#মেহেরজান
লেখনীতে- #সোহা
পর্ব ৬
আয়াশকে দেখতেই মুখ ঘুরিয়ে নেয় রাউশি। রাগ লাগছে তার।এই ছেলে এখানে কি করছে?ভার্সিটিতে তো ভর্তি হবে না আর। আর কি কাজে আসতে পারে?আবার তাদেরই ডিপার্টমেন্টে?নাকি জবের জন্য এসেছে?তখনই হালকা আওয়াজে শুনতে পায় আয়াশের সাথে তাদের ডিপার্টমেন্ট হেড কথা বলছেন।
“আপনি আজ থেকেই ক্লাস নিতে পারেন মি. আয়াশ।”
রুনা পাশ থেকে বলে,
“এই থেমে গেলে যে?”
পেছনে একবার তাকিয়ে আবারও বলে,
“ইনি মনে হয় নতুন লেকচারার।আজ এসেছে।ডিপার্টমেন্ট হেড গতকালই বলে রেখেছিলেন।”
রাউশি এবার কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ে। শেষমেষ কিনা তারই ভার্সিটি, ডিপার্টমেন্টে। কিভাবে সহ্য করবে ওই জানোয়ারকে? ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে রাউশির। রুনা টেনে নিয়ে যায় রাউশিকে।ক্লাসে এসে সবাই মিলে গল্প করতে থাকে।রুনা জিজ্ঞাসা করে,
“সকালে তোমার সাথে একটা হ্যান্ডসাম ছেলে দেখলাম সে কি তোমার বয়ফ্রেন্ড?”
রুনা যে মেহরানের কথা বলছে এটা রাউশি বুঝে যায়।চটজলদি রুনার ধারণা পালটে দিয়ে বলে,
“কিসের বয়ফ্রেন্ড।আমার কাজিন ভাই সে।”
রুনার চোখ চকচক করে ওঠে।পাশে বসা মিলি খুশি হয়ে বলে,
“আরেহ ছেলেটা তো একদম জোস।আমার দারুণ লেগেছে।সেটিং করিয়ে দিও।যেহেতু তোমার কাজিন।”
চোখ ছোট ছোট করে মিলিকে দেখে রাউশি। মিলি রাউশিকে দেখে দাত কেলিয়ে হাসে। রাউশি বলে,
“মেহরান ভাই অনেক রাগী।”
রুনা বলে,
“হোক রাগী।ভালোবাসায় শান্ত বানিয়ে ফেলবো।”
কথাটা শুনে বাকিরা হেসে ওঠে।ক্লাসে এখনও স্যার আসে নি।তাই এতো গল্প করছে সবাই।
“এই রুনা তুই এতো লুচু কেন?”কথাটা হাসিব বলে ওঠে।হাসিবের কথা শুনে রুনা তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে।হাসিব, নাঈম আরও একটি ছেলে যার নাম ইউসুফ সে রুনাদেরই পাশের সাড়িতে তাদের বরাবর বেঞ্চে বসে।রুনা হাসিবের চুল টেনে দেয়। হাসিব চেঁচিয়ে ওঠে।
” ছাড় আমাকে।কি করছিস কি?চুল ছাড়।”
“ছাড়বো না।তোর চুল ছিড়ে এগুলো দিয়ে মালা বানাবো।”
হাসিবের পাশে বসা নাঈম বলে,
“চুল দিয়ে মালা কিভাবে বানায় রুনা?”
“আগে হাসিবের মাথার চুলগুলো ছিড়ে নেই তারপর তোর পালা।”
বাকিরা হাসছে।রাউশি ভাবনা মত্ত।আয়াশ কি তাদের ক্লাসও নিবে?রুনা যেহেতু বলছে লেকচারার তাহলে নিতেও পারে।রাউশির এসব ভাবনার মাঝে ক্লাস গম্ভীর হয়ে উপস্থিত হয় নুজাইশের।সবাই উঠে সালাম দাঁড়ায়।রাউশিরা শেষের এক বেঞ্চ আগে বসেছে।তারাও উঠে দাঁড়ায়।নুজাইশ সালামের উত্তর দিয়ে সবাইকে বসতে বলে। কথামতো সকলে বসে পড়ে।নুজাইশ একটি চ্যাপ্টার পড়ানো শুরু করে।পেছনে রুনা আর হাসিব ঝগড়া করছিলো শান্তস্বরে তবে সেটা নুজাইশ শুনে ফেলে।সামনে তাকিয়ে রাউশির দিকে আগে চোখ যায়।রুনাকে না দাড় করিয়ে সে রাউশিকে উদ্দেশ্য করে দাড়াতে বলে।রাউশি থতমত খেয়ে যায়। কোনো কথা না বলে সেও দাঁড়িয়ে যায়।
“কথা বলছো কেন ক্লাসে?”
রাউশি যথেষ্ট বুদ্ধিমান।দোষটা তার নয়।তবুও তার নামে অভিযোগ উঠেছে।তাও সে মাথা নিচু করে ভদ্রভাবে উত্তর দেয়,
“ক্ষমা করবেন স্যার।এমনটা আর হবে না।”
নুজাইশ এবার কিছুটা চমকিত হয়।ভাবটা প্রকাশ করে না।মেয়েটার ব্যবহার আর কথাটা শুনে নিজেও মুগ্ধ হয়।এবার মেয়েটাকে ভালোভাবে খেয়াল করে নুজাইশ।দেখতে কিছুটা হলিউড অভিনেত্রী ‘ডাকোটা ফান্নিং’ এর মতো তবে চোখের মণি ঘনকালো।নুজাইশ আর কিছু বলতে না পেরে বসতে বলে।রাউশিও বসে পরে। নুজাইশ আবারও নিজ কাজে মন দেয়। বোঝানোর পর এবার সে প্রশ্ন করে সবার উদ্দেশ্যে,
“এনি কুয়েশ্চন এনিওয়ান?”
একটি মেয়ে তালগাছের মতো দাঁড়িয়ে বলে,
“স্যার।”
নুজাইশ মেয়েটির দিকে তাকাতেই মেয়েটি আবারও বলে,
“নো কুয়েশ্চন স্যার।”
ক্লাসের সবাই হেসে ওঠে।রাউশিও হেসে ওঠে।সেই মেয়েটি আবারও বলে,
“আমি তো শুধু আপনাকেই দেখছিলাম।”
আবারও হাসে সবাই।কয়েকজন তো উত্তেজনার ঠেলায় হাত তালিও দিয়ে ওঠে।নুজাইশ রেগে যায়।ধমকে ওঠে মেয়েটিকে। মেয়েটি নুজাইশ স্যারের ধমক খেয়ে বসে পড়ে।নুজাইশ হাতঘড়িতে টাইম দেখে নেয়। আর এক মিনিট বাকি আছে এই ক্লাসের। তখনই ডিপার্টমেন্ট হেড ক্লাসের দরজার সামনে আসে।নুজাইশের থেকে অনুমতি চায় আসার জন্য।ক্লাসে আসেন তিনি।পেছন পেছন আয়াশও উপস্থিত হয়।এতক্ষণ এসবের দিকে খেয়াল না থাকলেও ডিপার্টমেন্ট হেড কবির স্যার যখনই বলেন,
“ইনি আপনাদের নিউ লেকচারার।”
তখনই চোখ বড় বড় করে মাথা তুলে সামনে তাকায়।আর আয়াশকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।আয়াশকে হাসিমুখে সবাই সালাম জানায়।আয়াশও সালামের উত্তর দেয়।এরই মাঝে তার চোখ পেছনের বেঞ্চের স্টুডেন্টদের দিকে যেতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় রাউশিকে দেখে।আয়াশ রাউশির দিকেই তাকিয়ে থাকে।এই ভার্সিটিটা শহরের নামকরা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। খুব কষ্টে এখানে লেকচারার এর পদ পেয়েছে।এখন যদি আবার এই খান পরিবার তার পেছনে লাগে তাহলে বাঁচা মুশকিল হয়ে যাবে আয়াশদের।আয়াশ এতক্ষণ রাউশির দিকেই তাকিয়েছিলো।পাশে থাকা কবির স্যার বারকয়েক আয়াশকে ডাকতেই আয়াশ সৎবিৎ ফিরে পায়।কবির স্যারের দিকে ফিরে তাকাতেই কবির স্যার হেসে বলেন,
“আপনি যদি চান, এখনই এই ব্যাচে এক্সট্রা একটা ক্লাস নিতে পারেন।”
আয়াশ চটজলদি বলে,
“না স্যার আগামীকালকে। আজ একটু ক্লান্ত আমি।”
কবি স্যারও মাথা নাড়ায়।দুজনে চলে যায়।তবে আয়াশ যাওয়ার আগেও রাউশির দিকে একবার তাকিয়ে চলে যায়।আয়াশের এমন চাহনী রাউশির মোটেও সহ্য হচ্ছিলো না। আয়াশ যেতেই হাফছেড়ে বাঁচে।রাউশি মোটামুটি একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে এই আয়াশকে নিয়ে।এবার সে আয়াশকে আচ্ছা মতো শিক্ষা দেবে এই ভার্সিটিতেই।
.
অবসন্ন বিকেল।পক্ষীকলতানে আশপাশ মুখরিত।ছাদে পাতানো দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে রাউশি।তার মন ভালো নেই।দিন গুলো কেমন নিরব লাগে।বাড়িতে এত এত মানুষ থাকতেও নিজেকে একা মনে হয় তার।কি যেন একটা নেই এই অনুভুতি বড্ড পীড়া দেয় তাকে।গাড়ির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।কেউ এসেছে হয়তোবা।রাউশিকে ডাকার জন্য ছাদে আসে তানিয়া।
“রাউশিপু।”
রাউশি পেছনে তাকায়।তানিয়া তার কাছে আসে।আর বলে,
“নিচে এসো।মেহরান ভাই তোমাকে ডাকছে।”
“কেন?”
“জানিনা।ভাইয়া বললো তোমার নাকি কিসের প্রয়োজন।”
“কিসের প্রয়োজন?”
“এটা তো জানি না।চলো চলো।নিচে চলো।”
“এই দাড়া তানি।”
তানিয়া থেমে রাউশির কাছে আবারও আসে।রাউশি বলে,
“মেহরান ভাই কখন এসেছে?”
“এইতো এইমাত্র আসলো।আমাকে নিচে দেখে তোমায় ডাকতে বললো।”
ওহ বলে রাউশিও উঠে দাঁড়ায়।নিচে নেমে আসে দুজনে।তবে নিচে মেহরান নেই। উর্মিলা বেগমকে দেখে রাউশি উনার কাছে যায়।উর্মিলা বেগম রাউশিকে দেখতেই হাসে।মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“মৌরি মা যা রেডি হয়ে নে।মেহরান তোকে নিয়ে শপিং এ যাবে।তোর তো কিছু জিনিস কিনতে হবে তাই না।”
‘মৌরিন’ নামটায় বাড়ির কেউ ডাকে না।শুধু উর্মিলা বেগমই খুব আদর করে ‘মৌরি’ ডাকেন।এতে অবশ্য রাউশিরও ভালো লাগে।মাথা নাড়িয়ে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে পা চালায়।রুমে এসে রেডি হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে।তানিয়াও তার পিছু পিচু এসেছে।রাউশি দুটো ড্রেস বের করে তানিয়াকে বলে,
“কোনটা ভালো হবে তানি?”
“তোমাকে লাল ড্রেসে সুন্দর লাগে।এই লাল জামাটা পড়ো।”
অদ্ভুত হলেও রাউশির লাল রঙ ভীষণ পছন্দের।লাল আর হলুদ।রাউশির মতে লাল আর হলুদ রঙ একে অপরের জামাই বউ।এটা সে ছোট থেকেই ভেবে আসছে।এমনকি লাল রঙের সাথে সে কখনোই অন্য রঙ সহ্য করতে পারে না বললেই চলে। রাউশিও লাল ড্রেসটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে।কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে আসে। লাল সালোয়ার কামিজ।ওড়নাটাও লাল।দেখতে ভীষণ সুন্দর লাগছে রাউশিকে।রাউশির চুলগুলো বেশি লম্বা নয়।ঘাড় সমান হতে আরেকটু লম্বা।চুলগুলো ঝুটি করে নেয়। তানিয়া রাউশির কাছে এসে বলে,
“আপু তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে।”
রাউশি হালকা হাসে।তানিয়াসহ দুজনে বেরিয়ে যায় রুম থেকে।রূপা বেগম কআজ করছিলেন মেয়েকে দেখে চমৎকার হাসেন। কাছে গিয়ে গালে হাত রেখে শুধান,
“মাশাল্লাহ আমার মেয়েটাকে খুব সুন্দর লাগছে।কারো নজর না লাগুক।এখন যা মেহরান বাইরে তোর জন্য অপেক্ষা করছে।”
রাউশিও বাইরে বেরিয়ে আসে।মেহরান কালো শার্ট আর প্যান্ট পড়ে ছিলো। রাউশি কাছে যেতেই ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকা মেহরান চোখ তুলে সামনে তাকায়।রাউশিকে আসতে দেখে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে।রাউশির মাঝে কোনো জড়তা নেই।নেই কোনো ভয়। বাড়ির সব ছেলেমেয়েগুলো যখন মেহরানকে বেশ ভয় পায় সেখানে রাউশি খুব শান্ত।মেহরানের মন হঠাৎ করেই বলে ওঠে ‘মেয়েটাকে আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে’।চোখ জুড়ে মুগ্ধতার মাত্রা বেড়ে যায় মেহরানের।রাউশি কাছে আসতেই মিষ্টি সুঘ্রাণ নাকে এসে লাগে মেহরানের।নিমিষেই তার খিটখিটে মেজাজটা শান্ত হয়ে যায়। ঘোরে চলে যায় নি মেহরান।রাউশির থেকে চোখ ফিরিয়ে গাড়ির দরজা নিজেই খুলে দেয়।রাউশি তার পাশ দিয়ে গাড়িতে উঠে বসে।রাউশির চুল থেকে সুমিষ্ট ঘ্রাণ বেরোতেই মেহরানের খুব করে মন যেন চেয়ে উঠলো রাউশির চুলে একবার নাক ডুবাতে।পরক্ষণেই নিজের ভাবনাকে ঠেলে দিয়ে নিজেও গাড়িতে উঠে বসে।সিটবেল্ট লাগিয়ে একবার রাউশির দিকে তাকায়। রাউশি সিল্টবেল্ট লাগিয়েই ভদ্রভাবে বসে আছে।মেহরানের অনুভুতিটা আজ অন্যরকম সুন্দর মনে হচ্ছে।তার যেন রাউশিকে খুব করে একবার বলতে ইচ্ছে করছে “রাউশি লাল রঙে তোকে খুব ভালো মানায়।”
এমন অনুভুতি খুবই নতুন মনে হয় মেহরানের কাছে।রাউশি অন্যদের তুলনায় আলাদা।মেয়েটার এই দিকটা যেন নজরকাড়া লাগে মেহরানের।সামনে তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়।মেহরান রাউশিকে বলে,
“কেমন কাটলো ভার্সিটির প্রথম দিন?”
রাউশি আয়াশের কথা মেহরানকে বলবে কিনা ভাবছিলো।তবে সেটা না বলে উত্তর দেয়,
“ভালো কেটেছে ভাইয়া।”
“যদি বন্ধুবান্ধব হয়ে থাকে আজ তাহলে তারা ব্যতীত অন্য ছেলেদের থেকে দূরে থাকবি।আর ছেলে বন্ধুদের সাথেও এত মিশবি না।”
রাউশি মেহরানের দিকে তাকায়।মেহরানের কথাটা বোধগম্য হলেও উদ্দেশ্য বোধগম্য হলো না।খুব ছোট করেই মেহরানই আবার বলে,
“আজ এই মুহুর্ত থেকে কেউ একজন হয়তো সহ্য করতে পারবে না।”
চলবে…
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/