#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_৩২
#আ_মি_না
নিজের মায়ের মৃত্যু শোক, বাবার ওপর হওয়া রাগ আর জীবনের সমস্ত না পাওয়া গুলো ক্রমে ক্রমে মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো আসওয়াদের। ভেতরে ভেতরে ফুসতে থাকা আসওয়াদের সমস্ত দিন টা কাটতো প্রাসাদের রাজ পরিবারের সদস্য দের জন্য তৈরি কৃত জ্যিমে, সেখানের ফাইটিং এরিয়াতে পাঞ্চিং ব্যাগে সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করে করে; আর রাত টা কাটতো ওর জন্য নির্ধারিত সুন্দরী দাসী গুলোর সাথে, যাদের কে ও শুধু মাত্র নিজের রাগ মেটানোর জন্য নৃশংস ভাবে খুন করে ফেলতো নিজের বিছানায়, ঘনিষ্ঠরত অবস্থাতেই!
এভাবে চলতে চলতে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করলো আসওয়াদ৷ মায়ের দেওয়া সাবধানবানী ভুলে নিজের ভেতরের পশু টাকে আরও বন্য করে তুলতে শুরু করলো। ধীরে ধীরে নিজের স্বাভাবিক রূপে থাকা বন্ধ করে দিলো ও। যে রূপ নিয়ে ও জন্মেছিলো সেটাকেই নিজের আসল সত্তা হিসেবে মেনে নিলো। ক্রমে ক্রমে নৃশংসতা বাড়তে বাড়তে চরম পর্যায়ে চলে গেলো ওর। কিন্তু এ খবর টা আসওয়াদের খাস কামরা আর হুজায়ফা আদনানের কান পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকলো তার বাইরে গেলো না৷
হুজায়ফা আদনান নাতির এমন কর্মকাণ্ডে প্রথমে খুবই চিন্তিত হয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি ভাবলেন এই কাজ করে যদি তার নাতি মানসিক ভাবে শান্তি পায়, তো পেতে থাকুক। আর তাই ব্যাপার টা কে সম্পুর্ন গোপন রেখে নাতির করা অপকর্ম টা কে সযত্নে ঢাকা দিলেন তিনি। সমস্ত লাশ গুলোকে নিজ দায়িত্বে একের পর এক গুম করে ফেললেন, কাকপক্ষী ও কখনো টের পেলো না!
কিন্তু এই খবর টা কোনো এক অতি গোপনীয় মাধ্যম দিয়ে পৌছে গেলো আরহামের নিকট। আর নিজের সন্তানের এহেন কর্মকাণ্ড, আর তাতে নিজের পিতার এমন পরক্ষ সায় তে যারপরনাই অবাক হলেন তিনি। সেই সাথে তার প্রচন্ড রাগ হলো হুজায়ফা আদনানের ওপর।
সেই মুহুর্তেই তিনি চলে গেলেন হুজায়ফা আদনানের খাস কামরায়, তার ছেলেকে এইভাবে অন্ধকারের ভেতর ডুবিয়ে দেওয়ার জবাব চাইতে। কিন্তু হুজায়ফা আদনান তার বিরুদ্ধে করা অভিযোগ শুনে আরহাম কে শান্ত কন্ঠে জবাব দিলেন,
— কি করেছো তুমি তোমার ছেলের জন্য? তার বয়স আর কিছু দিন পরই একশত তে পড়তে চলেছে। এই এত গুলো বছরে তার পেছনে তোমার অবদান কি? কি দায়িত্ব পালন করেছো তুমি তোমার সন্তানের প্রতি? অথচ তার দাদাজান হয়ে আমি তার পিতার থেকে তার প্রতি অনেক অনেক বেশি দায়িত্ব পালন করেছি। তার এই অবস্থার জন্য কে দায়ী? তুমি দায়ী, তোমার অপরিনামদর্শী কর্মকাণ্ড দায়ী৷ শুধুমাত্র জন্ম দিলেই পিতা হওয়া যায় না। পিতা হতে গেলে সন্তানের প্রতি পিতার দায়িত্ব কর্তব্য যথাযথ ভাবে পালন করতে জানতে হয়। আমি যেটা ভালো মনে করেছি সেটাই করেছি। তুমি যদি এখন তোমার সন্তান কে সেখান থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে চাও তবে চেষ্টা করে দেখতে পারো। আমার কোনো বাধা নেই।
হুজায়ফা আদনানের কথা শুনে আরহামের আর কিছু বলার রইলো না। তিনি ফিরে আসলেন নিজের কামরায়। আর তার বেশ কিছু দিন পর তিনি সময় নিয়ে একদিন গেলেন আসওয়াদের কামরায়। কিন্তু আসওয়াদ দিনের বেশির ভাগ সময় টা জ্যিমে কাটায় সেটা তার জানা ছিলো না। আসওয়াদ কে কামরায় না পেয়ে তার দ্বাররক্ষকের নিকট জানতে পারলেন আসওয়াদের বর্তমান অবস্থানের কথা। আর এরপর সোজা চলে গেলেন প্রাসাদের জ্যিমে। কিন্তু জীমে ঢুকেই বুকের ভেতর টা অজানা আতঙ্কে কেঁপে উঠলো তার।
আসওয়াদ জ্যিমে থাকাকালীন অন্য কারো জ্যিম এরিয়ায় প্রবেশ সম্পুর্ন নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। দ্বাররক্ষকের নিকট আসওয়াদের এমন নিষেধাজ্ঞা শুনে কিঞ্চিৎ অবাকই হয়েছিলেন আরহাম৷ কিন্তু এখন এই মুহুর্তে এসে আসওয়াদ কে দেখে আরহাম বুঝলেন নিষেধাজ্ঞার কারণ!
ফাইটিং এরিয়ার একটা বিশালাকার পাঞ্চিং ব্যাগে প্রচন্ড শব্দ তুলে বিদ্যুৎ গতিতে একের পর দানবীয় আঘাত করে চলেছে আসওয়াদ। প্রতি টা পাঞ্চের সাথে আসওয়াদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে ক্রোধ মিশ্রিত চাপা হিংস্র গর্জন। কুচকুচে কালোবর্ণের, পেশিবহুল বিশালার শরীর টা শারীরিক কসরতের কারণে ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে আছে। পুরু, চকচকা চামড়ার ওপর বয়ে চলা ঘামের সুক্ষ্ম স্রোত গুলোর ওপর আলোকরশ্মি পড়ে উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছে।
পাঞ্চিং ব্যাগ টা এমন বিশাল হওয়ার কারণ টের পেলেন আরহাম। আসওয়াদ যে শক্তি তে প্রতিটা ফিস্ট ব্লো দিচ্ছে তাতে কোনো সাধারণ পাঞ্চিং ব্যাগ ব্যবহার করলে আসওয়াদের করা দুইটা আঘাতেই তা ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতো!
জ্যিমের দরজাটা কিঞ্চিৎ ফাকা করে এতক্ষণ আসওয়াদ কে পর্যবেক্ষণ করছিলেন আরহাম। এবার দরজাটা পুরোপুরি খুলে ভেতরে ঢুকলেন তিনি। কিন্তু তার ভেতরে ঢোকার শব্দ পেয়েই ঝড়ের গতিতে পাঞ্চিং ব্যাগ টা এক হাতে থামিয়ে ক্ষিপ্র গতিতে জ্যিমের দরজার দিকে তাকালো আসওয়াদ। আর তার সে চাহনি দেখা মাত্রই আরহামের বুকের ভেতর টা ধক করে উঠলো!
আকাশ সমান বিরক্তিতে কুচকে যাওয়া ভ্রু জোড়ার নিচে জ্বলজ্বল করছে হিংস্র এক জোড়া অগ্নিগোলকের ন্যায় চোখ। শক্ত চোয়াল দ্বয়ের আড়ালে যে রাগে দাঁতে দাঁত পিষে আছে সেটা বাইরে থেকেই স্পষ্ট দৃশ্যমান হয়ে আছে। আরহাম থমকালেন। শব্দ করে শুকনো ঢোক গিললেন একটা। একবার ভাবলেন ফিরে যাবেন কিনা! কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলেন আজ নিজের ঔরসজাত সন্তানের এমন মূর্তি কে ভয় পেয়ে সন্তানের সামনে থেকে ফিরে গেলে দ্বিতীয় বার আর কখনো তিনি তার সন্তানের সামনে এসে দাঁড়ানোর সাহস পাবেন না। তাই তার যা করার আজকেই করতে হবে, নইলে আর কখনোই আসওয়াদ কে তার এই অবস্থা থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা কারো পক্ষে সম্ভব হবে না। আসওয়াদের শিকারী চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে থেকেই বুক ভরে দম নিয়ে সামনে আগালেন তিনি।
.
সেদিন আসওয়াদ কে সময় নিয়ে অনেক অনেক ক্ষণ ধরে বোঝালেন আরহাম। নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইলেন, পিতা হিসেবে নিজের অপারগতার কথা স্বীকার করে অনুতপ্ত হলেন। আসওয়াদ ধৈর্য ধরে শুনলো তার বাবার কথা। আর সব শেষে কথা দিলো যে সে নিজেকে শুধরানোর চেষ্টা করবে। আর করলোও তাই।
নিজেকে ধীরে ধীরে হিংস্রতা থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করলো আসওয়াদ, নিজের ভেতরের পশুটাকে আয়ত্তে নিয়ে এলো সময় নিয়ে। নিজের স্বাভাবিক জীবন যাপনে ফিরে আসার চেষ্টা করতে থাকলো প্রাণপণে। আরহাম নিজেও ছেলের সাথে সময় কাটানো শুরু করলেন। রোজ দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় তিনি ব্যয় করতে শুরু করলেন আসওয়াদের সাথে। ধীরে ধীরে তাদের পিতা পুত্রের ভেতরকার দুরত্ব টা কমতে শুরু করলো। নিজেদের সুখ দুঃখ কে আস্তে আস্তে ভাগাভাগি করে নিতে শুরু করলো তারা। হুজায়ফা আদনান নিজের ছেলে আর নাতির এমন পরিবর্তনে খুশি হলেন অনেক। আসওয়াদের খারাপের ভেতর দিয়ে কিছু একটা ভালো তো হয়েছে! এটাই অনেক।
কিন্তু এদের বাবা ছেলের সখ্যতায় সবাই খুশি হলেও খুশি হতে পারলো না কেবল ইলহাম। এতদিন ধরে স্বতন্ত্র ভাবে বাবার ভালোবাসা পেয়ে আসা ইলহাম হঠাৎ করেই তার বাবার ভালোবাসার ভাগাভাগি মেনে নিতে পারলো না। এখনো পর্যন্ত তার ভাই আসওয়াদের সাথে তার কখনো সরাসরি কথা হয়নি। জীবনে চলার পথে দেখা হয়েছে বহুবার। কিন্তু কেউ কারো দিকে তাকায়নি পর্যন্ত। ইলহাম তাকায়নি আশঙ্কায়, কারণ সে জানে যে সে সব কিছু পাওয়া সত্বেও আসওয়াদের ন্যায় যোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি। আর আসওয়াদ তাকায়নি আত্মবিশ্বাসে, কারণ সে জানে সে কিছুই না পাওয়া সত্বেও নিজেকে যোগ্য করে তুলতে কোনো দিক থেকে কম রাখেনি।
বাবার হঠাৎ এমন সন্তান প্রীতি তে প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হলো ইলহাম। এতদিন তার একটা ভরসা ছিলো যে আসওয়াদ তাকে কোনো দিক থেকে হারাতে না পারলেও তার বাবাকে কখনো তার থেকে নিতে পারবে না। কিন্তু এখন ইলহামের সে ধারণাও বিফলে যেতে চলেছে। আসওয়াদ শেষ পর্যন্ত তার বাবার মনোযোগ ও পেয়ে গেলো! এসব কথা ভাবলেই মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠতো ইলহামের হাত জোড়া।
.
ধীরে ধীরে একসময় ঠিক হয়ে এলো সব কিছু। যদিও আসওয়াদের বন্য স্বভাব টা পুরোপুরি ঠিক হলো না! এখনো মাঝে মাঝেই সে ভুল বসত হোক বা ইচ্ছা করে, তার কাছে আসা দাসী গুলোকে নৃশংস ভাবে হতা করে। কিন্তু সে খবর গুলো আর তার খাস কামরার বাইরে যায় না। তার খুবই কাছের কিছু সেবক রাই তার এই কুকর্ম কে অতি সাবধানতার সহিত সঙ্গোপনে বাতাসে মিলিয়ে দিয়ে আসে৷
কিন্তু আসওয়াদ তার হিংস্রতাকে অতিরিক্ত প্রশ্রয় দেয় না। যেটুকু করলে তার ভেতরের পশু তৃপ্ত হবে, কিন্তু লোভি হয়ে উঠবে না ততটুকুতেই সে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করে।
আরহামের সাথে এখন আসওয়াদের সম্পর্কের অনেক উন্নতি হয়েছে। আর সালিমের সাথে তো তার গলায় গলায় ভাব। যদিও সালিমের বাবা আজলান আসওয়াদের সাথে তার সন্তানের এমন মাখামাখি পছন্দ করেন না একদমই। আরহামের কোনো অস্তিত্ব কেই তিনি পছন্দ করেন না। কিন্তু যতদিন হুজায়ফা আদনান বেচে আছেন ততদিন তার এ অপছন্দের কথা তার ভেতরেই রাখতে হবে। বাইরে প্রকাশ করলেই সিংহাসন হাতছাড়া!
.
কেটে গেছে প্রায় অনেক গুলো বছর। পঞ্চদ্বীপ বরাবরের মতোই বহাল তবিয়তে চলছে। কিন্তু হুজায়ফা আদনানের শরীর টা ভালো নেই। বয়সের ভারে তিনি কাহিল হয়ে পড়েছেন৷ বয়স এখন চলছে ছশো নিরানব্বই। সাধারণ দেমিয়ান দের থেকে তুলনামূলক একটু বেশি দিনই পৃথিবীর বুকে টিকে আছেন তিনি। হাতে সময় আর বাকি নেই বেশি। এখন সময় ক্ষমতা হস্তান্তরের৷
দেমিয়ান ঐতিহ্য অনুযায়ী বাদশাহ নির্ধারণ করা হয় লাইফ ট্রির ইশারায়। অর্ধেক জীবিত আর অর্ধেক আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সমৃদ্ধ লাইফ ট্রি দেমিয়ান বংশের প্রতিটি সদস্যের ওপর পূঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে নজর রাখে। তাদের কর্মকাণ্ড, চালচলন, আচার আচরণ সবকিছুকে নিজের ভেতর অ্যানালাইসিস করে সে নির্ধারণ করে পরবর্তী বাদশাহ হওয়ার যোগ্যতা কে বেশি রাখে। আর লাইফ ট্রি দ্বারা নির্ধারিত শেহজাদা কেই সর্বদা বাদশাহ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এবারও তার ব্যাতিক্রম হবে না!
ঐতিহ্য কে অনুসরণ করে হুজায়ফা আদনান একরাতে মহাসমারোহে তার পরিবারের সকল সদস্য দের কে জড়ো করে লাইফ ট্রির নিকট নিয়ে এলেন। পরবর্তী বাদশাহ নির্ধারণ হলে তাকে দেখেই শান্তিতে মৃত্যু বরণ করতে পারবেন তিনি।
রেড জোনের ভেতরে এসে লাইফ ট্রির চারপাশ ঘিরে দাঁড়ালো দেমিয়ান বংশের শেহজাদা রা। আরহামের দুপাশে দাঁড়ানো আসওয়াদ এবং ইলহাম। এতগুলো দিনেও কেউ কারো সাথে কথা বলেনি। আজকের এই স্পেশাল দিন টিতেও না৷ আসওয়াদের পাশে দাঁড়ানো সালিম। আর সালিমের পাশেই তার বাবা আজলান। তাদের সবার সামনে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সমৃদ্ধ হুইলচেয়ারে বসা হুজায়ফা আদনান। তার ধবধবে সাদা দাড়ির ফাকে এক ফালি হাসি। অজানা এক আনন্দে চোখ জোড়া তার ঝিলিক দিয়ে উঠছে। দেমিয়ান সদস্য দের কে নিরাপত্তা দিতে নির্দিষ্ট দুরত্ব নিয়ে তাদের কে ঘিরে দাঁড়ানো প্রায় শ খানেক সৌলজার্স।
কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার পরই ধীরে ধীরে উজ্জলতা বাড়লো লাইফ ট্রির। একটি সাধারণ গাছের ন্যায় সর্বদা দৃশ্যমান হয়ে থাকা লাইফ ট্রিকে এতদিন জঙ্গলে যাওয়া আসার পথে আসওয়াদ বহু বার দেখলেও তার এই বিশেষ রূপ আজ প্রথম বার দেখছে ও৷ এই গাছ টির বিশেষত্ব দাদাজানের লাইব্রেরি তে থাকা বইতে পড়লেও কখনো সেটা চোখে দেখা সম্ভব হয়নি। তাই আজ এমন দৃশ্য দেখে অন্তর মন পুলকিত হয়ে উঠলো আসওয়াদের৷
লাইফ ট্রির উজ্জলতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ডালপালা গুলোর মুভমেন্ট হতে শুরু করলো। সুক্ষ্ম সোনা রঙা নকশা খেলে যেতে লাগলো লাইফ ট্রির সমস্ত শরীর জুড়ে। লাইফ ট্রি পুরোপুরি সচল হওয়ার পর দেমিয়ান দের দিকে তার উজ্জ্বল ডাল পালার কয়েকটি এগিয়ে এলো। দেমিয়ান দের সকল সদস্য গুলোকে নিজের ডাল গুলো দিয়ে ছুয়ে দিলো লাইফ ট্রি টা। কিন্তু আসওয়াদের কাছে গিয়ে থমকে গেলো তার ডাল গুলো।
এই বান্দা টা প্রায় প্রায় তার পাশ দিয়ে ঘুরে জঙ্গলে ঢুকে যায়। জঙ্গল টার প্রতি তার প্রচন্ড মায়া। লাইফ ট্রি নিজের সরু ডাল গুলো দিয়ে আসওয়াদের ঘাড় বাবরি ঝাকড়া চুল গুলোকে আদর দিয়ে এলোমেলো করে দিলো। নিজের প্রতি লাইফ ট্রির এমন অন্যরকম আচরণ দেখে আসওয়াদ খুশি হওয়ার সাথে সাথে অবাক হলো কিছুটা, কিন্তু প্রকাশ করলো না। অজান্তেই ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো ওর।
সবাইকে ছুয়ে দেওয়া শেষে লাইফ ট্রি নিজের ডালপালা গুলোকে একিয়ে বেকিয়ে হুজায়ফা আদনানের উদ্দেশ্যে শূন্যে ফুটিয়ে তুললো কিছু লেখা। যার সারমর্ম এই যে, আজ তাদের এইখানে সমবেত হওয়ার কারণ কি?
হুজায়ফা আদনান উত্তর দিলেন যে তিনি চান লাইফ ট্রি পঞ্চদ্বীপের পরবর্তী বাদশাহ নির্বাচন করুক। কারণ তার জীবনীশক্তি ফুরিয়ে এসেছে। কখন না জানি পরম শক্তিশালী সৃষ্টিকর্তার ডাকে সাড়া দিয়ে তাকে পরপারে পাড়ি জমাতে হয়!
লাইফ ট্রি তার ডালপালা গুলোতে রিনরিনে শব্দ তুলে নিজের নিকট ফিরিয়ে নিয়ে নিরাব হয়ে রইলো। তার শরীর বয়ে খেলে যেতে শুরু করলো নানা রঙের আলোচ্ছটা। হুজায়ফা আদনান বুঝলেন লাইফ ট্রি নিজের ভেতর কার সমস্ত ডেটা গুলো অ্যানালাইসিস করছে৷ ধৈর্য ধরে বসে রইলেন তিনি।
আরহাম আজলান দুজনেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকলো লাইফ ট্রির সিদ্ধান্তের। আজকের পর তাদের দুজনের কেউ একজন হবে বাদশাহ, আর বাদশাহ চাইলে অন্যজন হবে তার সহযোগী। আর যদি না চায় তবে সে বাদশাহর মন রক্ষা করে চলতে পারলে প্রাসাদে থাকতে পারবে, আর যদি সেটাও করতে ব্যর্থ হয় তবে তার স্থান হবে ডার্ক প্যালেসে। আজকের পরই সবার ভাগ্য পরিবর্তন হয়ে যাবে।
বেশ কিছুক্ষণ পর লাইফ ট্রি আবার সচল হলো। তারপর নিজের ডাল পালা গুলোতে আগের মতোই রিনরিনে শব্দ তুলে এগিয়ে দিলো হুজায়ফা আদনানের পেছনে দাঁড়ানো শেহজাদা দের দিকে আর এরপরই সেখানে উপস্থিত সবাইকে অবাক করে দিয়ে নিজের ডাল গুলো দিয়ে আসওয়াদের হাত জোড়া সাপের মতো একে বেকে জড়িয়ে ধরলো লাইফ ট্রি। তারপর আসওয়াদ কে নিজের ডাল গুলোর সাহায্যে নিজের কাছাকাছি টেনে নিয়ে এসে বাকি সবার দিকে ফিরিয়ে ধরলো। আর এরপর নিজের ডাল পালা গুলো দিয়ে আসওয়াদের মাথার ওপর মুকুট সদৃশ তৈরি করে দেখিয়ে দিলো যে এ-ই হবে পঞ্চদ্বীপের পরবর্তী বাদশাহ।
আসওয়াদ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো হুজায়ফা আদনানের দিকে। তার আগের প্রজন্ম কে রেখে লাইফ ট্রির তাকে চ্যুজ করার কারণ টা বোধগম্য হলো না ওর কিছুতেই। হুজায়ফা আদনান নিজেও অবাক হলেন। এমন টা এর আগে কখনো লাইফ ট্রি করেছে কিনা সন্দেহ! আর তাছাড়া আসওয়াদ এখন নিতান্তই ছোট! এটা ঠিক যে এখানে উপস্থিত অন্য সবার থেকে তার বুদ্ধিমত্তা, যোগ্যতা, পারদর্শীতা, ক্ষমতা কোনো অংশেই কম না। কিন্তু বয়সের পরিপক্বতার ও তো প্রয়োজন আছে।
কিন্তু হুজায়ফা আদনান আর দ্বিতীয় কোনো চিন্তা মাথায় আনলেন না। লাইফ ট্রি যখন অ্যানালাইসিস করে আসওয়াদ কেই উপযুক্ত মনে করেছে তখন আসওয়াদই উপযুক্ত, অন্য কেউ নয়। হুজায়ফা আদনান গর্বিত হলেন, তার নিজের হাতে গড়া নাতি যে অন্য সবার থেকে উপযুক্ত হয়ে উঠেছে এটা ভেবেই তিনি খুশি হলেন প্রচন্ড।
আরহাম ঠিক কেমন প্রতিক্রিয়া জানাবেন বুঝতে পারলেন না। তিনি তার বাবার বড় সন্তান, নিজেকে যথাসম্ভব যোগ্য হিসেবে তৈরি করার চেষ্টা করেছেন তিনি। তার দুই ছেলে, দুইটাই তার কাছে হীরক খন্ডের ন্যায়। সে হিসাবে লাইফ ট্রির তাকে বাদশাহ হিসেবে অধিষ্ঠিত করা উচিত ছিলো, কিন্তু তাকে না করে করা হলো তার ছেলে কে! কিছু সময়ের জন্য বুকে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করলেও সেটা পরক্ষণেই মিলিয়ে গেলো আরহামের। বাদশাহ তো হচ্ছে তারই ছেলেই, তার তো খুশি হওয়ার কথা! কিন্তু তা না করে তিনি হিংসা করছেন! নিজেকে মনে মনে ধিক্কার জানালেন আরহাম।
সালিম খুশি হলো সবচাইতে বেশি। চোখে মুখে আনন্দ উপচে পড়তে লাগলো ওর৷ এত গুলো বছর ধরে এই বন্ধু রূপি ভাইটির সাথে থেকে থেকে সে এতটুকু বুঝেছে যে সে সত্যিকার অর্থেই বাদশাহ হওয়ার জন্য যথেষ্ট যোগ্যতা রাখে। সে নিজে এতদিন আসওয়াদের সাথে সাথে থেকে, আসওয়াদ যা যা করেছে সবকিছু করেও আসওয়াদের সমপরিমাণ যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি! আর যারা ওর সাথে কখনো ছিলোই না তারা কি করবে!
কিন্তু আজলান আর ইলহাম রীতিমতো ক্রুদ্ধ হলো। লাইফ ট্রির এহেন সিদ্ধান্ত তারা দুজন একেবারেই মেনে নিতে পারলো না৷ এটা তাদের কাছে ঠেকলো সাক্ষাৎ অবিচারের ন্যায়৷ এই দুই ব্যাক্তি নিজেদের ভেতর কোনো মত বিনিময় না করেও মানসিক দিক থেকে হয়ে উঠলো একই পথের পথিক৷
আর সবার এসব ভাবনার মাঝেই লাইফ ট্রির দিকে পেছন ফিরে দাঁড়ানো আসওয়াদ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে চমকে দিয়ে তার পিঠের ভেতরে দিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে ধারালো খঞ্জরের ন্যায় প্রবেশ করলো লাইফ ট্রির বিশেষ ছয়টি সরু, সুক্ষ্ম ডাল। আর সেগুলো প্রবেশ করতেই তীব্র যন্ত্রনায় আকাশ বাতাস কাপিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো আসওয়াদ। আসওয়াদের এমন অবস্থায় আরহাম আঁতকে উঠে ছুটে ওর কাছে যেতে নিলে হুজায়ফা আদনান তাকে বাধা দিয়ে বললেন,
— কাছে যেও না৷ লাইফ ট্রি ওর কোনো ক্ষতি করছে না। ওকে ওর অধিকার বুঝিয়ে দিচ্ছে৷
বাবার কথা শুনে আবার নিজের জায়গায় ফিরে এলেন আরহাম। কিন্তু আসওয়াদের গগনবিদারী চিৎকার এসে তার বুকের ভেতর টা দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে যেতে লাগলো যেন।
বেশ কিছুক্ষণ পর লাইফ ট্রি ছেড়ে দিলো আসওয়াদ কে। লাইফ ট্রি ছেড়ে দিতেই হাটু গেড়ে মাটিতে ধাম করে বসে পড়লো আসওয়াদ৷ নিঃশ্বাস পড়ছে ওর প্রচন্ড জোরে। শরীরের থাকা পোশক গুলোর অধিকাংশই পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে। সমস্ত শরীর জুড়ে তার জন্মের সময়কার ডোরাকাটা সোনালি রঙা নকশা গুলো ফুটে উঠেছে। কালো রঙা পুরু চামড়ার ওপর সেগুলোকে অসম্ভব রকম সুন্দর দেখাচ্ছে। শরীরের শিরা উপশিরা গুলো অস্বাভাবিক ভাবে ফুটে উঠেছে সমস্ত দেহে। শিকারী চোখ জোড়া আগের থেকেও বেশি উজ্জলতা ছড়াচ্ছে। শরীর থেকে ধোঁয়া উড়ছে ওর।
আরহাম ছুটে গেলেন আসওয়াদের কাছে, তারপর ওর ভারী শরীর টা কে টেনে মাটি থেকে ওঠাতে চাইলেন। কিন্তু বাধা দিলো আসওয়াদ৷ তারপর কিছুক্ষণ সময় নিয়ে দুর্বল পায়ে নিজে নিজেই উঠে দাড়ালো ও। এরপর লাইফ ট্রির চারপাশ দিয়ে ধীর পায়ে কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে, এক বিশাল দায়িত্ব নিজের কাধে চাপিয়ে, সবাই কে পেছনে ফেলে রেখে এক প্রকার খুড়িয়ে খুড়িয়ে একা একাই প্রাসাদে ফিরে গেলো আসওয়াদ। আর ওর পেছন পেছন এগোলো হুজায়ফা আদনান সহ অন্যরা।
নিজের দায়িত্ব গুলো অন্য কারো ওপর অর্পণ করে দিয়ে প্রচন্ড হালকা হয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে প্রাসাদের দিকে এগোলেন হুজায়ফা আদনান।
চলবে…..
( রিচেক করিনাই ভালোভাবে, ভুল ভ্রান্তি থাকতে পারে অনেক। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন)