#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_৩৩
#আ_মি_না
সেদিন লাইফ ট্রি আসওয়াদ এর সাথে ঠিক কি করলো কেউ জানে না, কিন্তু হঠাৎ করেই আসওয়াদের মানসিক পরিপক্বতা যেন বেড়ে গেলো অনেক খানি! তার চেহারায় বিদ্যমান এতদিনের শেহজাদা শেহজাদা বৈশিষ্ট্য গুলো রাতারাতি পরিবর্তন হয়ে সেখানে প্রকট হয়ে উঠলো একজন বাদশাহর উপযুক্ত অভিব্যক্তি।
কোনো এক অজানা কারণে অন্যান্য শেহজাদা দের থেকে আসওয়াদ বরাবরই সমীহ বেশি পেতো। হোক সেটা তার অদ্ভুত দর্শন শরীর, বা তার বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার কাঠিন্যতার কারণে; কিন্তু রাজ পরিবারের সাথে সম্পৃক্ত প্রত্যেকেই তাকে বরাবর সমঝে চলত! আর এখন সেটা আরও বেশি প্রকট হতে শুরু করলো।
দাস দাসী গুলো প্রাসাদের প্রতিটা সিংহদুয়ারে থাকা রয়্যাল মেম্বার ইন্ডিকেটর এর স্পিকারে বাদশাহ নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান’ এর নাম শোনা মাত্রই নিজেদের ম্যানার্সের সর্বোচ্চ টা জাহির করে নির্দিষ্ট নিয়মে দাঁড়িয়ে যেতো, কেউ টু শব্দ টি করতো না৷ কেউ কেউ তো ভয়ে নড়াচড়াও করার সাহস টুকুও পেতো না! তরুণ বাদশাহর কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই, শুধু মাত্র প্রাসাদে তার পরোক্ষ উপস্থিতিতেই রাতারাতি প্রাসাদে নেমে এলো শৃঙ্খলা। ছুটা চাকর বাকর গুলো পর্যন্ত কাজে ফাকি দেওয়ার সাহস হারাতে লাগলো।
রাজ পরিষদে কর্মরত প্রত্যেক সদস্য এবং কন্ট্রোলার গণও তাদের তরুণ বাদশাহ কে সর্বদা ঠান্ডা মাথায় রাখার জন্য নিজেদের সর্বোচ্চ টা দিয়ে চেষ্টা করতে শুরু করলেন। কোনোভাবেই যেন এই লম্বা চওড়া সুঠামদেহের অধিকারী, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার ব্যাক্তিটা তাদের ওপর না চটে যায় সেদিকে তারা প্রচন্ড মনোযোগ দিতে শুরু করলেন৷
একজন বাদশাহর থেকে আসওয়াদকে কুরো আহমার বাসীর দেওয়া টেরর নামটা দিয়েই যেন বেশি বিবেচনা করা শুরু করলো সকলে; যেন কোনোভাবেই তাকে কোনো কিছুতে অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেওয়া যাবে না, যেন কোনো কিছুতে সামান্য ফ্ল’ থাকলেই বাদশাহ নামক টেরর সেটাকে ফ্ল লেস’ করতে যা করা প্রয়োজন করে ফেলবে!
বিছানায় শয্যাশায়ী হুজায়ফা আহমেদ তার বিশ্বস্ত সেবক দের নিকট থেকে তার নিজ হাতে গড়া নাতির সমগ্র প্রাসাদ টির ওপর এমন প্রভাবের কথা জেনে মনে মনে পুলকিত হলেন প্রচন্ড।
আজলান, ইলহাম, সালিম সকলে বর্তমানে প্রাসাদেই থাকছে। সালিম কে নিজের চ্যিফ অ্যাডভাইজর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে আসওয়াদ। সালিম ছাড়া আর অন্য কাউকে তার নিজের পাশে দাঁড় করানোর মতো উপযুক্ত মনে হয়নি ওর। যে ব্যাক্তি টা তার এত খারাপ সময়ে, তার জীবনের সমস্ত ঝড় ঝাপটাতে পাশে ছিলো তাকে নিজের এই সুসময়ে কোনো ভাবেই হাত ছাড়া করতে চাইলো না আসওয়াদ।
বাবা আরহাম কে পঞ্চদ্বীপের সেনাবাহিনীর দায়িত্ব অর্পণ করে পঞ্চদ্বীপের পাঁচ নম্বর দ্বীপ রামাদিসামাতে পাঠিয়ে দিলো আসওয়াদ। রামাদিসামা হলো সেই জায়গা যেখানে পঞ্চদ্বীপের সমস্ত সৌলজার্স দের কে ট্রেইনিং দেওয়া হয়। বলতে গেলে দ্বীপের পুরোটাই হলো একটা সামরিক ঘাটি৷ আর আরহাম কে করা হলো সেখানেরই প্রধান৷ নিজের পরের সবচাইতে ক্ষমতাবান পদ টি আসওয়াদ তার বাবা কে দিলো, যেন তার বাবা কোনো ভাবেই মনে না করতে পারেন যে বাদশাহ হওয়ার পর তার নিকট তার বাবার প্রতি তার আনুগত্য এক বিন্দু পরিমাণও হ্রাস পেয়েছে!
.
আসওয়াদের রাজ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার ছ মাসের মাথায় একদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘুমের মাঝে ইহলোক ত্যাগ করলেন আসওয়াদের প্রাণাধিক প্রিয় দাদাজান হুজায়ফা আদনান।
মায়ের পর সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ টাকে হারিয়ে কঠিন আসওয়াদ যেন আরও কঠিন হয়ে পড়লো। শক্ত চোয়াল দ্বয় আরও শক্ত হয়ে উঠলো ওর, হাসতেই যেন ভুলে গেলো আসওয়াদ। তার কাঠিন্যতা চোখে পড়তে শুরু করলো সবার। আরহাম কয়েক বার চেষ্টা করলেন ছেলের সাথে এ বিষয়ে কথা বলার, কিন্তু আসওয়াদ তাকে সাফ বলে দিলো যে সে যেন আসওয়াদের ব্যাক্তিগত কোনো বিষয়ে নাক না গলায়।
পঞ্চদ্বীপের আইন শৃঙ্খলা ব্যাবস্থা পুরোপুরি কঠোর হয়ে গেলো। আসওয়াদ অপরাধী দের কে শাস্তি দেওয়ার এক অভিনব পদ্ধতি বের করলো। শিরো মিদোরিরই এক কোণায় স্থাপন করলো সেইফ জোন, যেখানে পঞ্চদ্বীপের সকল প্রান্ত থেকে সাজাপ্রাপ্ত আসামি দের কে একত্রে রাখা হবে নিজেদের মতো করে কাজ করে খাওয়ার জন্য, যেখানে অনিয়মের কোনো সুযোগ থাকবে না। সবার কাজ সবাইকে সময় মতো করতে হবে।
আর মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামী দের জন্য আসওয়াদ তৈরি করলো এক নিকৃষ্ট তম পদ্ধতি। নিজের তৈরি ব্যিস্ট স্কোয়াডস এর বাঘা বাঘা সদস্য গুলোকে ততদিনে আরও হিংস্র আর বেপরোয়া করে তুলেছিলো আসওয়াদ। মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামী গুলোকে নিজের ব্যিস্ট স্কোয়াডস এর সদস্য দের ভুরিভোজের জন্যই ব্যাবহার করা শুরু করলো ও৷
ডেথ সেন্টেন্সড পাবলিক গুলোকে সমগ্র পঞ্চদ্বীপ থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে এসে নিজের প্রাসাদেরই পাতাল ঘরের এক বিরাট এরিয়া জুড়ে তৈরি কৃত জেইলে ভরে রাখতো আসওয়াদ। আর তার ব্যিস্ট স্কোয়াডস কে দিতো নানা ধরণের টাস্ক। ওরা টাস্ক পুরণ করতে পারলেই আসওয়াদের থেকে পেতো উপহার, আর সেটা হলো একটা বা দুটো জীবন্ত মানুষ।
আসামি গুলোকে নিয়ে গিয়ে রেড জোনের জঙ্গলের মাঝ বরাবর ছেড়ে দেওয়া হতো নিজেদের জীবন বাচানোর শেষ সুযোগ দিয়ে, জীবন বাচাতে সে লোক গুলোও ছুটতো প্রাণপণে। আর ব্যিস্ট স্কোয়াডসে থাকা পশু রূপি মানুষ গুলো তাদেরকে জীবন্তই শিকার করতো, আর তার পর মহাসমারোহে সেগুলোকে খেয়ে নিতো। এতে আসওয়াদের দুইটা লাভ হতো, প্রথমত বিনোদন আর দ্বিতীয়ত নিজের পোশা পশু গুলোর খাবারের ব্যাবস্থা।
কিন্তু তার এই ভয়ঙ্কর কাজের কথা সে আর তার খুবই বিশ্বস্ত কিছু সেবক ছাড়া আর কেউই জানতো না। সালিম ও না।
.
প্রায় বছর দুয়েক পর একদিন হঠাৎ মাঝ রাতে আসওয়াদের কামরায় এলো সালিম। আসওয়াদ তখনও নিজের রাজকার্যে ব্যাস্ত ছিলো। এত রাতে সালিম কে নিজের কামরায় দেখে আসওয়াদ কিছুটা চিন্তিত হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলো এখানে আসার কারণ। উত্তরে সালিম যা বলল তার সারমর্ম এই যে সে ইনায়া কে ভালোবাসে, এবং তার সাথে একত্রে বসবাস করতে চায়। কিন্তু ইনায়া যেহেতু একজন মুসলিম হিসেবেই বড় হয়েছে তাই সে সালিমের দাসী নয়। আর তাই তাকে হালাল ভাবে পেতে সালিম তাকে বিয়ে করতে চায়, কিন্তু সালিমের বাবা আজলান একজন চালচুলো হীনা জারজ সন্তান কে নিজের ছেলের বউ করে ছেলের ইমেজ নষ্ট করতে মোটেও চান না। কিন্তু সালিম ইনায়া কেই বিয়ে করবে! আর এক্ষেত্রে আসওয়াদ যেন তাকে সাহায্য করে।
সালিমের অসহায় মুখের এমন আকুতি শুনে আসওয়াদ শুধু মাত্র সালিমের দিকে এক টুকরো হাসি নিক্ষেপ করলো। আর সেই রাতেই নিজে কাজী ডেকে এনে ইনায়ার অভিভাবক হয়ে সালিমের সাথে বিয়ে পড়িয়ে দিলো ইনায়ার।
আর এদিকে নিজের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের সন্তান কে এক চালচুলোহীন মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দেওয়ায় আগের থেকেই ক্ষেপে থাকা আজলান এবার অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলো। কিন্তু একজন বাদশাহর বিরুদ্ধে সরাসরি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা সে ভাবনাতেও আনলো না। কিন্তু তক্কে তক্কে থেকে একদিন পরোক্ষভাবেই আসওয়াদ কে ধরাশায়ী করার নীলনকশা আঁকতে বসলো।
সালিমের বিয়ে উপলক্ষে কয়েক মাস পরেই একদিন প্রাসাদ জুড়ে বিরাট এক আয়োজন করা হলো। আর আজলান এই দিনটাতেই নিজের প্লান সাকসেসফুল করার জন্য ওত পেতে রইলেন। এই দিনটাকে উদ্দ্যেশ্য করেই তিনি পরিকল্পনা করলেন রাতের বেলার ভুরিভোজের সময় আসওয়াদের খাবারে বিষ মিশিয়ে দেওয়ার, যাতে প্রতিশোধের সাথে সাথে রাজসিংহাসন টাও তার হাতেই চলে আসে।
কিন্তু তার এই নোংরা পরিকল্পনার খবর কোনো এক অতি গোপনীয় মাধমে পৌছে গেলো পঞ্চদ্বীপের পাঁচ নম্বর দ্বীপ রামাদিসামা তে, আরহামের নিকট। নিজের মায়ের পেটের ভাই এমন বিশ্বাসঘাতকতা করার পরিকল্পনা আটছে জেনে আরহাম যেন আকাশ থেকে পড়লেন!
জরুরি কাজের কারণে আরহাম সালিমের বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে অপারগ ছিলেন৷ কিন্তু গোপন সূত্রে নিজ সন্তানের অ্যাসাসিনেশনের খবর পাওয়া মাত্রই রামাদিসামা থেকে যত দ্রুত সম্ভব রওনা দিলেন আরহাম। নিরাপত্তার স্বার্থে সাথে নিলেন কিছু সৌলজার্স।
অন্যদিকে কিমালেবে সংঘটিত হওয়া একটি রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে ব্যাস্ত থাকা আসওয়াদ তার বিরুদ্ধে হওয়া এমন ষড়যন্ত্রের কিছুই জানতে পারলো না।
আরহাম প্রাসাদে পৌছে, উপযুক্ত প্রমাণের সাথে আগেই চলে গেলেন নিজের ভাই আজলানের নিকট। তার এই নোংরা পরিকল্পনার জবাব চাইতে। কিন্তু আরহামের রামাদি সামা থেকে রওনা দেওয়ার খবর আগেই পেয়ে গেছিল আজলান। আর সেভাবে সে প্রস্তুত ও ছিল।
আরহাম নিজের সাথের সৌলজার্স গুলোকে নিয়ে আজলানের ঘাটি তে প্রবেশ করা মাত্রই আজলানের পোষ্য সৌলজার্স গুলো কৌশলে ঘিরে ফেলে আরহাম সহ অন্য দের কে। আর এরপর সবার অগোচরে আরহাম এবং তার সাথে থাকা সৌলজার্স গুলোকে হত্যা করে ফেলে দিয়ে আসে রেড জোনের জঙ্গলের ভেতর, আসওয়াদ যে রাস্তা দিয়ে কিমালেব থেকে প্রাসাদে ফিরবে ঠিক সেই রাস্তাতে!
.
সে রাতে জঙ্গলের ভেতরে নিজ পিতার রক্তাক্ত লাশ দেখে আসওয়াদ যেন পাথর বনে গিয়েছিলো! জঙ্গল থেকে লাশ তুলে এনে বাকি সমস্ত রাস্তাটা গাড়ির ভেতরে নিজের বাবাকে বুকে করে প্রাসাদে এসেছিলো আসওয়াদ। আর তার মাথায় তখন থেকে একটি মাত্র অক্ষর ঘুরছিলো, সেটা ছিলো ‘আ’।
রেড জোনে ফেলে দিয়ে আসার পরও হয়তো সামান্য দম তখনো উড়ে যেতে বাকি ছিলো আরহামের, আর সেই দম টুকু দিয়েই সে প্রাণপণে চেষ্টা করেছিলো জঙ্গলের মাটিতে আঙুল দিয়ে কারো নাম লিখতে, কিন্তু প্রথম অক্ষর টা লেখার পরপরই প্রাণপাখি উড়াল দেয় তার। বাকিটুকু লেখার ফুরসত তার আর মেলেনা!
বাবার লাশ দেখে যে মানুষ টি সবচেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছিলো সে ছিলো ইলহাম। ওর পুরো দুনিয়াটাই ছিলো ওর বাবা। এ ছাড়া আর কখনো কারো কাছেই ও যায়নি৷ ওর যাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি৷ আর এই বাবার মৃত্যুই কাছে টেনে নিয়ে আসলো এই জমজ দুই ভাই কে। আসওয়াদ পরম যত্নে কাছে টেনে নিলো তার পিতার শোকে কাতর হওয়া দু মিনিটের বড় ভাইকে। আর ইলহাম নিজেও অন্য একটা আশ্রয় পেয়ে সাথে সাথেই লুফে নিলো। ভাইয়ের বুকেই বাবাকে হারানোর শোকে চিৎকার করে কাদলো ও!
আজলান ও এলেন, ভাইয়ের মৃত্যু শোকে কাদলেন। কিন্তু আসওয়াদের শকুনী চোখ জোড়া বার বার চলে যেতে লাগলো কুমিরের কান্না করা আজলানের দিকে। আজলানের কান্না টাকে ঠিক কান্না মনে হলো না ওর কাছে! আজলানের চেহারার দিকে লক্ষ্য করে ক্ষণে ক্ষণে আসওয়াদের মন বলে উঠলো ‘সামথ্যিং ইজ নট রাইট’!
.
কিন্তু আসওয়াদের সাথে হওয়া ইলহামের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন বেশি দিন দৃঢ় রইলো না। আজলান এবার ইলহাম কে আসওয়াদের বিরুদ্ধে নিজের ঘুটি হিসেবে ব্যাবহার করার জন্য তৈরি হলেন৷ ইলহাম কে তিনি ধীরে ধীরে ফুসলাতে থাকলেন আসওয়াদের বিরুদ্ধে। সদ্য পিতাহারা ইলহাম ভাইয়ের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে প্রথমে আজলানের ফুসলানিতে সায় না দিলেও ক্রমে ক্রমে তার ভাবনা চিন্তা বদলাতে শুরু করলো। আর ইলহামের এমন উন্নতি দেখে আজলান এবার হাত ধুয়ে পড়ে গেলেন। ইলহাম কে রোজ তিনি কয়েক ঘন্টা ধরে তালিম দিয়ে বোঝাতে শুরু করলেন যে তার সাথে যা হয়েছে ঠিক হয়নি, সে আসওয়াদের থেকে কোনো অংশেই কম না। বাদশাহ যদি কাউকে হতেই হয় তবে ইলহাম কে হওয়া উচিত৷ ইলহাম শুনতে থাকলো আজলানের কথা, আর আজলান নকশা করতে থাকলো নিজের নতুন পরিকল্পনার৷
এরই মাঝে শোনা গেলো একটি সুখবর। সালিম বাবা হতে চলেছে! এত গুলো দুঃসময়ের পর এই সংবাদটি যেন মরুভূমির বুকে এক পশলা বৃষ্টির ন্যায় ঠেকলো সবার কাছে! প্রাসাদে একজন নতুন সদস্য আসতে চলেছে শুনে প্রচন্ডরকম খুশি হলো সবাই। আর আসওয়াদ খুশি হলো এই নতুন সদস্য টা সালিমের ঘরে আসার খবর শুনে।
আর এর বেশ কিছু মাস পরেই আলট্রাসনোগ্রাফি তে দেখা গেলো দেমিয়ান বংশে এবার আসতে চলেছে একজন শেহজাদী! সালিমের তো আনন্দ আর ধরে না! একটা মেয়েই তো সে চেয়েছিলো! খুব খুব দুয়া করতো দেমিয়ানের পরবর্তী শেহজাদী টা যেন তার ঘরেই আসে। আর সৃষ্টিকর্তা তার ডাকে সাড়াও দিয়েছেন!
মেয়ে হবার খবর শুনে এক প্রকার নাচতে নাচতে সে এসে পৌছালো আসওয়াদের নিকট। এসে উচ্ছাসের সাথে ঝাপিয়ে পড়লো আসওয়াদের বুকে। সালিমের এমন আনন্দের কারণ জানতে চাইলে আসওয়াদ কে দাঁত কেলিয়ে নিজের মেয়ের বাবা হবার খবর টা শুনিয়ে দিলো সালিম। আর সালিমের মেয়ে হবে শুনে অনেক অনেক গুলো দিন পর আসওয়াদের মুখে দেখা দিলো হাসির রেখা। মিষ্টি করে হেসে সে সালিম কে বলল,
— সেদিন জাহাজে করা দুয়া টাই কাজে দিয়েছে আমার!
সালিম দ্বিগুণ উচ্ছাস নিয়ে আবারও জড়িয়ে ধরলো আসওয়াদ কে!
কিন্তু তার কিছুদিন পরেই ঘটলো এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। সেদিন বাবার কক্ষে ঢোকার আগ মুহুর্তে ভুল বসত বাবা আর ইলহামের ভেতরকার কথোপকথন শুনে ফেললো সালিম। কিন্তু সেই মুহুর্তে সে এই বিষয়ে কিছুই বলল না কাউকে। পরদিন বাবাকে একা পেয়েই সালিম তার বাবাকে প্রশ্ন করে বসলো তার আর ইলহামের ভেতর হওয়া গতকালের কথপোকথন নিয়ে। ইলহাম কে এইভাবে নিজের ভাই এবং একজন বাদশাহর বিরুদ্ধে উস্কে দেওয়ার যথাযথ কারণ জানতে চাইল সালিম।
আজলান হঠাৎ করে সালিমের এমন কৈফিয়ত গ্রহণে থমকাল কিছুটা। কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে সালিম কে সে নিজের দলে টেনে নিয়ে আসার জন্য বোঝাতে শুরু করল যে সে যা করছে সালিমের জন্যই করছে। কারণ এরা দুই ভাই বিদায় নিলে আজলান নিজে সিংহাসনে বসতে পারবে। আর সে সিংহাসনে বসলে পরবর্তী উত্তরাধিকার হবে সালিম। আর যেহেতু সালিম একজন শেহিজাদীর বাবা হতে চলেছে সেহেতু ব্যাপার টা তাদের জন্য আরও সহজ হয়ে যাবে, কারণ শেহজাদী গুলোই এই শিরো মিদোরি কে হাতের মুঠোয় রাখতে সক্ষম!
কিন্তু সালিম তার বাবার এমন ঘৃণ্য কাজে কোনো মতেই সায় দিলো না৷ সে তার বাবার এই প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলো। আর বলল যে পঞ্চদ্বীপের বাদশাহর প্রধান উপদেষ্টা, এবং তার চাইতে বড় ব্যাপার বাদশাহর বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে সে এই কাজ কিছুতেই হতে দেবে না, এবং খুব দ্রুতই সে বাদশাহ কে তার এই নোংরা পরিকল্পনার ব্যাপারে জানাবে৷ কিন্তু এর মাঝে যদি আজলান নিজের মত পরিবর্তন করে নেয়, এবং বাদশাহর বিরুদ্ধে করা সব ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা গুলো বাদ দিয়ে দেয় তবে সে বাদশাহ কে আজলানের এসব পরিকল্পনার ব্যাপারে কিছুই বলবে না। আর সালিমের এমন সিদ্ধান্তই হয়ে উঠলো তার কাল।
আজলান ততদিনে ক্ষমতার লোভে নিজের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছে। নিজের সন্তানের জন্য তার এত বছরের পরিকল্পনা নস্যাৎ হোক তা সে কোনোভাবেই চাইলো না। একটি সন্তান চাইলেই সে পেয়ে যাবে, তার দাসী দের তো আর অভাব নেই!
আর ঠিক তার কিছুদিন পরেই এক রাতে খাবার খাওয়ার পর বিষক্রিয়ায় প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়লো সালিম। খবর পেয়ে সাথে সাথেই প্রাসাদের মেডিক্যাল এরিয়ায় ছুটলো আসওয়াদ। সালিমের অবস্থা তখন ভয়াবহ। ইমার্জেন্সি কক্ষের বিছানায় শুয়ে নিজের ফুসফুসের ভেতর সামান্য অক্সিজেন নেওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছে সে। নাক মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে অবিরত! ডাক্তার নার্স রা ছোটাছুটি করছে চারদিকে। কিন্তু সালিমের শরীরে প্রবেশ কারী বিষ যে তার রক্তে মিশে গেছে ততক্ষণে। তবুও শেষ চেষ্টা!
আসওয়াদ হুড়মুড়িয়ে গিয়ে সালিমের নিকট পৌছাতেই তার দিকে রক্ত জমাট বাধা ঝাপসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে কেঁপে যাওয়া ফিসফিসে কন্ঠে সালিম অতি কষ্টে শুধু দুটো বাক্যই উচ্চারণ করলো,
— আমার কলিজার টুকরা মেয়েটাকে দেখে রাখিস, ভাই আমার! আর আমার বাবা….. আমার বাবা…..
বাকি বাক্য টুকু শেষ করতে পারলো না সালিম! তার আগেই ওর বুক টা এক ঝটকা দিয়ে বিছানা থেকে উপরের দিকে উঠে ধনুকের ন্যায় বাকা হয়ে এলো, আর তার পরমুহূর্তেই একটা বিরাট দীর্ঘশ্বাসের সাথে এই ধরণীর মায়া ত্যাগ করলো সালিম। নিথর শরীর টা পড়ে রইলো বিছানায়৷ রক্তজবার ন্যায় চোখ জোড়া তখনো তার অতি ভরসার বন্ধু আসওয়াদের দিকে নিবদ্ধিত, যেন চোখ জোড়া এখনো বলছে আমার কলিজার টুকরা মেয়েটাকে দেখে রাখিস!
এই প্রথম বার, এই প্রথম বার কাউকে হারিয়ে চিৎকার দিয়ে কাদলো আসওয়াদ! ওর গগনবিদারী আহাজারিতে কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকলো প্রাসাদের প্রতিটা প্রস্তর খন্ড!
মেডিক্যাল এরিয়ার বাইরে এসে জড় হয়ে গেলো প্রাসাদের প্রত্যেক টা দাস দাসী! কঠোরতার প্রতীক, তাদের পরাক্রমশালী বাদশাহ নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান কে এই প্রথম বারের মতো এতটা অসহায় হতে দেখলো তারা! সমস্ত প্রাসাদ জুড়ে নেমে এলো শোকের ছায়া, নিরব হয়ে এলো চারপাশ।
আজলান সকলের অগোচরে ছেলের জন্য সত্যিকার অর্থে দু ফোটা চোখের পানি ঝরালেন! হাজার হলেও নিজের ঔরসজাত সন্তান কিনা!
.
আট মাসের অন্তসত্তা ইনায়া নিজের গর্ভে দেমিয়ান সন্তান বহন করতে গিয়ে এমনিতেই কাহিল হয়ে গেছিল। তবুও নিজের প্রাণপ্রিয় স্বামীর অত্যাধিক হাসিমাখা মুখের কাছে নিজের সমস্ত কষ্ট গুলোকে ফিকে মনে হতো তার। কিন্তু যার মুখ দেখে এত কিছু সহ্য করা, সেই প্রাণের স্বামী কে হারিয়ে পাগলপ্রায় হয়ে গেল ইনায়া! গর্ভের সন্তানের কথা যেন তার মাথা থেকেই বেরিয়ে গেলো! তার আহাজারি তে ভারী হয়ে উঠলো প্রাসাদের অন্দরমহল! আর সেই সাথে প্রচন্ড অসুস্থতা জেকে ধরলো তাকে। আর সে অসুস্থতা তাকে নিয়ে গেলো মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে!
সালিমের মৃত্যুর শোক শেষ হতে না হতেই ইনায়ার অসুস্থতার খবরে এবার মানসিক ভাবে পুরোপুরি ভেঙে পড়লো আসওয়াদ। কিন্তু এবার ও আর রিস্ক নিলো না। চব্বিশ ঘন্টা প্রাসাদের ডাক্তার দের নজর দারিতে রেখে দিলো ইনায়া কে। আর সেই সাথে বাড়িয়ে দিলো প্রাসাদের নিরাপত্তা। আর চোখে চোখে রাখতে শুরু করলো আজলান কে। তার প্রতিটা পদক্ষেপের ওপর নজর রাখতে শুরু করলো আসওয়াদ। সে এখন পুরোপুরি নিশ্চিত যে আজলানই তার বাবা আর তার ভাইয়ের খুনি। কিন্তু এই ঝামেলার ভেতরে নতুন ঝামেলা সৃষ্টি না করে আসওয়াদ অপেক্ষা করলো সব কিছু একটু শান্ত হওয়ার!
ইনায়া কে চব্বিশ ঘন্টা অবজারভেশনে রাখার কিছুদিন পরেই একদিন ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়ল ও৷ সারাদিন রাত হ্যালুসিনেশনে সালিমের সাথে কথপোকথন চালিয়ে যেত ইনায়া, কিন্তু হঠাৎ করেই তার মুভমেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে। চোখের পাতা টা পর্যন্ত তার প্রচন্ড ধীর গতিতে পড়ছে। এসব দেখে চিন্তিত হয়ে পড়লেন ডাক্তার রা।
ইনায়া ভয়ানক ডিপ্রেশনে ভুগছে তার ওপর সে সন্তানসম্ভবা। এই অবস্থায় ডিপ্রেশনের কড়া ওষুধ দিলে তার প্রভাব গিয়ে পড়বে গর্ভের সন্তান টির ওপর। যার জন্য ডাক্তার রা তাকে ডিপ্রেশনের জন্য খুব লাইট পাওয়ারের মেডিসিন দিয়েছে। কিন্তু তাতে কোনো উপকার হয়নি। দিনে দিনে ইনায়ার অবস্থা হয়েছে আরও শোচনীয়! আর আজ এই মুহুর্তে সে তার শরীরের সমস্ত মুভমেন্ট বন্ধ করে দিয়েছে!
আসওয়াদের নিকট এ খবর গেলে সে সাথে সাথেই মেডিক্যাল এরিয়ার এসে সেখানে উপস্থিত ডাক্তার দের উদ্দেশ্যে সাফ সাফ বলে দিলো কোনোভাবেই যেন গর্ভের বাচ্চা টার শরীরে বিন্দুমাত্র আচড় না লাগে। যার যা হয়ে যায় যাক, গর্ভের বাচ্চা টা যেন পুরোপুরি সুস্থ থাকে। আর এরপর ডাক্তার দের কে বলে দিলো পেটের বাচ্চা টাকে সি সেকশন ডেলিভারির মাধ্যমে মায়ের গর্ভ থেকে বের করতে, এমনিতেও ইনায়ার যে শারীরিক কন্ডিশন তাতে সে নরমাল ডেলিভারি করতে সক্ষম হবে না কোনোভাবেই।
ডাক্তার রা আর কোনো উপায় না পেয়ে সেটাই করলো। কিন্তু সার্জারীর জন্য ইনায়া কে অ্যানেস্থেসিয়া দেয়ার পর পরই ধীরে ধীরে ইনায়ার রেস্পন্স হারাতে শুরু করলো তারা। আসওয়াদ নিজেও সেখানে উপস্থিত ছিলো। ইনায়ার হৃৎপিণ্ডের গতি বাড়তে শুরু করলে সে ডাক্তার দের কে তাড়া দিয়ে বলল বাচ্চা টার যেন কোনো ক্ষতি না হয়, যত দ্রুত সম্ভব বাচ্চাটিকে যেন এই মেয়ের পেট থেকে বের করে ফেলা হয়। এই মেয়ে এমনিতেও মরবে!
ততক্ষণে শিরো মিদোরির আকাশে ঘন কালো মেঘ জমে গুরু গুরু শব্দ তুলতে শুরু করে দিলো, আর সেই সাথে ভয়ানক আকারে বাড়তে শুরু করলো ইনায়ার হার্টবিট, আর ইনায়ার এমন অবস্থা দেখে, অন্যদিকে আসওয়াদের তাড়া খেয়ে ডাক্তার রা আর ইনায়ার প্রাণের তোয়াক্কা করলো না। যত দ্রুত সম্ভব বাচ্চাটিকে পেট থেকে বের করে আনার চেষ্টা করলো, দুর্ঘটনা ঘটার তীব্র আশঙ্কা থেকে আসওয়াদ ও এগিয়ে গেলো সেদিকে। আর ডাক্তার দের এত দোনোমোনো করতে দেখে এক প্রকার রেগে গিয়ে আসওয়াদ নিজেই বাচ্চাটিকে তার মায়ের গর্ভ থেকে বের করে নিয়ে এলো, আর এই বের করে আনার মাঝ পথেই পুরোপুরি বন্ধ হয়ে এলো ইনায়ার হৃৎপিণ্ডের কম্পন।
কিন্তু সেই নিরাবতাকে ছাপিয়ে তারস্বরে চিৎকার করে উঠলো আসওয়াদের হাতে এক পা রেখে মাথা নিচের দিকে দিয়ে ঝুলে থাকা রক্তে আচ্ছাদিত, ফকফকা সাদা রঙা ছোট্ট দেহটি। আর সেই মুহুর্তেই বাইরে শুরু হলো বজ্রপাতের সাথে ঝমঝমে বৃষ্টি।
আসওয়াদ সহ অন্যরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সদ্য জন্মানো এই বাচ্চাটির দিকে। সমস্ত শরীর তার লতাপাতার নকশা দ্বারা সজ্জিত, যেন কেউ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হীরক কণা বসিয়ে দিয়েছে তার সে সমস্ত নকশা জুড়ে, মাথার থাকা রক্ত মিশ্রিত চুল গুলো ধবধবে সাদা রঙা! চোখ জোড়া তার কোনো রকমে মেলছে, কিন্তু যেটুকু মেলছে সেটুকুর ভেতর দিয়ে টিকরে পড়ছে এক অদ্ভুত আলোকরশ্মি! দুই হাত মুঠি করে ধরে চিৎকার করে চলেছে বাচ্চা টা।
ঠিক সেই মুহূর্তেই একটা বজ্র এসে পতিত হলো মেডিক্যাল চেম্বারের জানালায়, জানালার কাচ গুলো ভেঙে গুড়িয়ে এসে পড়লো কামরার ভেতরে। আসওয়াদ দ্রুত গতিতে তারস্বরে চিৎকার করতে থাকা বাচ্চাটিকে নিজের শরীর দিয়ে আগলে নিলো তাদের দিকে ছুটে আসা কাচের টুকরোর থেকে। আর এরপর বিপদ সম্পুর্ন কেটে গেলে পা ধরে উচু করেই এই অদ্ভুত সৌন্দর্যের অধিকারিনী টির ক্রন্দনরত মুখ খানাকে নিজের মুখের সামনে ধরে নরম গলায় বলে উঠলো,
— আ’ম গ’না প্রোট্যেক্ট ইয়্যু ফ্রম এভরি হার্ম অব দ্যিজ ক্রুয়্যেল ওয়ার্ল্ড, মা’ লিটল সুয়্যিট প্রিন্সেস!
চলবে…..
( প্রচন্ড দ্রুত লিখেছি, এলোমেলো হয়ে গেছে হয়তো সব। ভুল ত্রুটি গুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন)