ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-১৩)
হালিমা রহমান
আকলিমা খাতুন কপাল কুঁচকে চেয়ে থাকেন স্বামীর দিকে।রিনরিনে গলায় বলেনঃ” আমি আপনেরে কিছু জিগাইছি।”
_” হু,কি যেন জিগাইছিলা?”
_” এতো টাকা কই পাইছেন আপনে?”
_” এডি তথার টাকা।তথার কামের টাকা আমার কাছে দিছে।”
_” এতো টাকা! এতো ছোট একটা কাজের লেগা এতো টাকা দেয়?”
_” কি জানি! দিলো তো।”
_” কে দিছে?”
_” ডিরক্টর আখতার হোসেন।”
_” এডা ওই যে ওই ব্যাডা না,আপনেগো গ্রামে যে থাকে।গড়ের পুকুরের পাশে যে একটা বড় বাড়ি আছে।হেয়নি?”
_”হ।”
_” ওই ব্যাডার তো শুনছি অনেক দোষ। কিসব দুই নাম্বারি কাজ-কাম করে।হের লগে কাম করতাছে তথায়! কি কন এডি।মাইয়া তো যাওয়ার আগে হের নাম কয় নাই আমারে।কইলে আমি কহনো যাইতে দিতাম না।”—- শেষের দিকে আকলিমা খাতুনের গলা কেঁপে উঠে।মেয়ে তার কোন গর্তে পড়েছে আল্লাহ মালুম!
_” আরে লিমা, তুমি শুধু শুধু দুঃশ্চিন্তা করতাছো।আমগো তথার রাজ কপাল।ওয় অনেক ভালো জায়গায় পড়ছে।ডিরেক্টর স্যার ওরে ঠিক জায়গায় পৌঁছায় দিব।চিন্তা কইরো না।”
_” ঠিক জায়গা আবার কি,হ্যাঁ? ওই ডিরেক্টর দুই বছর আগে কি করছে,শুনেন নাই?গ্রাম থেকা দুইডা মাইয়ারে কামের কথা বইলা ঢাকায় আনছিল।পরে মাইয়াগোরে বিদেশে পাঠায় দিছে।মাইয়ার বাপ-মায় কি হেরে এই কামের অনুমতি দিছিলো?তবুও পাকনামি কইরা করছে। কত বড় হারামজাদা!”
_” চুপ কর, লিমা।যা বুঝো না, তা নিয়া কথা কইবা না।তুমি কি বুঝো এগুলির?মাইয়া মাইষের লগে কথা কওনই ভুল।দেও টাকাডি দেও।সবকিছু তে বাড়াবাড়ি।যত্তসব।পন্ডিত আইছে এক্কারে।সব জানে।”
ইকবাল মিয়া চোখে-মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে টাকাগুলো আলমারিতে সংরক্ষণ করেন।আকলিমা খাতুনকে বিড়বিড় করে কয়েকটা গালি দেন।আর আকলিমা খাতুন? তিনি বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে থাকেন স্বামীর দিকে।এই ইকবাল মিয়াই এক বছর আগে আখতার হোসেনকে দেখতে পারতেন না।কত নিন্দা করতো এই লোকের।আখতার এটা করেছে, ওটা করেছে,সে একটা কুলাঙ্গার –এরকম আরো কত কি।আজ কি হলো? ইকবাল মিয়া কবে থেকে ডিরেক্টরের এতো ভক্ত হয়ে গেলেন? এতো বড় মেয়েকে এরকম খারাপ একটা লোকের সাথে কাজে পাঠাতে একটুও দ্বিধা করলেন না!হিসাব মেলাতে পারেন না আকলিমা খাতুন।তার মাতৃহৃদয়ের এককোনে দুর্ভাবনারা বাসা বাধে।মনের কোনে ভয় জমে। মেয়েটা ভালো থাকবে তো?ইকবাল মিয়াকে আর কোনো প্রশ্ন করেন না আকলিমা খাতুন।কেবল জ্বিভ নাড়িয়ে পরম দয়াময় সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেন। ” আমার মাইয়াডারে সুস্থভাবে ঘরে ফিরায়া দেও আল্লাহ।আমার তথারে আমার বুকে ফিরায়া দেও।”
ঘর থেকে এলোমেলো পায়ে বেড়িয়ে যান আকলিমা খাতুন।তিনি এখন তথার ফোনে হাজারবার কল করবেন।তথার সাথে কথা না বলা অবধি তার ছটফটানি কমবে না।
এই ডিরেক্টরকে নিয়ে গ্রামে অনেক কথা প্রচলিত আছে।বলাবাহুল্য, সেগুলো মোটেও ভালো কথা নয়।একদম নিম্নবিত্ত ঘড় থেকে উঠে এসেছে আখতার হোসেন।বয়স হলেও কাজ করতো না সে।বিশ বছর বয়সে চুরির দায়ে গ্রামছাড়া হয়েছিল।তারপর বহুদিন আর দেখা পাওয়া যায়নি তার। বছর সাতেক আগে বহু বছর পর আখতার হোসেন যখন আবার গ্রামে ফিরলেন, তখন তার রমরমা অবস্থা।মাস তিনেকের মাঝেই পুরোনো ভিটায় নতুন করে বিশাল এক বাড়ি করলেন।গড়ের পুকুরে নতুন করে চকচকে ঘাট তৈরি করলেন।গ্রামবাসীর চক্ষু চড়কগাছ।চোরা আখতার এতোদিন কোথায় ছিল,কি করতো, সৎ কাজ নাকি অসৎ কাজ–এসব নিয়ে গবেষণা শুরু হয়ে গেল সবার মাঝে।এসব খবরে বেশ কয়েকদিন চায়ের দোকান সরগরম থাকতো। কেউ কেউ বলতো আখতার হোসেন শহরে যেয়ে ভালো কাজই করেছে।সৎ কাজ করেই এতো টাকা কামাই করেছে।এসব কথা শুনে আরেকদল মুখ ভেংচি দিলো।হুহ! সৎভাবে কেউ এতো তাড়াতাড়ি এতো টাকা কামাতে পারে।এসব অসৎ কাজের ফল নিশ্চয়ই। কতদিন এই দুই দলের মাঝে তর্কাতর্কি,কথা-কাটাকাটি চলেছে।চায়ের কাপে ঝড় উঠতো এসব আলোচনাকে ঘিরে।
ডিরেক্টর আখতার হোসেন কিন্তু এসব কথায় বিন্দুমাত্র পাত্তা দিলেন না।বাড়ি করার পর একপাল ছেলে-মেয়ে নিয়ে গ্রামে ঘুরতে গেলেন।রক্ষণশীল গ্রাম্য সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হৈ-হুল্লোড় করে আবার কিছুদিন পর ফিরে এলেন।যারা পূর্বে আখতার সাহেবের পক্ষে ছিল তারা মাথা নিচু করে ভুল স্বীকার করলো।না,আখতার সাহেবকে তারা যতটা ভালো-ভদ্র ভেবেছিল ততোটা সাধু-সন্যাসী সে নয়।এতো বছরে তার অনেক নৈতিক অধঃপতন হয়েছে।অনৈতিক মানুষেরা আবার সৎপথে চলতে পারে নাকি?
***
বিকালের নরম আলোতে সবকিছু উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।সবদিকে কেমন একটা শান্ত-স্নিগ্ধ ভাব।কোনো আওয়াজ নেই,হৈ-হুল্লোড় নেই,গাড়ি-ঘোড়ার অযাচিত শব্দ নেই,আশেপাশে দূষিত বায়ু নেই।বারান্দায় দাঁড়িয়ে সবটা আনমনে দেখে সোনালী।সে মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নেয়।শেষ বয়সে সে গ্রামে থাকবে।কোনো অজপাড়া এক গায়ে।যেখানে যানবাহনের শব্দে কান ঝালাপালা হবে না,দূষিত বায়ুর কারণে শ্বাসকষ্ট হবে না,ফরমালিনের খাবার খেয়ে পেট খারাপ হবে না।রিটায়ার্ড করার পরেই গ্রামে চলে আসবে।দো-চালা ঘর করবে একটা।ছোট্ট ঘরের সামনে একফালি উঠোন থাকবে।উঠোনে বুনবে লাল শাকের চারা,লাউশাক,কুমড়ো শাকের চারা।এককোনে একটা বাতাবি লেবুর গাছও থাকবে। ছোট একটা পুকুর করবে সোনালী।সেখানে শুধু তেলাপিয়া মাছ ছাড়বে।যখনই মাছ খেতে ইচ্ছে করবে,তখনই পুকুরের শেষ ঘাটে পিড়ি পেতে বসে বড়শি ফেলবে। সাধ মিটিয়ে পছন্দের মাছ ধরে ছোট লালশাক দিয়ে রাঁধবে। মাটিতে লেপ্টে বসে সস্তা স্টিলের প্লেটে গরম তরকারি দিয়ে গরম ভাত খাবে। আহ! ভাবতেই জ্বিভে পানি চলে আসে সোনালীর।হাত ঘড়ির দিকে একবার নজর বুলায় সে।বিকাল চারটা বাজে।আজকে তারা ডাহুক নদীর তীরে ঘুরতে যাবে। এই নদীর পাড়ে নাকি শুটিং হবে।শুটিংয়ের কথা মনে করে হাসে সোনালী।শুটিং নয়,দুধ-ভাতের লোভ দেখিয়ে এ পর্যন্ত তাদেরকে টেনে আনা হয়েছে।
সোনালী ঘরের দিকে পা বাড়ায়।ওর তৈরি হতে দু-মিনিট সময় লাগেনি।অথচ সবার কতো সময় লাগছে। কতো কিছু মাখছে এরা মুখে? বিয়ে বাড়িতে দাওয়াত খেতে যাবে নাকি?আশ্চর্য! বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে আসে সোনালীর।তথাকে একপ্রস্থ কথা শোনাতে ঘরের দিকে যায়।
কুচকুচে কালো রঙের একটা শাড়ি গায়ে জড়িয়েছে তথা।সুতির শাড়িতে সোনালী রঙের আঁচল। নিচু করে একটা খোপা করে নেয় সে।চোখে মোটা করে কাজলের রেখা আঁকে।আসার পথে ব্যাগে করে দুই ডজন রেশমি চুড়ি এনেছিল।কালো রঙের ছয়টা চুড়ি হাতে গলায় তথা।সামনের চুলগুলো খানিক অগোছালো হয়েছিল।সেগুলোতে আরেকবার চিরুনি চালিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখে। সব ঠিক আছে।শুধু খোপায় একটা টকটকে লাল রঙের কৃষ্ণচূড়া গুজতে পারলে ষোলকলা পূর্ণ হতো।নিচে নেমে একটা ফুল কুড়িয়ে খোপায় গোজার সিদ্ধান্ত নেয় সে।আয়নার দিকে চেয়ে সন্তুষ্টির হাসি হাসে তথা। দারুন লাগছে দেখতে।নদীর তীরে ঘুরতে যাওয়ার ক্ষেত্রে সাজটা একটু বেশিই হয়ে গেছে।কিন্তু,তাতে কি?তথা খুব সাজতে ভালোবাসে।মেয়েরা না সাজলে সাজবে কারা?এই কাজল,শাড়ি কারা ব্যবহার করবে?এসব তো মেয়েদের জন্য।
_” তথাপু করেছো কি তুমি?তোমায় যা লাগছে না।ইশ! ছেলে হলাম না কেন?আমি ছেলে হলে এক্ষুনি কাজি অফিসে নিয়ে জোর করে বিয়ে করতাম তোমায়।”
_” খুব বেশি সুন্দর লাগছে নাকি?”
_” তা আবার বলতে।তোমায় ঠিক রাতের আকাশের এক টুকরো চাঁদের মতো লাগছে।উজ্জ্বল সুন্দর চাঁদ।আসো আসো একটু থু থু ছিটিয়ে দেই।তাহলে কারো নজর লাগবে না।”
চওড়া হাসি দেয় তথা।প্রশংসায় কে না খুশি হয়?
_” আর চাপাবাজি করতে হবে না।চলো নিচে যাই।সবাই বোধহয় তৈরি হয়ে নিচে অপেক্ষা করছে।”
_” হাহ! সত্যি কথার ভাত নাই আজকাল।আমি মোটেও চাপা মারছি না।”
_” আচ্ছা মানলাম।এখন নিচে যাই চল।”
নিচে শুধু শাফিন, খোকন ও দুটো মেয়েকে চোখে পড়লো সোনালীর।মেয়ে দুটোকে চিনে না সে।দুজনের মাঝে একজন তথার দিকে একবার চাইলো মাত্র।তারপর আবার ফোনে ডুব দিলো।কিন্তু আরেকটা মেয়ে এগিয়ে এলো তথার দিকে।মিষ্টি হেসে বললঃ” আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে,আপু।”
_” ধন্যবাদ।”– মৃদু হেসে উত্তর দেয় তথা।
_” আপনার নামটা কি জানতে পারি?”
_” আমি তথা।তুমি?”
_” মালিহা খানম।আপনিই কি নায়িকা?”
_” না।আমি সহকারী চরিত্র।তুমি কোন চরিত্রে আছো?”
_” কাজের মেয়ে”—মন খারাপ করে মাথা নিচু করে ফেলে মেয়েটা।বরাদ্দ চরিত্র নিয়ে সে মোটেও খুশি নয়।
_” মন খারাপ করো না আপু। তুমি তো তাও পুরো নাটকে ঝাড়া-মোছা করবে।আর আমি কি করব, জানো? বোবার মতো মাঝে মাঝে নায়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকব।আমি নায়কের বোবা ভাগনীর চরিত্রে আছি। সারা নাটকে আমার কোকিল কন্ঠ শুনবে না কেউ।দর্শকদেরকে আমার সমধুর কন্ঠ শোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে এরা।হুহ!”
সোনালীর কথায় হেসে উঠে তথা।তা দেখে গর্জে উঠে সোনালী।
_” খবরদার তথা আপু,হাসবে না।নিজে ভালো চরিত্র পেয়েছ বলে আমার দূর্ভাগ্যে হাসতে হবে কেন?”
তথা নাটকীয় ভঙ্গিতে ঠোঁটের উপর আঙুল রাখে।ইশারায় বলেঃ” আচ্ছা,আর কথা বলব না।”
_” আচ্ছা মালিহা আপু,আপনি এখানে চান্স পেয়েছেন কিভাবে?মানে কার মাধ্যমে এ পর্যন্ত এসেছেন?”
_” আমি আমার………
ওদের কথার মাঝে আর দাঁড়ায় না তথা।সোনালী ভীষণ কৌতূহলী।মেয়েটা সেকেন্ডের মাঝে ভাব জমাতেও পারে।কোনো জড়তা কাজ করে না ওর মাঝে।তথা কৃষ্ণচূড়া গাছের কাছে যায়।নিচে অনেক ফুল পড়ে আছে।বেশিরভাগ নেতানো।খোপায় দেওয়ার মতো উপযুক্ত ফুল খুঁজে পায় না তথা।
_” আপনি কি কিছু খুঁজছেন,মিস তথা?”
শাফিনের কন্ঠে পাশ ফিরে তাকায় তথা।সে এতোক্ষণ অশ্বত্থ গাছের নিচে বেঞ্চিতে বসা ছিল।
_” হ্যাঁ, আমি একটা সুন্দর ফুল খুঁজছি।”
_” আমি কি সাহায্য করতে পারি?”
প্রশ্ন করলেও উত্তরের অপেক্ষা করে না শাফিন।গাছ থেকে সুন্দর একটা ফুল পেড়ে দেয়।তথার হাতে দিয়ে বলেঃ” এটা খোপায় দিলে আরো বেশি সুন্দর লাগবে আপনাকে।”
অপ্রস্তুত হাসি হাসে তথা।শাফিনকে সে দেখতে পারে না।তাই কথা বলতে একটু জড়তা কাজ করে ভিতরে।তবে শীঘ্রই তা কাটিয়ে উঠে তথা।হুটহাট অকারণে কাউকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না।
_” মিস তথা,আপনাকে কিছু বলার ছিল।”
_” জ্বি,বলুন।”
_” আসলে প্রথম দেখার কথা আমি এখনো ভুলতে পারিনি।হয়তো আপনিও পারেননি।সেদিন একটু বেশিই বাজে ইঙ্গিত করেছিলাম। ক্ষমা করবেন প্লিজ।আমি আমার আচরণের জন্য লজ্জিত।আমার এরকম করা মোটেও ঠিক হয়নি।আমার ঘরেও মা-বোন আছে।তারাও এরকম আচরণের স্বীকার হতে পারতো।আমার নিশ্চয়ই তখন ভালো লাগতো না।আমি খুবই লজ্জিত।”
_” আপনি যে বুঝতে পেরেছেন এটাই অনেক।যান ক্ষমা করে দিলাম আপনাকে।”
_” সত্যি?”
_” হ্যাঁ, সত্যি।”
তথার কথার বিপরীতে চওড়া হাসি দেয় শাফিন।আশেপাশে একনজর দেখে নিচু স্বরে বলেঃ” বাঁচালেন।সুন্দরী মেয়েরা রাগ করে থাকলে আমার মোটেও ভালো লাগে না।নিজেকে নরাধম মনে হয়।”
_” তাই নাকি?”
_” হ্যাঁ। আরে সেদিন আমার মেজাজ খুব খারাপ ছিল।গার্লফ্রেন্ডের সাথে একচোট ঝগড়া করে ডিরেক্টরের অফিসে গিয়েছিলাম। তাই না চাইতেও খারাপ আচরণ করে ফেলেছি।বুঝতেই পারছেন আমার দোষ ছিল না সেদিন।সব দোষ আমার দজ্জাল প্রেমিকার।”
তথা শাফিনের দিকে তাকিয়ে মুখ বাকায়।
_” আপনারা ছেলেরা শুধু মেয়েদের উপর দোষ চাপাতে পারলেই বেঁচে যান।খারাপ ব্যবহার করলেন আপনি আর দোষ হলো ওই বেচারির?”
_” হ্যাঁ জানি জানি।আপনি মেয়ে তাই আরেকটা মেয়ের কোল টানবেন।তারচেয়ে চলুন পুকুরের দিক থেকে একটু ঘুরে আসি।ওদিকের পরিবেশটা আমার খুব ভালো লাগে।”
_” চলুন।ওদিকটা আমারো খুব পছন্দ। ”
শাফিনের সাথে হাঁটা ধরে তথা।বিকেলের নরম আলো গায়ে মাখতে চায় সে।আজকে খুব ভালো লাগছে তথার।তবে তথা ও শাফিনের একসাথে পথ চলার দৃশ্য ভালো লাগলো না ইউসুফের।সে দাঁড়িয়ে ছিল বাড়ির দরজার সামনে।সানগ্লাসের ঢেকে আছে তার রক্তচক্ষু। তাই,কুঁচকানো কপালের নিচে একজোড়া চোখ তথা ও শাফিনের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে চেয়ে ছিল তা কেউ বুঝতে পারলো না।
***
_ ” ছোট্ট মেয়ে,এটাই সেই প্রাচীন ডাহুক নদী।এটা বাংলাদেশ -ভারতের আন্তঃসীমান্ত নদী।এই নদীতে সারাবছর পানি থাকে।এখানে বর্ষায় বন্যা হয় না আবার নদীর পাড় ভাঙেও না।এর দৈর্ঘ্য…..
_” ধুর ব্যাঙ।আপনাকে একটা ছবি তুলে দিতে বলেছি।এতো লেকচার কে শুনতে চেয়েছে?”
_” আমার কাছে ছবি তুলতে হলে লেকচার শুনতেই হবে।”
_” দিন আমার মোবাইল দিন।আপনার ছবি তোলা লাগবে না।”
মুখ ঝামটা দিয়ে মামুনের হাত থেকে নিজের মোবাইল কেড়ে নেয় সোনালী।অন্যদিকে চলে যায়।মামুন সেদিকে অপলক চেয়ে থাকে।মেয়েটার কাছ থেকে পালিয়ে থাকতে চায় সে।কিন্তু সোনালী যেন পিছুই ছাড়ছে না।এই যে এদিকে পা দেওয়ার সাথে সাথেই মামুনের দিকে ছুটে এসে তার হাতে মোবাইল ধরিয়ে দিল।মিষ্টি হেসে বললঃ” একটা ছবি তুলে দিন তো।আমি ডানপাশে হেলে দাঁড়াব,আপনি বামপাশ থেকে ছবি তুলবেন।ঠিকাছে?”
হাহ! মেয়েটা কি বুঝতে পারছে না মামুন তাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে।যেচে কোনো ভয়ংকরীর ফাঁদে পা দিতে চায় না মামুন।
_” হ্যালো তথা,কই আছোস মা?”
_” নদীর পাড়ে ঘুরতে এসেছি কাকি।জানো জায়গাটা খুব সুন্দর।”
_” এইসব বাদ দে।তুই এক্ষনি ঢাকা চইলা আয়।এক্ষন মানে এক্ষন।”
তথা অবাক হয়ে যায়।এটা আবার কি কথা!
_” কাকি,কাজ শেষ না হওয়া অবধি বাড়ি ফিরতে পারব না আমি।”
_” আমার ভালো লাগতাছে না মা।আয়া পড় না।”
_” তুমি বুঝতে চাইছো না কেন কাকি,আমি ওদের সাথে চুক্তিবদ্ধ। টাকা নিয়েছি আমি।কাজ তো করতেই হবে।”—খানিক বিরক্ত হয় তথা।এক কথা কতবার বলতে ভালো লাগে।
_” আসবি না তুই?”
_” কাজ শেষে আসব।”
_” আসা লাগব না তোর।আল্লাহ তোরে আমার সংসারে আর ফিরায়া না আনুক।আমার কথা না শুনলে আমার সংসারেও আর ঢুকবি না।”
খট করে লাইন কেটে দেন আকলিমা খাতুন।তথা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।কাকি কি সুন্দর করে সম্পর্কের মাঝে সীমারেখা টেনে দিল! চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, তথা ওই সংসারে কেবল বহিরাগত।অনেকদিন পরে নিজের মনেই প্রশ্ন করে তথা।আচ্ছা, আপন মা হলে এমন কথা বলতে পারতো?সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজের মেয়েকে নিয়ে এমন দোয়া করতে পারতো?কে জানে! তথা তো আর মা দেখেনি।
নদীর তীরের শীতল বাতাসে তথার প্রাণ জুড়িয়ে যায়।জলজ বাতাস ছুঁয়ে দেয় তথার ঘাড়,গলা, মুখ,ঠোঁট, নাক,সবকিছু।তথার মনটা ভালো নেই।নদীর পাড়ে একা দাঁড়িয়ে থাকে সে।আশেপাশে সবাই ছবি তুলছে,কথা বলছে, আনন্দ করছে।তথার চোখ বেয়ে একফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে।অতি সন্তর্পণে তা মুছে নেয় সে।
_” মিস তথা,এদিকে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?ওদিকে চলুন।সবাই কত আনন্দ করছে আর আপনি….
_” আমার ভালো লাগছে না শাফিন।আমি এখানেই ঠিক আছি।”
তথার ভারী কন্ঠ কানে বাজে শাফিনের।সে খানিকক্ষণ চিন্তা করে তথার সামনে যেয়ে দাঁড়ায়।মেয়েটার চোখ-মুখ পরখ করে বলেঃ” আপনি কাঁদছেন, তথা।”
_” মোটেও না”—পুরোপুরি অস্বীকার করে তথা।
_” মিথ্যা বলবেন না প্লিজ।আপনি চাইলে আপনার সমস্যাগুলো আমার সাথে শেয়ার করতে পারেন।”
বলবে না চিন্তা করেও বলেই ফেলে তথা।সে কথা চেপে রাখতে পারে না।শাফিনের দিকে একবার নজর বুলিয়ে বলেঃ” আমার পরিবার চাইছে না আমি এখানে থাকি।আমার কাকি একটু আগেও ফোন করে ঢাকা চলে যেতে বলল। খুব জোর করছে কাকি।আমি বুঝতে পারছি না কি করব।”
শাফিন সোজা হয়ে দাঁড়ায়।মুহূর্তেই তার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে যায়। সে গলা শক্ত করে বলেঃ” আপনার কাকি ভুল কিছু বলছে না।ঢাকায় চলে যাওয়া উচিত আপনার।আমিও বলছি চলে যান।পারলে আজকেই ঢাকা চলে যান।সেখানেই আপনি নিরাপদ থাকবেন,এখানে নয়।”
চলবে