#মেহেরজান
লেখনীতে- #সোহা
পর্ব ৪
মেহরান গাড়ি চালানো শুরু করতেই সকলে আবারও চুপচাপ হয়ে যায়।এই রাগী লোকটির সামনে তাদের গল্প করার মতো কোনো অবস্থা নেই।জানালা দিয়ে বিকেলের ঠান্ডা হাওয়া উপভোগ করছে রাউশি। তার পাশে এখন মাইশা বসা।রাউশির বিরক্ত লাগছে তাই মাইশাকে বলে উঠে,
“রাজশাহী ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করছে না।”
মাইশা একবার মেহরানের দিকে তাকায় তো একবার রাউশির দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলে,
“আস্তে কথা বল।ভাই রেগে যাবে।”
এটা শুনে আরও বিরক্ত হয় রাউশি।হ্যা সে যে ভয় পায় না এমন না।ভয় পায় তবে এতোটা না।যে ভয়ে থরথর করে কাঁপবে।রাউশির মা একদিন বলেছিলেন, মেহরান নাকি রাউশিকে অনেক আদর করতেন তবে বিদেশে গিয়ে এত গম্ভীর আর রগচটা কিভাবে হলো বুঝে আসে না তার।খুব অল্প বয়সেই মাহবুব খান মেহরানকে কিছু একটা কারণে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন। কারণটা সেটা সকলেরই অজানা।
“রাউশি।তোকে একটা ছেলেকে দেখায় আমি দাড়া।”কথাটা বলে মুচকি মুচকি হাসে মাইশা।রাউশি বোধ ফিরে পেয়ে মাইশার ফোনের স্ক্রিনে তাকায়।মাইশা একটি ছেলের আইডিতে ঢুকে ছেলেটির প্রোফাইল পিকচারে থাকা ছবিটা দেখায় রাউশিকে। রাউশি ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করে। দামী একটি গাড়ির সামনে সাদা শার্টের ওপর কালো কোর্ট জড়ানো, কালো প্যান্ট আর কালো বুট জুতা পড়া একটি ছেলে।দেখতে বেশ সুদর্শন।কিন্তু মাইশা এই ছেলেকে তাকে দেখাচ্ছে কেন বুঝতে পারলো না রাউশি। মাইশার ঠোঁটে লজ্জার হাসি,চোখের চাহনীতে মুগ্ধতা, রাউশির আরেকটু কাছ ঘেষে বসে ঘোর লাগা কন্ঠে বলে,
” হায় এই লোকটা আমাদের ভার্সিটির ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর নুজাইশ শাহ।ভাই ছবিতে দেখতে বেশি সুন্দর নয় তবে বাস্তবে আরও বেশি সুন্দর।তুই আমাদের ভার্সিটিতে ভর্তি হলে দেখতে পাবি।কারণ তুইও ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টেরই।”
রাউশি বেশি পাত্তা দেয় না সেসব।নামটাও শুনেছে কিনা সন্দেহ?মুখ ঘুরিয়ে আবারও জানালা দিয়ে তাকায় বাইরে। রক্তিমাকাশে ঢলে পড়া সূর্যের মাঝ বরাবর পাখির নীড়ে ফেরা দৃশ্যটা তার মন নাড়িয়ে দেয়।গাছগাছালিগুলো কালো লাগছে অন্ধকারে।অথচ আকাশে এখনও লাল আভা ছড়িয়ে।রাউশির প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে মন চাইছে।তার জীবন আর পাঁচটা মেয়ের মতো নয়।ভীষণ আলাদা হয়ে গেছে তার জীবন। রাউশি ভাবে সে কি জীবনযুদ্ধের এক ধাপে হেরে গিয়েছে?আয়াশের কথা মনে ওঠে। মানুষটা তার তিনটে বছর নষ্ট না করলেই পারতো।রাউশি মনে মনে ভাবে আয়াশের এর জন্য আরও শাস্তি পাওয়া উচিত।অন্তত বাড়িতে স্ত্রী রেখে প্রথম স্ত্রীয়ের অনুমতিবিহীন যে পুরুষ পরকীয়া করে অন্য আরেকজনকে বিয়ে করে সে কাপুরুষ ছাড়া অন্যকিছু নয়।তার শাস্তি অবশ্যই প্রাপ্য। আর আমেনা বেগম?উনিও সমান দোষী।এতবছর রাউশির সাথে ভালো ব্যবহারের নাটক করেছে সমস্তকিছু জেনেও।রাউশির শুধু তার মামা রায়হান সিকদার এর জন্য। মানুষটা না জানি এখন কেমন অবস্থায় আছেন।গাড়ি চালানোর ফাঁকফোকরে মিরোরে রাউশিকে অনেক্ষণ যাবৎ ভাবুক দেখতে পায় মেহরান।তবে নিজে কিছু করে না।
গাড়ি চলাকালীন হঠাৎ করেই নাহিন রাউশিকে বলে,
“এই রাউশি আয় লুডু খেলি।”
রাউশির মন ভালো নেই।এখন কোনোকিছু করার ইচ্ছে আপাতত নেই।নাকোচ করে দেয়।তাজবির বলে,
“রাউশিপু না খেললে আমি খেলবো।”
সবাই লুডু খেলা শুরু করে চুপিচুপি।যেন সামনে বসা মেহরানকে মোটেও দেখানো যাবে না।গতকালই লুডু খেলতে দেখে অনেক্ষণ বকাঝকা করেছিলো মেহরান তাদের।তাই আজ মেহরান গাড়ি চালানোর ফাঁকে একটা গেইম খেলা যায়ই।তখনই আবার তাদের খেলার ব্যাঘাত ঘটাতে পেছজে ফিরে তাকায় তানজিম।তানজিমও তাদের গাড়িতে করেই যাচ্ছে।তানজিম মেহরানের থেকে এক বছরের ছোট।পেছন ফিরে দেখে সবাই লুডু খেলায় মত্ত।তানজিম বলে,
“কি করছিস তোরা?”
এই একটা কথা শুনে তানিয়ার হাতে থাকা ফোনটা পড়ে যায় নিচে।তানজিম ভ্রু কুচঁকায়।তানিয়াকে জিজ্ঞাসা করে,
“কি করছিলি?”
বাকি সবাই চুপ করে বসে আছে।যেন তারা কিছুই করে নি।মেহরান বুঝতে পারে গাড়িতে সকলেই তার ভয়ে চুপচাপ আছে। তানজিমকে বলে,
“খেলতে দে।”
কথাটা শুনে রাউশিও একপলক তাকায় মেহরানের দিকে।তানিয়াসহ সকলেই খুশি হয়।নিচ থেকে ফোনটা তুলে পুনরায় নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।এবার সবাই একটু আধটু কথা বলতে বলতে কোলাহলময় হয়ে ওঠে গাড়ি।এরই মাঝে তানজিম কিছু একটা মনে পড়ার মতো করে বলে,
“রাউশি তুই লোকটাকে কিভাবে মারলি।আমরা যাস্ট শকড হয়েছি তোর এই প্রতিবাদীরূপ দেখে।আগে তো এমন ছিলি না।”
“সময়ের প্রয়োজনে এবং নিজ স্বার্থে এমন কঠোর এবং প্রতিবাদী হয়ে উঠতে হয় তানজিম ভাই।পরিস্থিতি যখন অস্বাভাবিক তখন নিজেকে ভুপৃষ্ঠে টিকিয়ে রাখার জন্য আত্মসম্মান,আত্মশিক্তি এবং কঠোর হতে হয়।” ম্লান হেসে কথাটি বলে রাউশি।সামনে বসা মেহরান খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে কথাটি।এমনকি গাড়ির সবাই।মেহরান যেন খুব খুশি হয়।নিঃশব্দে হালকা হাসে সকলের অগোচরে।গাড়ির সবাই হাত তালি দিয়ে ওঠে খেলার মাঝেই।আর বাহবা দিতে থাকে রাউশিকে।নতুন জীবনের শুভেচ্ছাও জানায় তাকে।রাউশি তৃপ্তির হাসি দেয়।কিছুক্ষণ কেটে যায়।বাকিরা নিজের খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লে রাউশিও ক্লান্ত হয়ে গাড়িতেই ঘুমিয়ে যায়।
রাউশির ঘুম ভাঙ্গে তখন মাইশা’র ডাকে।
মস্তিষ্ক সজাগ হতেই প্রথমেই চোখ যায় মেহরানের সুদর্শন মুখের দিকে।হালকা আলোতে দেখা যাচ্ছে মেহরানের মুখ।গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।ঘুম জড়ানো কন্ঠে রাউশু জিজ্ঞাসা করে,
“পৌঁছে গেছি?”
মাইশা ‘হ্যা’ বলে আবার তাড়া দিতে থাকে।রাউশিও গাড়ি থেকে নামে।তানজিম এগিয়ে এসে বলে,
“রাউশি! বাড়িতে তোকে পুনরায় স্বাগতম।”
রাউশি হালকা হাসে।সকলের পিছু পিছু বিশাল বড় বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ঢোকে।অনেক বছর পর আসছে রাউশি এই বাড়িতে।বাড়িতে থাকা কাজের লোকগুলো ব্যাগপত্র নিয়ে যাচ্ছে তাদের।তাজবিরকে কোলে করে রুমে নিয়ে যাচ্ছে নাহিন।তানিয়া আর মাইশা রাউশির সাথে হাটছে।মধ্যরাতে বাড়িতে এসে পৌঁছানোতে সকলেই বেশ ক্লান্ত।যে যার ঘরে চলে যায়।বাড়ির বড়রা অনেক আগেই পৌঁছেছে।নাস্তা করার মতো কারোরই ইচ্ছে নেই।রাউশিকে তার রুম দেখিয়ে দেয় তানজিম।রাউশি রুমে ঢুকতেই অবাক হয়।ভীষণ সুন্দর রুমটি।এবার থেকে তাকে এই রুমেই থাকতে হবে ভেবে সে ভীষণ খুশি হলেও রাজশাহীতে থাকা তাদের বাড়িটির কথা মনে পড়ে।সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে যায় সিকদার বাড়ির কথা।বাড়িটি ছোট হলেও, আর স্বামী ভালোবাসা না পেলেও বেশ ভালোই ছিলো সেই বাড়িতে।অন্তত তখন কঠিন সেই মুহুর্তের সাথে সাক্ষাৎ ছিলো না।জীবন মুহুর্তের মাঝেই বদলে যায়। রাউশি তার রুমে থাকা বারান্দাটাই গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ।আরেকটু পরই ভোর হবে।রাউশির ক্লান্ত লাগছে।তাই সেও রুমে গিয়ে লাইট অফ করে ঘুমিয়ে পড়ে।ভেবে নেয় কাল সকালেই সমস্ত গোছগাছ করে নেবে।
.
আয়াশ একটি বেসরকারি ভার্সিটিতে প্রফেসরের চাকরি পেয়েছিলো।তবে আজ সকালে ভার্সিটিতে গিয়ে জানতে পারলো যে সেই চাকরি থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।মুহুর্তেই রেগে হিংস্র হয়ে ওঠে আয়াশ।বুঝতে পারে এই কাজ কার?নিশ্চয় রাউশির বাবা চাচাদের। রাউশির বাবা চাচাদের ক্ষমতা অনেক তাই বলে এমন করবে?আয়াশ রেগে বাড়িতে চলে আসে।আমেনা দরজা খুলে দিতেই আয়াশকে দেখে অবাক হয়।
“বাবা তুই এতো তাড়াতাড়ি চলে এলি?” অবাক স্বরে কথাটি বলেন আমেন বেগম।আয়াশ তৎক্ষণাৎ জবাব দেয়,”আমার চাকরিটা খেয়ে দিয়েছে ওই খান বংশ।”
আমেনা বেগম হতচকিয়ে উঠেন।রায়হান সিকদার রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার।ছেলের দেশে ভালো চাকরি হয়েছিলো।কিন্তু চাকরী নেই শুনে কলিজার পানি শুকিয়ে যায় আমেনার।আননে চিন্তারেখা দেখা যায়। রায়হান সিকদার নিজের রুম থেকেই কথাগুলো শুনে হেসে উঠেন নিঃশব্দে।যা হয়েছে ভালোই হয়েছে।এমন বিশ্বাসঘাতকদের সাথে এটাই হওয়া উচিত। আয়াশ নিজের রুমে গিয়ে দেখে অনিমা কানে হেডফোন গুজে গান শুনছে আর গুনগুন করছে।
“অনিমা।” বলে ডেকে ওঠে আয়াশ।অনিমা খেয়াল করেনি আয়াশকে।আবারও ডাকে আয়াশ।তবুও কোনো লাভ হয় না।এবার কাছে গিয়ে ডাকে অনিমাকে।অনিমা মাথা তুলে আয়াশকে দেখে হেডফোন খুলে আয়াশের কাছে গিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে।আর বলে,
“তুমি এতো তাড়াতাড়ি চলে এসেছো বেইব?”
আয়াশ নিজের সাথে ঘটা ঘটনার ব্যাপারে বলে না।প্রশান্তির জন্য অনিমার কোমড় জড়িয়ে ধরে।টুপ করে অনিমার ঠোঁটে একটা কিস করে বসে।আয়াশ বলে,
“আমরা ঢাকায় চলে যাব কয়েকদিন পর।এখানে জব করবো না।”
অনিমাও খুশি হয়।মাথা নাড়ায় আয়াশের কথায়।মুহুর্তের মাঝেই দুজনে মেতে ওঠে দুজনেতে।ভুলে যায় তাদের করা পাপকর্মের কথা।
চলবে..
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/