#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকা-সাদিয়া মেহরুজ দোলা
#পর্ব__১০
শান্তিনিবাস ভবনটা পুরোপুরি নীরব। থমথমে, গুমোট ভাব বিরাজমান। এপার্টমেন্টের মালিক জায়েদ হাসান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন উশানের মুখোশ্রীর প্রতি। জায়েদের পাশে আরো ২ জন্য ব্যাক্তি দাঁড়ানো। তবে তাদের দৃষ্টি ভূমিতে আবদ্ধ। উশান শান্ত, নীরব। যেনো কিছুই হয়নি। যা হচ্ছে সব স্বাভাবিক। অপর দিকে মীরার অবস্থা করুন। অল্পতেই উত্তেজিত হওয়ার স্বভাব আছে তার। ভীতিগ্রস্ত নয়নে চারপাশ আঁড়চোখে দেখে চলেছে। হটাৎ মৌনতায় ধ্বংস সৃষ্টি করে জায়েদ বলে উঠলেন,
‘ উশান!কৈফিয়ত দাও। কি করতেছিলা রুমে দুইজনে?আসার সময় অমন ঢলাঢলি,জরাজরি করে আসতেছিলা ক্যান?’
উশান অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে তাকালো জায়েদের পানে। অতঃপর সেই অদ্ভুত দৃষ্টিপাত খেয়াল করে জায়েদ কেঁপে উঠলেন কিঞ্চিৎ।কেনো?জানা নেই। উশান শীতল কন্ঠে বলল,
‘ আপনার মতানুসারে আসার পথে আমি এবং মীরা ঢলাঢলি করে এসেছি। কে বলল আপনাকে এই কথা? নাকি নিজের চোখেই দেখেছেন? ‘
‘ আমি দেখি নাই। আফিফা আছেনা?ঐই দেখছে। দেইখা আমারে কইলো। ‘
‘ ফাইন! আফিফা খালা কোথায়?ওনাকে ডাকুন। কথা আছে তার সাথে। ‘
জায়েদের গলা শুকিয়ে আসছে বারংবার। উশানের ব্যাবহার স্বাভাবিক ঠেকছে না। তার মতে এত বড় ঘটনায় উশানের বিচলিত হয়ে পড়ার কথা।অথচ এই ছেলেকে দেখো! কতোটা শান্ত গলায় কথা বলছে।জায়েদ আফিফাকে হাঁক ছেড়ে ডাক দেন। আফিফা এই দশ তলা বিশিষ্ট ভবনের প্রতেকটা ফ্লাটে কাজ করেন। ক্ষনিকের মধ্যেই উপস্থিত হলেন আফিফা৷ তার পান খাওয়া ওষ্ঠদ্বয় শুষ্ক। নেত্রের উপরিস্থ চামড়া কেমন তিরতির করে কাঁপছে। মুখোশ্রীতে লেপ্টে আছে আতঙ্ক। সেকেন্ডের মাঝে আফিফার মুখোশ্রী সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে নিলো উশান। পূর্বের থেকেও অতীব শান্ত কন্ঠে বলে উঠে,
‘ আপনি নাকি আমাকে আর মীরার পথে ঢলাঢলি করে আসতে দেখেছেন?’
আফিফা মাথা তুলে দৃঢ়ভাব নিয়ে বললেন,
‘ হ দেখছি। লজ্জা নাই তোমাগো দুইজনের? ছিঃ! এতই যহন শখ বিয়া কইরা রুমে নিয়া যা খুশি করো। বাহিরে কি? চক্ষুলজ্জা খাইছো? ‘
উশান তেরছা হাসলো। নেত্র জোড়া তার এখন অব্দি অচঞ্চল। মীরা পদে পদে চমকাচ্ছে উশানের ব্যাবহারে। লোকটা এখনো এতো শান্ত? প্রতিবাদ কেনো করছে না? সে নাহয় চিবুকের অসহনীয় যন্ত্রণায় ‘ টু ‘ শব্দ করতে পারছে না কিন্তু উশান? মৌনতা ধরে রাখা সম্ভব হলো না আর। উঁচ্চ স্বরে বলল,
‘ আন্টি?কি বলছেন এসব আপনি জানেন? প্রমাণ আছে আপনার কাছে যে আমরা রাস্তায় ঢলাঢলি করে এসেছি? ‘
‘ প্রমাণ তো মাত্রই পাইলো সবাই। এক রুমে কি করতাছিলা দুইজনে কও! ‘
‘ আশ্চর্য তো! আপনারা কি আমার হাত, পায়ের আঘাত দেখতে পারছেন না? আপনাদের চোখের সামনেই তো রক্ত পড়ছে এখনো। রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলাম অসাবধান বশত। আসার পথে উশান ভাইয়ার সাথে দেখা। তিনি শুধুমাত্র আমার হাতটা আলগা করে ধরে ওপরে নিয়ে আসছিলেন। পায়ের তীব্র ব্যাথায় পড়ে যাচ্ছিলাম বারবার আমি।আর রইল রুমের ব্যাপার। রুম অন্ধকার ছিলো। আমার রুমমেট বাসায় নেই। অন্ধকারে ভেতরে গেলে আবারও আঘাত পেতাম তাই উশান ভাই আমায় রুম পর্যন্ত দিয়ে লাইট জ্বালিয়ে বের হতে নিচ্ছিলেন। আর আপনাদের আগমন।দরজা তো তেমন ভাবে লকও ছিলো না। ভেতরে ঢুকে দেখেননি কেনো আপনারা যদি এতোই সন্দেহ থাকে।’
আফিফা এবং মীরার কথোপকথন মধ্যে উশান ফোড়ন কেটে বলল,
‘ মীরা?চুপ কর। আন্টি যখন বলল আমরা ঢলাঢলি করে ভেতরে এসেছি। তাহলে সবাইকে সেই দৃশ্যটা আগে দেখাই। ‘
সকলের উৎসুক চাহনি। উশান পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফোন বের করে ব্যাস্ত ভঙ্গিতে টাইপিং করলো।তার দশ, পনেরো মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পর আগমন ঘটে তীব্রের। হাতে তার ল্যাপটপ। তীব্র এগিয়ে আসতেই উশান নিজ স্বভাবগত শান্ত সুরে বলল,
‘ অল সেট?’
‘ ইয়াপ! স্ক্রিনে আনাই আছে। জাস্ট ওপেন কর। ‘
উশান ল্যাপটপ হাতে নিয়ে জায়েদ সহ উপস্থিত ২ জন ব্যাক্তির দিকে দৃষ্টিপাত ফেলে বলল,
‘ জরাজরির সিনটা দেখবেন না? আসুন! ভেতরে আসুন। আয়েশ করে বসে দেখুন। ‘
উশান মীরার ফ্লাটে ঢুকলো। পেছন পেছন আসলো সকলে। পড়ার টেবিলের ওপর ল্যাপটপ রেখে তাতে ভিডিও ফুটেজটা ওপেন করে সামনের দিকে ঘুরিয়ে দিলো যাতে সকলে দেখতে পায়। ল্যাপটপ স্ক্রিনে স্পষ্টত দেখা যাচ্ছে মীরার হাত কতোটা আলগা করে ধরেছে উশান। তাদের মাঝে দুরত্ব প্রায় অনেকখানি। ফ্লাটের সামনে এসে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে দু’জন। এতটুকু দৃশ্য শেষেই উশান ‘ পজ ‘ করে দেয় ভিডিও। বক্ষঃস্থলের মাঝে দু’হাত ভাজ করে নিয়ে আয়েশী ভঙ্গিমায় দাঁড়ায়।পরিশেষে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ তো?জরাজরি করে আসছিলাম আমরা তাই না আন্টি? সিসিটিভি ফুটেজ ছিলো এটা। ‘
জায়েদ হাসান চটে গেলেন তৎক্ষনাৎ। ক্ষুদ্ধ নেত্রে আফিফার পানে চাহনি নিক্ষেপ করে বললেন,
‘ আফিফা! এসব কি? মিথ্যা কথা কইলা ক্যান?’
‘ ওনার প্রতি ক্ষুদ্ধ হওয়ার পূর্বে। সর্বপ্রথম নিজের দোষটা দেখা উচিত ছিলো না আংকেল? সবকিছু সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে তো আসা উচিত ছিলো না? আপনার বাড়ি। নিশ্চয়ই জানতেন গ্রাউন্ড ফ্লোরে সিসি ক্যামেরা ছিলো। ‘
কাচুমাচু করে তাকালেন জায়েদ। লজ্জায় নতজানু হলেন। কন্ঠের খাদ নামিয়ে অনুতপ্ত হয়ে বললেন,
‘ আমায় মাফ কইরা দাও বাবা। এই আফিফা আমারে এমনে বাজে ভাবে কইছিলো আমার মাথা ঠিক ছিলো না। রাগে বোধ বুদ্ধি ফালাইয়া আইসা পড়ছি। ‘
‘ রুমে গিয়ে কি করেছি তার বিশদ বর্ণনা তো মীরার থেকেই পেলেন। নাকি বিশ্বাস হয়নি ওর কথা? প্রমাণ চাই? আমার কাছে তারও প্রমাণ আছে। ‘
জায়েদ ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বললেন, ‘ না, না বাবা। মাফ করো। এই আফিফা! এই মিথ্যা কথা ক্যান কইলি ক। ‘
‘ আমি বলছি আঙ্কেল। আফিফা আন্টির ছেলেকে মীরা একদিন থাপ্পড় মেরেছিলো রাস্তায়। অনেক অপমানও করেছিলো। আন্টির ছেলে মেয়েদের রাস্তায় বিরক্ত করতো তাই মীরা থাপ্পড় মেরে হুমকি দিয়েছিলো।সেদিন পুলিশ এসে জেলেও নিয়েছিলো তার ছেলেকে। যতদূর বুঝতে পারলাম। ছেলের অপমানিত হওয়া এবং জেলে যাওয়া নিয়ে আন্টি ক্ষুব্ধ। তারই হয়তো শোধ তুললেন। মাঝে আমাকে ফাঁসালেন। ‘
আফিফা ন্যাকা স্বরে কেঁদে উঠলেন। সায় জানান উশানের কথায়। অনুনয়ের সুরে বললেন,
‘ হ! এর লেইগাই আমি এমনটা করছিলাম। মাফ কইরা দাও আমারে বাবা। আমি আমার পোলাডারে অনেক ভালোবাসি। পুলিশ ওরে ধইরা নিয়ে অনেক মারছিলো। পোলাডা আমার জ্বরে অনেকদিন বিছানা থেকে উঠবার পারেনাই। তারপর থেকাই মীরার ওপর রাগ উঠলো আমার। তাই সুযোগ বুইঝা এমনটা করছি। মাফ কইরা দাও বাবা। ‘
উশান জোড়াল শ্বাস ফেললো। বক্র চোখে তাকালো একবার মীরার মুখোশ্রীতে। ব্যাথায় আঁটসাঁট হয়ে কোনোরকম দাঁড়িয়ে আছে। উশান কঠিন গলায় বলল,
‘ এমনটা না করে নিজের ছেলের দোষটা আগে দেখলেও পারতেন আন্টি। সম্পূর্ণ দোষ কিন্তু এখানে আপনার ছেলের। ছেলেকে মানুষ করুন। আজ আপনার ছেলে যেই মেয়েদের ডিস্টার্ব করে সেই মেয়েদের মধ্যে যদি আপনার মেয়ে থাকতো। তাকে যদি অন্য কেও এভাবে জ্বালাতো তখনো কি সেই ছেলের করা কর্মে চুপ থাকতেন? সবাইকেই নিজের আপনজন ভাবুন। কাজ করতে সহজ হবে।’
ঘটনার সমাপ্তি ঘোষণা হলো কিয়ৎক্ষণ বাদে। পরিবেশ আগের মতে হয়ে উঠলো প্রানবন্ত। সকলে ক্ষমা চেয়ে কোনোরকম কেটে পড়লো। উশান আর এই ব্যাপারে মাথা ঘামালো না।দৃষ্টিপাত ফেলে এবার মীরার প্রতি। তীব্রকে নিজের রুমে যেতে বলে মীরার হাতে ফার্স্ট এইড বক্স তুলে দিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে যেতে বলে,
‘ ড্রেসিং করে নে। নয়তো ইনফেকশন হতে পারে। ‘
মীরা তপ্তশ্বাস ছাড়ে। দরজা লাগিয়ে এসে বসে বিছানায়। একটা ছোট ঘটনায় কি থেকে কি হয়ে গেলো। সমাজের মানুষ এমন অদ্ভুতুরে কেনো?
_
ঘটনার ১৮ দিন পর। সবকিছু আগের মতোই চলছে স্বাভাবিক রূপে। সেদিনকার ঘটনা যেনো মাথায় নেই কারোরই। উশানের ভীষণ ব্যাস্ত সময় কাটছে। মীরার দিনাতিপাত হচ্ছে নিজের পড়াশোনা নিয়ে।আজ বাসায় ফিরেছে উশান। দুইতলায় এসে পা জোড়া থেমে গেলো আপনা-আপনি। প্রতিবার যখন সে ফ্লাটে ফিরে বহুদিন পরপর তখন মীরা লুকিয়ে দরজা ফাকঁ করে তাকে দেখে। উশান যতক্ষণ অব্দি ওপরে উঠে চলে না যায় ততক্ষণ অব্দি মীরা দরজা কিঞ্চিৎ উন্মুক্ত করে উঁকি দিয়ে তাকিয়ে থাকে। উশান ব্যাপারটা খেয়াল করেনি প্রথমত৷ অতঃপর এক সময় এই জিনিসটা উপলব্ধি করেছে।উশান নির্লিপ্ত, নিশ্চুপ ছিলো এ ব্যাপারে। কিন্তু আজ কেনো যেনো মীরাকে কিছু বলতে ইচ্ছে হচ্ছে।
সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উশান ভরাট কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ বাহিরে আয় মীরা। আমি জানি তুই আমায় চোরের প্রায় সময় এমন করে দেখিস। ‘
দরজার ওপাশ থেকে মীরা হকচকিয়ে উঠলো। হতভম্ব সে। লোকটা বুঝলো কি করে?আশ্চর্য তো! মীরা একবার ভাবলো যাবেনা উশানের সামনে কিন্তু মন সায় দিলো না তার ভাবনায়। পরবর্তীতে ত্রস্ত পায়ে সে ফ্লাট থেকে বের হলো। পিছনে বসে থাকা রুহি এই দৃশ্য দেখে হতাশ চোখে মীরার যাওয়া দেখলো।
মীরা বেড়িয়ে আসে। তবে উশানের মুখোশ্রীর প্রতি ভুলেও তাকায় না। লোকটার চাহনি মারাত্মক।শ্বাস রুখে দেয়। উশান মীরাকে আপাদমস্তক দর্শন করে বলল,
‘ এরকম চোরের মতো আমায় লুকিয়ে দেখার মানে কি? ‘
মীরা অন্তঃকরণে শব্দগুচ্ছ বিন্যস্ত করে সাজাতে লাগলো। কিন্তু কি অদ্ভুত ব্যাপার। কন্ঠনালীতে যেনো শব্দগুচ্ছ জট পাকিয়েছে। মীরাকে নিশ্চুপ দেখে উশান তেজী কন্ঠে বলল,
‘ কি হলো? উত্তর দে! ‘
মীরা কেঁপে উঠলো। অন্তঃকরণ নির্দেশনা দিলো আর মৌনব্রত পালন করা ঠিক হবেনা। বার দুয়েক ঢোক গিলে জিহ্বা দ্বারা ওষ্ঠাধর সিক্ত করে মীরা বলে উঠলো,
‘ নিজেকে কি মনে করেন আপনি হ্যা যে আপনাকে আমার লুকিয়ে দেখা লাগবে৷ আমি অবশ্যই উঁকি দিয়ে আপনাকে দেখছিলাম না। কয়েকদিন ধরে রাতের বেলা কেও দরজা ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। প্রথম কয়েকদিন ধরতে পারিনি কে করছে এমনটা। তারপর থেকে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করি কে করে কিন্তু কয়েকদিন ধরে বন্ধ। কাল আবার এমন করেছিলো তাই আজ উঁকি দিয়ে দেখছিলাম।দ্যাট’স ইট! ‘
মীরা দম নিলো। জীবনে প্রথম বোধহয় কোনো মিথ্যা কথা এতো সুন্দর করে বাস্তবিক ভাবে বলতে পেরেছে। উশান তার কথা বিশ্বাস করেছিনা তা দেখার স্বার্থে মাথা ওপরে তুলতেই ভীষণ অবাক হয় মীরা। উশানকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। ঈষৎ আগে দর্শন করা উশান এবং বর্তমানে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা উশানের মাঝে যেনো আকাশ, পাতাল তফাৎ। বাদামী, প্রানোচ্ছাস মুখোশ্রী ফ্যাকাশে। স্থির অধর যুগল কম্পমান৷ নেত্রযুগল চঞ্চল। ঘন ঘন নিঃশ্বাস টানছে। কঠিনতার খোলস ফেলে নমনীয় হয়ে উঠলো মীরা। আলত সুরে বলল,
‘ আর ইউ ওকে ? ‘
উশান নিরুত্তর। প্রতিত্তুর করার জন্য অধর যুগল প্রসারিত করতেই শব্দ করে ভূমিতে ভারী শরীরটা নিয়ে আছড়ে পড়লো সে।
চলবে…