#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_১০
#আ_মি_না
চারদিকে একবার ভয়ে ভয়ে চোখ বুলালো রুথ৷ জুলিয়া তো তাকে বলেছিলো যে, তারা জঙ্গলের যে এরিয়া তে থাকে সেটা সেইফ জোন, সেখানে ভয়ের কোনো কারণ নেই। কারণ বাদশাহর এক বিশেষ সৈন্য দল এই এরিয়া টা নাকি সর্বক্ষণ পাহারা দেয় যেন কোনো হিংস্র প্রাণী বা অন্য কোনোকিছু লোকালয়ে প্রবেশ করতে না পারে। তাদের কাজ শুধু এই একটাই৷ কিন্তু লোকালয় থেকে এই এরিয়ার বাইরে কে গেলো বা না গেলো তা নিয়ে তাদের মাথা ব্যাথা নেই! শুধু বাইরে থেকে যেন কেউ ভেতরে না আসে সেটাই তাদের কনসার্নের প্রধান বিষয়।’
কিন্তু তাহলে সে শব্দ শুনলো কিসের! স্পষ্ট শুনেছে সে কারো পায়ের মৃদু আওয়াজ, এত রাতে কে আসবে এখানে? আশে পাশে তাকিয়েও তো কাউকে দেখা যাচ্ছে না! তাহলে কি তার মনের ভুল?’
মনে সাহস সঞ্চার করে, ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবারও সামনে পা বাড়ালো রুথ, কিন্তু তখনি কই থেকে একটা তীক্ষ্ণ ম্যাও শব্দ ভেসে আসলো তার কানে। আর সে শব্দ টা শুনেই এই আতঙ্কের মধ্যে চাপা একটা চিক্কুর দিয়ে ভয়ে লাফিয়ে উঠলো রুথ।
কিন্তু শব্দ টা বিড়ালের টের পাওয়া মাত্রই হাফ ছেড়ে বাচলো ও। কিন্তু পুরো সেইফ জোনের ভেতরে তো কোনো বিড়াল নেই! আর এত রাতে এইখানে বিড়াল আসবে বা কই থেকে! বিড়াল তো আছে শুধু অ্যানার! অ্যানা কি তাহলে আশেপাশেই আছে?
রুথ আবারও চোখ লাগিয়ে, চাঁদের ক্ষীণ আলোতে নিজের চারপাশ টা দেখার চেষ্টা করলো একবার, আর তখনি তার ঠিক পেছন থেকে একটা নারী কন্ঠ ভেসে এলো,
— রুথ!
শব্দটা নিজের একেবারেই কাছে হওয়ায় লাফিয়ে উঠে সেখান থেকে এক হাত দূরে সরে গেলো রুথ, তারপর তড়িৎ গতিতে পেছনে ফিরে তাকালো ও!
যাক বাবা, বাচা গেলো, এইটা অ্যানাই!’ মনে মনে ভাবলো রুথ। তারপর ভ্রু জোড়া ওপরে তুলে মুখে বলল,
— উফ, তুমি তো আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে অ্যানা! আর একটু হলে তো আমি হার্ট অ্যাটাক করে মরতাম নিশ্চিত!
কিন্তু অ্যানা নিশ্চল, রুথের কথায় তার কোনো ভাবান্তর হলো না৷ স্থীর চোখ জোড়া তার কঠোর, প্রচন্ড কঠোর! যেন পৃথিবীর কোনো মায়া মমতা, ভালোবাসা তাকে আর ছুতে পারবে না! পরণে তার এখনো ডিউটি আওয়ারের হুডি। হুডির পকেটের ভেতরে পুরো শরীর টা রেখে বসে পকেটের বাইরে মুখ বাড়িয়ে দিয়ে রুথের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে আছে লিন্ডা৷ আর মাঝে মাঝে ফোস ফোস করছে, যেন রুথ কে ওর এখন সহ্যই হচ্ছে না!
রুথ অ্যানা কে এমন স্থীর দেখে কিছুটা ভয় পেলো। অ্যানা ওর সাথে কথা বলছে না কেন? এমন নিশ্চুপ স্থীর হয়ে আছে কেন? এটা অ্যানাই তো!’ অ্যানার দিকে তাকিয়ে মনে মনে আওড়ালো রুথ।
অ্যানা কিছুক্ষণ নিষ্পলক চোখে রুথের দিকে তাকিয়ে থেকে অতঃপর শক্ত গলায় বলে উঠলো,
— তোমাকে তোমার নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা রুথ। আশা করি ওই প্রাসাদে গিয়ে তুমি খুব সুখেই থাকবে। তবে নিজের চোখ কান খোলা রেখো সবসময়৷ কারণ, সেখানে যে জিনিস টা অহরহ ঘটে সেটা হলো মৃত্যু; আর তোমার মতো নগন্য দাসীর মৃত্যু হলে সেটা নিয়ে কেউ মাথাও ঘামাবেনা! জাস্ট রাতের আধারে সমুদ্রের পানিতে ফেলে দিয়ে আসবে।
কথা গুলো বলেই নিজের হুডির বুকের ভেতর থেকে কিছু একটা বের করতে লেগে গেলো অ্যানা, আর রুথ ভাবতে লাগলো অ্যানার বলা কথা গুলো! ওই প্রাসাদ কি তাহলে সে যেমন ভাবছে তেমন নয়! সুখের আড়ালে কি সেটা কোনো মৃত্যুপুরী! কিন্তু যেটাই হোক না কেন, অ্যানা কিভাবে জানলো?
রুথের ভাবনার মাঝেই অ্যানা নিজের হুডির বুকের ভেতর থেকে বের করলো একটি খঞ্জর৷ মহামূল্যবান পাথর খচিত সে খঞ্জরের ধাতব আবরণ টা চাঁদের ওই ক্ষীন আলোতেও দ্যুতি ছড়াচ্ছে যেন! রুথের চোখ ধাধিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো খঞ্জরের ওই নকশা আর রূপ দেখে। সে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে রইলো খঞ্জর টা দিকে। তখন অ্যানা আবারও বলে উঠলো,
— এই খঞ্জর টা রেখে দাও কাছে, এইটা তোমার অনেক কাজে লাগবে, যেমন ধরো নিজেকে রক্ষা করা! আর হ্যা, এই খঞ্জর টা তোমার কাছ থেকে নিয়ে নেওয়ার জন্য প্রাসাদে হয়তো প্রতিযোগিতা লেগে যাবে, তাই এটাকে যথাসম্ভব সাবধানে রেখো!
রুথ খঞ্জরের দিক থেকে চোখ সরিয়ে অ্যনার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো, তারপর কিছুটা ভীতি, কিছুটা কৌতুহল নিয়ে সে অ্যানাকে জিজ্ঞেস করলো,
— প্রতিযোগিতা কেন লাগবে, এই খঞ্জরের বিশেষত্ব কি? আর এত দামী খঞ্জর তুমি কোথায় পেয়েছো? আর তুমি প্রাসাদের এতসবই বা কিভাবে জানো অ্যানা!
অ্যানা ঠাই দাঁড়িয়ে আগের মতো করেই উত্তর দিলো,
— কারণ, একসময় আমি ওই প্রাসাদেই ছিলাম!
উত্তর টা দিয়েই অ্যানা শরীর টা ঘুরিয়ে নিজের মাঞ্জারের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো, আর রুথ নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো অ্যানার বলা কথা টা! অ্যানা রাজপ্রাসাদ থেকে এসেছে? সেও কি তার মতোই বাদশাহর কোনো দাসী ছিলো! কিন্তু তখন ওই বৃদ্ধা, ওই লাঠি বুড়ি যে বললেন ওই প্রাসাদে যে একবার প্রবেশ করে সে আর কখনোই বের হতে পারে না! তাহলে অ্যানা এখানে কেন? আর কোন অপরাধের কারণে এখানে এসেছে ও?’
রুথ অ্যানার যাওয়ার পানে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কৌতূহল দমাতে না পেরে, মনে সাহস জুগিয়ে, তার থেকে দশ বারো হাত দূরে চলে যাওয়া ওই কঠোর চোখের, কঠিন গলার অ্যানাকে ও প্রশ্ন করে বসলো,
— তোমার অপরাধ কি ছিলো অ্যানা?
রুথের এ প্রশ্নে চলন্ত পা জোড়া থামিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো অ্যানা, তারপর নিজের মাথা টা রুথের উদ্দ্যেশ্যে কিঞ্চিৎ ডান দিকে ঘুরিয়ে, রুথের প্রশ্নের উত্তরে সে বলল,
— খুন করেছিলাম, অন্তঃসত্ত্বা এক মেয়ে কে!
উত্তর টা দিয়েই অ্যানা এক প্রকার ঝড়ের গতিতে প্রস্থান করলো সেখান থেকে। আর রুথ ওখানেই যেন থমকে গেলো!
অ্যানা কাকে খুন কিরেছিলো! তখন লাঠি বুড়ি যে বলেছিলো বাদশাহর এক সন্তানসম্ভবা দাসী কে খুন করা হয়েছিলো, অ্যানা কি তবে তাকে খুন করেছিলো! আর যদি এটা সত্যি সত্যিই হয়ে থাকে তাহলে অ্যানা এখনো বেচে আছে কিভাবে? বাদশাহর দাসী আর অনাগত সন্তান হত্যার দায়ে তো তার মৃত্যুদণ্ড অনিবার্য ছিলো! তবে সে এখনো নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে কিভাবে? নাকি সে অন্য কাউকে খুন করেছিলো! কিন্তু প্রাসাদে সন্তানসম্ভবা নারী আর কে-ই বা থাকবে! প্রাসাদের কোনো কর্মচারী তো আর নিজের সন্তানসম্ভবা স্ত্রী কে নিয়ে সেখানে থাকবে না! তাহলে, তাহকে কি? তাহলে কি বাদশাহর দাসীকেই…….?’
নাহ, আর ভাবতে পারছে না রুথ! ওর মাথার ভেতর সব কিছু যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে! অ্যানা! এউ অ্যানা সাধারণ কেউ নয়! সে হয়তো তার মতো দাসীও নয়! সে হয়তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ কেউ!’
এসব ভাবনা চিন্তা নিজের মনে আওড়াতে আওড়াতে এক ঝাক প্রশ্ন মাথায় নিয়ে সেখানেই ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো রুথ৷
|
|
|
|
১৭. সকাল বেলা আউটসাইডার্স দের আবাসিক এলাকায় রুথের টেন্টে থাকা জিনিস পত্র গুলোর তদারকি করছিলো থিয়োডর৷ রুথ রাতে প্রাসাদে চলে গেছে, তার ফেলে রেখে যাওয়া জিনিস পত্র গুলো আবারও তুলে রাখা হবে নতুন কোনো আউটসাইডারের জন্য। কিন্তু টেন্ট টা থিয়োডর ওভাবেই রেখে দিলো, সেটা আর খুলে নিলো না। এই নকশাদার, কারুকাজ করা তাবু গুলো তার খুবই পছন্দের। সে যেহেতু এখন আউটসাইডার্স দের লিডার তাই মাঝে মাঝে এইখানে এসে থাকলে মন্দ হবে না৷ ওয়ার্কার্স দের আবাসিকের মতো এখানেও তার এক টুকরো আশ্রয়স্থল থাকলে অসুবিধা কোথায়! আর তাছাড়া কালকের ওই খবর শোনার পর থেকে ওয়ার্কার্স দের ওদিকে ওর আর যেতেই ইচ্ছা করছে না। সবকিছু প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে ওর! যে শিরো মিদোরিকে ও মায়ের মতো করে আপন করে নিয়েছিলো সেই শিরো মিদোরি কেই এখন ওর কাছে অসহ্য লাগছে যেন!
তাবুর ভেতর থেকে রুথের সব জিনিসপত্র গুলো গুদামে পাঠিয়ে দিয়ে ফাকা তাবুর ভেতরে কিছুক্ষণ দাড়ালো থিয়োডর৷ নিজের বিছানা আর অন্যান্য আসবাবপত্র কোনটা কোথায় রাখলে ভালো হয় সেটা তাবুর চারদিকে তাকিয়ে মনে মনে ছক কষে নিতে থাকলো ও৷ ঠিক তখনই বাইরে থেকে জুলিয়ার আওয়াজ ভেসে এলো,
— মিস্টার ব্রাউন!
জুলিয়ার ডাকে ধ্যান ভাঙলো থিয়োডরের, সে চমকে তাকালো জুলিয়ার দিকে, তারপর উত্তর করলো,
— হ্যা জুলিয়া, বলো।
জুলিয়া মেয়েটি নিজের আনুগত্য বজায় রেখে মাথা টা কিঞ্চিৎ নত করে বলল,
— মিটিং জোনে মিস্টার উইলসন সব ওয়ার্কার্স দের ডেকেছেন, আপনাকেও দ্রুত যেতে বলেছেন৷
থিয়োডর ব্রায়ানের এমন হঠাৎ মিটিং এ কিছুটা আশ্চর্যান্বিত হলো। এই সকাল বেলা ব্রায়ানের কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা থাকতে পারে যে সবাইকে এইভাবে ডাকা হচ্ছে! নাকি নতুন লিডার হয়েছে বলে নিজের লিডার গিরি দেখাতে সবাইকে ডাকছে সে?
মিটিং জোনে সমস্ত ওয়ার্কার্স দের একসাথে কখনো বসা হয় না৷ একসাথে বসার মতো কোনো ঘটনাও ঘটে না বহুদিন৷ তাহলে ব্রায়ান অকারণে কেন সবাইকে ডাকছে!
থিয়োডর তাবুর ভেতরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তা করে এরপর তাবুর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা জুলিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
— ঠিক আছে, আমি আসছি৷
থিয়োডরের উত্তর শুনে জুলিয়া মাথা নেড়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলো, আর থিয়োডর তাবু থেকে বেরিয়ে রওনা দিলো মিটিং জোনের উদ্দ্যেশ্যে।
.
ব্রায়ান মিটিং জোনের মাঝের লিডারের চেয়ারে বসে আছে। ওর পাশে একটা ছোটখাট, জোড়াতালি দেওয়া সাউন্ড বক্স৷ সাউন্ড বক্স টা ওর নিজস্ব, এইখানে আসার সময়ে সাথে করে এইটা নিয়ে এসেছিলো ও। কিন্তু যাওয়া আসার পথে কিভাবে কিভাবে জানি সেটা একটু খুলে টুলে নড়বড়ে হয়ে যাওয়ায় চালু হতো না পরে আর৷ পরবর্তী তে সেটা ঠিক করতেও চেয়েছিলো ও , কিন্তু থিয়োডর একদিন বক্স টা দেখেই বলে দিয়েছিলো যে, এসব সে ওয়ার্কিং জোনে অ্যালাও করবে না, বক্স টাকে যেন ব্রায়ান ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে আসে।
কিন্তু ব্রায়ান ফেলেনি, নিজের কাছেই যত্ন করে রেখে দিয়েছে, আর কাল রাতে ওয়ার্কার্স দের টেকনিশিয়ান ড্যানিয়েলের থেকে সাউন্ড বক্স টা সারিয়ে এনেছে ও। এখন যেহেতু সে নিজেই লিডার, তাই তাকে আর বাধা দেওয়ার মতো কেউ নেই৷
ব্রায়ানের হাতে একটা মাইক্রোফোন, অনেক্ষণ ধরেই সাউন্ড বক্স টার সাথে ওয়ারলেস মাইক্রোফোন টাকে কানেক্ট করার চেষ্টা করছে ও, কিন্তু এখনো পারেনি। শার্লট ব্রায়ানের পাশে বসে বসে ব্রায়ানের কাজ কর্ম দেখছে৷ অ্যানা এই মাত্র কিচেনের টুকিটাকি কাজ কর্ম সেরে এসে মিটিং জোনে এলো। সেই মুহুর্তে ব্রায়ানও সাউন্ড বক্সের সাথে মাইক্রোফোন টাকে কানেক্ট করে ফেললো।
কানেক্ট করেই মাইক্রোফোনে ও সব ওয়ার্কার্স দের কে উদ্দ্যেশ্য করে মিটিং জোনে দ্রুত পৌছাতে বলল৷ থিয়োডর প্রায় কাছাকাছিই এসে গেছিলো, হঠাৎ করে মাইক্রোফোনে ব্রায়ানের কন্ঠ কানে আসতেই ও চমকালো। প্রথমে ওর মাথায় এলো না ব্রায়ান সাউন্ড বক্স কই থেকে জোগাড় করলো, কিন্তু কিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তা করার পর ওর মস্তিষ্ক খুজে খুজে বের করলো কয়েক বছর আগের ব্রায়ানের সেই ভাঙা চোরা সাউন্ড বক্স টার কথা যেটা সে ব্রায়ান কে তখন মেরামত করতে দেয়নি। কারণ তার এসব উচ্চশব্দ, গান বাজনা তেমন পছন্দ ছিলো না। আর আজ, ব্রায়ান লিডার পদ পাওয়ার সাথে সাথেই সে সাউন্ডবক্স টা মেরামত করে ফেলেছে। থিয়োডরের আদেশ নিষেধের আর কোনো দাম নেই কারো কাছে!
তীব্র মনোকষ্টে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো থিয়োডরের বুক চিরে৷ তারপর আবার চলা শুরু করলো ও মিটিং জোনের দিকে৷
.
সব ওয়ার্কার্স রা মিটিং জোনে এসে পৌছালে ব্রায়ান মিটিং জোনের মাঝখানে থাকা লিডারের চেয়ারে বসা থেকে উঠে দাড়ালো৷ ও উঠে দাড়ানোর সাথে সাথেই ওয়ার্কার্স দের ভেতরে চলা গল্প গুজব গুলো বন্ধ হয়ে পিনপতন নিরাবতা নেমে এলো চারদিকে৷
ব্রায়ান উঠে দাঁড়িয়ে চারদিকে একবার নজর বুলালো, তার প্রধান উদ্দ্যেশ্য হলো অ্যানা কোথায় বসেছে আর থিয়োডর কোথায় অবস্থান করছে সেটাই দেখা৷ কিছুক্ষণ আশেপাশে তাকাতাকির পর থিয়োডর কে দেখলো ও, ওয়ার্কার্স দের ডাইনিং এরিয়াতে বসে আছে ও। মুখে ওর কেমন যেন হতাশার ছাপ৷ আশেপাশে তাকিয়ে থিয়োডরের চোখ জোড়া কাকে যেন খুজছে, ব্রায়ানের বুঝতে বাকি রইলো না যে থিয়োডরের চোখ জোড়া কাকে খুজে চলেছে৷ কিন্তু সেদিকে পাত্তা না দিয়ে এবার অ্যানার খোজে আবার চারদিকে নজর বুলাতে শুরু করলো ও৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই অ্যানা কে চোখে বাধলো ওর৷
লাইব্রেরী এরিয়ার কাছে একটা চেয়ারে বসে নিজের পাশে বসা ফাতমার সাথে টুক টাক কথা বলছে অ্যানা, ব্রায়ানের দিকে তার একটা ফোটাও মনোযোগ নেই৷ এ দৃশ্য দেখেই ব্রায়ানের মন খারাপ হয়ে গেলো। তার এমন সুন্দর একটা দিনের শুরুতে অ্যানা তাকে এক ফোটাও পাত্তা কেন দিচ্ছে না! অ্যানা তো তার খুব ভালো বন্ধু, অ্যানার তো উচিত ছিলো ব্রায়ানের এই সুন্দর মুহুর্ত গুলো চরম আনন্দের সাথে উপভোগ করা! অন্য কিছু হিসেবে না হোক, অন্তত বন্ধু হিসেবে! কিন্তু না, অ্যানার কোনো মনোযোগই নেই তার দিকে, সে এক মনে ফাতমার সাথে গল্প করতে ব্যস্ত।
যে উচ্ছাস নিয়ে ব্রায়ান উঠে দাঁড়িয়েছিলো সে উচ্ছাস টা মুহুর্তেই নিভে গেলো ওর৷ হাসি হাসি মুখটাতে আঁধার নেমে এলো সাথে সাথেই। শার্লট পাশেই কাঠের গুড়ির ওপর বসে ছিলো, ভাইয়ের মুখের অভিব্যাক্তির এমন পরিবর্তনে সে তার ভাইয়ের চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো সেদিকে।
ভিড়ের মাঝ দিয়েই সে অ্যানাকে দেখতে পেলো, খোশ মেজাজে গল্প করছে সে ফাতমার সাথে৷ আর এটা দেখেই শার্লট বুঝে ফেললো ব্রায়ানের মন খারাপের কারণ। তার ভাই যে সামান্য মনোযোগ চায়, কিন্তু সে তো জানে অ্যানা সেটুকুও কাউকে দিবে না! নিজেকে সে সবকিছু থেকে দূরে দূরে রাখে সর্বদা, যেন সামান্য কালীমাও তাকে ছুতে না পারে!
ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে, অ্যানার দিক থেকে চোখ সরিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো শার্লট, তারপর ব্রায়ানের কাছাকাছি গিয়ে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
— মন খারাপ করো না ভাইয়া, জানোই তো ও কেমন! ওর মনে কোনো ছেলের প্রতিই কোনো ফিলিংস নেই। তবুও তুমি এগিয়ে আছো কারণ তোমাকে ও বন্ধু ভাবে, যা আর কাউকেই ভাবে না৷ তাই যা যেভাবে চলছে চলতে দাও, দেখবে একদিন ঠিকই ওকে তুমি নিজের করতে পারবে।
ব্রায়ান আহত দৃষ্টিতে একবার তাকালো শার্লটের দিকে৷ শার্লট ওকে ইশারায় মন খারাপ করতে বারণ করলো। ব্রায়ান শার্লটের ইশারায় মাথা নেড়ে সায় দিয়ে মাইক্রোফোন টা মুখের কাছে নিয়ে গলা খাকারি দিলো। আর সেটার শব্দে আবারও গল্পরত ওয়ার্কার্স রা সবাই তাকালো ব্রায়ানের দিকে৷ অ্যানাও ফাতমার সাথে গল্প থামিয়ে তাকালো সেদিকে।
সবার মনোযোগ আকর্ষণের পর ব্রায়ান মাইক্রোফনে বলা শুরু করলো,
— আজকে সবাইকে এইখানে ডাকার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে ওয়ার্কার্স দের রুলস এন্ড রেগুলেশন্সে কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসা। আজ থেকে সব ওয়ার্কার্স রা তিন বেলাই ডাইনিং এরিয়া তে খাওয়া দাওয়া করবে৷ সবাই ডিউটি আওয়ারে একসাথে থাকবে এবং সবাই সবার কাজে যথাসম্ভব সহোযোগিতা করবে৷
আজ থেকে কাউকে কোনো কাজ বেধে ধরে দেওয়া হবে না। যে কাজ যাকে বেধে দেওয়া হয়েছে সে-ই একমাত্র করবে সেই কাজ করবে, আর কেউ করবে না, এই নিয়ম আজ থেকে বাতিল করা হলো। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে সবাই মিটিং জোনে চলে আসবেন আর তারপর সেখানে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে সেদিন কে কি কাজ করবে৷
আজ থেকে ওয়ার্কার্স দের জন্য বিনোদনের ব্যাবস্থা করা হবে৷ রোজ রাতের খাবারের পর সবাই মিটিং জোনে উপস্থিত হবেন, কিন্তু সেটা বাধ্যতামূলক নয়। যার ভালো লাগবে সে থাকবেন আর যিনি চলে যেতে চান চলে যাবেন। রোজ রাতে আমরা সবাই মিলে বসে নিজেদের ভেতর গল্প গুজব হাসি আড্ডা করবো। কাজের চাপে আমাদের ওয়ার্কার্স দের কারো সাথে কারো তেমন কথা হয় না, আমাদের একটা হিউজ কমিউনিকেশন গ্যাপ আছে। সেটা আমরা ধীরে ধীরে পূরণ করে ফেলবো৷
ওয়ার্কার্স দের ভেতরে বেয়াদবির কোনো স্থান হবে না। যে বেয়াদবি করবে, তাই সে যে-ই হোক না কেন তাকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে৷ এখানে সবাই সবার সাথে ভালো আচরণ করবেন, ছোটদের স্নেহ এবং বড়দের সম্মান করবেন। এটাই আপনাদের কাছে কাম্য।
ওয়ার্কার্স দের জন্য মাসের একটা দিন ছুটির ব্যাবস্থা করা হবে। সেই দিন টাতে ওয়ার্কার্স রা কেউ কোনো কাজ করবে না, নিজেদের কে সময় দিবে ওই দিন টাতে আউটসাইডার্স রা নিজেদের কাজ নিজেরা করে নিবে।
আর, এখন থেকে প্রতি মাসে আপনাদের কে আপনাদের ‘গুড ওয়ার্কস’ পয়েন্টস দেখানো হবে এবং প্রতি ছয় মাস পর পর দেখানো হবে আপনাদের কার কত দিন শাস্তি বাকি আছে৷ যেন আপনারা আরও বেশি বেশি ভালো কাজের উৎসাহ পান৷
কথা গুলো বলে ব্রায়ান কিছুক্ষণ বিরতি দিলো। ওয়ার্কার্স রা এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো ওর কথা৷ এতদিন থিয়োডরের কড়া শাসনে তারা তটস্থ হয়ে থাকতো সর্বক্ষণ। তাই এখন ব্রায়ানের থেকে এই সামান্য স্বাধীনতা পেয়ে মুখে হাসি ফুটে উঠলো তাদের সবার৷ নিজেদের ভেতরে তারা চাপা সুরে নতুন হওয়া রুলস গুলো নিয়ে আলোচনায় লেগে গেলো৷ তখন ব্রায়ান আবারও বলে উঠল,
— এখন আপনারা যে যার কাজে ফিরে যান৷ আজ যার যা কাজ সে সেই কাজ করুন। আগামী কাল থেকে সবাই কে আমি নিজ দায়িত্বে কাজ ভাগাভাগি করে দেবো। রোজ কে কি কাজ করবে সেটা আমি তার আগের দিন রাতেই ডিসাইড করবো আর পরদিন সকালে আমার নেওয়া ডিসিশন সবাইকে জানানো হবে। আর সবাইকেই সব কাজে পার্টিসিপেট করতে হবে। গড়িমসি করলে চলবে না৷ এখন আপনারা আসতে পারেন।
কথা গুলো বলে মাইক্রোফোনটা নামিয়ে রাখলো ব্রায়ান। আর ওয়ার্কার্স রা ব্রায়ানের এই নতুন রুলসে খুশি হয়ে মিটিং জোন থেকে বেরিয়ে যে যার কাজে চলে গেলো নতুন উদ্যামে। অ্যানা আর ফাতমাও উঠছিলো নিজেদের কাজে যাওয়ার জন্য।
এমন সময়ে আউটসাইডার্স দের আবাসিক এরিয়া থেকে ছুটতে ছুটতে মিটিং জোনে এসে পৌছালো জুলিয়া, তারপর ফাতমার একেবারে কাছে এসে দাঁড়িয়ে হাফাতে হাফাতে বলল,
— হেকিম ফাতমা! লাঠি বুড়ির কাশি টা আবার বেড়েছে কাশির সাথে রক্তও উঠছে এখন, আপনি জলদি চলুন!
জুলিয়ার কথা শুনে আঁতকে উঠলো ফাতমা! লাঠি বুড়ির কাশির ওষুধের জন্য যে লতাগুল্ম প্রয়োজন সেটা তার কাছে এই মুহুর্তে নেই। ওই বিশেষ ওষধি লতা গুলো প্রাসাদ থেকে মাসান্তরে সাপ্লাই দেওয়া হয়, কিন্তু সে সাপ্লাই টা কাল আসবে। সে লতাটা জঙ্গলে গিয়ে নিয়ে আসাও সম্ভব না, কারণ সেটা সেইফ জোনের বাইরে। আর সেইফ জোনের বাইরে যাওয়া মানেই জংলি পশুর হাতে পড়ে জীবন দেওয়া৷
ফাতমার মুখ খানা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। সে নিজের জায়গায় মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। তাকে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকিতে দেখে জুলিয়া তাগাদা দিয়ে বলল,
— দাঁড়িয়ে আছেন কেন! চলুন ফাতমা, লাঠি বুড়ির অবস্থা খুব খারাপ! আপনি ওদিকে যান আমি না হয় আপনার মাঞ্জার থেকে আপনার ট্রিটমেন্ট টুলস এর ব্যাগ টা নিয়ে আসছি।
কিন্তু ফাতমা তবুও নড়ছে না দেখে অ্যানা পাশ থেকে উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— কি ব্যাপার ফাতমা? কোনো অসুবিধা? তুমি ঠিক আছো?
ফাতমা অ্যানার দিকে তাকিয়ে কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলল,
— লাঠি বুড়ির ওষুধের সাপ্লাই তো ফুরিয়ে গেছে অ্যনা! ওইটা তো প্রাসাদ থেকে আসতো, প্রতি মাসে মাসে ওরা এসে দিয়ে যায়। কিন্তু ওদের সাপ্লাইএর ডেট টা তো আগামী কাল! কিন্তু আজ আমি কি করবো! ওই ওষুধ টা না দিতে পারলে তো লাঠি বুড়ির কাশতে কাশতেই দম আটকে যাবে, তার ওপর জুলিয়া বলল কাশির সাথে রক্ত আসছে নাকি, সেটা তো আর ও গুরুতর!
— নাম কি ওষুধ টার?
ফাতমার পিঠের ওপর হাত রেখে ফাতমা কে ভরসা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো অ্যানা।
ফাতমা অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল,
— ওইটা একটা লতাগুল্ম, প্রাসাদের কর্মচারীরা জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে আসে সেটা।
অ্যানা কিছুক্ষন ফাতমার দিকে তাকিয়ে ভেবেচিন্তে বলল,
— নাম কি সে লতাটার, জানো?
ফাতমা আগের মতো করেই বলল,
— কোল্টসফুট সম্ভবত, গোল গোল পাতা হয়, হলুদ রঙের ফুল, ফুলের মাঝখানটা কিছুটা শাপলা ফুলের মাঝের মতো।
অ্যানা আবারও কিছুক্ষণ ভাবনাচিন্তা করে এরপর ফাতমা কে অভয় দিয়ে বলল,
— ঠিক আছে, আমি গিয়ে খুজে নিয়ে আসছি সে লতাটা। তুমি দ্রুত লাঠি বুড়ির কাছে যাও, আপাতত প্রাথমিক চিকিৎসা যা দেওয়ার দিতে থাকো, আমি যত দ্রুত সম্ভব লতাটা খুজে নিয়ে আসবো৷
অ্যানার কথায় ফাতমা বলে উঠলো,
— তুমি একা যেয়ো না অ্যানা, জঙ্গলের ওই বাইরে টা খুবই ভয়ঙ্কর! ক্রিস্টিনার কি হয়েছিলো মনে নেই তোমার! সেও তো ওই গাছটা খুজতেই গেছিলো। জুলিয়া কে সঙ্গে নিয়ে যাও তুমি৷
তারপর জুলিয়ার দিকে ফিরে ফাতমা জিজ্ঞেস করলো,
— অ্যানার সাথে তুমি একটু যেতে পারবে না জুলিয়া?
অনিচ্ছা সত্বেও জুলিয়া এখন উপায় না পেয়ে মানবতার খাতিরে ফাতমা কে বলল,
— হ্যা, আমি যাচ্ছি ওর সাথে। তুমি লাঠি বুড়ির কাছে যাও৷ আর মিস্টার ব্রাউন কে বলে দিও যে আমি অ্যানার সাথে জঙ্গলের দিকে গেছি।
অ্যানা তখন ফাতমা কে বলল,
— ক্রিস্টিনা যেদিকে মরেছিলো সেদিকে ওই লতা গাছ টা বেশি পাওয়া যায় না, ওটা রাজপথের দিকে বেশি পাওয়া যায় আমি ওদিকেই যাবো।
ফাতমা কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস কতলো,
— সত্যি নাকি? কিন্তু তুমি জানো কিভাবে?
অ্যানা ফাতমার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে প্রশ্ন টা এড়িয়ে গিয়ে বলল,
— তুমি দ্রুত লাঠি বুড়ির কাছে যাও, আমি ওদিক টায় যাচ্ছি, বেশি দেরি হলে তখন ওনার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটবে৷
বলেই জুলিয়া কে ইশারা করে নিজের সাথে আসতে বলল অ্যানা৷ তারপর দুজনে মিলে চলল প্রাসাদের রাজপথের দিকের জঙ্গলের দিক টাতে।
চলবে…….
|
|
( রিচেক করার সময় পাইনি, ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, আর গল্প সম্পর্কে নিজেদের ভালোলাগা খারাপ লাগা জানাবেন 💙)