#হৃদয়ে_রক্তক্ষরণ
#পর্বঃ১০
#লেখিকাঃমেহের_আফরোজ
“নিধি নির্জনের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বললো,
‘অপেক্ষার প্রতিশোধ অপেক্ষা দিয়ে
যন্ত্রণার প্রতিশোধ যন্ত্রণা দিয়ে,
মৃ**ত্যুর প্রতিশোধ মৃ**ত্যু দিয়ে,
আর ধা’ক্কার প্রতিশোধ নিতে হয় ধা’ক্কা দিয়ে।”
“নিধির মুখনিঃসৃত কথাগুলো শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো নির্জন।হাতে প্রচন্ড ব্যথা নিয়ে ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিধির দিকে গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,’এভাবে বাঁকা নজরে তাকাবেন না,আমার নজর লেগে যাবে ডার্ক কুইন।’বলেই ব্যথাতুর মুখ নিয়েই ঠোঁটের কোণা হালকা প্রসারিত করলো নির্জন।”
“নির্জনের এহেন কথায় ভড়কে গেলো নিধি।কিছু একটা ভেবে পরক্ষণেই মুখ ভেং**চি কে**টে বললো,’আমার দিকে আপনার নজর পড়লে,আপনার নজর স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে সোজা করে দিবো নির্জ….
“উহুমম এই নামে আমায় সেদিন ডাকবেন,যদিন পুনরায় আমাদের সাক্ষাৎ হবে।হ্যাপি জার্নি।’কথাগুলো বলে নির্জন নিজের কা**টা হাতের দিকে তাকালো।”
“নিধি আর একমুহূর্তও সেখানে অপেক্ষা করলো না।ছু**রি টা নদীর তীরে ফেলে, চলে গেলো নিজ গন্তব্যে।নিধি কে দেখে রফিক মির্জা ওকে জড়িয়ে ধরলেন।তারপর দুই মেয়ে কে পাশে নিয়ে আবেগী স্বরে বললেন,’তোমাদের দু’জনের ফোন বন্ধ পেয়ে আমার আর তোমাদের মায়ের নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছিলো।তোমরাই তো আমাদের দুই পৃথিবী।তোমাদের ঘিরেই আমাদের সকল সুখ।এই ভুল আর কখনোও করবে না।আমার হাতে হাত রেখে কথা দাও।”
“নিধি এবং তোহা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে ওদের বাবার হাত ধরে একসাথে বললো,’কথা দিলাম বাবা আর কখনোও তোমাদের কথার অবাধ্য হবো না।’নিধি কান্নারত অবস্থায় বললো,’এখন থেকে তোমার নিরুপমা দস্যিপনা ছেড়ে দিয়ে, তোমার ভালো মেয়ে হওয়ার চেষ্টা করবো বাবা।তুমি আমায় ক্ষমা করে দাও।”
“নিধির কোমল স্বরে এতোটা নমনীয় ভাষায় কথা শুনে, রফিক মির্জা খুব খুশি হয়ে গেলেন।এদিকে নাদিয়া এখনও ওর বাবা কে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।দিগন্ত সেদিকে তাকিয়ে ভাবছে,’ইশশ!এই কান্না টা যদি আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদত, তাহলে আমি এতক্ষণে অন্যকিছু শুরু করে দিতাম।কবে যে সেই শুভক্ষণ আসবে আল্লাহ জানে।’ভেবে ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছাড়লো দিগন্ত।”
“রফিক মির্জা এবং জহির সাহেব পুলিশ অফিসার সহ পুরো টিম কে অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন।পুলিশ অফিসার নিধি,নাদিয়া এবং তোহাকে কিছু জ্ঞানের বাণী শোনালেন।ওরা চুপচাপ সেগুলো শুনে মাথা নাড়িয়ে (আচ্ছা,হা,হুম) জবাব দিলো।”
“রফিক মির্জা এবং জহির সাহেব নিধি,নাদিয়া এবং তোহাকে গাড়িতে উঠে বসতে বললেন।জহির সাহেব বললেন,’এই গাড়িতে জায়গা কম,আমি পুলিশের গাড়িতে উঠে যাই।তোমরা পেছনের সিটে বসো,আর রফিক ভাই আপনি ড্রাইভারের পাশে বসুন।”
“রফিক মির্জাও জহির সাহেবের মতো একই বাক্য আওড়ালেন।কিন্তুু জহির সাহেব তার কথায় অটল থেকে পুলিশের গাড়িতে গিয়ে বসলেন।”
“পুলিশের গাড়ি চলতে শুরু করেছে।নিধিদের গাড়ির ড্রাইভার যখনই গাড়ি স্টার্ট দিবে,তখনই নাদিয়া বললো,’আমার না মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে।তাছাড়া ঘামে পুরো মুখমণ্ডল ভিজে গেছে।আমি একটু নদীর তীরে গিয়ে নদীর পানি দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে আসি,তাহলে হয়তো ভালো লাগবে।বেশি সময় লাগবে না;মাত্র ৫মিনিটের মধ্যেই চলে আসবো।”
“নাদিয়ার কথা শুনে তোহাও একই কথা বললো।নিধি চুপচাপ কপালে হাত দিয়ে, গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে।রফিক মির্জা বললেন,’ঠিকাছে যাও।’নাদিয়া এবং তোহা হাসি মুখে গাড়ি থেকে নামলো।”
“নির্জন সবেমাত্র নদী থেকে উঠে ড্রেস চেঞ্জ করে ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে, হাতে ব্যান্ডেজের মতো করে বেঁধেছে।তখনই দেখলো, নাদিয়া এবং তোহা নদীর পারে যাচ্ছে।ওদের দু’জন কে নদীর পারে যেতে দেখে, নির্জনের মাথায় শ**য়তানি বুদ্ধির উদয় হলো।নির্জন নিধিদের গাড়ির দিকে গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে,বিড়বিড় করে কিছু বলতে থাকল।এই মুহূর্তে নির্জন কে দেখলে যে কেউ অকপটে ভেবে নেবে যে, নির্জন খাতা-কলম ছাড়া বিড়বিড় করে কোনো অংকের হিসাব মেলাচ্ছে।”
“নির্জনের হিসাব টা এইরকম,’নিধির বাবা এবং ড্রাইভার সামনের সিটে বসেছে।নিধি,নাদিয়া এবং তোহা পেছনের সিটে বসেছে।এই মুহূর্তে নাদিয়ার যদি কিছু একটা হয়ে যায়,তাহলে ওর সব ভার স্বাভাবিক ভাবেই নিধির বহন করতে হবে।তোহা কখনোই নাদিয়াকে নিজের ঘাড়ে নিবে না।’কথাগুলো একমনে বিড়বিড় করে বলে, কপালে চার আঙ্গুল দিয়ে স্লাইড করে কু**টিল হাসলো নির্জন।”
“ব্যথাতুর হাতে ব্যান্ডেজের দিকে একবার গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ডেভিল হেসে বললো,’এরা তো দেখছি আমার ভাবনাগুলো কে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য সবসময় প্রস্তুুত হয়ে থাকে।ভেবেছিলাম,এইবার হয়তো শাস্তি টা না দিতে পারলেও, ঢাকা গিয়ে বন্ধুর গার্লফ্রেন্ড কে শাস্তি দিয়ে সবকিছু শোধবোধ করে দিবো।কিন্তুু মেয়েটা তো দেখছি, আমার আগে থেকে প্ল্যান করা কাজ টা খুব সহজে বাস্তবায়ন করার সুযোগ করে দিলো।সত্যি মানতেই হবে,’লেডিস ফার্স্ট।”
“নির্জন একমনে কথাগুলো বলে ভাবলো,’আমার হাত কা**টার শাস্তি তুমি অবশ্যই পাবে ডার্ক কুইন।তবে একটু অন্য ভাবে।
‘ব্যথার প্রতিশোধ নেবো ব্যথা দিয়ে।’ভেবে ব্যাগ থেকে খুব প্রয়োজনীয় একটি জিনিস বের করে,ঝটপট সেটা পরিধান করলো।”
————-
“নাদিয়া এবং তোহা নদীর পারে বসে মুখে,হাতে-পায়ে পানি দিলো।নাদিয়া বললো,’এখন একটু ভালো লাগছে।তোহাও মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে একই কথা বললো।”
“সোডিয়ামের টিমটিমে আলোতে হঠাৎ নাদিয়ার চোখ জোড়া আটকে গেলো, কিছুটা দূরত্বে নদীর বুকে ভেসে ওঠা একটি অদ্ভুত প্রাণীর দিকে।নাদিয়া তোহা কে বললো,’তোহা দেখো নদীতে কিছু একটা ভাসছে।’তোহা সেদিকে তাকিয়ে বিস্ময়ের স্বরে বললো,’আরে এতো দেখছি জলপরা।”
“নাদিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘জলপরা মানে?”
“আরে তুমি টিভিতে দেখোনি, যে নদীর বুকে জলপরী ভেসে বেড়ায় তাদের শরীর কিছুটা মানুষের মতো।শুধু নিচে লেজের মতো থাকে।আর মাথায় একটু বড় চুল থাকে।ওটাকে বলা হয় ‘জলপরী’।আর এটার যেহেতু মাথায় কোনো চুল দেখা যাচ্ছে না।এর মানে এটা হলো ‘জলপুরুষ’ মানে ‘জলপরা’।ওয়াও শেষ মুহূর্তে এতো কাছ থেকে এমন একটা জিনিস দেখবো, কখনো কল্পনাও করিনি।আমি তো ভাবতাম এগুলো কাল্পনিক।এখন দেখছি সত্যি।আমি যাই নিধি আপু কে ডেকে আনি।আপু দেখলে খুব খুশি হবে।’বলেই তেহা দৌড়ে চলে গেলো।”
“এদিকে নাদিয়া হা করে সেই উদ্ভট প্রাণীর দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।হঠাৎ নাদিয়া খেয়াল করলো,প্রাণীটি ওর দিকেই সাঁতার কেঁটে আসছে।এটা দেখে নাদিয়া তো স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে গেলো।ভাবলো,’এটা কি আমাকে দেখে ফেলেছে নাকি?আমার দিকেই তো আসছে মনে হয়।”
“নাদিয়ার ভাবনার মধ্যেই, প্রাণীটি নদীর পারে এসে চোখের পলকে নাদিয়ার হাত ধরে দিলো এক টান।চোখের সামনে এমন অদ্ভুত রকমের চুল বিহীন প্রাণী দেখে, নাদিয়া ভ**য়ে দিলো এক চি**ৎকার।নাদিয়া জোর গলায় চি**ৎকার করতেই, প্রাণীটি তার মুখোশে মোড়ানো হাত টি ছেড়ে দিয়ে ডুবসাঁতার কেঁটে,সেখান থেকে দ্রুত গতিতে প্রস্থান করলো।”
“দিগন্ত মন খারাপ করে নদীর পার দিয়ে হাটছিলো,আর নির্জন কে খুঁজছিলো।তখনই কর্ণকুহরে নাদিয়ার চি**ৎকার ভেসে আসতেই,দিগন্ত জোর কদমে সেখানে গিয়ে দেখলো,নাদিয়া নদীর পারে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে।নাদিয়ার চি**ৎকার গাড়ি থেকে রফিক মির্জা সহ সবাই শুনেছে।তারা খুব ভ**য় পেয়ে, তড়িঘড়ি করে ড্রাইভার সহ গাড়ি থেকে নেমে নদীর পারে চলে গেলো।”
“এদিকে দিগন্ত দৌড়ে গিয়ে নাদিয়াকে কোলে তুলে নিয়ে রাস্তায় এলো।নিধি এগিয়ে গিয়ে উত্তেজিত স্বরে বললো,’কি হয়েছে নাদিয়ার?ও এভাবে চি**ৎকার করলো কেনো?আর ওর এমন অবস্থা হলো কি করে?বালিতে ওর পুরো কাপড় নষ্ট হয়ে গেছে।”
“রফিক মির্জা দিগন্ত কে দেখে এই জায়গার বাসিন্দা ভেবেছেন।তিনি দিগন্ত কে উত্তেজিত স্বরে বললেন,’কি হয়েছে নাদিয়ার?তুমি কিছু বলতে পারবে?”
“দিগন্ত রফিক মির্জার দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ‘আমি নদীর পার দিয়ে হাঁটছিলাম।তখনই নদীর পার থেকে ওর চি**ৎকারের শব্দ শুনতে পেয়ে, সেখানে গিয়ে দেখি ও সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে।হয় তো মাথা ঘুরে পড়ে গেছে।”
“নিধি ভাবুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,’মাথা ঘুরে পড়ে গেলে, এতো জোরে চি**ৎকার করবে কেনো?’নিধির সাথে তাল মিলিয়ে তোহাও একই কথা বললো।পরক্ষণেই,তোহার সেই জলপুরুষের কথা মনে পড়ে গেলো।তোহা বুঝতে পারলো,’নাদিয়া আপু কে ওখানে একা রেখে আসা উচিত হয় নি।হয়তো গুমোট অন্ধকারে চোখের সামনে এমন অদ্ভুত প্রাণী দেখে ভ**য় পেয়ে সেন্সলেস হয়ে গেছে।’ভেবে তোহা নিধির কানে খুব নিচুস্বরে নদীর পারে ঘটে যাওয়া কথাগুলো বললো।তোহার কথা শুনে নিধি সবকিছু বুঝতে পারলো।ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছেড়ে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে বললো,’ভাইয়া হেল্প করার জন্য অনেক ধন্যবাদ। এখন দয়া করে নাদিয়া কে আমাদের গাড়িতে তুলে দিন প্লিজ।”
“দিগন্ত ভাবলো,’ভালোই তো লাগছিলো বিয়ের আগে জেদি গার্লফ্রেন্ডের নরম তুলতুলে শরীর টা কোলে নিতে।ধুর..বেশি সুখ কপালে সয় না।চাইলেও এখন আর কোলে রাখতে পারবো না।সমস্যা নেই বিয়ের পর ভালোভাবে পুষিয়ে নেবো।’ভেবে দিগন্ত নাদিয়া কে নিয়ে গাড়ির সিটে বসালো।”
“অচেতন নাদিয়া কে সিটের মাঝখানে বসানো হলো।নাদিয়ার দুই পাশে নিধি এবং তোহা বসলো।ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিতেই, নাদিয়ার মাথা ঢলে পড়লো নিধির কাঁধের ওপর।জঙ্গলের মধ্যে এতো দ্রুত দৌঁড়ানোর ফলে, নিধির শরীর এমনিতেই খুব ক্লান্ত।সেখানে নাদিয়ার মাথা এভাবে ওর কাঁধের ওপর পড়াতে, নিধি কাঁধে খুব ব্যথা পেলো।নাদিয়া অচেতন হওয়ায়,ওর শরীরের পুরো ভরটাই নিধির ওপর ছেড়ে দিয়েছে।নাদিয়ার মাথা টা নিধির কাছে ভারী পাথরের মতো মনে হচ্ছে।’বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে নিধি নাদিয়ার মাথা টা কাঁধ থেকে সরিয়ে, ঠিকঠাক ভাবে সিটে রাখলো।”
“কিন্তুু আজ গাড়ি টাও হয়তো নিধির সাথে বেইমানি করছে।কিছুক্ষণ পরপর গাড়ি ব্রেক করলেই, নাদিয়া আবারও নিধির কাঁধের ওপর ঢলে পড়ছে।নিধি এইবার বিরক্ত হয়ে ড্রাইভারের কাছ থেকে পানির বোতল নিয়ে,হাতে পানি ঢেলে নাদিয়ার চোখে-মুখে ছিটিয়ে দিতেই, ধরফরিয়ে নাদিয়া উঠে বসলো।চোখজোড়া অর্ধেক মেলে চারিদিকে তাকিয়ে, আবারও জ্ঞান হারালো।”
“নাদিয়ার এই অবস্থা দেখে নিধির চি**ৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।গাড়ি আবারও ব্রেক কষতেই, নাদিয়া আবারও নিধির কাঁধে এসে খুব জোরে পড়তেই, অস্ফুটস্বরে আর্তনাদ করে উঠলো নিধি।এইবার নিধি নাদিয়ার মাথা তোহার দিকে ঠেলে দিয়ে বললো,’ওকে তুই একটু সামলা।আমার হাত আর কাঁধ খুব ব্যথা করছে।”
“তোহা ৫মিনিটের মতো নাদিয়ার মাথা ওর কাঁধে রাখতেই,তোহার নরম কাঁধে ব্যথা অনুভব হলো।তোহা নিধি কে বললো,’আপু নাদিয়া আপু তো তার শরীরের সব ভর ছেড়ে দিয়েছে,আমার কাঁধ খুব ব্যথা করছে।পেছনের সিটে তো সিটবেল্টও নেই, যে লাগিয়ে রাখবো।প্লিজ তুমি তোমার বেস্টি কে সামলাও।’বলেই তোহা নাদিয়া কে নিধির দিকে ঠেলে দিলো।”
“নিধি অসহায় মুখ করে আবারও নাদিয়ার চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে দিলো।কিন্তুু নাদিয়া আবারও ধরফরিয়ে উঠে, পুনরায় অচেতন হয়ে গেলো।বাধ্য হয়ে সাড়ে ৩ঘন্টার পুরো রাস্তায় নাদিয়া নিধির কাঁধে মাথা রেখে জার্নি করলো।এদিকে প্রচন্ড ব্যথায় নিধির হাত এবং কাঁধের বেহাল দশা হয়ে গেলো।অতিরিক্ত ব্যথায় ডান হাত অবশ প্রায়।”
———–
“পুলিশের গাড়ি থেকে নেমে, বাসার সামনে দাঁড়িয়ে জহির সাহেব নাদিয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।প্রায় ২০মিনিট পর নাদিয়াদের গাড়ি এসে সেখানে থামল।রফিক মির্জা নাদিয়ার অচেতন হওয়ার বিষয়টি জহির সাহেব কে বুঝিয়ে বলতেই,জহির সাহেবের চেহারায় একরাশ বিষন্নতা ছেয়ে গেলো।নিধি এবং তোহা গাড়ি থেকে নামতেই, জহির সাহেব নাদিয়া কে আস্তে করে ধরে খুব ধীর পায়ে তার মেয়েকে নিয়ে নিজ বাড়িতে প্রবেশ করলেন।”
“রফিক মির্জা,নিধি এবং তোহা ক্লান্ত শরীরে বাসার সদর দরজায় পা রাখতেই,তিন জন তাহমিনা বেগম কে দেখে হকচকিয়ে গেলো।তাহমিনা বেগম হাতে মোটা লাঠি নিয়ে, নিধি এবং তোহার দিকে ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।তার চোখজোড়া দেখে মনে হচ্ছে, আজ নিধি এবং তোহার ওপর দিয়ে টর্নেডো হবে।”
“তোহা নিধির দিকে তাকিয়ে বললো,’আপু মা তো মনে হয় খুব রেগে আছে।এখন কি হবে?”
“কিছু হবে না।বাবাকে তো কান্নাকাটি করে পটিয়ে ফেলেছি।বাবা আমাদের পক্ষে আছে,তুই চিন্তা করিস না।”(নিচু স্বরে বললো নিধি।)
” রফিক মির্জা তাহমিনা বেগমের দিকে বিস্ময়কর চাহনি নিক্ষেপ করে বললেন,’মেয়ে দু’টো কতটা পথ পাড়ি দিয়ে বাসায় এসেছে।কোথায় তুমি ঠান্ডা লেবুর শরবত নিয়ে দাঁড়াবে।সেখানে তুমি মোটা একটা লাঠি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছো,যাও আমাদের জন্য শরবত বানিয়ে আনো।আমার শরীর টা খুব দুর্বল লাগছে।”
“রফিক সাহেবের খাপছাড়া কথায় তাহমিনা বেগম তেঁতে উঠলেন।লাঠি নিয়ে নিধি এবং তোহার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন,’হঠাৎ করে তুমি এই দুই দস্যি মেয়ের পক্ষ কেনো নিচ্ছো?তুমি কি একবারও ভালো করে আমার দিকে তাকিয়ে দেখেছো, যে ওদের জন্য অতিরিক্ত টেনশন করতে করতে অনবরত কান্নার ফলে আমার চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে?আমি কি ক্লান্ত হই নি?আমি তো ওদের গর্ভধারিণী মা।ওদের হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যাওয়াতে আমার হৃদয়ে কতটা যন্ত্রণা হয়েছে ভেবে দেখেছো?নাহ!তুমি সেটা ভাববে কেন?কারণ তুমি তো ওদের বাবা;বাচ্চা জন্ম দেওয়ার সময় আমার মতো ৯মাস কষ্ট সহ্য করে, শরীরের স্বাভাবিক শক্তির থেকেও বেশি শক্তি ব্যয় করে তোমার সন্তান ও হয়নি।তারপর সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সন্তান কে কোলেপিঠে করে মানুষ করতে যে কতটা কষ্ট হয়,সেটাও তো তোমার সহ্য করতে হয় নি।তুমি আমার কষ্ট বুঝবে কিভাবে?আমার যন্ত্রণা বোঝার সাধ্য তোমার নেই।”
“তাহমিনা বেগম একাধারে কথাগুলো বলেই,প্রথমে তোহার দিকে তীক্ষ্ণ চাহনি নিক্ষেপ করে;ওর পায়ের ওপর লাঠি দিয়ে কিছুটা জোরে আ**ঘাত করতেই, তোহা ‘ও বাবা গো’ বলে লাফিয়ে উঠলো।তাড়াতাড়ি দৌড়ে নিজের রুমের কাছে গিয়ে কান্না করতে করতে বললো,’আমি কি দোষ করেছি?সব দোষ আপুর।আপুই তো তোমাদের কথার অবাধ্য হয়ে, সন্ধ্যার সময় নৌকা ভ্রমণ করেছে।নইলে অনেক আগেই আমরা বাসায় আসতে পারতাম।উফফ! কি ব্যথা পেলাম।’বলেই তোহা পায়ে হাত দিয়ে হু হু স্বরে কান্না করে রুমে চলে গেলো।”
“এইবার তাহমিনা বেগম নিধির দিকে তাকিয়ে কটমটিয়ে বললেন,’বুইড়া শ**য়**তান মেয়ে যত দিন যাচ্ছে, ততই তোর অধঃপতন হচ্ছে।দিন দিন ছোট টা কেও নষ্ট করে ফেলছিস।’বলেই নিধিকে যেই আ**ঘাত করতে যাবে,তখনই নিধি পালাতে নিলে,তাহমিনা বেগম ওর হাত ধরে সেই ব্যথাতুর ডান হাতে মোটা লাঠি দিয়ে কিছুটা জোরে আ**ঘাত করতেই ‘নিধি মা-বাবা সহ চৌদ্দগুষ্টির নাম নিয়ে দিলো এক চি**ৎকার।এক ঝটকায় তাহমিনা বেগমের হাত সরিয়ে দৌড়ে গিয়ে রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো।”
“আকস্মিক ঘটনায় রফিক মির্জা হা করে নিজের স্ত্রীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে,আবহাওয়া বার্তা খারাপ দেখে দ্রুত পায়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন।অনেক দিন পর নিজের অর্ধাঙ্গিনী কে এভাবে আগুনের ফুলকির ন্যায় রেগে যেতে দেখলেন।তাই তিনি রুমে গিয়ে টি-টেবিল থেকে পানি নিয়ে, ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে তৃষ্ণা মেটালেন।তাহমিনা বেগমের এহেন কান্ডে রফিক মির্জার লেবুর শরবত খাওয়ার শখ পুরোপুরি মিটে গেছে।”
—————
“এদিকে নির্জন এবং দিগন্ত নিধিদের গাড়ি ফলো করে ঢাকা পৌঁছে গেছে।দিগন্ত সেই কখন থেকে নির্জন কে জিজ্ঞেস করে চলেছে,’ কিভাবে ওর হাত কা**টলো?’
কিন্তুু পুরো যাত্রাপথে নির্জন শুধু একবার বলেছে,’চুপ থাক।’
তারপর দিগন্ত আরও কত কিছু জিজ্ঞেস করলো,কিন্তুু গম্ভীর স্বভাবের নির্জনের কাছ থেকে আর কোনো উত্তর পেলো না।নির্জন দিগন্তের বাসার সামনে বাইক থামাতেই,দিগন্ত নেমে গিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করলো,’এখন তো একটু বলবি, যে কিভাবে তোর হাত কা**টলো?”
“নির্জন হেলমেট খুলে দিগন্তের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,’ডার্ক কুইন কে**টেছে।আর হ্যা,তোর গার্লফ্রেন্ডের শাস্তি শেষ।ওকে একটু স্ট্রং হতে বলবি।খুবই দুর্বল হৃদয়ের অধিকারী।তাই শাস্তির ক্ষেত্রে কিছুটা দুর্নীতি করেছি।’
কথাটি বলে হেলমেট পড়ে,নির্জন বাইক স্টার্ট দিয়ে দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করলো।”
“নির্জনের কথার আগাগোড়া বুঝতে না পেরে, দিগন্ত ক্যাবলা কান্তের ন্যায় পিচঢালা রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলো।”
————
“চলনবিল থেকে আসার পর কে**টে গেছে ৭দিন।এই ৭দিনে নিধির ডান হাতের ব্যথা কিছুটা কমেছে।তাহমিনা বেগম এখন তার মেয়েদের সাথে কিছুটা স্বাভাবিক ভাবে কথা বলেন।তোহা সেদিন নিধির নামে এতোগুলো সত্যি কথা বলার জন্য, নিধি তোহার নতুন কেনা কসমেটিকস গুলো নষ্ট করে ফেলেছে।এই নিয়ে তোহা প্রতিবাদ করতে গেলে, নিধি তোহা কে ওর নতুন জামা-কাপড় পু**ড়িয়ে ফেলার হু**মকি দিয়েছে।তোহা বেচারি দাঁতে-দাঁত চেপে সবকিছু সহ্য করে গেছে।অবশ্য কিছুদিন পর নিধি নিজেই ওর বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে, তোহা কে নতুন কসমেটিকস কিনে দেবে;সেটা তোহা জানে।তাই আপাতত মুখে কুলুপ এঁটে ধৈর্য ধারণ করছে।”
“এদিকে চলনবিল থেকে আসার পর নির্জন অফিসে নিয়মিত যাচ্ছে।কয়েকদিন যাবৎ অফিসে কাজের খুব প্রেশার যাচ্ছে।আজ বৃহস্পতিবার,আইটি কোম্পানিতে কাজ বেশি থাকলে,অফিসে বেশি সময় কা**টাতে হয়।অথবা কেউ চাইলে অফিস থেকে বাসায় গিয়ে ল্যাপটপে নিজেদের কাজ গুলো করতে পারে।তবে সেটা কাজের ধরন বুঝে।নির্জন আজ দুপুরের দিকেই বাসায় ফিরেছে।”
“নির্জন দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে,ওর প্রিয় ২টি রুমে ভ্রমণ করে, এখন রুমের দরজা এবং বেলকনির দরজা
আটকে, জানালায় কালো রঙের পর্দা দিয়ে
লাল রঙের ডিম লাইট জ্বালিয়ে বিছানার মাঝখানে আসন করে বসলো।এতোদিন অফিসের কাজের প্রেশারে তার ব্যক্তিগত দুই বেস্টফ্রেন্ডের সাথে তার তেমন ভাবে কথা হয় নি।নির্জনের বাহিরের পৃথিবীতে একমাত্র বেস্টফ্রেন্ড হলো দিগন্ত।আর অন্তর্জগতে অবিচ্ছেদ্য দু’টি বেস্ট ফ্রেন্ড হলো, ‘মন এবং হৃদয়।’নির্জন আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছে ‘মনের’ সাথে মিটিং করবে।”
“নির্জন র**ক্তিম ডিম লাইটের আবছা আলোতে,নতুন কেনা রিমলেস চশমাটি ঠিকঠাক করে পড়ে,তার দিব্যশক্তি দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে ‘মন’ কে ডেকে উঠলো,’মন’কোথায় তুমি?তোমার সাথে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে।তাড়াতাড়ি চলে আসো।”
“নির্জনের কথামতো ‘মন’ এসে পড়লো।নির্জন ‘মন’ কে বসার জন্য একটু সরে বসলো।তারপর মুচকি হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,’কেমন আছো মন?”
“হুমম মোটামুটি ভালো আছি।তুমি কেমন আছো?তুমি তো আমাকে ভুলেই গেছো।আগে তো ৩দিন পরপর কথা বলতে,এখন তো খুব ব্যস্ত জীবন পার করছো।আচ্ছা এক কাজ করি ‘হৃদয়’কে ডেকে আনি।আমি তোমার সাথে যে একা কথা বলছি, এটা ও জানতে পারলে ওর #হৃদয়ে_রক্তক্ষরণ শুরু হবে।তখন তোমারই কষ্ট হবে।”
“মন আরও কিছু বলতে যাবে,তখনই ‘হৃদয়’ এসে সেখানে হাজির হলো।হাসি মুখে বললো,’ট্যানট্যানাং আমি এসে গেছি।”
“নির্জন হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে, একটু সরে গিয়ে ‘হৃদয়’ কে বসতে জায়গা করে দিলো।”
“এই মুহূর্তে নির্জনের সিরিয়াস ভাব-ভঙ্গি যদি ক্যামেরায় ক্যাপচার করে রাখা যেতো।তাহলে সবাই ভাবতো, ‘নির্জন তার শরীরের অবিচ্ছেদ্য অংশ ‘মন এবং হৃদয়’ কে নিয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশে বসেছে।”
“নির্জন ‘মন’ কে বললো,’তুমি তো আমার কথা সবই জানো।চলনবিল থেকে আসার পর আমি ওই পা**গলি,জেদি মেয়ে টা কে কোনভাবেই ভুলতে পারছিনা।ও আমাকে আ**ঘাত করে কষ্ট দেওয়ার পরেও,দিন-রাত মিলিয়ে অসংখ্যবার ওর কথা স্মরণ হয়।জঙ্গলের মধ্যে আমার বুকের ওপর ওর শরীর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাওয়া,আমার কথা শুনে ওর বিষম খাওয়া র**ক্তিম মায়াবী মুখস্রি আমি কিছুতেই ভুলতে পারছিনা।রাতে ঘুমাতে গেলে সেই দৃশ্যগুলো বার বার আমার ঘুমের মাঝে স্বপ্ন হয়ে ধরা দেয়।তখন আমার মধ্যে সেই স্বপ্নপরী কে গভীরভাবে কাছে পাওয়ার আকুলতা সৃষ্টি হয়।আচ্ছা তুমি কি আমাকে ওর কথা বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছো?যদি এটাই হয় তাহলে কিন্তুু খুব খারাপ হয়ে যাবে।”
“নির্জনের মৃদুস্বরে হু**মকি শুনে খুব ভ**য় পেয়ে গেলো মন।’সেটা দেখে পৈ**শাচিক আনন্দ পেলো নির্জন।মন আমতা আমতা করে বললো,’বিশ্বাস করো নির্জন এই কাজ আমি করিনি।হ্যা, আমি দিন-রাত মিলিয়ে ৪-৫বার ওই মেয়েটির কথা তোমার প্যাঁচানো মস্তিষ্কে স্মরণ করিয়েছি।কিন্তুু এর থেকে বেশি না।আমি তো তোমাকে সবচেয়ে কাছ থেকে চিনি।রেগে গেলে তুমি ঠিক কতটা ভ**য়া*নক হতে পারো,সেটা শুধু আমি জানি।”
“মনের কথা শুনে ‘হৃদয়’ বললো,’আমার মনে হয় এই কাজ টি তোমার ‘অবচেতন মন’ করেছে।আমাদের সবার মধ্যেই ‘হৃদয়’ এবং ‘মনের’ বাহিরে একটা ‘অবচেতন মন’ আছে।যেটা আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে।আমি নিশ্চিত, এই কাজটি ওই ধূর্তবাজ ‘অবচেতন মন’ করেছে।যাকে তুমি চাইলেও ছুঁতে পারবে না।”
“শরীরের অবিচ্ছেদ্য অংশ ‘হৃদয়ের’ কথা শুনে নির্জনের চক্ষুদ্বয় মুহূর্তেই র**ক্তিম বর্ণ ধারণ করলো।”
#চলবে…
(প্রিয় পাঠকমহল আমি জানি, আজকের পর্ব পড়ে অনেকের মাথা ঘুরান্টি দিবে।যারা বুঝবেন না,তারা আবার ভালো করে পড়বেন।আমি আগেই বলেছি, এটা একটা সাইকোপ্যাথ গল্প।তাই আমার এবং আপনাদের সাধারণ মস্তিষ্কের ভাবনার সাথে এই গল্পটার যোজন-যোজন পার্থক্য হবে।তাই ধৈর্য ধারণ করে পুরো গল্পটা পড়তে হবে।সব সাইকো লাভার গঠনমূলক মন্তব্য করে উৎসাহিত করবেন।ভালোবাসা অবিরাম।)