মেহেরজান লেখনীতে- #সোহা পর্ব ৩

0
0

#মেহেরজান
লেখনীতে- #সোহা
পর্ব ৩

সন্তান খারাপ হলে বাবা মায়ের কষ্ট।তবে আয়াশের জন্য শুধুই রায়হান সাহেবের যত কষ্ট হয়েছে।ছেলেটাকে ছোট থেকেই আদরে আদরে মানুষ করেছে আর এখন তার এই প্রতিদান দিচ্ছে।আমেনা বেগমও জেনে গিয়েছিলেন ছেলে বিদেশে গিয়ে আরেকটা বিয়ে করেছে তবে এ বিষয়টি তিনি গোপন রেখেছেন সকলের থেকে।রাউশিও ঘটনাটা জেনে গিয়েছিলো সেদিন সকালে যেদিন আয়াশ বাড়িতে ফিরেছে দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে। অথচ আমেনা বিষয়টা জেনেও কাউকে জানান নি।শুধুমাত্র নিজেদের অবস্থা রাউশির মাধ্যমে আরও সচ্ছল করার জন্য।এদিকে আয়াশও কখনো তার বাবাকে অন্য পছন্দের কথা বলেনি।নয়তো কখনোই রাউশির জীবন নষ্ট করে দিতেন না তিনি।খুব আফসোস করছেন রায়হান সাহেব এখন। রায়হান সাহেবের জীবনেই যত দূর্ভোগ নেমেছে।ছেলেকে নিজেরই কয়েকটা চড় মারতে ইচ্ছে করছে।মারতেও গিয়েছিলো তবে স্ত্রী আমেনার জন্য পারে নি।আমেনার সাথেও ব্যাপক ঝগড়া লেগেছে রায়হান সিকদারের।আয়াশদের রুমে ঢুকেন আমেনা।ছেলের পাশে গিয়ে ছেলের গালে হাত বুলিয়ে বলেন,
“ওই মেয়েটা আমার ছেলেকে চড় মারলো।”

আয়াশের আরও মেজাজ চটে যায়।এমনিতেই নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছিলো রাউশির কথা মনে করিয়ে দিতেই আরও বেশি রেগে যায়।

“ওই মেয়েটাকে আমি ছাড়বো না।সাহস কত আমাকে চড় মারার।”

আমেনা ছেলের কথায় সায় দিয়ে বলেন,
“উচিত শিক্ষা দিবি একদম।”

আয়াশ ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে।অনিমা বসে বসে নখ পরিচর্যা করছে।এদিকে এসব কথাগুলো বাইরে থেকে রায়হান সিকদার শুনতে পেতেই রুমে এসে এবার আয়াশের গালে দুটো চড় লাগিয়ে দেন।আয়াশ রেগে গেলেও বাবাকে কিছু বলতে পারে না।রায়হান সিকদার চেচিয়ে বলেন,
“মা ছেলে মিলে মেয়েটার জীবন ধ্বংস করে ক্ষান্ত হওনি এখনও?আর কি চাও তোমরা?এক কাজ করো আমাকেই মেরে ফেলো, তোমাদের এসব তামাশা আর আমাকে দেখতে হবে না ইহজনমে।”

আমেনা বিরক্তির সাথে তাকায় রায়হান সাহেবের দিকে।ছেলের মেজাজ খারাপ বিধায় টেনে নিয়ে নিজেদের রুমে নিয়ে যান রায়হান সিকদারকে।এ নিয়ে বাড়িতে বেশ কিছুদিন ঝামেলা হওয়ার আশঙ্কা আছে বলে মনে করেন আমেনা।

.

গাড়ির জানালার বাইরে থেকে ঠান্ডা হাওয়া এসে গা ছুয়ে দিচ্ছে রাউশির।মেহরান রাউশির ডিজে গান ছেড়ে দেওয়ার কথাটা শুনে সত্যিই সত্যিই মুহুর্তক্ষণে একটি গান ছেড়ে দেয়।গানটি বাজতে শুরু করে,

“আজ প্রতি রাতে জেগে থাকি তোমার আশায়,
তুমি চলে গেছো তাই,বিরহের গান গাই।”

এমন গান শুনতেই কেঁশে ওঠে রাউশি।চোখ বড় বড় করে মেহরানের দিকে তাকায়।মেহরানের মুখ গম্ভীর।রাউশি আশ্চর্য ভাব নিয়ে বলে,
“এটা আবার কি গান মেহরান ভাইয়া?”

মেহরান গম্ভীর স্বরেই জবাব দেয়,
“তোর দশা অনুসারে দিয়েছি।”

মেহরান তার বর্তমান দশা নিয়ে মজা করছে দেখে রেগে যায় রাউশি।রাগে নাকের ডগা লাল হয়ে যায়।মেহরানকে সে ছোট থেকেই ভয় পেতো এবং দেখতে পারতো না কিন্তু এখন যে কার চেহারা দেখে নিজের মাথা খেয়ে এই বদলোকের সাথে কথা বলছে সেটাই বুঝতে পারছে না।মেহরান আড়চোখে রাউশির দিকে তাকায়।মুখে নিকাব লাগানো থাকায় বোঝা যাচ্ছে না রেগে আছে নাকি অন্যকিছু?তাই সে আবারও গাড়ি চালানোতে মন দেয়।এদিকে গাড়িতে তখনও সেই গান বেজেই চলেছে।রাউশির আর সহ্য হচ্ছে না এমন গান।এটা কোনো গান হলো?সে তো শুনতে চেয়েছিলো একটি ডিজে গান।কিন্তু বিরহের গান তো মোটেও শুনতে চায় নি সে।রেগে গিয়ে আবারও মুখ ফুলিয়ে বসে থাকে।তবে সেটা নিকাবের আড়ালেই ঢাকা থাকে।গাড়িটা বাড়ির সামনে এসে থামতেই রাউশি তাড়াহুড়ো করে নেমে যায়। মেহরানও নামে।রাউশি বাড়িতে ঢুকতে নিয়েও আবার ফিরে এসে মেহরানকে বলে,
“ভাইয়া মোটেও বাড়ির কাউকে বলবেন না প্লিজ।”

মেহরান নিরুদ্বেগ কণ্ঠে সামনের দিকে দৃষ্টি রেখে বলে,
“আর যদি বলে দেই।”

নিজের ভয় আর জড়তা পাশ কাটিয়ে নিকাবের আড়ালে মুখ ভেংচে বলে,
“তাহলে আপনি একটা বাদাইম্মা।”

‘কি’ বলতে না বলতেই রাউশি বাড়ির পেছনের দিকে এক দৌঁড় দেয়।এখন তার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজের রুমে পৌঁছাতে হবে যে করেই হোক।সকলের নজর পেরিয়ে নিজের রুমে ঢুকতে ভাই বোন সবাইকে দেখে চমকে ওঠে রাউশি।বুকে হাত দিয়ে বলে,
“তোরা এখানে কি করছিস?ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি।”

সবাই বিস্মিত কণ্ঠে একসাথেই বলে ওঠে,
“মেহরান ভাইয়ের সাথে কোথায় গিয়েছিলি তুই?”

প্রশ্নটা এমন ভাবে করেছে যেন রাউশি কোনো এলিয়েনের সাথে এসেছে।রাউশি দরজা লাগিয়ে পেছন ফিরে নিকাবটা খুলে জবাব দেয়,
“একটা কাজে গিয়েছিলাম।”

আবারও সবাই একসাথে বলে,
“কি কাজ?”

বিরক্ত হয় রাউশি।এসব প্রশ্নের উত্তর সে কাউকে দিতে রাজি নয়।তাই জবাব না দিয়ে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হওয়ার জন্য ঢোকার আগেই সবগুলো এসে রাউশিকে ঘিরে ধরে।তানিয়া বলে,
“রাউশিপু মেহরান ভাইকে নিয়ে কোথায় গিয়েছিলে বলো না?”

“এমন ভাবে জিজ্ঞাসা করছিস যেন তার সাথে কোথাও যাওয়া মানা।”

পাশ থেকে আবার নাহিন বলে,
“মানা নয় এটা হলো দুঃসাহসিক ব্যাপার।”

রাউশি ভ্রু কুচকে বলে,
“কেন?সে কি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নাকি?”

নাহিনই সে প্রশ্নের উত্তর দেয়,
“বড় মা’র কাছে শুনেছি মেহরান ভাই অনেক রাগী।এই বিষয়ে কিন্তু আমরাও জানি। ছোটবেলায়ও দেখেছি আমি কত রাগী মেহরান ভাই।এইযে আজ সকালে নাকি কোন লোককে বেধরম পিটিয়েছে তানজিম ভাইয়ের থেকে শুনলাম।”

রাউশির রূহ কেঁপে ওঠে সবেগে।যেই কথা বলে এসেছে আজ মেহরানকে সে যদি মেরে মাটিতেই পুতে দেয়?পরক্ষণেই মনে পরে সে তো মেহরান ভাইয়ের বোন তাকে মারতে পারবে না।তবুও মনে মনে ঠিক করে ওই লোকের থেকে দূরে দূরে থাকতে হবে।

.

ডিভোর্সের সমস্ত কাগজপত্র রেডি।রাউশির সেখানে সাক্ষর করতে বিন্দুমাত্র হাত কাঁপেনি।এখন পালা হলো আয়াশের।তাদের বাড়িতে কাগজ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।রাউশিরা সকলেই রেডি রাজশাহী ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য।প্রিয় শহর রাজশাহী ছাড়তে মন না চাইলেও রাউশিকে চলে যেতে হবে।কারণ এই শহরে থাকলে সে ভালো থাকবে না।যতই দুষ্টুমিতে,আনন্দ করে থাকার চেষ্টা করুক মনের কোণে কোথাও ফাঁকা ফাঁকা ভাব কিন্তু এখনও রয়ে গেছে।প্রিয় বন্ধুবান্ধবদের থেকে ফোনালাপেই বিদায় নিয়েছে।কথা দিয়েছে সময় হলে দেখা করে যাবে রাজশাহী। রাউশি তার মামা রায়হানের জন্য খারাপ লাগছে।তবে তারও কিছু করার নেই।

আর কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা হবে।তপ্ত রোঁদের উষ্ণতা এখন কমে এসেছে।আকাশে সাদা সাদা মেঘগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।দেখতে অদ্ভুত সুন্দর।বারান্দা দিয়ে আজকের আকাশটা কিছুক্ষণ উপভোগ করে রাউশি।মায়ের ডাকে নিচে নেমে আসে।সবাই রেডি হয়ে আছে।সদর দরজার সামনে মেহরানকে উজানের সাথে কথা বলতে দেখেই নাহিনের পেছনে লুকিয়ে পড়ে রাউশি।নিজেকে এখন কিশোরী মনে হচ্ছে তার।অথচ রাউশির বয়স এখন একুশ।আর কয়েকমাস পেরোলে বাইশে পা দেবে।এমন একটা বয়সে এসে এসব বাচ্চামোই মনে হচ্ছে তার।মেহরান চলে যেতেই রাউশি নাহিনের পেছন থেকে সড়ে আসে।সবাই মিলে উদ্যত হয় বাইরে যাওয়ার জন্য।কাজিনরা সবাই এক গাড়িতে উঠবে বলে ঠিক করেছে।তাই সবার পেছনে গাড়িটিতে এক এক করে সকলে উঠে পড়ে।আর বাকি দুইটা গাড়িতে বাড়ির বড়রা।কয়েক ঘণ্টার রাস্তা জমিয়ে আড্ডা দিতে পারবে সবাই।এই মনোষ্কামনা তাদের মুহুর্তেই পরিবর্তন হয় যখন দেখে তাদের গাড়িতে মেহরান ড্রাইভিং এর জন্য উঠেছে।রাউশির পাশে বসা তাজবির রাউশির কানে কানে বলে,
“রাউশিপু আজ আড্ডার বারোটা বাজবে আমাদের।যম আমাদের সাথেই আছে।তাই বেশি আনন্দ উৎফুল্ল করা যাবে না।”

রাউশিও চুপ থাকে সাথে বাকিরাও।মেহরান সবাই উঠেছে কিনা সেটা একবার পেছন ফিরে দেখতেই প্রথমে চোখ যায় রাউশির দিকে।মনে পড়ে রাউশির সকালে বলা কথাটা।রাউশির সাথে মেহরানের চোখাচোখি হতেই রাউশি দ্রুত চোখ সড়িয়ে জানালার বাইরে তাকায়।মেহরান সবার উপস্থিতি বুঝতে পেরে গাড়ি চালানো শুরু করে।গাড়ি আপন গতিতে চক্তে থাকে।জানালার পাশে বসে রাউশি বাইরে তাকিয়ে থাকে।প্রিয় শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে তাই কান্নাও পায় তার।আধঘণ্টা বাদে রাজশাহীর শেষ প্রান্তে গাড়ি থামিয়ে মেহরান বলে,
” কার কিছু লাগবে নাকি? বা কারোর ওয়াশরুমের প্রয়োজন হলে যেতে পারিস।গাড়ি আর থামবে না পরে।”

সবাই একসাথেই নেমে পড়ে।রাউশিও আস্তে আস্তে নেমে যায়।গাড়ির দরজার সামনে মেহরানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্রুত মাইশার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় রাউশি।মাইশা একটি দোকান থেকে কিছু চিপস কিনছে।বাকিরাও নিজেদের পছন্দসই জিনিস কিনছে।হঠাৎ রাউশির পাশ ঘেষে কেউ দাড়াতেই চোখ তুলে পাশে তাকায়।এক প্রাপ্তবয়স্ক লোক তার গা ঘেষে দাড়িয়েছে।ঠোঁটে বিশ্রি হাসিটা দেখেই গা গুলিয়ে ওঠে রাউশি।সড়ে যেতে চাই রাউশি তবে লোকটি আরও পাশ ঘেষতেই এবার রাউশি ক্ষেপে গিয়ে এক চড় দিয়ে বসে লোকটিকে।ধমকে বলে,
“সাহস কি করে হয় আপনার আমার সাথে নোংরামি করার?”

মেহরান দূর থেকে এসব লক্ষ্য করছিলো।লোকটির এরূপ ব্যবহারে তারও মাথা গরম হয়ে যায়।সামনে পা বাড়াতেই রাউশির কর্মকাণ্ডে থেমে যায়।রাউশি আবারও চেচিয়ে বলে,
“তোদের মতো জানোয়ারদের জন্যই নারীরা নিরাপদ নয়। তোকে আজ আমি খুন করবো।”

বলে মাটিতে পড়ে থাকা একটি ছোট অথচ শক্তপক্ত গাছের ডাল দিয়ে মারা শুরু করতেই নাহিন এসে থামায় রাউশিকে।রাউশি হাঁপাতে থাকে।তার আজকের এই ঘটনায় মনে পড়ে গিয়েছিলো ভার্সিটির এক বান্ধবীর কথা।যাকে ধর্ষণ করা হয়েছিলো।এবং মেয়েটা মারাও গিয়েছিলো।তাইতো এখন রণমুর্তি ধারণ করেছে রাউশি।নাহিন রাউশিকে টেনে নিয়ে গাড়িতে বসায়।পরপর সকলেই উঠে পড়ে।তবে মেহরান কিছু কাজ করবে বলে সবাইকে গাড়িতে থাকতে বলে।কিছুক্ষণ পর সেও গাড়িতে এসে বসে একবার রাউশির দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালানো শুরু করে।রাউশি স্পষ্ট দেখেছে মেহরানের ঠোঁটের মুগ্ধ করা হাসি।

চলবে…

(ভুল ক্রুটি হলে ক্ষমা করবেন।)

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here