হৃদয়েশ্বরী #লেখিকা- সাদিয়া মেহরুজ দোলা #পর্ব- ১৯

0
1

#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকা- সাদিয়া মেহরুজ দোলা
#পর্ব- ১৯
___________________

শূন্য কেবিনে ছটফট করছে মীরা। বারংবার দৃষ্টি ফেলছে সম্মুখে। মৃদু শব্দ কর্ণপাত হলেই অন্তঃকরণ নড়েচড়ে উঠে এই বলে উঠলো, সে আসছে! কিন্তু কোথায়? সেই কাঙ্খিত ব্যাক্তির দেখা নেই আধা ঘন্টা যাবৎ। মীরা আগত ক্রন্দন ঠোঁট কামড়ে রুখে নেয়। মাত্রাতিরিক্ত চিন্তায় ললাটে উৎপত্তি ঘটেছে বলিরেখার। শান্ত, স্থির মস্তিষ্কের নিউরন বর্তমানে অস্থিতিশীল। পা দু’টো কম্পমান। হাত জোড়া কম্পমানশূন্য তবে হীম হয়ে পাথর। মীরা নেত্রযুগল বন্ধ করলো। ফিসফিসিয়ে বলল,

-‘ আমাকে এভাবে চিন্তায় ফেলে উধাও হয়ে ভালো করেননি আপনি। একদমই ভালো করেননি। ‘

রায়ানের দুই হাত বেঁধে রেখে উশান ধমকে – ধামকে মীরা কে এসে কেবিনে রেখে যায়। পথিমধ্যে মীরা নিষেধ করছিলো বারংবার না যেতে এভাবে একা। কিন্তু জেদী, একরোখা উশান তার কথা শুনলে তো।বাহির থেকে মীরাকে লক করে রেখে সেই যে গেছে, আধাঘন্টা পার হলো, উশান লাপাত্তা! মীরার মনে কু ডাকছে। লোকটা ঠিক আছে তো? সুস্থ রূপে আছে তো?

পদধ্বনির জোরদার শব্দ। মীরা উঠে দাঁড়ালো। কেবিনের দরজা খুলে এবার তার কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তি দর্শন দিলো। উশানের হাতে তার ফোন। ব্যাস্ত হাতে টাইপিং করতে করতে প্রবেশ করলো। সিটে বসে ক্লান্তি নিয়ে বলল,

-‘ পানি দাও তো মীরা। গলা শুকিয়ে গেছে। ‘

মীরা দ্রুত পায়ে ব্যাগের নিকট এগোল। পানির বোতল নিয়ে ফিরে আসার পর উশানের নিকট এগিয়ে দিয়ে উশানকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল কোথাও আঘাত লেগেছে কিনা। শেষে উশানের গলার কাছে শার্টে লেপ্টে থাকা রক্তিম তরল পদার্থ দর্শন করে শিউরে উঠলো মীরা। বেশ খানিকটা রক্ত বের হয়েছে আঘাতপ্রাপ্ত স্থান হতে তা শার্টের সিক্ত অংশ দেখে মীরা ঢের বুঝতে পারলো। আতঙ্কিত হয়ে অকস্মাৎ সে বসলো উশানের পাশে। দ্বিধা ফেলে হাত দিলো উশানের ঘাড়ে। বিচলিত কন্ঠে বলল,

-‘ এখানে আঘাত পেলেন কি করে? রক্ত বের হচ্ছে তো অনেক। ‘

মীরার হটাৎ হামলে পড়াতে উশান চমকে বিষম খেলো। পানি নাক দিয়ে উঠে গিয়েছে। কাশতে শুরু করলে হুঁশে ফিরে মীরা। ইতস্তত বোধ করে বলল,

-‘ সরি! সরি! ‘

উশান স্বাভাবিক হয়ে বক্ষঃস্থলের মাঝে হাত দিয়ে শ্বাস টানলো। গভীর, দীপ্ত নেত্রে দৃষ্টি দিয়ে বলল,

-‘ এভাবে শার্টের কলার ধরে টান দিলে কেনো মেয়ে? দেখছোনা পানি খাচ্ছি? ‘

-‘ বললাম তো সরি। আপনার কাঁধে রক্ত দেখে..,ইয়ে মানে! আপনার কাঁধে আঘাত কিভাবে পেলেন? বললেন না তো। ‘

উশান বিরক্তি সহিত নাক-মুখ কুঁচকে নিলো। জবাব দিলো ক্ষীণ সুরে,

-‘ এলেন! ঘাড়ত্যাড়া একটা। সেন্সে এসেই ছু’রি দিয়ে আঘাত করে বসলো। ঐটার হাত ভেঙে এসেছি। আঘাত তেমন গুরুতর না। এমনিই ঠিক হয়ে যাবে। ‘

মীরা মৌন! ফের নিজের স্থান থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগের কাছে গেলো। হাতে ফার্স্ট এইড বক্সটা নিয়ে এসে বসলো উশানের পাশে৷ দ্বিধা নিয়ে বলল,

-‘ রক্ত তো এখনো পড়ছে। আমি ড্রেসিং করে দিচ্ছি। প্লিজ না করবেন না। না করলে আমি শুনবো না। ‘

উশান ঘোর অনিচ্ছা প্রকাশ করলো। মীরার তাতে ভাবান্তর নেই। সে ইতিমধ্যে নিজের কাজে তুমুল ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে। বিনা স্পর্শে ড্রেসিং করছে ক্ষত স্থান। উশান উঠে যেতে নিলেও উঠলো না। রক্ত পরিস্কার আবশ্যক। এভাবে রক্তক্ষরণ হলে বাহিরে যাবে কি করে? ট্রেনে আরো মানুষ জন্য রয়েছে। মুঠোফোনে দৃষ্টি ফেলে পিছনে পিঠ এলিয়ে দেয় উশান। তপ্তশ্বাস ফেলে বলে উঠলো,

-‘ ফার্স্ট এইড বক্স এখানে? এইটা নিয়েই ঘোরাঘুরি করো নাকি? ‘

-‘ উঁহু! তবে লং জার্নিতে ক্যারি করি। দরকার পড়ে অনেক সময়। যেমন এখন পড়লো। ‘ মীরার কাঠ কাঠ, একটু অন্যমনস্ক প্রতিত্তুর।

উশান তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,

-‘ আমি তো জাস্ট এক্সকিউজ! দরকার টা আসল পড়ে তো তোমার। বাচ্চা মানুষ তুমি। হাঁটতে, চলতে ধপাধপ পড়ে গিয়ে আঘাত পাও। ‘

মীরা রুষ্ট চাহনি নিক্ষেপ করলো। তবে, কন্ঠনালী দ্বারা একটা শব্দও উচ্চারণ করলো না। এখন কিছু বলা মানেই বিপদ। মহা বিপদ! এমনিতে উশানের কাঁধের ক্ষতটা মোটামুটি গভীর। অদূর থেকে ক্ষতের গভীরতা বোঝা যায় অতোটা কিন্তু কাছে এসে দেখলে উপলব্ধি করতে পারবে ক্ষতের পরিমাপ। মীরার হাত কাঁপছে প্রবল। নেত্রপল্লব ঘন ঘন পল্লব ফেলছে। বক্ষ পিঞ্জর হু হু করে উঠলো তার। লোকটার নিশ্চয়ই ভীষণ ব্যাথা করছে? কষ্ট হচ্ছে? যন্ত্রণা হচ্ছে? নেত্রকোণায় উপস্থিত অশ্রুকণা পল্লব ঝাপটে বিতাড়িত করলো মীরা। এখন কিছু বলবে না সে। বললে যদি একরোখা লোকটা উঠে চলে যায়? তাহলে তো ইনফেকশন হয়ে যাওয়া আশঙ্কা আছে।

মীরার নির্লিপ্ততা উশানের পছন্দ হলো না। মীরা কে রাগাতে না পারলে কেনো যেনো তার মনে শান্তি মিলে না। উশান চুপ রইল কয়েক সেকেন্ড। অতঃপর ভরাট কন্ঠে বলল,

-‘ রায়ান, রাহিনের সাথে তোমাকেও ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবো ভাবছি? হোয়াট ছে? তুমি তো তখন মরতেই চাচ্ছিলে। ‘

ব্যান্ডেজ করা শেষ মীরার। উশানের কথা শ্রবণ করে তার হাত দু’টো থমকে গেলো প্রায়। বিষ্নয়কর দৃষ্টি দিয়ে বলল,

-‘ মানে? ওদের দু’জনকে কে কি সত্যিই ট্রেন থেকে ফেলে দিবেন? ‘

গলায় শব্দ করে হাসলো উশান। যেনো কৌতূক শুনেছে। বড্ড বিরক্ত হলো সে। মেয়েটা এতো বোকা কেনো?
উশানের হাসির মাধ্যমে মীরা বুঝে গেলো, সে ভুল প্রশ্ন করেছে। নিজেকে আবারও উশানের কাছে বোকা প্রমাণিত করেছে। উঠে দাঁড়িয়ে সামনের সিটে গিয়ে বসলো মীরা। রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি। লজ্জা লাগছে তার। সঙ্কোচ পায়ে ঠেলে বহু চেষ্টায় বলল,

-‘ রুহি, উমাইশা আপু, তীব্র, দিগন্ত ভাইয়া তারা কোথায়? রুহি আর আপু তো এই কেবিনেই ছিলো। আমি আসার পর তো আর দেখলাম না এখানে। ‘

-‘ তীব্র, দিগন্ত রায়ান রাহিনের সাথে। রুহি আর আপুকে একটা সেফ কেবিনে সরিয়ে নিয়েছি। ‘

-‘ অহ! আমি ওদের কাছে যেতে পারি? ‘

-‘ সকাল হওয়ার আগে কেবিন থেকে বের হওয়া যাবে না। ঘুমিয়ে পড়ো। বাহিরে গার্ড পাহারা দিবে। চিন্তার কিছু নেই। আমি এখনি চলে যাবো। ‘

মীরার ভীষণ বলতে ইচ্ছে করলো, আপনি একটু থাকুন উশান। আমার এতদিনের নির্ঘুমতা একটা দিনে একটু ভিন্ন হোক। প্রশান্তির ঘুম আসুক। ‘
বলা হলোনা! মীরা শুয়ে পড়তেই উশান বেড়িয়ে গেলো। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ঘুমানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা শুরু করলো সে।

__

বৃষ্টিস্নাত প্রভাত। সকাল হতেই ঝুম বৃষ্টির তান্ডব লীলা শুরু হয়েছে। ট্রেন থামবে আর আধা ঘন্টা পর অথচ বৃষ্টি থামার কোনো নাম গন্ধ নেই। মীরা চিন্তায় পড়ে গেলো। বৃষ্টিতে ভিজলে উশানের জ্বর আসে প্রচন্ড।এক সপ্তাহ ধরে সেই জ্বর আষ্টেপৃষ্টে জরিয়ে থাকে তার। এটা সম্পর্কে অবগত সে।মূলত এ কারণেই চিন্তিত মীরা। পরক্ষণেই সিটে মাথা এলিয়ে নেত্র জোড়া বন্ধ করে জোড়াল শ্বাস ফেললো। নিষ্প্রাণ কন্ঠে আনমনে বলল,

-‘ কুল ডাউন মীরা! উশান ডাজেন্ট লাভ ইউ। তাকে নিয়ে এতোটা চিন্তিত হওয়ার মানেই হয় না। ‘

দরজায় কড়াঘাত পড়লো। সচেতন হলো মীরা। দুই সেকেন্ড অতিবাহিত হওয়ার পর কেবিনে হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করলো রুহি। দৌড়ে এসে মীরাকে জরিয়ে ধরে বলল,

-‘ তুমি ঠিক আছো জান? আমার কতোটা চিন্তা হইছে তোমার জন্য জানো? ‘

মীরা তপ্তশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘ ঠিক আছি আমি। ছাড়, দূরে গিয়ে বস!’

রুহি মীরাকে ছেড়ে তার পাশ ঘেঁষে বসলো। মীরার প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত ফেলে পর্যবেক্ষণ করলো কিছু। শেষে সন্দিহান গলায় বলল,

-‘ ঠিক আছিস? দিবো এক থাপ্পড়! চেহারার এই অবস্থা কেন? কি নিয়ে চিন্তা করতেছিস? ‘

হতাশ দৃষ্টিতে তাকালো মীরা। রুহি তার মন অবস্থা সর্বক্ষণ বুঝে ফেলে ভাষায় প্রকাশ না করলেও। সে চাইছিলো তার বর্তমান অবস্থা অন্তর্লীন থাকুক।

-‘ বৃষ্টি পড়ছে রুহি। ‘

-‘ তো? ‘

-‘ উশানের বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর আসে। ‘ মীরার মিনমিনে সুর।

রুহি রাগতে গিয়েও পারলো না। নিষ্প্রভ চাহনি নিক্ষেপ করলো। মলিন কন্ঠে বলল,

-‘ তুই..! তুই উশান ভাইরে কি ভুলতে পারবি না মীরা? মানে এটা কি পসিবল না? উশান ভাই তোকে ভালোবাসে না মীরা। দূরে থাক তার থেকে। যে তোর মূল্য বোঝেনা অযথা সেই লোকের পিছে পড়ে থেকে কি লাভ বল?আমি তোকে উশান ভাইয়ের থেকেও ভালো কাওকে এনে দিবো জান। মন খারাপ করে না। ‘

মীরা অন্যত্রে দৃষ্টিপাত ছুড়লো। আপনমনে স্বগতোক্তি করলো, ‘ আমার কাওকে চাইনা রুহি! কাওকে না। কেও আমার উশানের মতো হতে পারবে না। কক্ষনো না। ‘

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here