ডাহুক_নদীর_তীরে ( পর্ব-২৮) #হালিমা রহমান

0
11

ডাহুক_নদীর_তীরে ( পর্ব-২৮)
#হালিমা রহমান
তথা সবে গেটের বাইরে পা দিয়েছে।এমন সময় কোথা থেকে একদল ছেলে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো তার সামনে।সাত-আটটা ছেলে। প্রত্যেকের বয়স বোধহয় সতেরো-আঠারোর ঘরে।তথার কপাল কুঁচকে যায়। গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করেঃ” কি চাই?”
_” আসসালামু আলাইকুম, ভাবি।কোথায় যাচ্ছেন?”— সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা তথার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পুনরায় প্রশ্ন করে।সে মনে হয় দলের নেতা।তার দৃষ্টি নিচের দিকে।
সকাল সকাল মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল তথার।তবে বাচ্চা ছেলেগুলোর উপর রাগ দেখায় না।বড় এক দম নিয়ে বিরক্তি মেশানো রাগটুকু গিলে নেয়।তথার পিছনেই মাহাদী বেরিয়েছিল।তথা কপাল পর্যন্ত ওড়না টেনে দিয়ে ভাইকেই আদেশ দেয়।
_” মাহাদী,তুই এখন তিন রাস্তার মাথায় যাবি।ওখানে তোর ভাইয়া থাকবে।তাকে আমার সাথে দেখা করতে বলবি।আমি রামিম ভাইয়ের কোচিং থেকে বের হব সাড়ে দশটায়।কোচিং সেন্টারের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে বলিস।”
মাহাদী বিরক্ত হয়। কপাল কুঁচকে বলেঃ” আমি একটু ব্যাডমিন্টন খেলতে যাব আপু।তুমি ফোন দেও ভাইয়ারে।”
_” তোর ভাইয়ার নম্বর নাই আমার কাছে।তুই একটু বলে দিস।ওদিক দিয়েই তো যাবি।”
_” ধুর ভাল্লাগে না।”— মাহাদী তথার বিপরীতে পা বাড়ায়। দিন-দুনিয়া অন্ধকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার।আগে আগে না গেলে বড়রা খেলায় নেবে না।আর এই তথা আপু সবসময় একটা না একটা ভেজাল করবেই।মাহাদী মুখ ভার করে রাস্তা দিয়ে হাঁটে।নিজেকে কবুতর মনে হচ্ছে তার।মুখের ভিতর খবর ঠেসে দিলো, ইরফানের কাছে এগুলো উগড়ে দিতে হবে। দু-দিন পর বিয়ে অথচ নম্বর নেই ফোনে। যত্তসব ঢং।
_” ভাবি রিকশায় উঠেন।এই রোদে হেঁটে যেতে হবে না।”
তথা ভেবেছিল কিছুই বলবে না তবে খুব বেশিক্ষণ না বলে থাকতে পারলো না।গলায় একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললঃ” ছোট ভাইয়ের দল,তোমরা বিরক্ত কেন করছো আমাকে? আমি নিজের মতো যাচ্ছি ভালো লাগছে না?”
দলনেতা ছেলেটা একটু থতমত খেয়ে গেল।চোখ নিচের দিকে নামিয়ে বললঃ” ভাই বলেছিল আপনি রাস্তায় বেরোলেই আপনাকে রিকশায় তুলে দিতে। ”
হাহ! সেই আগের কাহিনী। তথার চোখ পঁচে গেল এসব দেখে।ইরফানের এসব বাড়াবাড়ি একদম অপছন্দ তথার। মনে হয় যেন আল্লাহর দুনিয়ায় সে একাই প্রেমিক।বাকি সবাই বসে বসে ঘাস কাটে।বিরক্তিতে ভিতর‍টা তেতো হয়ে আসে তথার।
_ ” আমি সামনেই যাব রিকশার দরকার নেই।তোমাকে চিন্তা করতে হবে না, তোমাদের ভাইকে আমি বুঝিয়ে বলব।”
দাঁড়ায় না তথা। ইরফানের সবকিছু ভালো লাগলেও এসব একদম বিরক্ত লাগে ।তথা কি রাস্তা চিনে না? বাড়াবাড়ি করতে কতবার নিষেধ করলো তথা,কিন্তু ইরফান শোনেই না। তথার কথা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়।একে নিয়ে আর পারা গেল না।
তথা আস্তে-ধীরে হাঁটে। গ্রাফিক্স ডিজাইনিংয়ের উপর একটা কোর্স করছে। এই বুদ্ধিটা অবশ্য ইরফানের।কয়েকদিন আগেও মরিয়া হয়ে একটা চাকরি খুঁজেছে তথা। এতোগুলো মানুষ মাথার উপরে। শুধু টিউশনিতে হচ্ছে না।কিন্তু অনার্স শেষ হয়নি বলে ভালো কোনো চাকরিই পেল না।ঘর ভাড়া,রুবাইদা-মাহাদীর স্কুলের বেতন,বাজার খরচ,কাকির ঔষধ খরচ — এতোগুলো খরচ মেটানোর একমাত্র উৎস কিছু জমানো টাকা।দিনদিন খরচ বাড়ছে অথচ টাকা কমছে।দু-একটা টিউশনি ছাড়া তথার হাতেও কোনো কাজ নেই।মাথার উপর এক হাত পানিতে অন্ধকার দেখছিল তথা। দিন-রাতে নিঃশ্বাসের সাথে পাল্লা দিয়ে আল্লাহর নাম জপেছে । জমানো টাকাগুলো শেষ হলেই সর্বনাশের কোনো সীমা-পরিসীমা থাকবে না। এমন বিপদের সময়েই তথাকে বুদ্ধি দিল ইরফান। গতানুগতিক চাকরির চাইতে ফ্রিল্যান্সিংয়ের দিকে নজর দেওয়া ভালো।তাছাড়া অনার্স শেষ হলেই তো আর চাকরি পাচ্ছে না তথা।গ্রাফিক্স ডিজাইনিংয়ের বাজার ভালো এখন।কোর্স কমপ্লিট করলে তথারই লাভ। চাকরি না পেলেও সমস্যা হবে না।ঘরে বসেই মুশকিল আহসানের সুযোগ আছে।
বুদ্ধিটা মনে ধরলো তথার। ক্ষ্যাপাটে লোকটা মন্দ বুদ্ধি দেয়নি। সবসময় যে সনাতন পথেই চলতে হবে তার তো আর বাধা-ধরা নেই। তাছাড়া, ফেসবুক খুললেই তো দেখা যাচ্ছে কত-কত মানুষ ঘরে বসেই আয় করছে।তবে তথা কেন রাত-দিন নাকের আগায় দম নিয়ে চাকরি খুঁজবে? একবার ইরফানের কথা শুনে দেখাই যাক কিছু হয় কি না।ব্যস আগ-পিছ আর ভাবলো না তথা।কোর্স করতে রাজি হয়ে গেল।এরপর তাকে আর কিছুই করতে হয়নি। ভালো কোচিং সেন্টার খুঁজে তথাকে ভর্তি করে দিলো ইরফান।
তথা এদিক-ওদিক নজর বুলিয়ে হাঁটে। দু-পাশের বাড়ির মাঝে একটুখানি সরু গলি। একসাথে অনেক মানুষ হাঁটা যায় না।পৌষ মাস চলছে।তবে খুব বেশি ঠান্ডা নেই ঢাকায়। তথা কাঁধের উপর ভালোভাবে চাদর জড়িয়ে নেয়।সাদা রঙের পাতলা চাদর। মাথাটা ব্যাথা করছে তার। কত রাত যে শান্তিতে ঘুমাতে পারে না তার হিসাব নেই। ঘুমের উদ্দেশ্যে চোখ বন্ধ করলেই ওই মুখটা ভেসে উঠে। কানে তার কন্ঠ ভাসে। চোখের উপর ভেসে উঠে সেই সবুজ মনি দুটো। ইশ! কি খারাপ একটা অবস্থা। এরপর আর ঘুমাতেই পারে না তথা।অর্ধেক রাত তন্দ্রায় আর অর্ধেক রাত চিৎকার করেই কেটে যায়। কখনো কখনো রুবির কাঁথার নিচে শরীর গুজে রুবিকে বুকে জড়িয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে তথা। আবার কখনো কখনো কাকির বুকে মাথা গুজে ঘুমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুতেই ঘুম হয় না।মাঝ রাতে রুটিন করে ঘুম ভাঙবেই। গভীর ঘুমে থাকলেও মাঝ রাতের দিকে ঘুম ভেঙে যায়।অভিমান জড়ানো গলায় প্রতিরাতে কে যেন কানের কাছে ফিসফিস করে। কাঁদো কাঁদো গলায় অভিযোগ করেঃ” কেন প্রতারণা করলেন কামিনী ফুল?”
অবশ্য শুধু রাতে না দিনের বেলাও ইউসুফকে দেখতে পায় তথা।স্পষ্ট তার কন্ঠ শুনতে পায়। মনে হয় যেন একদম পাশে দাঁড়িয়েই কথা বলছে। শুধু তথাই দেখে ইউসুফকে আর কেউ দেখে না। আশ্চর্য হয়ে যায় তথা। এ কি তবে হ্যালুসিনেশন?
সকাল নয়টা বাজে কেবল। চারপাশে আবছা কুয়াশা।সরু গলি পেরিয়ে বড় রাস্তায় পা দিতেই সামনে এক রিকশা থামে।কম বয়সী রিকশাওয়ালা ছেলেটা বিনীত ভঙ্গিতে বললঃ” ভাবি রিকশায় উঠেন।রামিম স্যারের কাছে আমি নিয়া যাইতাছি।”
তথা আশ্চর্য না হয়ে পারে না।ঘটনা কি? এতো তোয়াজ করছে কেন এই ছেলে? আশেপাশে নজর বুলাতেই ঘটনা বুঝতে পারে তথা।ওই তো পাতলা কুয়াশা ভেদ করে ইরফানের কালো রঙের বাহনটা দেখা যাচ্ছে। এদিকেই আসছে সে।তথা কপাল কুঁচকে ফেলে। এই লোকটা এমন কেন?
_” সুপ্রভাত, তথা।দাঁড়িয়ে আছো কেন? দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।”
_” আমি হেঁটেই যেতে পারব।রিকশা লাগবে না।আর মাহাদীর সাথে আপনার দেখা হয়েছে? ”
_” হুম।”
_” সাড়ে দশটায় মনে করে যাবেন কিন্তু।আমি অপেক্ষা করব।”
_” জরুরি কথা থাকলে এখানেই বলো।”
_” না।এলাকার মাঝে আপনার সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলতে ভালো লাগে না।সবাই কিভাবে যেন তাকায়।”
ইরফান তথার কথা গায়ে মাখে না।অবহেলার ভঙ্গিতে বলেঃ” তাকালে তোমার কি? তুমি তোমার হবু স্বামীর সাথে কথা বলবা,এতে কার বাবার কি? মানুষের দিকে এতো নজর দিয়ে লাভ আছে?”
_” আপনার মতো সমাজ ছাড়া নির্লজ্জ হতে পারিনি এখনো। হতে পারলে মানুষের দিকে নজর দেওয়া লাগতো না।”
ইরফান গাল ফুলায়। অন্যদিকে চেয়ে বলেঃ” সবসময় খালি নির্লজ্জ বলো আমাকে। আমি তো আর অন্য মেয়েদের সাথে নির্লজ্জের মতো আচরণ করিনি,পিছু পিছুও ঘুরিনি।আমার সবকিছু তো হবু বউয়ের জন্য। আমার বউয়ের সাথে আমি নির্লজ্জের মতো আচরণ না করলে কে করবে? অন্য ছেলেরা? হুহ।”
তথা মনে মনে হাসে।ইরফানের মুখ থেকে বউ কথাটা শুনতে ভালোই লাগে।অন্যরকম একটা শিহরণ জাগে মনে।আর ছেলেটাও কম যায় না।তথার সামনে এলেই শুধু বউ, বউ করে।
_” ভাই, ভাবি কি যাইব না?”
_ ” হুম যাবে।তুই একটু দাঁড়া।”
রিকশাওয়ালা ছেলেটাকে আদেশ দিয়ে হাতঘড়ির দিকে তাকায় ইরফান। নয়টা বিশ বাজে।তথার দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলেঃ” তাড়াতাড়ি ওঠো।নয়টা বিশ বেজে গেছে। আমি সাড়ে দশটায় পৌঁছে যাব ওখানে।”
_” আমি হেঁটে যেতে পারব।সবসময় বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছিলাম আপনাকে।”
_” তুমিও বাড়াবাড়ি করছো এখন।দু-সেকেন্ডের মাঝে রিকশায় না উঠলে আমিও তোমার সাথে হেঁটে হেঁটে রামিম স্যারের কাছে যাব।বাজারের মাঝ দিয়ে একসাথে হেঁটে গেলে মানুষ হা করে চেয়ে থাকবে।ভালো লাগবে তখন?”
তথা প্রচন্ড বিরক্ত হয়।গাল ফুলিয়ে রিকশায় উঠে।
_” তোর ভাবিকে কোচিং সেন্টারের সামনেই নামিয়ে দিস।সাবধানে যাবি।”
রিকশা চলতে শুরু করলে মাথা নিচু করে একবার পিছনে তাকায় তথা। হ্যাঁ, যা ভেবেছিল ঠিক তাই।ইরফান পিছু পিছু আসছে। মুহূর্তেই মনটা ভালো হয়ে যায় তথার। এই মানুষটা এমন করে কেন? তথা কি তার সাধনার ফল।কে জানে! তথার মনে মনে গানের সুর বাজে।গলা ছেড়ে গান গাইতে ইচ্ছে করে। আজকে সকালটা খুব সুন্দর। অবশ্য ইরফান সাথে থাকলে সব বেলাই ভালো লাগে। ইদানিং রাস্তায় বেরোলে তথা বারবার পিছনে তাকায়। মুখে স্বীকার না করলেও মনে মনে ইরফানকে কামনা করে। কি যে হয়েছে তথার!
***
সাদা রঙের একতলা বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ইরফান। ভিতরে রামিম স্যার গ্রাফিক্স ডিজাইনিংয়ের কোর্স করাচ্ছেন।ঘড়িতে দশটা বিশ বাজে। তথা এখনো বেরোয়নি।ইরফান বাইকে হেলান দিয়ে পাকা রাস্তার দিকে চেয়ে থাকে। হুট করেই জীবনের রঙ এতোটা বদলে যাবে, তা মোটেও ভাবেনি ইরফান। আর মাত্র দশ দিন পরে তথার সাথে তার বিয়ে হবে। একসপ্তাহ আগে ইরফানের বাবা-মা তথার বাড়ি গিয়েছিল আঙটি পরাতে। সেদিনই দিন-তারিখ ঠিক হয়েছে। আঙুল গুনে ইরফান।দশ দিন অনেক বেশি সময়।আঙটি পরানোর পর এতো দেরি করে বিয়ের তারিখ ফেলতে হয়? দু-একদিনের মাঝে বিয়েটা হয়ে গেলেই ভালো হতো। আর কতোদিন প্রেয়সীর পিছু পিছু ঘুরবে ইরফান? বিয়েটা তাড়াতাড়ি দিয়ে দিলেই হয়। তখন আর পিছু পিছু ঘুরতে হবে না।তথাকে বাইকের পিছুনে বসিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরতে যাবে। নিজের বাবার উপর রাগ হয় ইরফানের। বাবা অনেক নিষ্ঠুর। এতো দেরি করে বিয়ের তারিখ না ফেললেই পারতো।
ইরফান একমনে চেয়ে থাকে নিচের দিকে।মাঝে মাঝেই দুই মাস আগের সেই অপয়া দিনটার কথা মনে পড়ে যায়। ডাহুক নদীর তীরের সেই জমিদার বাড়িতে কাটানো কয়েকটা ঘন্টার কথা মনে পড়তেই গলা শুকিয়ে আসে ইরফানের। তথার ঘর থেকে গুলির শব্দ কানে আসতেই প্রাণপন ছুটেছে ইরফান।ছুটে গিয়েছিল প্রেয়সীর ঘরের দরজায়।আল্লাহ বাঁচিয়েছে সেদিন। বুলেট ইউসুফের বন্দুক থেকে নয়, বেরিয়েছিল অফিসার আরিফ হোসেনের বন্দুক থেকে। সোনালীকে খুঁজতে বাড়ির পিছনে যাওয়ার কথা ছিল তার। সেই উদ্দেশ্যেই উপরে এসেছিল আরিফ। শাফিনের কাছে শুনেছিল,দোতলার হাম্মামখানার ভাঙা জানলা দিয়ে বাইরে যাওয়া যায়। আরিফের ইচ্ছে ছিল সেখান দিয়েই যাবে।মূলত একারণেই শেষ দুপুরে দোতলায় এসেছিল সে। দোতলায় পা দিতেই তথার কন্ঠ কানে আসে। কাঁদতে কাঁদতে মৃত্যু কামনা করছে সে।পা টিপে টিপে তথার ঘরের দরজায় উঁকি দিতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় আরিফের। ইউসুফের রিভলবারের নল তথার কপালে ঠেকানো,তথা চোখ বন্ধ করে কাঁদছে।ব্যাস আর কিছু ভাবেনি আরিফ। তথাকে বাঁচানো তার দায়িত্ব। তাই পকেট থেকে রিভলবার বের সোজা গুলি চালিয়েছে ইউসুফের পিঠে। ভয়ংকর অপরাধী আহমেদ ইউসুফ মরেছে মাত্র দুটো বুলেটে। ইউসুফ লুটিয়ে পড়তেই চোখ খোলে তথা। হতভম্ব চোখে চেয়েছিল ইউসুফের দিকে,সবুজ রঙের অদ্ভূত মনি দুটোর দিকে।শাফিনের নিষেধ সত্ত্বেও ইরফান ছুটে গিয়েছিল তথার দিকে। চোখের পানি ও ঘামে মাখামাখি পুরো চেহারা,গলার দু-পাশে আঙুনের ছাপ,ডান হাতে আঙুলের ছাপ।ইরফান দিশেহারা হয়ে পড়ে। প্রবল আবেগে তথাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। আস্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলেঃ” কিছু হয়নি তথা। ভয় পেয়ো না।”
তবে তথা ভয় পেয়েছিল।তীব্র ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছিল ইরফানের বুকেই। শাফিনের তত্ত্বাবধানে তথাকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল ইরফান। আশ্রয় নিয়েছিল বাজারের সরকারী হাসপাতালে। শাফিনের মুখ থেকেই তথা-ইউসুফের মিথ্যা সম্পর্কের কথা জানতে পেরেছিল। শাফিনের কথায় অভিনয় করতো তথা। তথার ডায়রিয়ার সময় ইউসুফের যত্ন-আত্তি চোখে পড়েছিল শাফিনের।তখনই বুদ্ধিটা মাথায় আসে।তথাকে দিয়ে যদি ইউসুফকে ব্যস্ত রাখা যায়, তবে তাদের কাজ সহজ হবে।এরপর এক বিকালে তথাকে সব খুলে বলল শাফিন।ইউসুফের অপরাধের কথা,পরিকল্পনার কথা,অতীত -বর্তমান সবকিছু। সে নিজেও যে গোয়েন্দা পুলিশ সেটাও বলেছিল।অবশ্য বাকিদের কথা বলেনি।তথার মাধ্যমে যদি ইনফরমেশন লিক হয় তবে সাড়ে সর্বনাশ।আমও যাবে, ছালাও যাবে।তারপর সন্ধ্যার দিকে জ্ঞান ফিরলো তথার। সে আরো ভয়ংকর অবস্থা।তথা কাউকে কিছু বলছে না শুধু চিৎকার করে কাঁদছে,হাতের অবস্থা ভালো না।এর মাঝে শাফিনের কোনো খোঁজ নেই।জমিদার বাড়িতে কি চলছে তাও জানা নেই। ইরফান যেন দিশেহারা হয়ে পড়লো। শেষে কোনো উপায় না পেয়ে রাফায়েতকে কল করলো। নিজের অবস্থা বুঝিয়ে বলল।রাফায়েত আর অপেক্ষা করেনি।সে রাতেই মাইক্রো নিয়ে ছুটে এসেছে পঞ্চগড়। তথা কে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে সারা রাত ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল। সে রাতে একটা ঘূর্ণিঝড় বয়ে গিয়েছিল ইরফানের উপর। শাফিনও পাশে ছিল না। সোনালীর মৃতদেহ উদ্ধারের পর বেশ ভেঙে পড়েছিল ছেলেটা। বোনের লাশ দেখে তো কয়েক ঘন্টা অজ্ঞানই ছিল।
পরদিন অসুস্থ তথাকে নিয়ে ঢাকা এলো ইরফান ও রাফায়েত।এলাকায় পা দিতেই কানে এলো আরেক দুঃসংবাদ।তথার চাচাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।এদিকে রুবাইদা হাসপাতালে ভর্তি,তার অপারেশন চলছে।যত প্রকার বিপদ ছিল সব একদিনেই হানা দিলো যেন।ইরফান আর কি করবে? উপায় না পেয়ে তথাকে নিয়ে নিজের বাড়িতেই ছুটলো। সাজ্জাদ সাহেবকে সব বুঝিয়ে বলল। পঞ্চগড় যাওয়ার কথা,তথার কতাহ,ইউসুফের কথা, শাফিনের কথা,সোনালীর মৃত্যুর কথা —-সব।সাজ্জাদ সাহেব অমানবিক নয়।অসুস্থ,দূর্বল তথাকে আশ্রয় দিলেন নিজের বাড়িতে।অবশ্য ইরফানকে দুটো চড় মেরেছিলেন তখন।বেয়াদব ছেলে না জানিয়ে এতো দূরে গেল কোন সাহসে?
সেই দুঃসময়ের কথা মনে পড়লে গায়ে কাটা দেয় ইরফানের। তথা ও তথার পরিবারকে একসাথে সামলাতে হয়েছে। রুবাইদা অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি।স্বামীর অধপতনের কথা শুনে আকলিমা খাতুন নিজেও শয্যাশায়ী। মাহাদী ছোট মানুষ। মা-বোনের অবস্থা দেখে সেও কাহিল।পুরো পরিবারকে সামলাতে হয়েছে ইরফানকে।ঘরে তথা,হাসপাতালে তথার পরিবার।দিন-রাত ছুটোছুটি করতে করতে ইরফান ক্লান্ত। অবশ্য খালেদা বানু খুব যত্ন নিয়েছেন তথার।মায়ের মতো স্নেহ করেছেন মেয়েটাকে।হয়তো তিনি ছেলের দূর্বলতা জানতেন।তাই নিজের সবটুকু দিয়ে বিপদের সময় আগলে রেখেছেন মেয়েটাকে।নাহয় সপ্তাহ দুয়েকের মাঝে শারিরীক ও মানসিকভাবে কিছুতেই সুস্থ হতে পারতো না তথা।
_” আপনি কখন এসেছেন?”
তথার কন্ঠ পেয়ে চিন্তা রাজ্যে ভাঙন ধরে ইরফানের।আলগোছে একবার নজর বুলায় তথার দিকে।মেয়েটা শুকিয়ে গেছে।চোখের নিচেও কালি পড়েছে।রাতে ঘুমায় না নাকি।
_” কি জিজ্ঞেস করলাম?”
_” একটু আগে এসেছি। চল কোথাও ঘুরতে যাই।রমনায় যাবে?”
তথা চোখ ছোট ছোট করে তাকায়।
_” আপনার ব্যবসা- বানিজ্য নেই?”
_” বিয়ের ছুটি চলছে।”
_” এখনো দশ দিন বাকি বিয়ের! ”
_” হোক। আমি জীবনে একবারই বিয়ে করব।এতুটুকু ছুটি কাটালে পাপ হবে না।তাছাড়া নিজের বিয়েতে অনেক কাজ, বুঝলে। তোমার বিয়ের শাড়িগুলোই এখনো কিনতে পারলাম না।তিন দিন তিন মার্কেট থেকে ঘুরে এসেছি।যা দেখি তাই ভালো লাগে।ইচ্ছে করে সব দোকানের শাড়িগুলো নিয়ে আসি।কি একটা অবস্থা বলো তো! ”
তথা কপাল চেপে ধরে।এই লোক আসলেও এক পাগল।এর সাথে কথা বলতে গেলে তথা নিজেই পাগল হয়ে যাবে।
_” তুমি কি যেন বলবে বলেছিলে।”
তথা এক পলক তাকায় ইরফানের দিকে। কয়েক সেকেণ্ড অপলক চেয়েই থাকে। হালকা গলায় বলেঃ” আহমেদ ইউসুফ আমার কপালে তিনবার চুমু দিয়েছিল।ঠিক তিনবার।”
ইরফান অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। গম্ভীর গলায় বলেঃ” তুমি অনেকবার এই কথা বলেছে আমাকে। এটা শুনতে ভালো লাগে না আমার।রাগ লাগে অনেক।আমার বউয়ের কপালে চুমু দিয়েছে আরেক শয়তানের ছাও! আমি নিশ্চয়ই আনন্দে ধেইধেই করে নাচব না। ”
_” না,তবুও এই কথাটা আপনাকে শোনাতে খুব ভালো লাগে আমার।”
_” বিয়ের পর আমি দিনে একশটা চুমু দেব কপালের মাঝে।তখন ভাল লাগলেই চলবে।”—ফিচেল হেসে উত্তর দেয় ইরফান।
_” আপনি একটা নির্লজ্জ।”
_” হ্যাঁ, জানি। পাঁচ বছর ধরে এক তোমার পিছনে ঘুরছি। আর কতো ভালো লাগে বলো।আমারও একটা ধৈর্যের সীমা আছে। এখন আর প্রেমিকা নয়,বউ ভাবতে ইচ্ছে করে তোমাকে।আমার ছেলেকে আমি খুব দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেব।ছেলে যেই মেয়ে পছন্দ করবে ঠিক সেই মেয়ের সাথেই বিয়ে দেব।দরকার পরলে বিয়ের পর ছেলে আর ছেলের বউকে একসাথে পড়াশোনা করাবো।তাও আমি যতটা ভুগেছি ততোটা ভুগতে দেব না আমার ছেলেকে।”
তথা কপাল চাপড়ায়। মিনমিন করে বলেঃ” কই আছে কি,পান্তা ভাতে ঘি।”
ইরফান শুনতে পেলো না তথার কথা।সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলেঃ”আর কি বলবে? ”
তথা মাটির দিকে চেয়ে চুপ করে থাকে। মনে হয় যেন সে কথা সাজিয়ে নিচ্ছে মনে মনে।কয়েক সেকেন্ড নীরবতা পালন করে বলেঃ” আমি মনে হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি,ইরফান।আমি ইউসুফকে দেখতে পাই,ওর কথা শুনতে পাই,ওর উপস্থিতি টের পাই। রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারি না।মনে হয় যেন ও খাটের পাশে দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকছে।কখনো কখনো মনে হয় ও ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।ভেবেছিলাম দিন গড়ালেই সমস্যা ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু হচ্ছে না।দিনদিন অসুখ বেড়েই চলছে।আমার ভালো লাগে না ইরফান।একটুও ভালো লাগে না। ইউসুফকে যখন দেখি তখন মরে যেতে ইচ্ছে করে।কি করব আমি?”
তথার চোখে পানি টলমল করে।ইরফান এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে প্রেয়সীর দিকে। মেয়েটার চোখের নিচের কালি বলে দিচ্ছে, কতরাত সে ঘুমাতে পারে না।আফসোস হয় ইরফানের।দুজনের মাঝে বৈধতা থাকলে ভালো হতো।ইরফান আষ্টেপৃষ্টে তথাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। নির্ভরতার সুরে বলতোঃ” তুমি চিন্তা করো না, তথা।সব ঠিক হয়ে যাবে।তোমার সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে। আমি আছি তো।”
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here