#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকা-সাদিয়া মেহরুজ দোলা
#পর্বসংখ্যা__০৯
প্রায় তিনমাস নিজের কর্মস্থলে টানা থেকে আজ বাসায় ফিরেছে উশান৷ এসেছে তাও ক্ষনিকের জন্য। তার দায়িত্ব অনেক। নিজের ফ্লাটে থাকতে পারেনা কখনো। কয়েকমাস পরপর আসে, এসেই কিয়ৎক্ষণ থেকে চলে যায়।এখানে তার আগমন ঘটে মূলত ব্যাক্তিগত কিছু কাজ সম্পূর্ণ করতে। উশান ক্লান্ত দেহ নিয়ে বাহিরে নাস্তা আনতে গিয়েছে। ইচ্ছে ছিলো মীরাকে দিয়ে সকালের খাবার বানিয়ে নিবে কিন্তু তিনমাস আগের সেই ঘটনা স্বরণ হতেই সেই ইচ্ছেটা মাটিচাপা দিয়েছে। শীতে কাঁপতে কাঁপতে বাহির থেকে খাবার এনে খাওয়ার পর্ব শেষ করে যেই না ঘুমোতে যাবে তৎক্ষনাৎ নীরবতা ধ্বংস করে শব্দের উৎপত্তি হয় কলিংবেলের মাধ্যমে। উশান দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
‘ ফর গড সেইক! ‘
তীব্র তার পাশে শুয়েছিলো। কলিংবেলের শব্দে চট করে আঁখি’জোড়া উন্মুক্ত করে বিশ্রী এক গালি দিয়ে বসলো আগন্তুক কে। শেষে উশানের পানে দৃষ্টিপাত ফেলে বলল,
‘ এতো সকালবেলা তোর বাসায় কে আসছে? ‘
‘ তুই যেখানে আমিও সেখানেই। কি করে জানবো কে আসছে? ‘ উশান ধমকে বলল।
তীব্র উঠে বসে আমতা আমতা করে প্রতুত্তর করে,
‘ আচ্ছা বুঝলাম! যা দেখ গিয়ে কে আসলো। ‘
উশান লম্বা কদম ফেলে দরজার নিকট এগোল। পেছন হতে তীব্র উঁকি দিয়ে আছে। দরজা খোলার পর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিকে দেখে দাঁত দিয়ে জিভ কাটলো তীব্র।নিভৃতে নিজেকে কয়েকটা গালি দিয়ে বসলো। পরিশেষে বিড়বিড়িয়ে শুধালো,
‘ ছিহঃ! ভাবীকে গালি দিয়ে ফেললাম। আল্লাহ মাফ করো। তওবা! তওবা! ‘
মীরাকে এতো সকালে দেখে উশান ঈষৎ চটে গেলো। মেয়েটার সমস্যা কি?আসতে না আসতেই বাসায় তার আগমন। উশান ধমকের সুরে বলল,
‘ এতো সকালে কি চাই?আমায় ডিস্টার্ব করতে নিষেধ করেছিনা?’
মীরা সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে উশানকে দেখছিলো। উশানকে আজ প্রায় তিনমাস পর দর্শন করা। মাঝে তিনমাস উশান ফ্লাটে আসেনি। চিন্তা,চোখে দেখার তৃষ্ণায় একাকার হয়ে ঘুম আসেনি মীরার। বারংবার মন একটাই বার্তা দিয়েছে তাকে, উশান কবে ফিরবে? অল্প কয়েকদিন এর মধ্যেই এই ব্যাক্তির ওপর কতোটা সে দূর্বল হয়েছে ভাবা যায়?উশানের প্রতি তার ভালোলাগা সৃষ্টি বহুদিন যাবৎ।উশানকে দেখলেই তার অন্তঃস্থল শীতল হয়ে যেতো। মন অজান্তে চলতো এই প্রক্রিয়া। তারপর আস্তে ধীরে সৃষ্টি হলো ভালোলাগা।ঘৃণা, বিরক্তবোধ করা ব্যাক্তিটিকে জায়গা দিয়ে দিলো নিজ অন্তঃমহলে। উশানের মুখোশ্রী, চাহনি, কথা বলার ধরণ, হাঁটাচলা, সুঠাম দেহ দেখে যে কেও তার প্রতি দূর্বল হতে বাধ্য। মীরা এর একটা দেখেও উশানের প্রেমে পড়েনি। প্রেমে পড়েছে বিশেষ এক মনোভাব দেখে।
‘ মীরা…?’
কেঁপে উঠলো মীরা উচ্চস্বর শ্রবণ করে। ধাতস্থ হয়ে নিজের হাতের শপিং ব্যাগটা উশানের হাতে তুলে দিয়ে বলল,
‘ আপনার শার্টটা। আজকে আমার বাসায় ফিরতে লেইট হবে। তার আগে আপনার লাগে কিনা তাই দিয়ে গেলাম। ‘
উশান খপ করে শপিং ব্যাগ হাতে তুলে দরজা বন্ধ করবে তৎক্ষনাৎ তাকে থামিয়ে দিয়ে মীরা নম্র সুরে বলল,
‘ এতদিন কোথায় ছিলেন আপনি? ‘
‘ জাহান্নামে। ‘
স্ব-শব্দে দরজা বন্ধ করে উশান রুমে ফিরে আসে। হাতের ব্যাগ ছুঁড়ে মারে ফ্লোরে৷ দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে মাথার চুল। নাহ! ফ্লাট ছাড়তেই হবে। অতঃপর ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতেই তীব্র হুট করে বলে উঠলো,
‘ মেয়েটার সাথে এমন ব্যাবহার করিস কেনো?’
উশান কম্বল শরীরের ওপর দিয়ে বালিশে মাথা এলিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। নিরস কন্ঠে বলল,
‘ যেমন ব্যাবহার ও প্রাপ্য। তেমন ব্যাবহারই করি।’
‘ ভালোবাসে তোকে। ফিরিয়ে দিচ্ছিস দে। এমন উগ্র ব্যাবহারের কি দরকার? ‘
‘ ভালো ব্যাবহার করেছিলাম দেখেই আজ সে এই পর্যায়ে। শাসন না করলে আমার পিছু ছাড়বে না। ‘
‘ জাস্ট কয়েকজন মেয়ের অপরাধ দেখে পুরো নারী জাতীকেই ঘৃণা করতে হবে। এটা কেমন হলো? ভুলে যা পিছনের কথা। মীরা অমন না উশান! ‘
‘ প্রথম নারী! যাকে আমি মায়ের পর সবথেকে আপন ভাবতাম। সে আমার চোখের সামনে আমার মা’কে হ/ত্যা করলো। দ্বিতীয় নারী! যিনি আমার কাছে সম্মানিত ব্যাক্তি ছিলেন। সে আমার মা’কে হ-ত্যা করায় সাহায্য করলো। তৃতীয় নারী! যে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিলো। সে আমায় এক মাস বিনা অপরাধে জেল খাটালো। চতুর্থ নারী! আমার বোন, সে আমায় হ/ত্যা করার চেষ্টা করলো। পঞ্চম নারী! সে তোকে আমার সামনে ক্ষতবিক্ষত করে ধোঁকা দিয়ে চলে গেলো। এতকিছুর পর তুই আমায় নারী জাতীর ওপর বিশ্বাস করতে বলছিস তীব্র? তুই পারবি? বল তো! ‘
তীব্র স্তম্ভিত! নাহ, এই উশানকে বোঝানো তার কাম্য নয়।
_
রাত দশটা ছুঁই ছুঁই! ক্লাস, টিউশনি শেষ করতে করতে আজ একটু বেশিই লেট হয়ে গেছে মীরার। দ্রুত পদে হাঁটছে সে। পাশ দিয়ে শা শা করে দুই একটা গাড়ি ছুটেঁ যাচ্ছে তাকে পেছনে ফেলে। রিকশা নিবো নিবো করেও নেয়নি। ব্যাগে টাকা নেই। টিউশনির টাকা দিয়ে পরশু সে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই কিনেছে। মাসের বাকি আরো ১২ দিন। অথচ হাত খালি। বাবার কাছে টাকা চাইতেও লজ্জা লাগে। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটার মাঝেই ইটের সাথে পা আঁটকে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যায় মীরা, থুতনিতে তরল কিছু টের পাওয়ার পর মাটিতে হাত ভর দিয়ে উঠে বসে সে। তরলের উৎস দেখার প্রয়াসে থুতনি স্পর্শ করে চক্ষু সম্মুখে আনার পর দৃশ্যমান হলো রক্তিম হাত। পায়ের হাঁটু ছিলে নীলচে পোশাক রক্তিম হয়েছে। ব্যাথায় দাঁতে দাঁত চেপে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয় মীরা৷ তৎক্ষনাৎ কর্ণকুহরে ভেসে আসে পিছন হতে আগত কঠিন কন্ঠস্বর!
‘ রাস্তার মাঝে এভাবে বসে কি নিজেকে ভিক্ষুক প্রমাণিত করতে চাচ্ছিস মীরা? ভিক্ষা করতে নেমেছিস? ‘
মীরা ধপ করে আঁখি জোড়া উন্মুক্ত করে পিছনে তাকায়। উশান বাইকে বসে। কিয়ৎক্ষণ মৌন থেকে মীরা চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
‘ একদম উল্টোপাল্টা কথা বলবেন না। পরে গিয়েছি আমি। ‘
‘ পড়ে গেছিস মানে? চোখ আকাশে থাকে? দেখে শুনে হাঁটতে পারিস না?’
মীরা নিশ্চুপ! নিভৃতে আহত সে৷ উশান কি তার আঘাতপ্রাপ্ত, রক্তে রঞ্জিত স্থানটি দেখেনি?পায়ের ব্যাথায় যে সে ক্রমাগত কাঁপুনি দিচ্ছে সেটা কি খেয়াল করেনি? হাঁটু ছিলে যে নীল রঙের পোশাক রক্তিম হয়েছে তা দর্শন করেনি? সবকিছু তো সম্মুখেই দৃশ্যমান। না দেখার তো কথা না। তার মানে মীরার জন্য উশানের কি সামান্যতম মায়া অব্দি নেই? এতোটা পর মীরা উশানের? হাতে ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করে মীরা ভূমি থেকে। ব্যার্থ সে ফের। পায়ের ব্যাথাটা তুমুল।
উশান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় ।সে আজ ফিরে যায়নি। কাল যাবে। উশান মীরার মুখোশ্রীর দিকটায় দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করতেই রক্তিম তরল দেখে ভড়কে যায়। পায়ের হাঁটুর কাছের পোশাকে অব্দি র’ক্ত! পরেছে কিভাবে এই মেয়ে যে এতোটা আঘাত পেলো? মীরা উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা বাদ দিয়ে উশানের মুখোশ্রীর তাকায়।কন্ঠের খাদ ফেলে বলে,
‘ একটু এদিকে আসবেন? ‘
কোমল আকুতি! মায়া ভরা চাহনি৷ তিরতির করে কাঁপা ওষ্ঠাধর। উশান ঘোর থেকে হোক কিংবা বাস্তবিক। নেমে আসলো বাইক থেকে। শ্রান্ত পায়ে মীরার নিকট দাঁড়াতেই উশানকে চমকে দিয়ে মীরা দু’হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ কোলে নিন! ‘
নিঃসঙ্কোচ আবেদন। উশান বিস্মিতপূর্ণ দৃষ্টি ফেলে।
কতোটা সঙ্কোচহীন আকুতি, আবেদন। যেনো উশান কোনো পর-পুরুষ নয় তার অতি নিকট কেও। অধর জোড়া প্রসারিত করে উশান রুষ্ট জিজ্ঞেস করে,
‘ মাথা খারাপ তোর? কি বলছিস জানিস?এই তোর লজ্জা নেই?পর-পুরুষ কে কোলে নিতে বলছিস? ছিহঃ!’
উশান বিদঘুটে রূপে মুখোশ্রী কুঁচকে নিলো। মীরা কিঞ্চিৎ হেঁসে অন্যদিকে তাকায়। নাহ! সে ভুল কোনো মানুষকে পছন্দ করেনি। ফের নিজ চেষ্টায় উঠে দাঁড়ানোর পর পড়ে যেতে নিলে উশান তার হাত আঁকড়ে ধরে।মীরার হাত পাঁচ আঙুল দ্বারা চেপে ধরে নিজের বাইকের কাছে এসে হাত ছেড়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলে উশান। হেলমেট খুলে মীরার হাতে দিয়ে বাইকে উঠে বসে। তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠে,
‘ হেলমেট পড়ে জলদি উঠে পড়। আর এক মিনিট লেট হলে তোকে আমি এখানেই ফেলে চলে যাবো। ‘
মীরা ফটাফট উঠে বসলো। আজ ইচ্ছা বশতই সে তার একহাত স্থাপন করলো উশানের কাঁধে। উশান মৌন, নিরব, নির্লিপ্ত! কিছু বললে যে মীরা এখন সেই কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করবে তা সম্পর্কে অবগত উশান। আধাঘণ্টার মাঝে কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছে উশান বাইক থামিয়ে প্রায় হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়লো। ভ্রু কুঁচকে নেয় মীরা৷ নিজে নেমে গিয়ে সঙ্কোচ, দ্বিধা ছাড়া উশানের একহাত আঁকড়ে ধরে বলল,
‘ রুম পর্যন্ত দিয়ে আসুন। এটলিষ্ট মানবতার খাতিরে। ‘
বিতৃষ্ণায় ওষ্ঠাধর আকৃতি ‘ চ ‘ এর ন্যায় করা হতে থেমে যায় উশান। হেলমেট বাইকে রেখে হাঁটা ধরে সামনে। মীরাকে রুম পর্যন্ত দিয়ে এসে তারপর বাইক নির্দিষ্ট স্থানে রাখবে বলে মনস্থির করলো। দুই তলা অব্দি দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাথা হজম করে নিজের ফ্লাটের সামনে আসে মীরা। দরজা খুলে রুম অন্ধকার দেখে উশান ভিতর পর্যন্ত এগিয়ে যায়।মীরা আসার পথে দরজা বন্ধ করে দেয়। রুহি নেই! মীরাকে বিছানায় বসিয়ে উশান লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে বের হতে নিবে তৎক্ষনাৎ মীরা বলে উঠলো,
‘ কাবার্ডে ফার্স্ট এইড বক্স আছে। একটু এগিয়ে দিবেন প্লিজ? ‘
নেত্রযুগল চট করে বন্ধ করে রাগ দমন করার চেষ্টা করে উশান। মীরাকে তার এ মূর্হতে তুলে আছাড় দিতে ইচ্ছে করছে। বিনাবাক্যে ফার্স্ট এইড বক্স মীরার নিকট এগিয়ে দিতেই কলিংবেলের শব্দ কর্ণকুহরে পৌঁছায় দু’জনের। উশান রাশভারি গলায় বলল,
‘ আমি দেখছি। ‘
দরজা খোলার পর সম্মুখে বেশ কয়েকজন ব্যাক্তিকে দেখে একটু চমকায় উশান।উপস্থিত ব্যাক্তিদের মাঝে প্রবীণ এক ব্যাক্তি যিনি এ বাড়ির মালিক তিনি উপস্থিত সাথে কয়েকজন মহিলা এবং পুরুষ। উশান কিছু বলার পূর্বেই প্রবীণ লোকটি কর্কশ কন্ঠে বলল,
‘ একই জায়গা থেকে আসছো বলে এতদিন তুমি, মীরা কথা বলছো। নিজেদের বাসায় আসা-যাওয়া করছো কিছু বলি নাই। আজ রুহি বাসায় নাই। তোমরা দু’জন অবিবাহিত হয়ে এক ঘরে কি করো দরজা আঁটকে? আসার পথে দেখলাম ভালোই জরাজরি, ঢলাঢলি কইরা আসতেছো। আজকে তোমাদের দুজনরে ছাড়ুম না। ঐ ধর দুইটারে। নিয়া আয় বাহিরে। আজকে উচিৎ শিক্ষা দিমু এই দুইজন কে। ‘
চলবে~