বাদশাহ_নামা #পর্বসংখ্যা_৪৭ #রানী_আমিনা

0
1

#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_৪৭
#রানী_আমিনা

৬৮. মীরের কামরার সামনের বিশাল বারান্দায় মীরের বুকে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অ্যানা৷ চারদিকটা কেমন যেন কুয়াশাচ্ছন্ন, আশেপাশের কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না৷ মীরের কোলে একটা তুলতুলে বাচ্চা, বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে আছে ওরা দুজনেই। অ্যানা বাচ্চাটার নরম গালে নিজের সরু আঙুল বুলাতে বুলাতে আনমনে বলে উঠলো,

— বাচ্চাটা দেখতে একদম তোমার মতো!

— কারণ আমি ওর বাবা!

বাচ্চাটার বড়ো বড়ো চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর করলো মীর। এমন সময় তারস্বরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো বাচ্চাটা। অ্যানা চমকালো। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বাচ্চাটাকে নিজের কোলে নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলো,

— বাচ্চাটা কাঁদছে দেখো! ওকে আমার কাছে দাও।

— ওর ক্ষিদে পেয়েছে, ওকে ওর মায়ের কাছে দিতে হবে।

— আমি কি ওর মা নই? তবে কে ওর মা? কোথায় ওর মা!

ভ্রু জোড়া তুলে অসহায় কন্ঠে শুধোলো অ্যানা। মীর বাচ্চাটিকে তুলে নিজের বুকে আগলে নিলো, তারপর অ্যানার দিকে এক পলক স্নেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে অ্যানার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চলল অন্য দিকে। অ্যানা সেখানে স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো মীরের যাওয়ার পানে, মীর কোথায় যাচ্ছে? কার কাছে যাচ্ছে? কে দাঁড়িয়ে আছে ওখানে? কে ওই মেয়েটা?
পেছন থেকে মীর কে ডেকে উঠলো ও,

— মীর, কোথায় যাচ্ছো তুমি? এখানে অন্ধকার, মীর! আমাকে একা রেখে যেও না! কে ওই মেয়েটা? তোমার কোলে ওইটা কার বাচ্চা!

মীর শুনছে না, তাকাচ্ছে না পেছন দিকে! ওর চিৎকার কি মীর শুনতে পাচ্ছে না! ভড়কালো অ্যানা। মীরের পেছনে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো ও, একি! ওর পায়ে কি আটকে আছে এটা! শিকল বাধা কেন ওর পায়ে! মীর! মীর ওকে এখানে রেখে কোথায় গেলো!

অ্যানা সামনে তাকালো আবার, মীর মিলিয়ে যাচ্ছে কারো সাথে, ওই ধোঁয়াসার ভেতরে! অ্যানা মীরের নাম ধরে প্রাণপণে ডাকার চেষ্টা করলো কয়েকবার!
কিন্তু একি! ওর গলা থেকে শব্দ বের হচ্ছে না কেন! কি হলো ওর! মীর তো চলে যাচ্ছে! আরও কয়েকবার উচ্চস্বরে ডেকে উঠলো ও
‘ মীর, মীর মীর! ’

কিন্তু ওর সে ডাক মীরের কান অব্দি পৌছালো না! কণ্ঠনালী দিয়ে বেরোনো সমস্ত আর্তনাদ গুলো ক্ষীণতর হয়ে ধোঁয়ার ন্যায় মিলিয়ে গেলো বাতাসে!

এই পর্যায়ে আঁতকে উঠে ঘুম থেকে জেগে গেলো অ্যানা! বিছানায় উঠে বসে জোরে জোরে দম ছাড়তে লাগলো। বালিশ ভিজে গেছে ওর চোখের পানিতে, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে একেবারে! উফফফ, কি ভয়ঙ্কর স্বপ্ন!

বিছানা থেকে হাত বাড়িয়ে সাইড টেবিলের ওপর থাকা পানির বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি খেলো ও।
ভোর হয়ে গেছে। পাখিদের সুমধুর সুর ভেসে আসছে জঙ্গলের ভেতর থেকে। মীর নেই পাশে। হয়তো অনেক আগেই উঠে গেছে। মীরের পাশের বালিশটাকে একবার ছুয়ে দিলো অ্যানা, তারপর ঝুকে চুমু খেলো বালিশটায়। মীরের শরীরের গন্ধ লেগে আছে এখনো বিছানায়, লেগে আছে ওর সমস্ত শরীর জুড়ে।

অ্যানা আরও কিছুক্ষণ মীরের বালিশটাকে মীর ভেবে আদর করে বিছানা ছেড়ে উঠে শাওয়ার নিতে চলে গেলো। অ্যানিভার্সারির পর প্রায় সপ্তাহ খানেক পার হয়ে গেছে। এই কটা দিন অ্যানার কাছে স্বপ্নের মতো ঠেকেছে। মীর সারাদিন সাম্রাজ্যের কাজে ব্যাস্ত থাকলেও সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত সময়টা সম্পুর্ন ওকে দিয়েছে, আর কোনো কাজ করেনি। দুজনে মিলে রাতগুলো ঝগড়া, মারামারি, খুনসুটি, আর আদরে আদরে কাটিয়ে দিয়েছে।

শাওয়ারে গিয়ে পানি ছেড়ে দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো অ্যানা। ওর সমস্ত শরীর টা জুড়ে মীরের আদুরে ছোয়া। ধুয়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে না, মনে হচ্ছে বাকি জীবনটার জন্য এ ছোয়া গুলো চিরস্থায়ী হয়ে বসে যাক ওর শরীরে। অ্যানা আয়নাতে নিজের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো, তারপর চলে গেলো গোসলে৷

.

অ্যানার ভালো লাগছে না কিছু। কামরার ভেতর এ মাথা থেকে ও মাথা পায়চারী করে বেড়াচ্ছে ও৷ ভোর বেলাতে ওই আজগুবি স্বপ্ন টা দেখার পর থেকে বার বার শুধু ওই অস্পষ্ট দৃশ্য গুলোই ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছে। মীর টা কোথায় কে জানে! বিছানায় পড়ে থাকা ফোন টা হাতে নিলো অ্যানা। তারপর মীর কে কল লাগালো।

নট রিচেবল! নট রিচেবল মানে কি? মীরের ফোন তো কখনোই নট রিচেবল দেখাবে না! ওর ফোনে ফুল চার্জ ছিলো মাঝ রাতেও। তবে? চিন্তিত হয়ে উঠলো অ্যানা।

মীরের এখন প্রাসাদের আউটার এরিয়াতে, রাজ পরিষদে থাকার কথা। সেখানে গিয়ে কি খোঁজ নিবে একবার?
কিছুক্ষণ কি করবে ভেবে না পেয়ে গায়ে একটা ঢিলাঢালা রোব জড়িয়ে নিয়ে বাইরে এলো অ্যানা। ইয়াসির দাঁড়িয়ে ছিলো সেখানে৷ অ্যানাকে দেখে এগিয়ে গিয়ে আনুগত্য দেখিয়ে বলে উঠলো,

— আদেশ করুন শেহজাদী। আপনার কিছু প্রয়োজন?

— মীর কোথায় গেছে, জানো ইয়াসির?

অ্যানা ভ্রু জোড়া সামান্য কুঞ্চিত করে প্রশ্ন করলো। সাথে সাথেই ইয়াসিরের চোখ মুখ শুকিয়ে গেলো, সেখানে দেখা দিলো স্পষ্ট ভয়ের আভাস৷ সে শুকনো একটা ঢোক গিলে উত্তর দিলো,

— ক্ষমা করবেন শেহজাদী, উনি আমাকে বলে যাননি!

ইয়াসিরের কথায় অন্যরকম কোনো কিছুর আভাস পেলো যেন অ্যানা। ওর দিকে এক পলক সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে অ্যানা ফিরে গেলো কামরায়, তারপর কল লাগালো ফ্যালকনের কাছে। কয়েকবার রিং হলো কিন্তু ফ্যালকন ফোন ধরলো না।
কি ব্যাপার, সবার হলো কি! মীরের ফোনে কল ঢুকে না, বন্ধ দেখায়, ওদিকে ফ্যালকন কেও ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না! উফফফ!

ওরা কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যাস্ত আছে ভেবে নিজেকে আস্বস্ত করলো অ্যানা৷ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকলেও মীর তো কখনোই ফোন বন্ধ রাখে না!
অ্যানা বিছানায় গিয়ে স্থীর হয়ে বসলো কিছুক্ষণ। তারপর নিজেকে কিছুক্ষণ সময় নিয়ে শান্ত করে ঢুকলো ক্লজেটে। সেখান থেকে একটা নরম ফ্যেব্রিকের মেরুণ রঙা গাউন বের করে পরে নিলো। চুল গুলো এখনো ভেজা। নিতম্ব ছাড়ানো ভেজা চুল গুলো পিঠময় ছড়িয়ে দিয়ে অ্যানা কামরা থেকে বের হয়ে এগোলো প্রাসাদের ছাদের দিকে।

প্রাসাদে ফেরার পর থেকে এখনো ছাদে যাওয়া হয়নি ওর। ছাদ টা মীর শুধুমাত্র ওর জন্য দারুণ করে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখে দিয়েছে। ছাদ ওর খুব পছন্দের, ওয়ার্কিং জোনে যাওয়ার আগে ওর বেশিরভাগ সময় কাটতো ছাদের ওপর, খোলা আকাশের নিচে৷

ছাদে গিয়ে বেশ কিছুক্ষন এমাথা থেকে ওমাথা পায়চারি করলো অ্যানা। মনের ভেতরে কেমন জানি অশান্তি হচ্ছে একটা।ভোর বেলার ওই আজগুবি স্বপ্নটাও মাঝে মাঝে চোখের সামনে ভেসে উঠছে! তারওপর কালাভুনা টা নট রিচেবল!
কিছুক্ষণ ছাদে চুপচাপ ঘুরেফিরে, ছাদে থাকা ফুলের গাছ গুলোকে আলতো হাতে ছুয়ে দিয়ে অ্যানা এসে বসলো ছাদের ওপর থাকা সুন্দর বসার স্থান টাতে। আকাশে মেঘ করেছে সামান্য, সূর্যের তাপ নেই বললেই চলে। সাদা কালো মেঘের আড়ালে সূর্য মুখ লুকিয়ে আছে তখন থেকে। বাতাস নেই তেমন, মেঘ গুলো ছবির মতো স্থীর হয়ে আছে যেন।

অ্যানা মেঘ গুলোকে একবার পরখ করে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকাশের অন্যদিকে তাকালো। তখনি ওর চোখে বাধলো ফ্যালকন কে। সমুদ্রের দিক থেকে উড়ে ও জঙ্গল অভিমুখে রওনা দিয়েছে। ফ্যালকন কে দেখা মাত্রই চমকালো অ্যানা৷ ফ্যালকন তো এখানেই আছে, তাহলে ও ফোন তুললো না কেন?

অ্যানা বসা থেকে উঠে ছাদের কিনারে এসে উচ্চস্বরে ডেকে উঠলো,

— ফ্যালকন!

অ্যানার ডাক শোনা মাত্রই আকাশে উড়তে থাকা ফ্যালকন চমকে উঠে ভড়কালো। অ্যানাকে ও খেয়ালই করেনি। অ্যানা যে এমন সময় ছাদে আসতে পারে সেটা ও ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবেনি। বিকেলে ছাড়া তো অ্যানা কখনোই ছাদে আসেনা!

ফ্যালকন দিক পরিবর্তন করে এলো প্রাসাদের ছাদের দিকে। এরপর ছাদের মেঝেতে লাফিয়ে পড়েই নিজের হিউম্যান ফর্মে ফিরে এলো ও৷ চোখ মুখ জুড়ে ওর অদ্ভুত অপ্রস্তুত ভাব। অ্যানা ওর দিকে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে গাঢ় স্বরে প্রশ্ন করলো,

— আমার ফোন উঠাসনি কেন?

— ক্ষমা করবেন শেহজাদী, আমি হয়তো খেয়াল করিনি। ফোন মেইবি সাইলেন্ট ছিলো।

একটা ঢোক গিলে শুকনো গলায় বলে উঠলো ফ্যালকন। অ্যানার ফোন অ্যানার কাছেই ছিলো। সেটা হাতে নিয়ে ফ্যালকনের দিকে দৃষ্টি রেখেই ফ্যালকনের ফোনে আবার কল দিলো অ্যানা। সাথে সাথেই ফ্যালকনের প্যান্টের পকেটে থাকা ফোন টা শব্দ করে বেজে উঠলো। ধরা পড়ে গিয়ে চোখে মুখে আতঙ্ক দেখা দিলো ফ্যালকনের৷

— তুই আমার সাথে মিথ্যা কথা বলছিস ফ্যালকন!

কঠিন স্বরে বলল অ্যানা। ফ্যালকনের গলা শুকিয়ে গেলো। কি বলবে ভেবে পেলো না ও৷ অ্যানা ওর উত্তরের অপেক্ষা না করে আবার শক্ত গলায় প্রশ্ন করলো,

— আমার মীর কোথায়? ওর ফোন বন্ধ কেন?

ফ্যালকন কি বলবে ভেবে পেলো না। ‘আমার মীর’ কথাটা ওর কানে বাজলো। এই একটা জিনিসে তার শেহজাদী কখনো ছাড় দেয়নি কাউকে! এই একজন মানুষ কে নিয়ে তার পজেসিভনেইসের শেষ নেই!
ফ্যালকন বুকের ভেতর টা কেঁপে উঠলো কিঞ্চিৎ। কোনো মিথ্যা বলে সে যে আবারও ধরা পড়ে যাবে সে বিষয়ে সে নিশ্চিত। একটা শুকনো ঢোক গিলে ও উত্তর করলো,

— হিজ ম্যাজেস্টি এখানে নেই।

— এখানে নেই মানে? কোথায় গেছে?

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে গাঢ় কন্ঠে প্রশ্ন করলো অ্যানা। ফ্যালকনের গা হাত পা কাঁপা শুরু করলো। অ্যানার ওই চোখের দিকে দৃষ্টি দেওয়া কোনো ভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। কিছুক্ষণ অ্যানার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থেকে ফ্যালকন উত্তর করলো,

— আমি জানিনা শেহজাদী। কোকো আসলে জানতে পারবেন। ও জানে হিজ ম্যাজেস্টি কোথায় গেছে!

— সকাল সকাল আমার পাশ থেকে উঠে ও কোথায় চলে গেলো? ফোন টা কেন বন্ধ রেখেছে? এমন তো রাখে না কখনো! আর প্রাসাদ ছেড়ে কোথাও গেলে তো আমাকে বলেই যায়! তবে আজ আমাকে কেন বলে গেলো না? তুই আমার ফোন ধরলি না কেন? কি লুকাচ্ছিস তোরা আমার থেকে?

অ্যানার করা একের পর এক প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে উঠলো ফ্যালকন। অ্যানাকে কি উত্তর দেবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে থেকে ও কিঞ্চিৎ অসহায় কন্ঠে বলে উঠলো,

— শেহজাদী। কোকো আসলে আপনি সবকিছু জানতে পারবেন৷ এখন এখানে একটু মাথা ঠান্ডা করে বসুন, আসুন।

অ্যানা কিছুক্ষণ ফ্যালকনের দিকে তাকিয়ে থেকে ধীর পায়ে হেটে এসে বসলো ছাদের এক পাশের ছাউনির তলায় থাকা বেতের চেয়ারের ওপর। ওর মনের ভেতর অশান্তি হচ্ছে প্রচুর। কি যেন ঠিক নেই ঠিক নেই ভাব! গলা শুকিয়ে আসছে বারবার।

— ফ্যালকন, আমাকে এক গ্লাস পানি খাওয়া তো!

শুকনো কন্ঠে বলে উঠলো অ্যানা। ফ্যালকন সামনে রাখা টেবিলের ওপর থেকে একটা স্ফটিকের গ্লাস উঠিয়ে নিয়ে গেলো ছাদের কিনারে থাকা একটা ছোট্ট কৃত্তিম ঝর্ণার ধারে। সেখানের ট্যাপ থেকে ঠান্ডা পানি এনে অ্যানার হাতে দিলো ও। তারপর অ্যানার সোজাসুজি বসে পড়লো ছাদের মেঝেতে। ওকে ওখানে বসতে দেখে অ্যানা পানি খাওয়া থামিয়ে বলল,

— ওখানে বসছিস কেন? আমার পাশে এসে বস।

ফ্যালকন ইতস্তত করে মেঝে থেকে উঠে এসে বসলো অ্যানার পাশে থাকা চেয়ারটিতে। ঠান্ডা পানি খাওয়ার পর অ্যানা একটু ঠান্ডা হলো যেন। ফ্যালকনের দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ও নরম গলায় প্রশ্ন করলো,

— সত্যি করে বলতো, তোরা সবাই মিলে আমার থেকে কি লুকাচ্ছিস! যদি সেটা এমন কিছু হয় যাতে আমি প্রচন্ড কষ্ট পাবো তবে তোদের কে আমি কোনোদিনও ক্ষমা করবো না ফ্যালকন!

অ্যানার এমন কথা শুনে বুক কেঁপে উঠলো ফ্যালকনের। অ্যানার দিক থেকে চোখ সরিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলো ও। আর অ্যানা ফিরে তাকালো আবার আকাশ পানে৷ সেখানে গুমোট মেঘের আনাগোনাতে সূর্যটা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে যেন!

৬৯. দুপুর গড়িয়ে বিকেলে হয়ে এলো। কোকো এখনো এলো না। অ্যানা সেই থেকে ছাদেই বসে আছে৷ ফ্যালকন অ্যানাকে ছেড়ে একটা মুহুর্তের জন্যও যায়নি। সকাল থেকে এখন পর্যন্ত ফ্যালকনের কাছে কয়েক কোটি বার প্রশ্ন করা হয়েছে গেছে ওর মীর কোথায় জানতে। ফ্যালকন শুধু বলেছে কোকো আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। অ্যানা যে কত শতবার কোকোর কাছে ফোন দিয়েছে তার ঠিক নেই৷

সকাল দুপুরের খাবার টাও খাওয়া হয়নি ওর, ফ্যালকন কয়েকবার সাধলেও অ্যানা একটা দানা পর্যন্ত মুখে নেয়নি। সোজা বলে দিয়েছে ওর মীর প্রাসাদে ফিরে না আসা পর্যন্ত ও খাবে না কিছু!

অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো এক সময়। ফ্যালকনের কাছে ফোন এলো কোকোর৷ কোকো ওকে বলল অ্যানার সাথে ও প্রাসাদের ছাদে আছে।
অ্যানা তখন ছাদের অন্য প্রান্তে ছিলো। কোকোর ফোন আসার খবরটা পেলো না ও। চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে ওর দুঃশ্চিন্তায়!

ওর মীরের কি কিছু হলো! খারাপ কিছু! এমন কিছু হলে তো ও মরেই যাবে! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বার বার আকাশের দিকে চোখ তুলে ও দুয়া করতে থাকলো যেন ওর মীরের কিছু না হয়, সুস্থ সবল থাকে অন্তত!

বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর অ্যানার কানে এলো কোকোর কন্ঠস্বর,

— আম্মা!

চমকে পেছনে ফিরে তাকালো অ্যানা। কোকোর সাথে সাথে ওর সব বাচ্চারাই এখানে এসেছে! কি হলো, সত্যিই কি ওর মীরের কিছু হলো! সৃষ্টিকর্তা কি ওর কথা শোনেননি!
আতঙ্কিত চোখ মুখ নিয়ে দ্রুত পায়ে ছাদের ও মাথা থেকে এদিকে ছুটে আসলো অ্যানা এসেই ভ্রু জোড়া তুলে অভিযোগের সুরে বলে উঠলো,

— তোকে কতবার ফোন দিয়েছি আমি কোকো! একবারও তুলিসনি কেন? আমার মীর কোথায়? ঠিক আছে ও? তোরা সবাই এখানে এভাবে একসাথে কি করছিস?

— হ্যাঁ আম্মা, হিজ ম্যাজেস্টি ঠিক আছেন।

ঠান্ডা স্বরে উত্তর করলো কোকো। অ্যানা দুকদম এগিয়ে এসে আবারও প্রশ্ন করলো,

— কোথায় গেছে ও? ওর ফোন নট রিচেবল বলছে কেন?

— উন….. উনি বহির্বিশ্বে গিয়েছেন।

— বহির্বিশ্বে গিয়েছে! বহির্বিশ্বে কেন গিয়েছে? ও বহির্বিশ্বে গেলো তবে আমাকে বলে গেলো না কেন? কি এমন কাজ পড়েছে ওর সেখানে? হঠাৎ ও সেখানে কেন গেলো?

অ্যানার কন্ঠে এক রাশ বিস্ময়! মীরের কি এমন কাজ পড়লো যে ও হুট করে বহির্বিশ্বে চলে গেলো! গেলোই যখন ওকে বলে গেলো না কেন?
অ্যানার ওই বিস্ময় ভরা চাহনীর দিকে তাকিয়ে কোকো ধীর গতিতে একটা চিঠি এগিয়ে দিলো অ্যানার দিকে।
চিঠিটার দিকে এক পলক তাকিয়ে খপ করে সেটা কোকোর হাত থেকে কেড়ে নিলো অ্যানা৷ তারপর মেলে ধরলো নিজের সামনে। এ তো মীরের হ্যান্ড রাইটিং!

“ শিনু, আমার প্রাণের শিনু!
এই মুহুর্তে তোমার সামনে দাড়ানোর মতো মুখ আর সাহস কোনোটাই আমার নেই! তাই অনেক গুলো বছর পর আজ তোমাকে আবার চিঠি লিখলাম আমি।
আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি শিনু, এতটা ভালোবাসি যে আমার শেষ নিঃশ্বাসটা বাতাসে মিশে যাওয়ার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত আমি তোমাকে চাই, আমার মৃত্যু পরবর্তী সেভেন মিনিটস এর জন্য আমি তোমাকে চাই, পরকালে গিয়েও আমি শুধুমাত্র তোমাকেই চাই, আর অন্য কাউকে না, কখনোই না!

কিন্তু এই পৃথিবীতে আমার ওপর একটা বিশাল দায়িত্ব পাহাড়ের মতো চেপে আছে শিনু। এ বিশাল সাম্রাজ্যের ভার আমার ওপর। এ সাম্রাজ্যের জন্য আমাকে আমার পরবর্তী উত্তরসূরীকে পৃথিবীতে নিয়ে আসতে হবে। আমার দুর্ভাগ্য যে তুমি পৃথিবীর যেকারো সন্তানের মা হতে পারলেও আমার সন্তানের মা হতে পারবেনা! আমি এতটাই হতভাগা!
তুমি আমার সন্তানের মা হতে গেলে তোমাকে সহ আমার অনাগত বাচ্চাকে আমি হারাবো, যা আমি কখনোই মেনে নিতে পারবো না শিনু! তুমি সারাটাজীবন আমার আদুরে বাহুবন্ধনে আমাকে জড়িয়ে থাকবে, এছাড়া আর কোনো চাওয়া নেই আমার তোমার কাছে!

আমি জানি তুমি আমাকে ঠিক কতোটা ভালোবাসো! তোমার ভালোবাসা সীমাহীন! আমার মায়ের সাথে যেদিন আমার শেষ কথা হয় সেদিন আমার মা আমাকে বলেছিলেন, আমার জীবনে একদিন এমন কেউ আসবে যে আমার মায়ের থেকেও আমাকে বেশি আপন করে নিবে, জাগতিক কোনো কষ্টকে সে আমায় ছুতে দিবে না। আমাকে অনেক অনেক ভালোবাসবে, আমার মায়ের থেকেও বেশি! আমার সমস্ত দুঃখের স্মৃতি, সমস্ত প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তির কষ্ট সে আমাকে ভুলিয়ে দেবে, যাকে দেখা মাত্রই আমার অন্তর প্রশান্তিতে ছেয়ে যাবে!

সেদিন আমার মায়ের করা দুয়া বিফলে যায়নি! কবুল করেছেন ওপর ওয়ালা, তোমাকে পাঠিয়েছেন আমার কাছে। তুমি আমাকে যত ভালোবাসা দিয়েছো তা পৃথিবীর কোনো নারী কোনো পুরুষকে দিয়েছে কিনা সে ব্যাপারে আমি সন্দিহান! আর কেউ আমাকে এতটা ভালোবাসা কখনোই দেয়নি শিনু, আর কেউ কখনো দিবেও না!
তোমাকে তোমার এই ভালোবাসার বিনিময়ে আমি অতোটা ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হইনি কখনো আমি জানি। কিন্তু আমি স্বেচ্ছায় তোমাকে কখনো কষ্ট দিতে চায়নি, এটা বিশ্বাস করো তো শিনু!
প্রতিবার আমি বাধ্য হয়ে তোমাকে কষ্ট দিয়েছি, আর প্রতিবারই তুমি আমাকে ক্ষমা করেছো। কখনো সে ক্ষমার করার মধ্যবর্তী সময়টা দীর্ঘ হয়েছে কখনো বা স্বল্প। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছো প্রতিবার!

কিন্তু এবার আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিতে যাচ্ছি শিনু! স্বেচ্ছায় নয়, বাধ্য হয়ে, বিশ্বাস করো!
আমি দ্বিতীয় বিয়ে করতে চলেছি শিনু, কিন্তু আমি তাকে ডিভোর্স দিয়ে দেবো, আমার সন্তান টা পৃথিবীতে আসা মাত্রই! মেয়েটা মুসলিম হওয়ায় আমার তাকে বিয়ে করতে হচ্ছে শিনু!
কিন্তু বিশ্বাস করো, তার গর্ভসঞ্চার হওয়ার পর আমি তাকে আর কখনো ছুয়েও দেখবো না শিনু। আমার সন্তান্টা পৃথিবীর বুকে আসা মাত্রই আমি সে মেয়েটিকে ডিভোর্স দিয়ে দিবো শিনু! আ’ সয়্যার!

আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি শিনু, এইটাই শেষ! তুমি শুধুমাত্র নিজেকে একটু সামলে রেখো! দয়া করে কোনো উলটো পালটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলো না! আমি মেয়েটিকে নিয়ে দ্রুতই ফিরে আসবো। তোমার তখন আমাকে যা করতে ইচ্ছা হয় তুমি কোরো। শুধু রাগ টা নিজের ওপর আর ওই মেয়েটার ওপর দেখিও না পাখি আমার! তোমার কাছে অনুরোধ আমার! আমার এই অনুরোধ টা রেখো শিনু!

আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি শিনু, শুধুমাত্র তোমাকেই। এ ছাড়া পৃথিবীর আর অন্য কোনো নারীর প্রতি আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই শিনু! তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও এবারও শিনু! নিজের কোনো ক্ষতি করে ফেলোনা শিনু, তোমার কাছে এ আমার অনুরোধ! আমি তোমাকে অনেক অনেক অনেক ভালোবাসি শিনু, নিজের থেকেও বেশি আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার জন্য হলেও নিজেকে একটু সামলে নিও তুমি প্রাণ আমার! ক্ষমা করে দিও আমাকে!

তোমার এবং শুধুমাত্র তোমারই মীর ”

চিঠিটা পড়ে পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে গেলো অ্যানা। কন্ঠরোধ হয়ে এসে কথা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো ওর! নিজের চোখ কে যেন ও বিশ্বাস করতে পারলো না! হতবাক হয়ে ও তাকিয়ে রইলো চিঠিটার দিকে! কি পড়লো ও এইমাত্র! এসব কি সত্যিই মীর লিখেছে! ওর মীর!

ধীরে ধীরে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাওয়া মুখটা কঠিন হয়ে এলো অ্যানার, শক্ত হয়ে এলো চোয়ালদ্বয়! চোখ জোড়াতে দেখা দিলো ভয়ঙ্কর ক্রোধ! উত্তপ্ত হতে শুরু করলো চারপাশ টা। উত্তপ্ত হতে শুরু করলো শিরো মিদোরি!
হঠাৎ করেই দূর সমুদ্রে শোনা গেলো গর্জন! বাতাস গরম হতে শুরু করল সমস্ত পঞ্চদ্বীপের। তারপর হঠাৎ করেই বইতে শুরু করলো ঝড়ো হাওয়া। প্রচন্ড গতিতে, রেড জোনের জঙ্গলকে ভেঙেচুরে ঠান্ডা বাতাস ধেয়ে যেতে শুরু করলো সমুদ্রের দিকে! বাতাসের তোপে সমুদ্রে সৃষ্টি হতে শুরু করলো বড়ো বড়ো ঢেউ, আর একসময় সে ঢেউ রূপ নিতে শুরু করলো বিশাল জলোচ্ছাসে! বিরাট বিরাট উচ্চতার একেকটি ঢেউ এসে আছড়ে পড়তে শুরু করলো পঞ্চদ্বীপের পাঁচ দ্বীপের সাগর তীরে!

অ্যানার চোখ মুখ ভয়ানক হয়ে উঠলো, রাগের চোটে হীরকখন্ডের ন্যায় চোখ জোড়ায় ফুটে উঠলো লালচে আভা। দাঁতে দাঁত পিষে চেপে ধরে রইলো ও শক্ত করে।
ফ্যালকন কোকোদের চোখে পড়লো আবহাওয়ার এই হঠাৎ পরিবর্তন! সমুদ্রের দিকে চোখ গেলো ওদের, সমুদ্র থেকে ধেয়ে আসা একের পর এক বিশালাকার ঢেউ দেখে ভড়াকালো ওরা! ফ্যালকন এগিয়ে গেলো অ্যানার দিকে দুকদম, তারপর মৃদু স্বরে অ্যানাকে মানানোর ভঙ্গিতে বলল,

— শেহজাদী, দয়া করে আপনি শান্ত হোন। রাগ করবেন না শেহজাদী! আপনি রাগ করলে তার প্রভাব পঞ্চদ্বীপের ওপর কিভাবে পড়বে শেহজাদী! দয়া করে শান্ত হোন!

ফ্যালকনের কথা শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পর কোকো নরম গলায় বলে উঠলো,

— আম্মা! আপনি দয়া করে মাথা গরম করবেন না। শান্ত হয়ে বসুন একটু আম্মা!
রুথ মেয়েটা মারা যাবার পর হিজ ম্যাজেস্টি নিজের সন্তানের জন্য অন্য একটি শক্তিশালি মেয়ে খুজছিলেন। কিন্তু প্রাসাদের দাসীদের ভেতরে যারা আছে তারা ততোটাও স্ট্রং নয়! সেই হিসেবে রুথ মেয়েটা অনেক স্ট্রং ছিলো। তাই তিনি লোক পাঠিয়ে বহির্বিশ্বে খোঁজ লাগিয়েছিলেন রুথের ব্লাড লাইনের ভেতরে এমন আর কোনো স্ট্রং মেয়েকে পাওয়া যায় কিনা! আর তারা পেয়েছেও। কিন্তু দুর্ভাগ্যবসত সে মেয়েটি কিছু বছর আগেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে, তাই এখন তাকে দাসী হিসেবে আর গ্রহণ করা যাচ্ছে না! যার কারণে বাধ্য হয়ে হিজ ম্যাজেস্টি মেয়েটিকে বিয়ে করছেন! নতুন শেহজাদা ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্রই মেয়েটিকে হিজ ম্যাজেস্টি তালাক দিয়ে দিবেন আম্মা! আপনি দয়া করে মাথা ঠান্ডা রাখুন আম্মা, হুট করেই কোনো ভূল সিদ্ধান্ত নেবেন না প্লিজ! ভাবুন একটু সময় নিয়ে আম্মা!

অ্যানার দৃষ্টি স্তব্ধ। চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গেছে যেন! বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাওয়া চোখ জোড়া মেঝেতে নিবদ্ধ! অ্যানাকে এভাবে অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে থেকতে দেখে কোকো এগিয়ে যেতে নিলো অ্যানার দিকে, কিন্তু ওকে এগিয়ে আসতে দেখে অ্যানা মেঝের দিকে তাকিয়ে থেকেই দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,

— তোরা সবাই সবকিছু আগে থেকেই জানতি! সব জানতি তোরা!

কোকো ফ্যালকনরা থামকালো। অপরাধবোধে ছেয়ে গেলো ওদের চোখ মুখ। আর তার পরমুহূর্তেই অ্যানা বজ্রকন্ঠে চিৎকার করে বলে উঠলো,

— আমাকে বুকে নিয়ে ও এতদিন অন্য মেয়ে খুজে গেছে! আমার কোলে মাথা রেখে অন্য কাউকে বিয়ের করার মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছে! বিশ্বাসঘাতকতা করেছে আমার সাথে! আর তোরা! তোরা সবাই সবকিছু জানা সত্বেও আমাকে কিছুই জানাসনি, একটা বারের জন্যেও না! আমার সামনে হাসি মুখে ঘুরে বেড়িয়েছিস, আমাকে ধোঁকা দিয়ে গেছিস তোরা দিনের পর দিন, সকলে মিলে! এটা আমি কিভাবে মেনে নেবো!
কোথায় ও! আমাকে আদরে ভাসিয়ে দিতে দিতে যার মস্তিষ্ক জুড়ে অন্য মেয়ের চিন্তা ঘুরে বেড়ায় সে কোথায়! কেন আমার সামনে এলো না! কাপুরুষের মতো আমার চোখ ফাকি দিয়ে, আমাকে লুকিয়ে রাতের আঁধারে চলে গেলো! কেন চলে গেলো! কিভাবে পারলো সে এটা! কিভাবে! সে নিজে পালিয়ে গিয়ে তোদের কেন পাঠিয়েছে আমার কাছে? যেন আমার ওপর নজর রাখা যায়! যেন আমি পঞ্চদ্বীপের কোনো ক্ষতি না করে বসি! তাই তো!!

কোকো মাথা নিচু করে রইলো! নিরবতা নেমে এলো সমস্ত ছাদটা জুড়ে। অন্যরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো পেছনে। ওরা জানতো, সবই জানতো, জানতো প্রাসাদের হেরেমের গুরুত্বপূর্ণ কর্মচারীরা, জানতো ইয়াসমিন, জানতো ইয়াসির! সকলেই জানতো, সবকিছু! কিন্তু প্রবল নিষেধাজ্ঞায় সকলে প্রচন্ডরকম সতর্কতা অবলম্বন করে গেছে, সন্তর্পণে পুরোটা লুকিয়ে গেছে অ্যানার থেকে!

ফ্যালকন মাথা নিচু করে রেখেছিলো, অ্যানার মুখ খানার দিকে তাকানোর মতো সাহস ওর নেই! কিন্তু হঠাৎই ওর চোখ গেলো সমুদ্রের দিকে। চোখ যেতেই আঁতকে উঠলো ও!

ঝঅরো হাওয়ার কারণে সৃষ্টি হওয়া ঢেউ গুলো একসাথে মিকে প্রায় বিশ ফুটের কাছাকাছি উচ্চতার একটা বিশাল ঢেউ তৈরি হয়ে সমুদ্রের ভেতর থেকে প্রবল বেগে ধেয়ে আসছে শিরো মিদোরির দিকে। এটা শিরো মিদোরিতে আঘাত হানলে ওয়ার্কার্স দের আবাসস্থল গুড়িয়ে যাবে পুরাই।
ফ্যালকন সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে তড়িঘড়ি করে আকুতি পূর্ণ কন্ঠে বলে উঠলো,

— শেহজাদী, মাথা ঠান্ডা করুন প্লিজ! সমুদ্রের দিকে দেখুন একবার! ওই ঢেউ টা দ্বীপে এসে পড়লে আউটসাইডার্সদের সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে শেহজাদী! দয়া করে মাথা ঠান্ডা করুন শেহজাদী!

অ্যানা রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো ফ্যালকনের দিকে। ফ্যালকন ভড়াকালো প্রচন্ড রকম। অ্যানার ওই হিংস্র দৃষ্টিতে দম আটকে যেতে নিলো ওর! হাঁসফাঁস করতে শুরু করলো ও।

কিছুক্ষণ ফ্যালকনের দিকে দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে থেকে এবার সমুদ্রের দিকে তাকালো অ্যানা। ঢেউয়ের আকৃতি দেখে ইতোমধ্যে আউটসাইডার্স দের রেসিডেন্সিয়াল এরিয়াতে চিৎকার চেচামেচি শুরু হয়ে গেছে। ছোটাছুটি করে নিরাপদ জায়গায় যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে ওরা। কিন্তু নিরপদ জায়গা কোথায়! ওপাশে তো রেড জোন! সবখানেই যে ওদের মৃত্যু নিশ্চিত!

ওদের সে আতঙ্কিত আর্তচিৎকার কানে এলো অ্যানার। সমুদ্রের দিকে তাকিয় একমনে কিছু ভেবে চলল ও! সব শেষ হয়ে গেছে ওর। কি বাকি আছে আর? কিছুই তো বাকি নেই! কাকে রাগ দেখাচ্ছে ও! কে দেখছে ওর রাগ? কেউ দেখছে না তো! আর রাগে কার কি যায় আসে! কারো কি কিছু যায় আসে ওর অনুভূতিতে!
নিজের মস্তিষ্কের ভেতর নিজের সমস্ত কাছের মানুষ গুলোকে একে একে দেখে নিলো অ্যানা! কে ওর কাছের মানুষ! কে বুঝে ওকে? কেউ কি ওকে বুঝতে চায়? না, কাউকে পেলো না ও!

চোখ জোড়া বন্ধ করে বুক ভরে দম নিলো অ্যানা। তারপর ধীরে ধীরে সমুদ্রের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলো ও। আস্তে আস্তে আলগা করে নিলো ওর শক্ত হয়ে যাওয়া চোয়ালদ্বয়। স্বাভাবিক হয়ে এলো ওর রাগে কুচকে যাওয়া ভ্রু জোড়া। ক্রোধে লাল হয়ে যাওয়া চোখ জোড়াতে এখন রাগের বদলে দেখা দিলো একরাশ হতাশা আর যন্ত্রণা !

সমুদ্রের বিশাল ঢেউ টি আউটসাইডার্স দের রেসিডেন্সিয়াল এরিয়াতে আঘাত হানার আগেই ধীরে ধীরে মিশে গেলো সমুদ্রের সাথে। শান্ত হয়ে এলো সমস্ত শিরো মিদোরি। সেটা দেখে হাঁফ ছেড়ে বাচলো ওরা সকলে! আর একটু হলেই ভেঙে গুড়িয়ে যেত যে সবকিছু!

নিজেকে শান্ত করে নিয়ে ধীর গতিতে ছাদের মেঝেতে বসে পড়লো অ্যানা৷ গলা পাকিয়ে উঠে আসতে চাওয়া কান্নার বিশাল দলাটা একটা ঢোক গিলে আবার নিজের ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে ভেজা গলায় বাচ্চাদের উদ্দ্যেশ্যে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে, ধীর গতিতে বলে উঠলো,

— আমি জানি তোরা আমার কাছে কেন এসেছিস। তোরা আমার কাছে আমার জন্য আসিসনি, আমাই কষ্ট পাবো ভেবে আমাকে সামলাতে আসিসনি! তোরা এসেছিস রাগের মাথায় যেন আমি শিরো মিদোরির কোনো ক্ষতি না করে ফেলি তার জন্য!
তোরা চিন্তা করিস না, আমি আর রাগ করবো না কারো ওপর। শিরো মিদোরির কোনো ক্ষতি আর হবে না কখনো। তোরা এবার যেতে পারিস।

অ্যানার চোখ ফেটে কান্না এলো, নিঃশব্দে। কয়েক ফোটা লোনা পানি চোয়াল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো ওর মেরুণ রঙা গাউনটার ওপর। সাথে সাথেই মেঘ ভেঙে ঝমঝমিয়ে শুরু হলো বৃষ্টি। অ্যানা ঠাই বসে রইলো সেখানে। বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোটা এসে বুলেটের ন্যায় বিধতে থাকলো ওর সারা শরীর জুড়ে।

বাচ্চাগুলো চোখে মুখে অপরাধবোধ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। অ্যানার সাদা রঙা চুল গুলো ভিজে গেলো পুরোপুরি। মেরুণ রঙা পোশাক টা ভিজে উঠে গায়ের সাথে লেপ্টে রইলো।
কোকো কিছুক্ষণ ইতস্তত করে এগিয়ে গেলো অ্যানার দিকে, তারপর বলে উঠলো,

— আম্মা, বৃষ্টিতে ভিজবেন না! আপনার কামরায় ফিরে চলুন৷ এখানে থাকলে আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন।

— আমাকে আর কখনো আম্মা ডাকবি না, তোর আম্মা মরে গেছে!

শান্ত, নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে উঠলো অ্যানা। কোকোর বুক কেঁপে উঠলো অ্যানার কথায়! এক প্রকার আর্তনাদ করে ও ডেকে উঠলো,

— আম্মা!

— আমার কোনো সন্তান নেই, আমিও কারো আম্মা নই। কারো কেউ নই আমি। আমারও কেউ নেই। এই পৃথিবীর কারো সাথে কোনো সম্পর্ক নেই আমার। সবার সাথে সব রকমের সম্পর্ক ছিন্ন করলাম আমি আজ। তোরা চলে যা এখান থেকে। আর কখনো কেউ আমার সামনে আসবি না। তোদের কাউকে দেখতে চাইনা আমি।

আগের মতোই নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে উঠলো অ্যানা। অ্যানার এমন কথায় ঠোঁট উলটে কেঁদে উঠলো ফ্যালকন।

— এমন বলবেন না শেহজাদী। আপনাকে ছাড়া আপনার সন্তান গুলো অসহায় শেহজাদী! আমাদেরকে এভাবে পর করে দিবেন না শেহজাদী, দয়া করুন!

ফ্যালকনের কথায় অ্যানা কিঞ্চিৎ শব্দ তুলে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। তারপর বৃষ্টির বড় বড় ফোটাকে উপেক্ষা করে ছাদের মেঝের ওপর এলিয়ে দিলো নিজের ক্লান্ত শরীর টা। বৃষ্টির ফোটা এসে ছুরিকাঘাতের ন্যায় আঘাত করতে লাগলো ওর চোখে মুখে। ফ্যালকনের কথার প্রতিউত্তরে ও অনুভূতি শূন্যের মতো বলে উঠলো,

— মরে গেছে তোদের শেহজাদী! ও নামে আর কেউ নেই। তোরা চলে যা এখান থেকে। আর কখনো আমার খোঁজ নিতে আসবি না তোরা কেউ। চিন্তা করিস না, আমি কোনো ক্ষতি করবো না কারো। আমি ভালো হয়ে গেছি, আমি আর খারাপ নেই! আমার দ্বারা আর কারো কোনো ক্ষতি হবে না।
এ বৃষ্টিটাও থেমে যাবে, সময় দে একটু, তারপর! চলে যা তোরা এখান থেকে! আমার ওপর নজর রাখার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নেই আমাকে মানানোর, শিশুদের মতোন মিথ্যা আদর ভালোবাসা দিয়ে ভুলিয়ে রাখার! আমি বড় হয়ে গেছি আজ। চলে যা তোরা। আর আসিস না আর আমার কাছে, কখনো!

অ্যানা আর কোনো কথা বলল না। চুপচাপ পড়ে রইলো বৃষ্টির ভেতর। লিও জোভি রা আরও কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে কোকোর ইশারায় চলে গেলো ছাদ থেকে। রইলো শুধু ফ্যালকন আর কোকো। ফ্যালকন এগিয়ে গিয়ে বসলো অ্যানার পাশে। কিন্তু ওকেও সেখান থেকে উঠিয়ে চলে যেতে বাধ্য করলো অ্যানা। অবশেষে বাধ্য হয়ে কোকো ফ্যালকন দুজনে মিলে অ্যানার এলিয়ে দেওয়া শরীর টার দিকে একবার তাকিয়ে ভারী বুক নিয়ে প্রস্থান করলো ছাদ থেকে।

ওরা চলে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে একসময় থেমে গেলো বৃষ্টি। সময় গড়ালো, সন্ধ্যা পার হয়ে রাত নেমে এলো। সারাদিন ধরে অভুক্ত থাকা অ্যানা দুর্বল, ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত শরীরে ভেজা পোশাকে জড়ানো অবস্থাতেই পড়ে রইলো ছাদের ওপর, কাউকে আসতে দিলো না নিজের কাছে, কেউ আসার সাহস ও করলো না৷

মাঝরাতে নিজের নিরবতা ভেঙে অ্যানা ওর বসে যাওয়া ক্ষীণ, দুর্বল কন্ঠে গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠলো,

“You were running through me like water
Now the feeling’s leaving me dry
These days we couldn’t be farther
So how’s it feel to be on the other side?

So many wasted
Nights with you
I still could taste it
I hate it, wish I could take it back, ’cause

We used to be close, but people can go
From people you know to people you don’t
And what hurts the most is people can go
From people you know to people you don’t ”

(people you know, by Selena Gomez)

চলবে…….

( আমার হাতে ব্যাথা প্রচন্ড, তবুও লিখেছি কোনো রকমে। ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে কিছু, রিচেক করিনাই ভালোভাবে। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন 💙)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here