#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকা- সাদিয়া মেহরুজ দোলা
#পর্ব-১৪.
আজ প্রায় চারমাস হলো উশানের দেখা নেই। ফ্লাটে আসেনা। উশানের ভীষণ চাপ যাচ্ছে বলে মনে করলো মীরা। কারণ লোকটা এতো দেরী করে না। তিনমাস পর পর একবার করে সে ফ্লাটে আসে।তাছাড়া সে নিজেও চাইছেনা উশানের মুখোমুখি হতে। লোকটাকে দেখলেই তার কান্না পায়। কতই না কষ্ট পুষে রেখেছিলো এতদিন নিজ অন্তঃকরণে। সেদিন হয়তো আর চেপে রাখতে পারেনি।কঠিনতার খোলস দেখে বেড়িয়ে বাচ্চাদের মতো করে কেঁদে দিয়েছে।
ফাল্গুন মাসের আজ দশ তারিখ। অথচ ভ্যাপসা গরম, কড়া রৌদ্দুর দেখে মনে হচ্ছে চৈত্র মাসের প্রথমাংশ চলছে। মীরা তপ্তশ্বাস ছাড়ে। তীব্র তাকে বলেছিলো, উশান এই অপ্রীতিকর ঘটনার পর থেকে নারী জাতিকে ঘৃণা করে। মীরা’র বোধগম্য হয় উশানের তাকে এড়িয়ে চলার কারণটা হয়তো এটাই। সূর্যের কিরণের উত্তপ্ততার মাঝে মীরা লম্বা, লম্বা কদম ফেলে এগোচ্ছে। বাসায় যাওয়া অতীব জরুরি। বোরকার নিচে পরিহিত পোশাক ঘামে সিক্ত হয়ে আছে। গা গুলিয়ে আসছে তার। কিয়ৎ দূর যেতেই মীরার নিকট দৃশ্যমান হয় এক অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য! বিষ্ময়কর চাহনি নিক্ষেপ করে সে। মীরার হতে প্রায় দশ কদম দূরে দাঁড়িয়ে উশান।বাইকে হেলান দিয়ে ব্যাস্ত ভঙ্গিতে তীব্রের সাথে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলছে। মুখোশ্রীতে তার রাজ্যের ব্যাস্ততা এঁটে সেঁটে রয়েছে এমন ভাব।মীরা এগোল। আজ আবার ছ্যাচড়া হতে অন্তঃকরণ অনুমতি দিলো। লোকটা কেমন আছে? একবার জিজ্ঞেস করা উচিত।
প্রায় দৌড়ে গিয়ে উশানের সম্মুখে দাঁড়িয়ে পড়ে মীরা। উশান মীরাকে দেখে বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করলো না। সে দেখেছিলো এই মেয়েকে তড়িৎ বেগে ছুটে আসতে। উশানের মতে, মেয়েটা অযথাই তার পিছে পড়ে আছে। এতদিনে তো মীরার মোহ কেটে যাওয়ার কথা। কাটলো না কেনো? বিষয়টি মাঝেমধ্যে ভাবায় তাকে। উশান নিজের পূর্ব রূপে স্থির থাকলেও তীব্র তাতে ব্যাঘাত ঘটিয়ে গলা ঝেড়ে বলল,
-‘আব.. শান? মীরা মেবি তোকে কিছু বলবে। তোরা কথা বল। আমি একটা ফোন কল এটেন্ড করে আসছি। ‘
তীব্র মীরার মুখোশ্রীর প্রতি দৃষ্টিপাত ফেলে সৌজন্যতার হাসি দিয়ে কেটে পড়লো। মিথ্যা ফোনে কথার ভাং করে প্রায় অনেকটাই সে দূরে চলে গেলো। উশানের রক্তিম চাহনি উপেক্ষা করে অদূরে যাওয়াটা তার পক্ষে অতোটা সহজতর ব্যাপার ছিলো না। মীরা দু’হাতের তালু ঘসলো। কি আশ্চর্য! তার দেখি অস্বস্তি কাজ করছে। উশান মীরার আচরণ দেখে ধমকে বলে উঠলো,
-‘ কি চাই? কিছু বলতে চাস? গুরুত্বপূর্ণ কিছু হলে বল নয়তো এখনি আমার সামনে থেকে দূর হ! ‘
মীরা আঁড়চোখে উঁকি ঝুঁকি দিলো উশানের মুখোশ্রীতে। লোকটা তার স্বাভাবিক রূপে ফিরে এসেছে তাহলে। সেদিনের ভেঙে পড়া, ক্রন্দনরত, দূর্বল উশানকে মীরার পছন্দ নয়। বিন্দুমাত্র না। চটপটে, প্রানোচ্ছল এই উশানকেই চমৎকার লাগে তার নিকট। মীরা ঢোক গিলে কয়েকবার। শক্ত কয়েক কথা শোনাতে হবে উশানকে। বোঝাতে হবে সে ভুলে গেছে সেদিনকার উশানের ভেঙে পড়া রূপটার কথা। ওষ্ঠাধর সিক্ত করে মীরা নম্র কন্ঠে বলল,
-‘ আপনার সামনে থেকে সরবো মানে? আমি কি আপনার সাথে লেগে দাঁড়িয়ে? হুহ? আপনার থেকে প্রায় তিন ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আমি। ‘
উশান কড়া নজরে তাকালো। মীরা বুঝলো এখন এইসব ত্যাড়া উত্তর দেয়া চলবে না। তাহলে দেখা যেতে পারে জনসম্মুখে তিন – চারটে চড় পরতে পারে তার নির্মেদ গালে। মীরা ধাতস্থ করে নিজেকে নিভৃতে। জোর গলায় প্রশ্ন ছুড়ঁলো,
-‘ এতোদিন ফ্লাটে আসেন না যে? আপনি তো তিন মাস পরপরই আসতেন। এতদিন কেনো আসেননি?’
-‘ বলতে বাধ্য নই। ‘ উশানের শীতল কন্ঠ।
-‘ ওকে ফাইন। বাধ্য নন বলতে ধরে নিলাম। আপাতত একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আপনাকে জিজ্ঞেস করছি। কোথায় ছিলেন আপনি? ‘
উশান ললারো বলিরেখা ফেললো। সুক্ষ্ম নজর আবদ্ধ হলো মীরা’র মধ্যে। তীক্ষ্ণ স্বরে ঝটপট বলল,
-‘ সচেতন নাগরিক? এর এখানে কাজ কি? ‘
উশান মনে মনে হাসলো বেশ কিছুক্ষণ। মেয়েটা পাগল হয়েছে নিশ্চিত। পাগলামো করার চোটে কি বলছে তা হয়তো এই মানবী নিজেও অবগত নন। বহির্ভাগে উশান তার আগের রূপ বহাল রেখে কড়া গলায় ধমক ছুড়লো,
-‘ এক থাপ্পড়ে দাঁত ফেলে দেবো বেয়াদব মেয়ে। আমার পিছে এভাবে অযৌক্তিক কারণে লেগে থেকে নিজেকে ছ্যাচড়া প্রমাণিত করতে তোর বেশ লাগে না? ফাজিল! ‘
মীরা নিভলো। ঘোরের বশে সে কি বললো তা নিজ মনে আওড়ালো। পরিশেষে লজ্জায় নতজানু হয়ে ভূমিতে দৃষ্টিপাত নিবদ্ধ করে মীরা। ছিহঃ! আবারও সে নিজেকে ‘ছ্যাচড়া ‘ প্রমাণ করতে শুরু করেছে? অতীব নিম্ন সুরে ‘ সরি ‘ বলে মীরা হাঁটা ধরলো সামনে৷ নেত্র কার্নিশে বিন্দু পরিমাণ জমে থাকা নোনা, স্বচ্ছাকার অশ্রুকণা বুড়ো আঙুল দিয়ে মুছে ফেললো চটপট। দম বন্ধ হয়ে আসছে। উশানের থেকে দূরে যাওয়ার কি কোনো উপায় নেই?
উশান বিস্মিত হলো। সে ভেবেই নিয়েছিলো মীরা তাকে এখন উদ্ভট কয়েক কথা শোনাবে। অন্তঃস্থলে সে সেই কথা শুনতে প্রস্তুতিও নিয়েছিলো। কিন্তু কি আশ্চর্য! মেয়েটা মৌন থেকে চুপচাপ চলে গেলো? উশান অনুভব করে সে চমকেছে ভীষণ অথচ তার তো এখন স্বস্তির শ্বাস ত্যাগ করার কথা। উশান ধাতস্থ করলো নিজেকে। সেকেন্ড দুয়েক পর শব্দ করে পা ফেলে তীব্র এসে তার সম্মুখে দাঁড়ালো। শেষে কর্কশ কন্ঠে বলল,
-‘ কি বলেছিস আজ ওকে? এমন মনমরা হয়ে চলে গেলো কেনো?’
উশান দ্বিধাহীন গলায় প্রতুত্তর করলো,
-‘ আমার পিছে অযথা ঘুরঘুর করার জন্য ছ্যাচড়া বলেছি। ‘
-‘ শালা ঘাউরা! তুই কি মানুষ হবি না? মেয়েটাকে আর কত কষ্ট দিবি?যখন তোর থেকে দূরে চলে যাবে তখন বুঝবি। হীরের মূল্য বুঝিস না। এর জন্য তোকে পশ্চাতে হবে। ‘
উশান তৎক্ষনাৎ ধমকে বলল, ‘ থাপ্পড় মেরে গাল লাল করে দিবো বেয়াদব। সবসময় অতিরিক্ত কথা।শুধু মীরার ভালোবাসার সাইডটা দেখছিস। ওর সেফটির দিকটা তোর চোখে পরেনা? আমার সাথে জরীয়ে গেলে ওর নরমাল লাইফটা নরকে পরিনত হবে যা আমি চাই না তীব্র। ও আমার সাথে সেইফ না। আমার নিজেকেই নিজে প্রটেক্ট করতে গার্ড লাগছে আর ওর বেলায়?’
তীব্র বিষ্ময়কর দৃষ্টি ফেলে বলল,
-‘ ওয়েট, ওয়েট! তুই যদি নরমাল লাইফ লিড করতি তাহলে মীরাকে এক্সেপ্ট করে নিতি?ইভেন মন থেকে অলরেডি এক্সেপ্ট করে নিয়েছিস!গড! সিরিয়াসলি? ‘
_
বৃষ্টিস্নাত রজনী। রাত্রির দ্বিতীয় প্রহর। বৃষ্টি সিক্ত মাটির নেশালো ঘ্রাণ অনিলে মিশে চারপাশে বইছে।মাদকতার ন্যায় মিষ্টি ঘ্রাণ মীরা নেত্র যুগল বন্ধ করে শুষে নিচ্ছে অনায়াসে। নেত্র যুগল বন্ধ করার পর হতে মীরার বারংবার মনে হচ্ছে তাকে কেও দেখছে, গভীর মনোযোগ সহকারে দৃষ্টিপাত ফেলে রেখেছে তার মুখোশ্রীর প্রতি। চট করে অক্ষিপল্লব উন্মুক্ত করলো মীরা। তৎক্ষনাৎ সামনের এপার্টমেন্টের তার ফ্লাট বরাবর থাকা ফ্লাটের পর্দার আড়াল হতে কেও ঝটপট সরে গেলো। মীরা ভ্রু কুঁচকে নেয়। তার ধারণা তবে সত্যি হলো। কিন্তু কে দেখছিলো তাকে?সামনের এই ফ্লাটে তো উশান, তীব্র আজই উঠেছে। এই এপার্টমেন্টে ছেড়ে দিয়েছে উশান।
মীরা রুমে প্রবেশ করে পর্দা টেনে দিলো। লাইট অফ করে ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিলো সে। রাত হয়েছে অনেক। রুহি ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক আগেই। মীরা গিয়ে বসলো বিছানায়। তৎক্ষনাৎ তার কর্ণকুহরে ভেসে আসলো গিটারের সুরেলা ধ্বনি। সঙ্গে মনোমুগ্ধকর কারো কন্ঠে গাওয়া গান।
তোমার জন্য নীলচে তারা’র একটুখানি আলো।
ভোরের রঙ রাতে মিশে কালো..,
কাঠগোলাপের সাদার মায়া তোমায় মিশিয়ে দিয়ে ভাবি,
আবছা নীল লাগে তোমার ভালো…,
মীরার ষষ্ঠী ইন্দ্রীয় সচেতন হলো। কন্ঠস্বরটা তার বড্ড চেনা। কৌতূহল বশত নিঃশব্দে বের হয়ে বেলকনিতে উপস্থিত হলো৷ সঙ্গে সঙ্গে চমকিত হয়ে চক্ষুজোড়া বড়সড় আকৃতির ধারণ হলো। উশান গান গাইছে? কি ভয়ংকর ব্যাপার! পদে পদে ধমক দেওয়া কঠিন কন্ঠস্বরের মানুষটার তাহলে নরম, কোমল এক রূপ আছে৷
চলবে…
[ প্রচন্ড মাথা ব্যাথা নিয়ে লিখেছি পর্বটা। খাপছাড়া লাগতে পারে। তারজন্য ক্ষমাপ্রার্থী। ]