ শুধুমাত্র একটা ছোটখাটো থাকার মতো কামরা, একটা রান্নাঘর, একটা ওয়াশরুম, আর কামরার সাথে ছোট্ট একফালি বারান্দা, এই চারের সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে এক একটা কুড়েঘর৷ বড় বড় নাম না জানা গাছপালার ফাকে ফাকে অবস্থান করা এ কুড়েঘর গুলো পাশাপাশি অবস্থিত নয়, একে অপরের থেকে তাদের দূরত্ব বেশ খানিক টা। আর এইখানে এই কুড়েঘর গুলোকে ডাকা হয় মাঞ্জার নামে৷ পয়তাল্লিশ জন ওয়ার্কার্স এর জন্য পয়তাল্লিশ টা মাঞ্জার। আর রেসিডেন্সিয়াল এরিয়ার প্রথম মাঞ্জার টাই হলো থিয়োডরের। কিন্তু সে এখন চাইলেও তার কামরায় গিয়ে এক টা মিনিটের জন্যও ঘুরে আসতে পারবে না।

অ্যানা নামের মেয়েটার মাঞ্জার হলো সতেরো নম্বর মাঞ্জার। আর এই সতেরো নম্বর মাঞ্জার হলো পুরো পয়তাল্লিশ টা মাঞ্জারের ভেতর সবচেয়ে সুন্দর মাঞ্জার। কারণ এই মাঞ্জার টার চারপাশে চেরী ফলের গাছ লাগানো, যেগুলোর উচ্চতা মাঞ্জারের ছাদ ছাড়িয়ে দুই থেকে তিন ফুট উচুতে উঠে বাড়িটাকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো অ্যানা এইখানে আসার পর থেকে সে চেরি গাছ গুলো সারাটা বছরই ছোট্ট ছোট্ট গোলাপী রঙা ফুলে ছেয়ে থাকে, যখন ফল দেয় তখনও। এর রহস্য থিয়োডর আজ ও বের করতে পারেনি।

আট নম্বর মাঞ্জার টা পেরোতেই থিয়োডরের দেখা হলো শার্লটের সাথে। তাকে কিছুটা চিন্তিত দেখাচ্ছে৷ শার্লটের সাথে শার্লটের ভাই ব্রায়ান। ব্রায়ান শার্লটের থেকে বছর সাতেকের বড়। ব্রায়ানের এক গুরুতর অপরাধের কারণে তার দ্বীপ থেকে তাকে বের করে দিয়ে শিরো মিদোরিতে নির্বাসিত করা হয়েছে, কিন্তু শার্লটের শুধুমাত্র এক বড় ভাই ছাড়া অন্য কোনো রক্তের সম্পর্কের কেউ না থাকায় ভাইয়ের সাথে তাকেও নির্বাসনে দেওয়া হয়েছে। আর এই ব্যাপার টা সে বেশ খুশি মনেই মেনে নিয়েছে! গত দুই বছর ধরে সে শিরো মিদোরি তেই থাকছে। তার ভাইয়ের অপরাধের শাস্তি কবে শেষ হবে সে সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই তার। শাস্তি শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকেও এইখানেই থাকতে হবে, ভাইয়ের সাথে।

শার্লট অ্যানার বয়সী। নিজের সমবয়সী হওয়ায় অ্যানা মেয়েটার সাথে শার্লটের একটা মোটামুটি সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে গত দেড় বছরে৷ আর এই সুন্দর সম্পর্কের পেছনে আর ও একটা বড় কারণ নিহিত!
শার্লট খুবই আবেগি আর ছটফটে ধরনের, কিন্তু ব্রায়ান ওর ধারে কাছেও না, সে খুবই শান্ত, তবে রেগে যাওয়ার আগ পর্যন্ত। এইখানে আসার পর থেকে দুই ভাই বোন সারাক্ষণ এক সাথে থাকতো, কারো সাথেই তেমন কথা বলতো না, নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে খুবই অসুবিধা হতো তাদের। তবে কোনো ঝুট ঝামেলা তে দুজনের কেউই ওরা জড়াতে চায়তো না, কারো সাথে ঝামেলাতেও যেতে চায়তো না। আর এই কারণেই কিছু হাইয়ার লেভেলের ওয়ার্কার্স দের থেকে তারা দুজনেই বুলিং এর শিকার হতো এবং সেটা খুবই ভয়াবহ ধরনের বুলিং। অতিরিক্ত আবেগি শার্লটকে সুইসাইডাল মেন্টালিটির বানিয়ে ফেলার পর্যায়ে চলে গেছিলো ওয়ার্কার্স দের বুলিং এর তোপ। কিন্তু সবকিছু বদলে গেলো অ্যানা ওয়ার্কার্স দের ভেতরে যোগ দেওয়ার পর থেকে।

অ্যানা মেয়েটা অসম্ভব রকম চুপচাপ। প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটা কথাও তার মুখ থেকে বের করতে পারে না কেউই। কিন্তু তার সেই নিশ্চুপতা তাকে করে তুলেছে আর ও বেশি শক্তিশালী। অন্যান্য মেয়েদের তুলনায় অস্বাভাবিক লম্বা সে। প্রায় ছয় ফিটের কাছাকাছি উচ্চতার এই মেয়েটি যখন কালো রঙা মাস্কের আড়ালে তার শক্ত হয়ে থাকা নিশ্চুপ চোয়াল দুটো বদ্ধ ঠোঁটের ভেতরের ঝকঝকা দাঁতে দাঁত চেপে আর ও শক্ত করে শান্ত চোখে সবার মাথা ছাড়িয়ে সামনে তাকিয়ে থাকে তখন সে দৃষ্টি দেখে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে সবার! আর শার্লট এবং ব্রায়ান কে এই ভয়াবহ বুলিং এর হাত থেকে সে একা হাতেই উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে। এখন সব বুলিং কে পেছনে ফেলে শার্লট এবং ব্রায়ান, দুজনেই হায়ার লেভেলের ওয়ার্কার্স এ পরিণত হয়েছে। যার কারণে তাদের কে বুলি করা ওয়ার্কার্স দের অ্যানার ওপর ক্ষোভের সীমা নেই, যার রেশ ধরেই আজ তাকে অকারণে মার খাওয়ানো হলো!

কিন্তু শার্লট এ বিষয় নিয়ে চিন্তা করছে না। কারণ অ্যানা কতটা প্রতিশোধ পরায়ণ সে সম্পর্কে শার্লট বেশ ভালোভাবেই অবগত। নিজেকে সামনে না নিয়ে এসেই প্রতিপক্ষ কে কখন কিভাবে ঘায়েল করে এই মার খাওয়ানোর প্রতিশোধ টা সে নেবে সেটা শুধু সময় অপেক্ষা। শার্লট এখন চিন্তিত অন্য বিষয় নিয়ে।

শার্লট রা আর একটু কাছাকাছি আসলে থিয়োডর ওদের কে থামালো।

— কি ব্যাপার, তোমরা ওই অসুস্থ মেয়েটাকে রেখে চলে এলে কেন? হেকিম ফাতমা কে ডেকে পাঠিয়ে ছিলাম আমি, সে কি অ্যানা কে দেখেছে?

গমগমে কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো থিয়োডর। কথা টা শার্লট কে জিজ্ঞেস করলেও দৃষ্টি তার ব্রায়ানের দিকে৷ ব্রায়ান ছেলেটাকে সে কেন যেন পছন্দ করে না। এই ছেলেটা শান্ত আর চুপচাপ ধরনের হলেও এর চোখ মুখ দেখে মনে হয় কিছু একটা ঘাপলা আছে৷ কিন্তু চুপচাপ থাকার দরুন ঘাপলা টা টের পাওয়া যায় না৷

অতি আবেগী শার্লটের চোখের কোণে এখনো পানির রেশ৷ ঘন ঘন নাক টানছে সে। থিয়োডরের প্রশ্নের উত্তরে সে নাক টেনে বলল,
— অ্যানা আমদের কে ওর কামরায় ঢুকতে দেয়নি। নিজে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিয়েছে, আর আমাদের কে চলে যেতে বলেছে। হেকিম ফাতমা ও এসে পৌছেছিলো কিন্তু তাকেও সে ঢুকতে দেয়নি। আমরা অনেকবার অনুরোধ করার পর ও সে আমাদের কোনো কথা শোনেনি। জানেনই তো সে কেমন! একবার যা বলবে, তাই!

থিয়োডর তার ভ্রু জোড়া কুচকে নিলো। অ্যানার এমন আচরণের কারণ সে খুজে পেলো না। এখন হয়তো তার ও সেখানে যাওয়া ঠিক হবে না৷ কিন্তু মেয়েটা তো ভয়াবহ রকমের আঘাতপ্রাপ্ত, তার চিকিৎসা তো করা প্রয়োজন! কিছুক্ষণ চুপ থেকে থিয়োডর শার্লট কে উদ্দেশ্য করে বলল,

— ঠিক আছে, তোমরা আবার কাজে ফিরে যাও। আর অ্যানার রাতের খাবার টা ওকে তুমি রান্না করে দিয়ে এসো। ফাতমা কেও নিয়ে যেও সে সময়ে।

শার্লট মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। তারপর থিয়োডর ওদের কে চলে যেতে ইশারা করলে থিয়োডর কে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো ওরা দুজন। আর অ্যানার মাঞ্জারের রাস্তার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে ফিরে এলো আবার ওয়ার্কিং এরিয়ার দিকে।

.

ওয়ার্কার্স দের জন্য নির্ধারিত কাজের ভেতরে একটি হলো আউটসাইডার্স দের দেখাশোনা করা৷ আউটসাইডার্স দের জন্য বাদশাহর পক্ষ থেকে যে খাদ্য এবং বস্ত্রের অনুদান আসে সেগুলো ঠিকঠাক ভাবে বন্টন করা এবং আউটসাইডার্স দের স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখা হচ্ছে ওয়ার্কার্স দের অন্যতম কাজ। আর এছাড়া তাদের অন্যান্য কাজ হচ্ছে শিরো মিদরির জঙ্গলের যে অংশ টুকু তাদের তাদের জন্য বরাদ্দ শুধুমাত্র সেই অংশের গাছপালা এবং পশুপাখি কে দেখা শোনা করা, নতুন গাছ লাগানো, এবং অসুস্থ পশুপাখির চিকিৎসা করা।

সব অপরাধী দের কে এই ধরনের মানবতাবাদী কাজ কর্মে নিযুক্ত করা হয় যেন তাদের অপরাধ করার মতো মানসিকতা আর না থাকে। এবং বছর শেষে প্রতিটা ওয়ার্কার্স এর ভালো কাজের পয়েন্টের ওপর নির্ভর করে তাদের শাস্তির সময়সীমা ওঠানামা করে। যার কারণে সব ওয়ার্কার্স দেরই উদ্দ্যেশ্য থাকে ভালো কিছু করার, আর এ কারণে পঞ্চ দ্বীপের অপরাধ এবং অপরাধী, দুইটার সংখ্যাই খুবই সীমিত।

৩. রাতের এখন প্রায় দেড়টা। ওয়ার্কার্স রা যে যার মাঞ্জারে ঘুমাচ্ছে। আর আউটসাইডার্স রা নিজেদের জন্য নির্ধারিত জায়গায় যার যার তাবুর ভেতরে ঘুম দিচ্ছে৷

চেরী গাছ দ্বারা আচ্ছাদিত সতেরো নম্বর মাঞ্জারের ভেতর পিঠের দগদগে আঘাত আর গা পুড়ে যাওয়া জ্বর নিয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন অ্যানা ককিয়ে উঠছে থেকে থেকে। না ঘুম না জাগরণ অবস্থাতে থেকে আশেপাশের কিছুই সে ঠাহর করতে পারছে না, পিঠের বেদনা ছাড়া৷

তখন পানিশমেন্ট এরিয়া থেকে শার্লট তাকে নিয়ে এসে কামরায় রেখে যাওয়ার পর থেকে এভাবেই বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে সে। পিঠের আঘাতের কারণে সমস্ত শরীরেই যেন ব্যাথা হয়ে আছে, আর তা থেকেই জ্বর চলে এসেছে সমস্ত গায়ে। গায়ের পোশাক টা পর্যন্ত পরিবর্তন করার সামর্থ্য হয়নি তার৷ হেকিম ফাতমা কে পর্যন্ত সে ঢুকতে দেয়ন; রাগে, ক্ষোভে।

রাতের গভীরতার কারণে জঙ্গলের পশুপাখিরাও পুরোপুরি নিশ্চুপ হয়ে গেছে৷ থেকে থেকে ঝিঝি পোকা ডাকছে আশাপাশের ঝোপঝাড়ের ভেতর। মাঝে মাঝে দূরের জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে শেয়ালের হুক্কাহুয়া ডাক! কয়েকটা নেকড়ে নিজেদের ভেতর বিবাদে লিপ্ত হয়েছে অনেক্ষণ যাবৎ, কিন্তু তাদের সে বিবাদ নিষ্পত্তি হচ্ছে না৷

ঠিক সেই মুহুর্তে খট করে অ্যানার মাঞ্জারের কামরার লক টা খুলে গেলো। আধো ঘুমে থাকা অ্যানা সেই শব্দ টা শুনলো ঠিকই, কিন্তু তার মস্তিষ্ক কোনো সাড়া শব্দ দিলো না। জ্বরের তোপে জ্ঞানশূন্য হওয়ার উপক্রম তার৷ নাক থেকে গরম নিঃশ্বাস বের হচ্ছে, শরীরের তাপে বিছানা টা অস্বাভাবিক রকম গরম হয়ে উঠেছে৷ গায়ের ওপরের কাঁথা টাও সরে কোথায় যেন চলে গেছে৷

কামরার দরজা টা নিঃশব্দে, ধীরে ধীরে, একটু একটু করে আলগা হতে শুরু করলো। আর কিছুক্ষণ বাদে সেটা পুরোপুরি আলগা হতেই ভেতরে প্রবেশ করলো দীর্ঘকায় এক অবয়ব। অন্ধকারে তার অবয়ব টা বোঝার উপায় নেই। কিন্তু ঈগল চোখের ন্যায় তীক্ষ্ণ চোখ জোড়া স্পষ্ট। সে চোখ জোড়ার অদ্ভুত সোনালি রঙা মণীদ্বয় কামরার এই ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর অস্বাভাবিক রকম দ্যুতি ছড়াচ্ছে, যেন কেউ ছোট্ট ছোট্ট দুইটা আগুনের গোলক ছেড়ে দিয়েছে সেই দীর্ঘকায় ব্যাক্তিটার চোখের ভেতর৷

ধীর পায়ে সে অজানা অবয়বটি এগিয়ে এলো অ্যানার বিছানার দিকে। তারপর কামরার চারদিকে একবার নইজের তীর্যক দৃষ্টি বুলিয়ে নিলো সন্তর্পণে। এরপর পেছনে তাকিয়ে দরজার দিকে ইশারা করতেই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো বেশ কয়েকজন কালো পোশাকে আবৃত নারী এবং পুরুষ। তাদের ভেতরের কয়েকজনের হাতে বিশেষ ধরনের সাদা রঙা মাঝারি আকারের বক্স।

কালো পোশাকধারী রা বিছানার কাছে এসে পৌছাতেই দীর্ঘকায় লোকটা বিছানার পাশ থেকে সরে গিয়ে অ্যানার স্টাডি টেবিলের পাশে থাকা চেয়ার টা টেনে নিয়ে তাতে বসে পড়লো বীরদর্পে, পায়ের ওপর পা তুলে। আর ভেতরে প্রবেশ করা নারী গুলো দ্রুত নিজেদের কাজে নেমে পড়লো।

ঘুটঘুটে অন্ধকার টা কমাতে একজন ছোট্ট একটা মোমবাতি জ্বালালো, যেন কামরাটা সামান্য আলোকিত হয়৷ এরপর তাদের ভেতরের অন্য দুজন গিয়ে অ্যানা কে ধরাধরি করে নিয়ে গেলো ওয়াশরুমে। তারপর তার গায়ের পোশাক টা খুলে দিয়ে শাওয়ার ছেড়ে দিলো অ্যানার শরীরের ওপর। জ্বর তপ্ত শরীরে ঠান্ডা পানির ঝাপটা লাগতেই কেঁপে উঠলো অ্যানা, সমস্ত শরীরের পশম গুলো দাঁড়িয়ে গিয়ে শরীরে শিহরণ বইয়ে দিয়ে গেলো।

মেয়ে দুটো জ্বরের ঘোরে জ্ঞানশূন্য হয়ে থাকা অ্যানা কে ভালোভাবে গোসল দিয়ে, শরীরের পানি মুছে কামরার কাবার্ড থেকে পোশাক বের করে পরিয়ে দিলো অ্যানার গায়ে৷ তারপর আবার ও ধরাধরি করে তাকে নিয়ে এলো বিছানায়৷ তারপর উপুড় করে শুয়ে দিলো ওকে।
অ্যানা কে গোসল দিতে গিয়ে নিজেরাও ভিজে জবজবে হয়ে যাওয়া মেয়ে দুটো নিজেদের কাজ শেষ করে দরজার এক কোণায় গিয়ে আনুগত্যের সহিত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো৷

এরপর অন্য একজন মেয়ে গিয়ে নিজেদের হাতে করে আনা সে সাদা রঙা বক্স গুলো বের করলো। বক্সের মুখ খুলতেই আলোক রশ্নি তে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো সে বক্সের ভেতর টা। মেয়েটি বক্সের ভেতর থেকে তুলা বের করে নিয়ে সেটা দিয়ে ভালোভাবে আর একবার পরিষ্কার করে নিলো অ্যানার ক্ষতস্থান টা, তারপর বক্স থেকে অয়েন্টমেন্ট জাতীয় কিছু একটার টিউব বের করে, সেখান থেকে কিছুটা অয়েন্টমেন্ট নিয়ে অ্যানার পিঠের ওপর থাকা পোশাকের অংশবিশেষ সরিয়ে ধীর গতিতে, আলতো হাতে অয়েন্টমেন্ট টা লাগিয়ে দিতে থাকলো ওর পিঠের আঘাতপ্রাপ্ত স্থান গুলোতে।
আবছা আলোর ভেতরে খুব সাবধানতার সহিত কাজ টা করতে লাগলো যেন কোনো ভুল না হয়, কারণ এই মুহুর্তে কামরার ডান দিকের চেয়ারে যে বসে আছে তার সামনে সামান্যতম ভুল করলেই ধড় থেকে মাথা টা আলাদা হতে দু সেকেন্ডও সময় লাগবে না।

অয়েন্টমেন্ট টা ভালোভাবে লাগিয়ে দিয়ে বক্স থেকে দুইটা ইঞ্জেকশন বের করে মেয়েটা সেগুলো পুশ করে দিলো অ্যানার বাহু আর উরুতে। তারপর শরীরের দুর্বলতা কাটিয়ে তুলতে মেয়েটি বক্স থেকে এক বিশেষ ধরনের সবুজ রঙা লিকুইড সলুশন স্যালাইন বের করে সেটা সেট করে দিলো অ্যানার কব্জির ধমনীতে৷

তারপর অ্যানার ভেজা চুল গুলো শুকিয়ে দিয়ে, শরীরের তাপমাত্রা সহনীয় মাত্রায় আসার আগ পর্যন্ত মেঝেতে বসে বসেই অপেক্ষা করতে লাগলো ওরা সকলে। আর সেই আগুন চোখের পুরুষ টি নিজের গাম্ভির্যতা বজায় রেখে, বিছানায় শুয়ে ঘুমে কাদা হওয়া অ্যানাকে তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করলো পুরোটা সময় ধরে৷ একটা মুহুর্তের জন্যও অ্যানার ওপর থেকে তার দৃষ্টি সরলো না……

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here