বাদশাহ_নামা #পর্বসংখ্যা_৫২ #অন্তিম_পর্ব #রানী_আমিনা

0
2

#বাদশাহ_নামা
#পর্বসংখ্যা_৫২
#অন্তিম_পর্ব
#রানী_আমিনা

আর্টিফিশিয়াল ভয়েসটি শোনা মাত্রই বুকের ভেতর ধক করে উঠলো অ্যানার। সেই সাথে মাথায় চাপলো ভয়ঙ্কর জেদ। কোনোভাবেই মীরের সামনে আসবে না ও। একফোটাও না! কি পেয়েছে কি ওকে? ওর যখন যা ইচ্ছা হবে তাই করবে আর অ্যানার অনুভূতির সামান্য তোয়াক্কা পর্যন্ত করবে না! বিয়ে তো করেই ফেলেছে ওই মেয়েকে, রাতও কাটিয়ে ফেলেছে কত গুলো, তাহলে এখন আবার কিসের নাটক! কি প্রয়োজন ওর অ্যানাকে? সেটাও তো প্রয়োজন স্বার্থেরই জন্য! অ্যানাকে না দেখলে তো আবার তার ঘুম আসে না, এটাও তো স্বার্থ! এটাও তো নিজের কথাই ভেবে! অ্যানার যে কষ্ট হচ্ছে সেটা ভেবে তো নয়!

এদিকে বাদশাহর ওয়ার্কিং জোনে আসার খবরটা শোনা মাত্রই সমস্ত ওয়ার্কার্স আর আউটসাইডার্স দের ভেতরে হুড়োহুড়ি লেগে গেলো। যে যার কাজ ফেলে চলে তড়িঘড়ি করে চলে এলো মিটিং জোনে, আসার পথে অ্যানাকে দেখলো অনেকে, কিন্তু বাদশাহর উপস্থিতিতে অ্যানার দিকে মনোযোগ দেওয়ার মতো সময় পেলো না তারা। মিটিং জোনে এসে সকলে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে পড়লো সাথে সাথেই; চোখে মুখে তাদের ভয় আর উৎকন্ঠা! হঠাৎ বাদশাহ তাদের ওয়ার্কিং জোনে কেন আসছেন সেটাই ভেবে পেলো না ওরা কেউ।

শার্লট আর ব্রায়ান পড়লো বিপদে, একদিকে অ্যানা চলে যাচ্ছে, অন্যদিকে বাদশাহ এসে উপস্থিত হয়েছেন, কোনদিকে ওরা যাবে ভেবে পেলো না, দোনোমনা করতে শুরু করলো। আর অ্যানা ওদের কে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে দেখে দ্রুত গতিতে ছুট লাগালো মাঞ্জারের পেছন সাইডের দিকে।
আর ওকে ছুটে চলে যেতে দেখেই ব্রায়ান তড়িঘড়ি করে শার্লট কে মিটিং জোনের দিকে যেতে বলে নিজেও ছুটলো অ্যানার পেছন।

কিন্তু অ্যানা ছুটে বেশিদূর যেতে পারলো না। তার আগেই ওর পথ আগলে দাঁড়িয়ে গেলো কোকো, ফ্যালকন আলফাদ আর জোভি। সকলের চোখে মুখে উৎকন্ঠা, অ্যানাকে আটকে রাখার সাধ্য ওদের কারো নেই, তবুও চেষ্টা করতে ক্ষতি কি!
অ্যানা তড়িৎ গতিতে ওদের সবাইকে এক পলক দেখে নিয়ে কঠিন গলায় বলে উঠলো,

— ভালোয় ভালোয় আমার পথ ছেড়ে দে, আমি তোদের কাউকে আঘাত করতে চাইনা৷

অ্যানার কথার ভেতরেই ওর পেছনে এসে পৌছালো ব্রায়ান। সেইফ জোনের ভেতরে হঠাৎ করে এই অচেনা চারজন পুরুষ কে দেখে থমকালো ও! অ্যানাকে ওদের সাথে কথা বলতে দেখে বোঝার চেষ্টা করলো অ্যানার সাথে ওদের কি সম্পর্ক। ওরা কি তাদের লোকজন, যারা অ্যানাকে সেদিন নিয়ে চলে গিয়েছিলো?
ব্রায়ানের বুকের ভেতর ধক করে উঠলো, ছুটে অ্যানার সামনে এসে অ্যানাকে আগলে নেওয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে গেলো ও। তারপর ভীতসন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে কোকো ফ্যালকন দের উদ্দ্যেশ্যে প্রশ্ন করলো,

— কারা তোমরা? অ্যানার কাছে কি চাও?

কোকো ব্রায়ানের কথার কোনো তোয়াক্কা না করে ধীর, সতর্ক পায়ে অ্যানার দিকে এগোতে এগোতে ওকে মানানোর ভঙ্গিতে বলে উঠলো,

— আম্মা! আপনার কাছে হাত জোড় করছি! আপনি আর জঙ্গলে পালিয়ে যাবেন না! প্রাসাদে ফিরে চলুন আম্মা! আপনাদের ভেতরকার ঝামেলা মিটিয়ে ফেলুন না আম্মা! এরকম করবেন না আম্মা, আর অভিমান করে থাকবেন না প্লিজ!

— কোকো, আমার দিকে এগোবিনা, আমাকে যেতে দে! বেশি বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু আমি সবকিছু ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে যাবো! তোদের কে আঘাত করতে চাই না আমি! সরে যা আমার সামনে থেকে!

চোয়াল শক্ত করে, ভ্রু জোড়াতে প্রচন্ড ক্রোধ তুলে হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠলো অ্যানা। ব্রায়ান অ্যানার কন্ঠস্বর শুনে ভড়কালো। সেই সাথে এদের কথোপকথন শুনে দ্বিধায় পড়লো গেলো।
বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে একবার অ্যানা আর একবার কোকোর দিকে তাকালো ও। অ্যানাকে ওই হাতির মতো ছেলেটা আম্মা কেন ডাকছে সেটাই মাথায় এলো না ওর৷ এরা কি তবে একে অপরকে খুব ভালোভাবেই চেনে!
আর যদি চিনেই থাকে তবে এদের ভেতরকার ঝামেলাটা আসলে কি!

কোকো অ্যানার হুঙ্কারে টলল না, ধীর গতিতে আরও কয়েক পা এগিয়ে এসে আবার বলল,

— হিজ ম্যাজেস্টি ভালো নেই আম্মা! আপনি ফিরে চলুন, সব ঠিক হয়ে যাবে আম্মা! আপনি অভিমান করে থাকবেন না আমাদের ওপর! ফিরে চলুন!

অ্যানা বুঝলো এভাবে কাজ হবে না। মাঞ্জারের পেছন দিক থেকে বের হওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে ও এবার ছুটলো যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে৷ ওদিক দিয়ে সেইফ জোন পার হতে ওর দেরি হয়ে যাবে ঠিকই, কিন্তু এ ছাড়া আর উপায় নেই৷

ওকে বিপরীত দিকে ছুটে যেতে দেখে কোকো ফ্যালকনেরাও ওকে ডাকতে ডাকতে ছুটলো ওর পেছন পেছন। ব্রায়ান নিজেও অ্যানাকে ডেকে ফেরানোর চেষ্টা করতে করতে ছুটলো ওদের পেছনে৷

কিন্তু অ্যানা ছুটছে ঊর্ধ্বশ্বাসে! কোনোভাবেই মীরের হাতে ধরা দেবে না ও! ওই প্রাসাদে ও দ্বিতীয়বার আর ফিরবে না। ওটা এখন ওর কাছে জাহান্নামের চাইতেও বেশি যন্ত্রণাদায়ক। যে প্রাসাদে মীরের ওই দ্বিতীয় স্ত্রীর স্পর্শ আছে সেখানে ও কোনোভাবেই ফিরে যাবে না। যে শরীর, যে বিছানা ওই মেয়ে সুস্পষ্ট অধিকার নিয়ে স্পর্শ করেছে সেখানে ও আর কখনোই ফিরবে না!
ওই মানুষ টা আর ওর নেই! ও চায়ও না আর! একবার রেড জোনে পৌছাতে পারলেই আর কেউ খুজে পাবে না ওকে! ধোঁয়াসার ন্যায় বাতাসে মিলিয়ে যাবে ও! কারো সাধ্য হবে না ওকে খুঁজে পাওয়ার!

কিন্তু আরও কিছুদূর যেতেই ওর সামনে ও দেখতে পেলো লিও, কাঞ্জি, হাইনা আর ওকামি কে! লিও ওকে দেখামাত্রই এগিয়ে এসে ব্যাকুল কন্ঠে বলে উঠলো,

— শেহজাদী! আপনি যাবেন না প্লিজ! আমাদের দিকে তাকান একবার! একবার আপনার এই সন্তান গুলোর দিকে তাকান, হিজ ম্যাজেস্টির কথা ভাবুন একবার! উনি ভালো নেই শেহজাদী! আপনিও ভালো নেই হিজ ম্যাজেস্টি কে ছাড়া! ফিরে চলুন শেহজাদী! আর যদি যেতেই হয় আমাদের বুকের ওপর দিয়ে যান শেহজাদী! দয়া করুন আমাদের ওপর!

অ্যানা বুঝলো এরা সকলে প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে এখানে! ওকে কোনোভাবেই বের হতে দেবে না এখান থেকে! নিজের ওপর প্রচন্ড রাগ হলো ওর! কেন ও সকালে উঠেই চলে গেলো না! দাঁতে দাঁত পিষে ও তাকালো লিওর দিকে একবার। এখন এদের সাথে পেচাল করার মতো সময় ওর নেই৷ অ্যানা তড়িৎ গতিতে একবার তাকালো ওর বা দিকে থাকা মিটিং জোনে যাওয়ার রাস্তার দিকে৷ মীর আসলে ওদিক থেকেই আসবে৷ কিন্তু মীর এখনো এসে পৌছায়নি!

একবার ভাবলো ছুটে বেরিয়ে যাবে মিটিং জোন দিয়ে, একবার বের হতে পারলেই আউটসাইডার্স দের রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া পার হয়ে সমুদ্রের দিকে যেতে পারলেই রেড জোনে ঢুকে পড়বে ও।
কিন্তু হঠাৎ করে মীর এসে পড়লে কোন দিকে যাবে ও!

দিশেহারা হয়ে নিজের চারপাশে দেখতে লেগে গেলো অ্যানা৷ অসহায় লাগলো ওর প্রচন্ড। চোখ ফেটে কান্না আসতে চাইলো ওর! নিজের সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে আপন মানুষ টার থেকে ও আজ পালিয়ে বেড়াচ্ছে! যার শরীরের পুরুষালি ঘ্রাণ না পেলে ওর ঘুম আসতো না আজ তার থেকেই ও পালিয়ে বেড়াচ্ছে চিরতরে ঘুমিয়ে যাবার আশায়! যার ইস্পাত-দৃঢ় হাতের স্পর্শ শরীরে না পড়লে ও শান্তি পেতো না, আজ তার স্পর্শ থেকে বাচতেই ও ঝড়ের কবলে পড়া চড়ুই পাখিটির ন্যায় আশ্রয় খুজে বেড়াচ্ছে! যেন সামান্য গর্ত পেলেই সেখানে ঢুকে পড়বে! সেখানে বিষাক্ত সাপের উপস্থিতিতেও তার আর কিছু যাবে আসবে না!

বাচ্চাগুলোকে ও নিজের হাতে করে, আদরে আদরে মানুষ করেছে! এদের শরীরে একটা ফুলের টোকা পড়লেও ওর বুকে লাগে সেটা! এদের যে আঘাত করে ও কিভাবে যাবে! এত মায়া কেন সবখানে? সবকিছু ওকে বেধে ফেলে, ও কেন কাউকে বাধতে পারে না! কেন ওর আপন মানুষ গুলোর প্রতি ওর এত দুর্বলতা! ওর জন্য কারো দুর্বলতা তো ওর চোখে পড়ে না! এ কেমন অবিচার!
এইভাবে ও আর পারবে না, মুক্তি চায় ও সবকিছু থেকে। আজ যা হয়ে যায় যাবে, তবুও ও মীরের কাছে ধরা দিবে না একটা মুহুর্তের জন্যেও! কেউ ওকে রেড জোনে হারিয়ে যাওয়া থেকে আটকাতে পারবে না। আর যদি কোনো বাড়াবাড়ি হয়েই যায়, তবে যে সিদ্ধান্তটা মীরের সাথে প্রতিবার হওয়া পাহাড়সমান মনোমালিন্যের সময় নিতো, সেই সিদ্ধান্তটাই আজ বাস্তবে পরিণত করবে অ্যানা।

কোনোদিকে যাবে ভেবে না পেয়ে হাঁসফাঁস করতে করতে অ্যানা আবার ছুটে যেতে নিলো মাঞ্জারের পেছন দিকের উদ্দ্যেশ্যে। কিন্তু তার আগেই আকাশ কাপানো বজ্রের গতিতে মিটিং জোনে এসে পৌছালো একটি বুক খোলা রোব পরিহিত মীর। আর পৌছেই ওর দৃঢ়, পুরুষালি কন্ঠে উচ্চস্বরে ডেকে উঠলো,

— শিনজো!

মীরের সে মুখনিঃসৃত শব্দে কেঁপে উঠলো সেখানে উপস্থিত সকলের বুক। জীবনে প্রথমবার পঞ্চদ্বীপের বাদশাহ কে নিজেদের এত নিকটে পেয়ে থমকে গেলো ওরা, মাথা নত করে রেখেও শূন্য মস্তিষ্কের মানবশ্রেনীর ন্যায় তাদের সামনে উপস্থিত এই দীর্ঘকায় ব্যাক্তিটাকে দেখতে লেগে গেলো ওরা৷

এই পেশিবহুল, বলিষ্ঠ পরুষালি শরীরের অধিকারী ব্যাক্তিটার সমস্ত মুখখানা জুড়ে তীক্ষ্ণ অভিজাত্যের ছাপ; স্বর্ণালি দ্যুতি ছড়ানো চোখ জোড়ার গভীরে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস, যেন পুরো পৃথিবী তার করায়ত্তে। উঁচু, প্রশস্ত ললাট আর মসৃণ ত্বকের ওপর সকালের সূর্যের আলো ঝরে পড়ে প্রতিফলিত হচ্ছে যেন। গালে কিঞ্চিৎ দাড়ির ছোঁয়া তার চেহারায় জুড়ে দিয়েছে আরও বেশি গাম্ভীর্যতা।

ধীর পায়ে অ্যানার দিকে যাওয়ার জন্য এগোলো মীর, ওর প্রতিটা পদক্ষেপে যেন কেঁপে উঠলো মাটি। এক জীবন্ত কিংবদন্তির ন্যায় ভারী কদমে পা ফেলে সামনে এগোতে থাকলো ও।
ওয়ার্কিং জোনে নেমে এলো পিনপতন নিরবতা! আনুগত্যে নুইয়ে পড়লো সকলে; যেন সিংহ আজ তার গুহা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে অরণ্যের মাঝখানে রাজত্ব করতে।

এক মুহুর্তের জন্য মীর তাকালো ওর ডান দিকে দাড়িয়ে থাকা ওয়ার্কার্স দের দিকে। আড়চোখে তারা এতক্ষণ দেখছিলো এই দীর্ঘদেহী সুপুরুষ টিকে। মীরের চোখে চোখ পড়তেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো যেন তাদের!

ওই চোখ জোড়া জুড়ে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, যেখানে শুধু শাসন করার স্পর্ধাই নয়, আছে অদম্য সাহসের আগুন। সেখানে যেন লুকিয়ে আছে শত যুদ্ধের প্রতিফলন; ওই গভীর এবং গাঢ় দৃষ্টির সামনে যেন কেউ কিছুই লুকোতে পারবে না।
ওই শক্ত চোয়ালদ্বয় যেন তার বিশাল ক্ষমতা আর দৃঢ়তার প্রতীক। মুখের তীক্ষ্ণ রেখা গুলোয় যেন খোদাই হয়ে আছে শক্তির সিলমোহর, যেন দিবালোককে ছাপিয়ে অন্ধকারের সাথেও রয়েছে তার এক অলিখিত বন্ধন।
তার প্রশস্ত, লোমশ বুক যেন প্রতিশ্রুতি দেয় তার ক্ষমতা আর সৌন্দর্যের সামনে সবকিছু নত হতে বাধ্য!

মিটিং জোন আর মাঞ্জারের প্রবেশমুখ থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যানার সমস্ত শরীর জুড়ে বিদ্যুৎ খেলে গেলো যেন। মীরের থেকে পালানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো ও। চারদিক থেকে ওকে আটকে ফেলেছে সবাই! একদিকে কোকো ফ্যালকনেরা দাঁড়িয়ে আছে, অন্য দিকে আছে লিও, কাঞ্জিরা। এদিকে আছে ব্রায়ান আর ওদিকে মীর! ওর সামনে আর পথ খোলা নেই! সব পথ বন্ধ। তবুও ও আর থাকবে না এখানে, চলে যাবেই! তাই যা হয় হবে৷

মীর কোনোদিকে না তাকিয়ে এগিয়ে আসছে ওর দিকে দ্রুত পায়ে। ওর চোখে মুখে ভয়ানক বিষণ্ণতা আর সেই সাথে অ্যানাকে ফিরে পাওয়ার উচ্ছাস; যেন সর্বহারা কোনো ব্যাক্তি বহু সাধনার পর খুঁজে পেয়েছে তার সবচেয়ে মুল্যবান সম্পদ খানি!

মীর কে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে অ্যানা দাঁড়িয়ে গেলো সেখানেই, আর তারপর মীরের দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে চেয়ে, বাঘিনীর ন্যায় গর্জে উঠে বলল,

— যেখানে আছো সেখানেই থাকো! আমার দিকে আর এক পাও যদি আগাও তবে আমি নিজেকে আজ এখানেই শেষ করে দেবো!

কথাটা বলেই নিজের শরীরে থাকা অদৃশ্য আর্মরটার পিঠের নিকট থেকে ও বের করলো একটা ধারালো খঞ্জর। এরপর মীরের দিকে দৃষ্টি রেখেই সেটাকে ডান হাতে ধরে তার ধারালো অংশ চেপে ধরলো নিজের বা হাতের কব্জিতে থাকা শিরার ওপর৷ মীর কাছে এলেই আজ আর দ্বিতীয় বার ভাববে না অ্যানা, সবকিছু শেষ করে দেবে! এই শিরো মিদোরি নামক জাহান্নামে ও আর থাকবে না!

মীর থমকালো! দাঁড়িয়ে গেলো সাথে সাথেই! ওর আর অ্যানার মাঝে এখন কয়েক মিটারের দুরত্ব!
অ্যনার চোখ জোড়ার দিকে দৃষ্টি দিলো মীর। ওর শিনুর চোখ জুড়ে ওর প্রতি চরম বিতৃষ্ণা, আর সেই সাথে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার প্রবল ইচ্ছা!

অ্যানার চোখের ভাষা বোঝামাত্রই মীরের বুকের ভেতরটা জমে গেলো যেন! চোখে মুখে দেখা দিলো স্পষ্ট ভীতি! অ্যানাকে হারানোর ভয় জেঁকে ধরলো ওকে। আঁতকে উঠে ও তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো,

— এরকম কোরো না শিনু! একটিবার আমার কথাটা শোনো! একটু শান্ত হয়ে যাও প্রাণ আমার! খঞ্জর টা হাত থেকে ফেলে দাও প্লিজ! ওইটা ধারালো অনেক, তোমার আঘাত লেগে যাবে! কথা শোনো আমার!

কিন্তু অ্যানা শুনলো না। আগের থেকেও বেশি জোরে চেপে ধরলো খঞ্জরটা। ওর শুভ্র চামড়ায় লাগলো খঞ্জরের ধারালো অংশের আচড়, রক্তিম সরু সরলরেখা দেখা দিলো সেখানে।
এ দৃশ্য দেখে মীরের দম আটকে যেতে নিলো যেন! অ্যানার লাল হয়ে ওঠা কব্জির দিকে তাকিয়ে হাঁসফাঁস করতে শুরু করলো ও!
অ্যানা এর আগে কখনোই এমন করেনি, তাই সে যত বড় কলহই ওদের ভেতর হোক না কেন! প্রতিবারই মীর ওকে ওর অভিমান ভাঙিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে ওর কাছে, কখনোই জমে থাকতে দেয়নি অ্যানার অভিমান!

কিন্তু আজ যদি ওর শিনু ওর ওপর অভিমান করে ভুলেও এরকম কিছু করে ফেলে তবে ও নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবে না! শিনু কে মানাতে হবে, যেভাবেই হোক মানাতে হবে! ওর শিনু না থাকলে ওর সমস্ত পৃথিবীটাই যে অন্ধকার হয়ে যাবে!

মীর সাহস হারালো না। চেহারার দৃঢ়তা ধরে রেখে খুবই মৃদু গতিতে, অ্যানাকে বুঝতে না দিয়ে, অ্যানার দিকে এগোতে এগোতে ও আকুল কন্ঠে বলে উঠলো,

— শিনু, প্রাণ আমার! আমার কথা শোনো শিনু! আমি জানি আমি ভুল করেছি, তোমার সাথে আমি অবিচার করেছি, আর তাতে আমি ভীষণ অনুতপ্ত! কিন্তু আমার ভালোবাসা তো মিথ্যা নয় শিনু!

তোমাকে আমি ভীষণ রকম ভালোবাসি শিনু! তোমাকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ, একেবারেই অসম্পূর্ণ! তোমার হাসি, তোমার স্পর্শ, সবকিছু আমার হৃদয়ের গভীরে প্রতিনিয়ত প্রতিধ্বনিত হয়! আমার প্রতিটি শ্বাসে আমি তোমাকে অনুভব করি! আমি প্রতিটাদিন, প্রতিটা মুহুর্তে আমার মস্তিষ্কের ভেতর তোমার নাম উচ্চারণ করে বুঝি, তুমি ছাড়া আমার সব কিছুই অর্থহীন। তোমার ভালোবাসা ছাড়া আমি নিঃশেষ, তোমাকে ছাড়া আমি কিছুই না।
আমার হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসা শুধুমাত্র তোমার জন্য। তোমার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান স্মৃতি।
তোমার এই নিদারুণ অভিমান আমার হৃদয়ে অবিরাম বিষাক্ত ঢেউ আনে শিনু, ক্ষত-বিক্ষত করে দেয় আমার অন্তরকে! তুমি যে আমার সূর্য, তোমার আলো ছাড়া যে আমি নিকষ অন্ধকারে হারিয়ে গেছি শিনু! তোমার চলে যাওয়া যে আমার হৃদয়ের সমস্ত রঙ কেড়ে নিয়েছে। তোমাকে ছাড়া যে আমি একদম একা শিনু!

ফিরে এসো শিনু আমার কাছে! এখন, এই মুহুর্তে আমি তোমার কাছে আমার ভগ্ন হৃদয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি! অনুরোধ করছি তোমাকে, দয়া করে আবার আমার কাছে ফিরে এসো
আমি জানি তুমি এখন কঠোর হয়ে আছো! কিন্তু সৃষ্টিকর্তার কাছে আমি দুয়া করি আমার এই প্রার্থনা যেন তোমার ওই কঠিন হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়, যেন তুমি বুঝতে পারো তোমাকে ছাড়া আমি কতটা অসহায়!
তুমি যদি আমাকে আজ ফিরিয়ে দাও, অভিমানভরে আমার থেকে দূরে চলে যাও তবে আমি আমার সমস্ত সুখ হারিয়ে ফেলবো শিনু। তোমার চলে যাওয়া হবে আমার আত্মার শেষ নিঃশ্বাস।
তুমি আবার ফিরে এসো শিনু আমার কাছে! যেন তোমার কাঁধে মাথা রেখে বাকি জীবনটা আমি বুক ভরা শান্তি নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারি! তোমার হাসি, কান্না, রাগ অভিমান, ভালোবাসা, তোমার সবকিছুকে প্রতিটা মুহূর্তে আমি অনুভব করতে চাই শিনু! ফিরে এসো আমার কাছে! প্লিজ!”

আকাশ জুড়ে মেঘের ঘনঘটা, সাথে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি! অ্যানা ছলছল চোখে এতক্ষণ মীরের বলা কথা গুলো শুনছিলো মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায়। মীর যে কথা বলতে বলতে কখন ওর কাছে এসে পৌছেছে সেটা ও ঘূর্ণাক্ষরেও টের পায়নি। আর যখন টের পেলো ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে৷

অ্যানা মীরের আয়ত্তের ভেতর থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে নিতেই মীর ক্ষীপ্র গতিতে ধরে ফেললো ওকে। তারপর সর্বশক্তি দিয়ে অ্যানার হাত থেকে খঞ্জর টা ছিনিয়ে নিয়ে ছুড়ে দিলো কোথাও, আর এরপর নিজের সাথে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিতে চাইলো অ্যানাকে!

কিন্তু অ্যানা সেটা হতে দিলো না। নিজের শরীর টাকে মীরের শক্ত আলিঙ্গন থেকে, মীরের ইস্পাত-দৃঢ় হাতের স্পর্শ থেকে ব্যাকুল হয়ে ছাড়িয়ে নিতে নিতে আর্তনাদ করে বলে উঠলো,

— ছুইয়ো না আমাকে! একদম ছুইয়ো না! যে হাত দিয়ে তুমি ওই মেয়ের শরীরে স্পর্শ করেছো সেই হাত দিয়ে তুমি আমাকে ছোবে না! কোনোদিনও ছোবে না! ঘেন্না করি আমি তোমার স্পর্শ, ঘেন্না করি তোমাকে! ছেড়ে দাও আমাকে!

মীর ছাড়লো না! সর্বশক্তি দিয়ে অ্যানাকে নিজের বুকের সাথে লাগিয়ে রেখে অসহায় কন্ঠে বলে উঠলো,

— আমার কথা শোনো! ওকে আমি বিয়ে করিনি শিনু! স্পর্শ করিনি আমি ওকে! বিশ্বাস করো আমাকে! এরকম কোরো না! শান্ত হও প্রাণ আমার! আমি শুধুমাত্র তোমার, আর অন্য কারো না!

কিন্তু অ্যানা শান্ত হলো না! মীরের কোনো কথাই কানে গেলো না ওর! ওর মস্তিষ্ক শুনতে দিলো না ওকে কিছু, ওর মীর অন্য কোনো নারীকে ওর মতোই অধিকার দিয়েছে, ওর মতোই আদর দিয়েছে, ওর মতোই স্পর্শ দিয়েছে, এ খবরটাই ওর মস্তিষ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে ওর প্রতিটা নিউরনে, ওর শরীরে ছুটে চলা প্রতিটা রক্তকণিকায়! মীরের কোনো কথা ঠাই পেলো না সেথায়!

আর এরপর হঠাৎ করেই মীর কে অবাক করে দিয়ে প্রচন্ড শক্তি দিয়ে মীরের বুকে ধাক্কা দিয়ে নিজেকে মীরের আলিঙ্গন থেকে ছাড়িয়ে নিলো অ্যানা! আর তারপর দিকবিদিকশুন্য হয়ে ছুটতে শুরু করলো রেড জোনের দিকে!

কোকো ফ্যালকন সহ সমস্ত বাচ্চা গুলো ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এসে ওকে আটকানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু ওদের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে ওদের কে আঘাত করেই ওদের মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে চলে গেলো অ্যানা৷ অ্যানার আঘাতে ছিটকে পড়লো ওরা চারদিকে!

অ্যানার ছুটে চলে যেতেই মীর এক মুহুর্তও দেরি না করে ছুটলো ওর পেছন পেছন! বার বার ওকে ডেকে থেমে যেতে বললো মীর, কিন্তু মীরের কোনো কথাই কানে গেলো না ওর!
বাচ্চারা মাটি থেকে কোনোরকমে উঠে ছুটলো মীরের পেছন পেছন! শেহজাদীকে এবার হারিয়ে ফেললে যে আর কখনো পাবে না!

অ্যানা ছুটছে, ছুটছে! কোথায় ওর পা পড়ছে সেটা দেখার প্রয়োজন মনে করছে না! দম ধরে ছুটে চলেছে! গন্তব্য ওর নির্ধারিত, লাইফ ট্রি!
দেমিয়ান শেহজাদীরা লাইফ ট্রির সাথে কানেক্টেড! কোনো শেহজাদী যদি একবার লাইফ ট্রির ভেতর ঢুকে পড়ে তবে লাইফ ট্রি চিরকালের জন্য তাকে নিয়ে নিবে নিজের ভেতরে! নিজের অর্ধজীবিত, অর্ধমৃত, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সমৃদ্ধ শরীরের সাথে শেহজাদীর শরীরের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মিশিয়ে নিয়ে তৈরি করবে নিজের নতুন শক্তি! শিরো মিদোরি তখন হয়ে উঠবে আরও প্রাণবন্ত, আরও আকর্ষণীয়! প্রকৃতি হয়ে উঠবে আরও সতেজ! এক শেহজাদী আছে যে এ প্রকৃতিতে মিশে!

অ্যানাও মিশে যাবে এ প্রকৃতির সাথে! ওর জন্মই তো হয়েছে শিরো মিদোরির প্রকৃতির জন্য, শিরো মিদোরির খেয়াল রাখার জন্য! মীরও তো ওকে শুধুমাত্র চায় নিজের জন্য, নিজের শান্তির জন্য! ওর শান্তির কথাটা তো ভাবার প্রয়োজনই মনে করেনা!
সবাইকে এবার শান্তি দিবে ও! চারদিক টা প্রশান্তিতে ছেয়ে দেবে! নিজের সব সৌন্দর্য বিলিয়ে দিবে এই প্রকৃতিতে, নিঃশেষ করে দিবে নিজের অস্তিত্ব! কারো কোনো কিছুতে আর হস্তক্ষেপ করবে না ও! অনধিকার চর্চা করবে না, থাকুক সবাই তাদের মতো করে, যেভাবে ইচ্ছা! ও না হয় দূর থেকে অনুভব করবে সবকিছুকে!

এই শিরো মিদোরি, ওর মীর, ওর কোকো, ওর ফ্যালকন, ওর লিন্ডা, ওর সমস্ত বাচ্চাগুলো, শার্লট, ব্রায়ান, ফাতমা, ইয়াসমিন সবাইকে দূর থেকেই না হয় অনুভব করবে ও! সবার সুখ, দুঃখ, হাসি কান্না কে ও দূর থেকেই পরখ করে দেখবে!
তাতেই হবে, ওর দুঃখ গুলো কেউ না দেখুক সব সময়ের মতো! সুপ্ত থাকুক সেগুলো ওই প্রকৃতির ভেতরে। মীরের সন্তান গুলো নির্ভয়ে বড় হোক এই প্রকৃতিতে, এগিয়ে নিয়ে যাক এই সাম্রাজ্য কে অনেক অনেক দূরে! ও না হয় কোনো ছুতোয় নিজের পরিবর্তিত শরীরের স্পর্শ দিয়েই ছুয়ে দেখবে ওদের! ওরা ওর গর্ভের না হোক, মীরের ঔরসজাত সন্তান হবে তো! মীরের ছায়া থাকবে তো ওদের শরীর জুড়ে! তাতেই হবে! তাতেই খু্‌শি থাকবে ও!

এক ছুটে এসে লাইফ ট্রির সামনে এসে থমকে দাড়ালো অ্যানা। তারপর লাইফ ট্রির দিকে অনুভূতিশূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠলো,

— ওপেন ইয়্যোর ড্যোর! টেইক ম্যি ইনসাইড ইয়্যু। এমব্রেইস মি!

মীর অ্যানার কিছুটা পেছনেই ছিলো, অ্যানার কথা গুলো কানে যেতেই চমকালো ও!
না না না! এটা কখনো হতে পারে না! ওর শিনু ওকে ছেড়ে চলে যেতে পারে না কোথাও, কোনোভাবেই না! এটা ও কোনোভাবেই হতে দেবে না! ও শেষ হয়ে যাবে!

অ্যানার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে ছুটে আসতে আসতে ও ডুকরে কেঁদে উঠে আর্তনাদ করে বলল,

— শিনু! যেও না প্রাণ আমার! যেওনা ওখানে! আমাকে একা করে রেখে যেও না কলিজা আমার!

কিন্তু ওর কথার ভেতরেই অদ্ভুত শব্দ করে খুলে গেলো লাইফ ট্রির বুকটা, ভেতর থেকে টিকরে পড়লো ধোয়া যুক্ত অদ্ভুত আলো! অ্যানা মীরের দিকে এক পলক তাকিয়ে ফিরে তাকালো লাইফ ট্রির দিকে, তারপর এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলো লাইফ ট্রির খোলা দরজার দিকে! ওকে এগিয়ে আসতে দেখে লাইফ ট্রির বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো লতাপাতা যুক্ত সিড়ি, যা ওকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এগিয়ে এলো ওর দিকে! বাড়িয়ে দিলো লাইফট্রির অদ্ভুত ডালগুলো, যেগুলো ক্রমে ক্রমে জড়িয়ে নিতে শুরু করলো অ্যানাকে!

মীর সেই মুহুর্তে ছুটে এসে হাটু গেড়ে বসে পড়লো অ্যানার পায়ের কাছে, তারপর ওর উরু জোড়া জড়িয়ে ধরে লাইফ ট্রির নিকট থেকে সরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে করতে হাউমাউ করে বাচ্চাদের ন্যায় কেঁদে উঠে বলল,

— ক্ষমা করো আমাকে, আমাকে ছেড়ে যেও না! বাচবো না আমি তোমাকে ছাড়া, মরে যাবো আমি! সব ছেড়ে দেবো আমি, ছেড়ে দেবো ওই সাম্রাজ্য, শুধু তুমি থাকো আমার কাছে! চাইনা আমার বাচ্চা, চাইনা আমার সাম্রাজ্য! আমার শুধু তোমাকে চাই শিনু, শুধু তোমাকে! যেও না ওখানে, ফিরে চলো আমার সাথে! ফিরে চলো প্রাণ আমার! এতটা কঠিন হইয়ো না শিনু!

কিন্তু অ্যানা শুনতে পেলোনা ওর কথা, ততক্ষণে লাইফট্রির বুক থেকে বেরিয়ে আসা শিকড় গুলো জড়িয়ে নিয়েছে ওর হাত, মুখ, গলা, বুক, পেট! ওর মস্তিষ্ক আর ওর নিয়ন্ত্রণে নেই, সেটা চলে গেছে লাইফ ট্রির নিয়ন্ত্রণে!

নিজের সমস্ত অনুভূতি হারিয়ে ফেলার ঠিক আগ মুহুর্তে অ্যানার চোখের সামনে স্বপ্নের মতো ভেসে উঠলো মীরের সাথে কাটানো ওর সমস্ত সুন্দর সুন্দর মুহুর্ত গুলো, সবকিছু ছেড়ে যাওয়ার যন্ত্রণায় ওর শূণ্য হ্যে যাওয়া চোখ জোড়া থেকে কয়েকফোটা লোনা জল গড়িয়ে পড়লো ওর গাল বেয়ে, অস্ফুটস্বরে একবার ডেকে উঠলো,

— মীর!

ওর উরু জোড়া আকড়ে ধরে ওর কোমল তলপেটে মুখ ডুবিয়ে, রেড জোনটাকে কাপিয়ে ওকে হারানোর যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে থাকা মীরের কর্ণগোচর হলো না সেটা। লাইফ ট্রি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো অ্যানাকে, আর তারপর ধীরে ধীরে টেনে নিতে থাকলো নিজের ভেতর!

মীর ছাড়তে চাইলো না ওকে, বার বার করে জড়িয়ে ধরলো অ্যানাকে। ধীর গতিতে অ্যানার সমস্ত শরীর টা ঢুকে যেতে থাকলো লাইফ ট্রির ওই অদ্ভুত আলোকরশ্মির ভেতর! মীর অ্যানার শরীর টাকে আকড়ে ধরে রইলো সর্বশক্তি দিয়ে, কিন্তু আটকাতে পারলো না ওর শিনু কে, ওর থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে লাইফ ট্রি নিয়ে নিলো সমস্ত অ্যানাটাকে!

মীর আর্তনাদ করে উঠলো আবারও, আকড়ে ধরতে চাইলো অ্যানার মোলায়েম পা জোড়াকে, কিন্তু পারলো না! তার আগেই অদ্ভুত শব্দ হয়ে বন্ধ হয়ে গেলো লাইফ ট্রির বুকের দরজাটা!

মীর মানলো না, মানতে চাইলো না ওর মস্তিষ্ক, মানতে চাইলো না ওর মন! ওর শিনু নেই, ওর শিনু নেই! কোথাও নেই!
হাঁসফাঁস করতে করতে লাইফট্রির বুকের কাছটাকে ছিড়ে ফেলতে চাইলো দুহাতে! আর্তনাদ করে লাইফট্রির উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,

— ফিরিয়ে দাও আমার শিনু কে! আমার শিনু কে নিও না! ও থাকতে পারবে না আমাকে ছাড়া! ওকে ফিরিয়ে দাও আমার বুকে! ফিরিয়ে দাও ওকে এখনি!

কিন্তু কেউ শুনলোনা ওর আর্তনাদ! স্তব্ধ হয়ে রইলো সমস্ত রেডজোন! লাইফট্রি অ্যানাকে নিজের ভেতরে টেনে নিয়ে আবার নিস্তেজ হয়ে গেলো, মীরের আর্তনাদে সাড়া দিলো না একটুও! আর মীর লাইফট্রির শক্ত বাকলের ওপর দিয়ে যত্রতত্র আঘাত করতে করতে ডেকে উঠলো বারবার, শিনু, শিনু, শিনু, শিনু! ফিরে আসো!

বাচ্চা গুলো স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো! নিজেদের চোখের সামনে শেহজাদীকে হারিয়ে যেতে দেখে নির্বাক হয়ে গেলো ওরা! কোকো ধপ করে বসে পড়লো মাটিতে! ওর বিশ্বাস হচ্ছে না এখনো, ওর আম্মা নেই! চলে গেছে, চিরদিনের জন্য!
ফ্যালকন সহ্য করতে পারলো না, অস্ফুটস্বরে একবার শেহজাদী’ শব্দটা উচ্চারণ করেই জ্ঞান হারালো ও! জোভি ওকে আগলে নিলো দ্রুত!

মীরের চোখ মুখ উদভ্রান্ত! বড় বড় দম ফেলতে ফেলতে ও ডেকে উঠছে বার বার, শিনু, আমার শিনু!
অসহায় চোখে নিস্তেজ হয়ে যাওয়া লাইফ ট্রির দিকে তাকিয়ে দুর্বল পায়ে ও সরে এলো দুকদম! আর ঠিক সেই মুহুর্তেই একটা বিষাক্ত তীর সাই করে এসে লাগলো ওর খোলা বুকে, হৃৎপিণ্ড বরাবর!
মুহুর্তের জন্য থমকালো মীর, ভ্রু জোড়ায় ফুটে উঠলো অসম্ভব যন্ত্রণার ছাপ। দুর্বল ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে এক পলক দেখলো ওর বুকে বিধে যাওয়া তীর টির দিকে! আর তার পরমুহূর্তেই সাই সাই করে এসে ওর বুক জুড়ে বিধলো আরও চারটা তীর!

তীরগুলোর আগমনস্থলের দিকে একবার তাকালো মীর, তীক্ষ্ণ চোখে একবার দেখে নিলো ওকে আক্রমণকারী ব্যাক্তিটাকে! আর পরক্ষণেই মারাত্মক বিষের প্রভাবে টলে গেলো ওর পা জোড়া! বলিষ্ঠ, ভারী শরীর টা টলতে টলতে, পেছন দিকে সরতে সরতে ধাম করে পড়ে গেলো রেড জোনের মাটিতে। মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এলো একটি শব্দ, ‘শিনু’!

আওয়াজ শুনে সেদিকে তাকাতেই চিৎকার করে উঠলো কোকো! ছুটে চলে গেলো মীরের নিকট! অন্য বাচ্চাগুলো সচকিত হয়ে উঠলো সাথে সাথে!

লিও শত্রুপক্ষের উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্রই চিৎকার দিয়ে ডেকে উঠলো,

— সৌলজার্স!

মুহুর্তেই রেড জোন আর সেইফ জোনের বর্ডারে অদৃশ্য অবস্থায় থাকা রোবোটিক গার্ড গুলো দৃশ্যমান হয়ে জেগে উঠলো, আর এরপর নিজেদের অস্ত্রগুলো তুলে নিয়ে এগোলো শত্রুপক্ষের দিকে।
বাচ্চারা বিষের প্রভাবে অচেতন হয়ে পড়া মীর কে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা শুরু করে দিলো।
কিন্তু ঠিক সেই মুহুর্তেই ওদের বিপরীত দিক থেকে ধেয়ে আসতে শুরু করলো ডার্ক প্যালেসের সৈন্যরা! মুহুর্তেই সেইফ জোনের গার্ড আর ডার্ক প্যালেসের সৈন্যদের ভেতরে শুরু হয়ে গেলো তুমুল লড়াই!
তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের মুহুর্মুহু শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকলো রেড জোন!

দূরে দাঁড়িয়ে, অচেতন হয়ে মাটিতে পড়ে থাকা মীরের বলিষ্ঠ শরীর টার দিকে দৃকপাত করে ইলহান বাকা হেসে স্বগতোক্তি করলো,

— আহ, ম্যেকিং দ্যা মোস্ট অব অ্যান অপরচুনিটি!

( #বাদশাহ_নামা এর প্রথম পরিচ্ছেদ এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পরিচ্ছেদ নিয়ে আপনাদের মাঝে ফিরে আসবো খুব দ্রুতই। ততদিনে যেন আমাকে আবার ভুলে যাবেন না!)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here