#মেহেরজান
লেখনীতে- #সোহা
পর্ব ৫
রাউশির নতুন অধ্যায়ের দুদিন কেটে গেছে ঘরে বসে।এই দুদিনে মাইশা নাহিনদের সাথে একই ভার্সিটিতে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে তাকে।রাউশি তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হলেও কিছু সমস্যার কারণে তাকে দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি করাতে হয়েছে আবারও।আজ ভার্সিটি যাবে বলে ঠিক করেছে রাউশি।রেডি হয়ে দরজা খুলে বেরোতেই তানিয়া আর নাহিনকে দরজার সামনে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হতচকিয়ে যায় রাউশি।
“এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস?”
নাহিন সবেগে বলে,
“তোর অপেক্ষা করছিলাম।চল।”
নাহিন আর তানিয়া হাটা শুরু করে।পেছন পেছন রাউশিও।তানিয়া প্রথম বর্ষে পড়লেও নাহিন অনার্স তৃতীয় বর্ষে।নিচে আসতেই রূপা বেগম তাদের নাস্তা করতে বললে তিনজনই মানা করে দেয়।বাইরে আসতেই মেহরানকে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে একহাত পকেটে গুজে আর অন্যহাতে মোবাইলে ঘাটাঘাটি করতে দেখা যায়।তারা যেতেই মাথা তুলে সামনে তাকায়।মেহরানের এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ হলো মেহরান তাদের ভার্সিটি পৌঁছে দেবে নিজ উদ্যোগে।রাউশি চেয়েছিলো শুধু তারা তিনজন মিলেই রিকশায় চড়ে যাবে। তবে এই লোকটার জন্য তা হবে না এটা ভালোই বুঝতে পারলো রাউশি।একবার আড়চোখে তাকিয়ে গাড়িতে উঠে বসে পেছনের সিটে।নাহিন সামনের সিটে বসতে নিতেই মেহরান গম্ভীর ভাবে বলে,
“রাউশি তুই এখানে এসে বোস।”
সহজ সরল এমন উক্তি শুনে রাউশি ভ্রুকুটি করে নেয়।নাহিন থেমে যায়।এদিকে তানিয়াও মেহরানের দিকে তাকিয়ে আছে কেমন করে।সাথে নাহিনের ভোলাভালা দৃষ্টি তো কথায় নয়।রাউশিও বিনা বাক্যে ব্যয়ে সামনে গিয়ে বসে পড়ে মেহরানের পাশে।অন্যদের মতো ন্যাকামি সে করে না।সবাই নিজ নিজ জায়গায় বসতেই গাড়ি চলতে স্টার্ট দেয় মেহরান।সবাই চুপ রয়েছে।এই নিস্তব্ধতা মেহরানই ভঙ্গ করে সবার উদ্দেশ্যে বলে,
“নাহিন, তানিয়া তোরা দুজন রাউশিকে দেখে রাখিস।”
তানিয়া হালকা আওয়াজে বলে,
“ভাইয়া তুমি যেভাবে বলছো রাউশিপু যেন কোনো বাচ্চা।”
মেহরানের কথাটা পছন্দ হয় না।রাউশির আজ প্রথম দিন ভার্সিটিতে।কোনো সমস্যা হলে তখন একা হয়ে পড়বে।তাইতো এমন কথা বলেছে।তানিয়া আবারও বলে,
“আবার ডিপার্টমেন্টও ভিন্ন।”
মেহরান ভাবুক হয়।ভেবে নেয় ভার্সিটি গিয়ে টিচারদের সাথেই ভালোভাবে আলাপচারিতা করে নেবে।অবশেষে ভার্সিটি পৌঁছায় তারা।গাড়ি থেকে নামে চারজনই। নাহিন ভার্সিটি এসে সোজা বন্ধুদের কাছে চলে যায়।বিদায় নিয়ে তানিয়াও চলে যায়।মেহরান রাউশিকে তার সাথে যেতে বললে রাউশিও মাথা নাড়ায়।রাউশিদের ডিপার্টমেন্ট বিল্ডিং এর সামনে যেতেই মেয়েরা কেমন করে মেহরানের দিকে তাকিয়ে থাকে।মুখে মুখে শোনা যাচ্ছে ‘ইশ ছেলেটা কি হ্যান্ডসাম।’
রাউশি কথাগুলো শুনে একবার মেহরান তো একবার মেয়েদের দিকে তাকায়।মেহরান তার সেই চিরচেনা গম্ভীর মুখেই হেটে যাচ্ছে স্থিরদৃষ্টিতে।রাউশির ক্লাসরুম দেখিয়ে দিয়ে বলে,
“কোনো সমস্যা হলে আমায় কল করবি। যা।”
রাউশি ক্লাসে গিয়ে বসে পড়ে।মেহরান ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট অফিসের দিকে যাওয়ার সময় কারো সাথে ধাক্কা লাগে।চোখ তুলে পাশে তাকাতেই চিরচেনা ব্যাক্তিকে দেখে বলে,
“তুই?”
সামনের ব্যক্তিটিও মেহরানকে দেখে অবাক হয়েছে বোঝা যাচ্ছে তার কন্ঠস্বরে,
“তুই এখানে কি করছিস মেহরান?”
মেহরান শুনেছে নুজাইশ প্রফেসর হিসেবে একটি বেসরকারি ভার্সিটিতে জয়েন করেছে কিছুদিন হলো।কিন্তু সে যে এই ভার্সিটিতেই জয়েন করেছে তাও আবার ফিজিক্স বিভাগে সেটা নেহাৎই অজানা মেহরানের। নুজাইশ মেহরানের খুব কাছের বন্ধুও বলা চলে।তাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে নুজাইশ আর সাঈদের সাথে মেহরানের বন্ধুত্ব গাঢ়। এর কারণ মেহরানের সাথেই তারাও বিদেশেই পড়াশোনা করেছে একসাথেই। তবে নুজাইশ কয়েক মাস আগেই দেশে ফিরলেও মেহরানের কিছু জরুরী প্রয়োজনে দেশে ফিরতে দেরি হয়।মেহরান আর সাঈদ একসাথে দেশে ফিরেছে।বিদেশে থাকাকালীন বেশ কয়েকজন বাঙালির সাথে বন্ধুত্ব খুব প্রগাঢ় হয়েছিলো মেহরানের। তবে নুজাইশের সাথে তার ছোট থেকেই বন্ধুত্ব। ফ্যামিলি বন্ডিংও ভালো বলাই চলে। নুজাইশ এই প্রফেশন বেছে নিতে চেয়েছিলো তার বাবা মাও তাকে আর বাধা দেয়নি। নয়তো নুজাইশের বাবা নওয়াজ শাহ একজন এমপি। সেখানে নুজাইশ একজন বেসরকারি ভার্সিটি সহকারী অধ্যাপক ব্যাপারটা কেমন হলেও বাস্তব।
“তুই কি এই ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের?”
“হ্যা, কিন্তু তুই এখানে কি করছিস?নাকি আবার ভার্সিটি পড়ার স্বাদ জেগেছে মনে?দেশে ফিরে তো একটা পার্টিও দিলি না শাল__” বাকি কথাটা গিলে নেয় আশেপাশের পরিস্থিতি বুঝে।সে তো ভুলেই গিয়েছিলো এখন সে তারই ডিপার্টমেন্টের ছাপ্পান্ন ব্যাচ ক্লাসের সামনে।
নুজাইশের কথা শুনে বিরক্ত হয় মেহরান। বলে,
“বাজে কথা বাদ দে।আমার চাচাতো বোন রাউশি এই ভার্সিটি ভর্তি হয়েছে পারলে ভার্সিটি থাকাকালীন ওর কোনো সমস্যা হলে কাইন্ডলি নিজের বোন ভেবে হেল্প করবি।”
মেহরানের একটু কাছে আসে নুজাইশ।আস্তে দুষ্টুমি করে বলে,
“বোন না ভেবে অন্যকিছু ভেবে করা যায় না?”
তৎক্ষনাৎ নুজাইশের দিকে তাকায় মেহরান। মেহরানের এমন চাহনী দেখে নুজাইশ হেসে ফেলে।মেহরান কিছু না বলে হুট করেই চলে যায়।নুজাইশ ডাকে তবে থামে না।নুজাইশ জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছে তার চাচাতো বোন কে?নুজাইশ তো চেনে না।কাকে আন্দাজে সাহায্য করবে?কিন্তু মেহরান তো চলে গেলো?এটা ভেবেই নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে নুজাইশ।তখনই ‘ওপস’ আওয়াজ শুনে পাশে তাকাতেই দেখে ক্লাসের মেয়েগুলো তার দিকেই কুনজরে তাকিয়ে।চোখ দিয়েই গিলে খাওয়ার প্রবণতা বেশি তাদের। নুজাইশ ক্লাসে ঢুকতেই সবাই খুব ভদ্রভাবে সালাম জানাই নুজাইশকে।মেয়েগুলো শুধু তার দিকেই তাকিয়ে আছে হা করে।একেকজন পারছে তো চোখ দিয়েই নুজাইশকে গিলে খাচ্ছে।এতে অবশ্য নুজাইশ পাত্তা দেয় না।সে নিজমতো ক্লাস নিয়ে চলে যায়।
নতুন ক্লাসে আসতেই একটা বান্ধবী জুটে যায় রাউশির।মেয়েটার নাম রুনা।রুনা ভীষণ চটপটে, দুষ্টু, মিশুক স্বভাবের।রাউশির কেমন যেন ভালো লাগলো মেয়েটাকে।মেয়েটি রাউশিকে তার বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।এতে রাউশির আরও কতকজন বন্ধু মেলে।যাদের নাম হাসিব, মিলি, শ্রুতি, নাঈম আর সর্বশেষ রুনা। রাউশি প্রথম ক্লাস শেষে লাইব্রেরিতে যেতে চাই।বাকিরাও সহমত প্রকাশ করে।সবার সাথেই বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে একদিনেই। লাইব্রেরিতে তখন কেউ ছিলো না শুধু রাউশিরা ছিলো।তবে তাদের খেয়াল ছিলো না তারা বাদে আরও একজন আছে লাইব্রেরিতে।রাউশি বুকশেল্ফ থেকে পা উঁচু করে পছন্দসই একটি বই নিতে গিয়ে বইটি ওপাশে পড়ে যায়।আর একদম গিয়ে পড়ে নুজাইশের মাথায়।নুজাইশের সেকেন্ড পিরিয়ডে ক্লাস একটা সেটাও সবার শেষে।তাইতো লাইব্রেরিতে আসে বই পড়তে তবে হুট করেই মাথার ওপর বই পড়তেই হতচকিয়ে উঠে সাথে ব্যাথায় শব্দ করে ওঠে।তৎক্ষনাৎ ফিজিক্সের নিউটনের তিনটি সূত্রাবলি তড়িৎ বেগে মাথায় নাড়াচাড়া দিয়ে ওঠে।সাথে এটা মনে হতে থাকে নিউটনের মাথায় আপেল পড়েছিলো তার মাথায় কি পড়েছে দেখার জন্য পাশে তাকাতেই মোটা একটি বই দেখে ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে ফেলে।আবার রেগে যায় ভীষণ। নিশ্চয় কেউ ইচ্ছে করে করেছে এটা ভেবে হেটে ওপাশে এসে দেখে রাউশি কেমন চোড়াচোখে সেদিকেই তাকিয়ে।রাউশি নুজাইশকে দেখে চমকে ওঠে।নুজাইশ রাউশিকে উপর নিচ দেখতে থাকে।গলায় ঝুলানো আইডি কার্ডে নাম দেখে মৌরিন খান লেখা।রাউশির সার্টিফিকেটে মৌরিন খান দেওয়া।তবে বাড়ির সবাই এমনকি পুরো জাতির কাছেই যেন সে রাউশি নামেই পরিচিত।তবে নুজাইশের ভাবনায় মৌরিন নামটাই স্থান পায়।নুজাইশ বুঝতে পারে মেয়েটা দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।কিন্তু আগে কখনো দেখেনি নুজাইশ একে।আজ তিনমাস হলো এই ভার্সিটিতে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে জয়েন করেছে সে তবে এই মেয়েকে দেখেনি এখনও।মেয়েটির আপাদমস্তক দেখে।দেখতে ভীষণ মিষ্টি হলেও চোখের চাহনী ভারি কঠিন মনে হলো নুজাইশের।নিজের ইমেজ ঠিক রাখতে এবং এটিটিউড দেখাতে বলে,
“হাও ডেয়ার ইয়্যু। আমার মাথায় বই ফেলে দেওয়ার কারণ কি?শিক্ষককে সম্মান দিতে জানো না?”
কথাটা একটু জোরেসড়ে বলায় ওপাশে থাকা রুনারাও শুনতে পায়।তাড়াতাড়ি চলে আসে এদিকে।নুজাইশ স্যার আর রাউশিকে ওভাবে দেখে কাছে যায়।রাউশি মাথা নিচু করে ভদ্রতার সাথে জবাব দেয়,
“ক্ষমা করবেন স্যার।আমি আপনাকে দেখতে পায় নি।”
নুজাইশ কিছু বলার আগেই রুনা সেখানে গিয়ে বলে,
“স্যার ও আজই নতুন ভার্সিটি এসেছে।দয়া করে বকাঝকা করবেন না প্লিজ।”
বলেই রাউশিকে নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে তারা।নুজাইশ কিছু বলতে যেয়েও থেমে যায়।রাগ লাগে ভীষণ।হনহনিয়েও সে বেরিয়ে যায়।আর কিছু সময় বাদেই এদের ক্লাস তখন মজা বোঝাবে ভেবে সিদ্ধান্ত নেয়।
রাউশিরা নিজেদের ক্লাসে যাওয়ার সময় তাদের পাশ কাটিয়ে দুজন মানুষ হেঁটে যায়। রাউশি ভালোভাবে খেয়াল না করলেও চেনা চেনা লাগে তার।পেছনে ফিরে ভালোভাবে তাকাতেই চমকে যায় সাথে তির তির করে রাগও বাড়তে থাকে তার।এই জানোয়ার এখানে কি করছে?মাথায় ঘুরতে থাকে,
“আয়াশ এখানে কি করছে?”
চলবে….
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/