#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকা- সাদিয়া মেহরুজ দোলা
#পর্ব-২৩
_____________
সায়াহ্ন হতেই অম্বর ঘোলাটে, মেঘবর্ণ। পূর্ণিমাতিথি হলেও দেখা নেই চাঁদের। মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে চাঁদ। থেমে থেমে প্রকৃতিতে বইছে ঝড়ো হাওয়া। বৃষ্টি আসবে বলছে মেদিনী। মিনিট খানেক পর পর বজ্রপাত আছড়ে পড়ছে পৃথিবী পৃষ্ঠে। বজ্রপাতের সেই কড়া শব্দে উশানের হুঁশ ফিরে। জানালার উন্মুক্ত কপাট ব্যাস্ত হাতে বন্ধ করে দিয়ে ফিরে আসে নিজের চকিতে। উশান ঘাড় দুই দিকে কাত করে। পুরো শরীরে যেনো মূর্হতেই বিষ যন্ত্রণা এসে ভর করেছে। নিজের রোমশ এক হাত নেত্র সম্মুখে তুলে আনে উশান৷ হাতের এক কোণে কামড় দেয়ার ছাপ। লাল হয়ে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। উশান বিড়বিড়িয়ে শুধালো,
-‘ বড্ড ফাজিল হয়ে গেছো তুমি মীরা। বড্ড বেশি! ‘
উশান স্থির দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করলো মীরার প্রতি। মীরা তখন নিঃশব্দে বসে। দাঁত দিয়ে নখ কাটছে আর বিড়বিড় করছে৷ ভ্রু’কুটি এক করে উশান৷ এই মেয়েটা যে তার ওপর কিয়ৎক্ষণ পূর্বে যেই নির্যাতন চালিয়েছে তা কি মীরা স্বীকার করবে কখনো?আদও সকালে উঠে মনে থাকবে এসব কথা?
কিয়ংদশ পূর্বে! মীরা কে অচেতন অবস্থায় কক্ষে টেনে হিঁচড়ে আনতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে উশান এর। পথিমধ্যে মীরা তাকে কাঁদায় ফেলে দিয়ে নাকানি-চুবানি খাইয়েছে। উশান কোনোমতে কাঁদা থেকে উঠে মীরাকে ধরে কক্ষে প্রবেশ করতে নিলে মীরা তার চুল টানতে টানতে ভিতরে প্রবেশ করেছে। চুল টানার পর উশানের মাথার একাংশ যন্ত্রণায় কাতর। এতটুকুতেই থামেনি মীরা।
কক্ষে প্রবেশ করার পর মীরা তাকে ধমকে ধমকে কিল – ঘুষি দিয়েছে যে কতগুলো তা বেহিসেব!হাত ধরে কামড় দিয়েছে চার – পাঁচটা। কামড় দেয়ার পূর্বে মীরার কবিতার মতো করে বলেছিলো,
-” উশান তুই পাগল ছাগল।
তোকে দিবো আমি সজোরে কামড়!”
মীরা হুঁশে নেই! অচেতন সে। দিন- দুনিয়ার কোনো ধারণা আপাতত তার মাঝে নেই।এসব ভেবে নিয়ে নিজেকে সর্বোচ্চ শান্ত রাখার চেষ্টা করেছে উশান। তবুও ভুলবশত একবার রাগের বশে হাত উঁচু করে নিয়েছিলো সে মীরাকে থাপ্পড় দেয়ার ছলে। তবে সেটাই তার কাল হয়ে দাঁড়ালো। মীরা ক্ষেপে যায় আরো! রুষ্ট কন্ঠে বলে,
-‘ তুই আমাকে থাপ্পড় দিতে চাস? বেয়াদব ছেলে!তোকে তো আজ আমি মে’রে’ই ফেলবো। ফাজিল! কত বড় সাহস তোর। ‘
মীরা কথা শেষে উশানের গালে টপাটপ চার পাঁচটা থাপ্পড় মে’রে বসে। হতভম্ব উশান! তবুও সে শীতল, শান্ত, মৌন! পরিশেষে মীরা তাকে চিমটি দেয়া শুরু করে। যেই সে ঘুমে ঢুলে পড়ে ঠিক তখনই মীরা তার চুল টান দিয়ে বাহুতে চিমটি দেয়। রাগ দমন করতে উশান জানালার কাছে চলে আসে। মীরা পরবর্তীতে উঠে আর আসেনি বলে স্বস্তি পায় সে। ভাগ্যিস মীরা আর আসেনি। নয়তো এবার ধৈর্যের বাধঁ ভেঙে সে চড় দিয়ে বসতো মেয়েটাকে৷
বর্তমানে! উশান এসে চকিতে বসতেই মীরা এসে ঘেঁষে বসে তার সন্নিকটে। তপ্তশ্বাস ছাড়ে উশান। বিরক্তি নিয়ে বলে,
-‘ আরো কতো জ্বালাবে আমাকে? একটু ঘুমাও না। তোমার অত্যাচারে আমার মাথা ব্যাথা শুরু হয়েছে।’
মীরা আঙুল নাড়িয়ে বাচ্চাদের মতো করে জবাব দিলো,
-‘ ডিফেন্স অফিসার আমার মতো পুচকির হাতে মার খেয়েছে। তারপর আবার তার মাথা ব্যাথা শুরু হয়েছে। ছিহঃ! কাপুরষ! এই তোকে ডিফেন্সে এলাউ করলো কে? বল তো! তাকে গিয়ে আমি গু’লি মেরে আসবো। উল্টোপাল্টা লোককে দেশ রক্ষার দায়িত্ব দেয়। হুহ্! ‘
উশান মীরাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে মীরার চকিতে চলে যায়। সেখানে টান টান হয়ে শুয়ে পড়ে কঠিন গলায় বলল,
-‘ ঘুমাও মীরা। আর একটা কথা তোমার মুখ দিয়ে বের হলে আমি আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবো না। আই উইল বিট ইউ! ‘
উশান পাশ ফিরে ঘুমোনোর চেষ্টা করে। মীরার মুখে তুই-তুকারি শুনতে ভালো লাগছে না তার। ‘ তুমি ‘ বললেও হতো কিন্তু তুই? ছিঃ! শব্দটা এতো উদ্ভট লাগছে কেনো তার নিকট? আশ্চর্য! ভাবনার ঝালে আঁটকে পড়ার সময় উশান উপলব্ধি করে মীরা চকি থেকে উঠে আসছে তার নিকট। নেত্র যুগল খিঁচে বন্ধ করলো সে। নাহ! আর পারবেনা সে এই মেয়ের অত্যাচার সহ্য করতো। এবার জ্বালাতে আসলে ঠাস করে থাপ্পড় মে’রে বসবে।
মীরা বিড়াল পায়ে এগোল। উশানের পাশে বসে আঙুল দিয়ে উশানের পিঠে খোঁচা দিতে থাকলো। আহ্লাদী স্বরে বলল,
-‘ এই, এই ওঠ! আমাকে না ঘুম পাড়িয়ে তুই আগে ঘুমোচ্ছিস কেনো? আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দে।’
উঠে বসলো উশান। তার নেত্রযুগলে আশার আলো। ক্লান্তিমাখা কন্ঠে বলল,
-‘ ঘুম পাড়িয়ে দিলে ঘুমিয়ে পড়বে তো? ‘
-‘ হু। ‘
-‘ আচ্ছা চলো। তুমি ঐ চকিতে ঘুমাও। আমি ঘুম পাড়িয়ে দিবো। ‘
-‘ ও..কে! ‘ একটু টেনে বলল কথাটা মীরা।
উশান বুঝলো! ঘুম এসেছে মীরার। স্বস্তির শ্বাস ফেলে সে মীরার পিছু পিছু চললো। মীরা চকিতে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ে। ইশারায় নির্দেশ দেয় তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। উশান তাই করলো। ক্ষণ বাদে ফিসফিস করে আনমনে বলল,
-‘ আমি তোমার সব কথা এমন অক্ষরে অক্ষরে কেনো পালন করছি মীরা? আমি তো কারো কথা শুনি না। কারো কথা পালন করি না। আমি চলি নিজ মর্জি মতো। কিন্তু আজ? আজ তুমি আমার এতো বছরের অভ্যাস কে কিভাবে এক মূর্হতেই চেইঞ্জ করে দিলে? তোমার ওপর রাগতে পারছি না কেনো আমি? হোয়াই? ‘
মীরা ঘুমিয়ে পড়তেই উশান মীরার চোখের চশমাটা খুলে পাশে রেখে দিয়ে নিজের স্থানে ফিরে আসে। কিছুক্ষণ গভীর ভাবে চিন্তা করার পর সঠিক উত্তর না পেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো সে।
এতক্ষণ ঘুমের নাটক করা মীরা নেত্রযুগল উন্মুক্ত করলো। আলত হেঁসে আঁধারের মাঝে উশানকে পরখ করার চেষ্টা করে। সে হুঁশে ছিলো এতক্ষণ যাবৎ। যা করেছে হুঁশে থেকেই। পানি খাওয়ার জন্য কলস থেকে তরল জাতীয় দ্রব্য গ্লাসে ঢালার পরই সে বেশ বুঝতে পেরেছিলো এটা পানি নয় ‘ ভাং ‘! চট্রগ্রামে না থাকুক কিন্তু কিছু জিনিস সম্পর্কে তার জ্ঞান আছে ভালোই। ভাং গ্লাস থেকে ফেলে দেয়ার লহমায় সে খেয়াল করে উশান আসছে। বুদ্ধি চাপে মস্তিষ্কে। অন্ধকারে গোপনে গ্লাস থেকে ভাং ফেলে দিয়ে তারপর খালি গ্লাসে চুমুক দেয়ার ভঙ্গি করে। উশান আঁধারে হতে সম্মুখে এসে বুঝতে পারে এমন ভাবক যেনো মীরা ভাং খেয়ে ফেলেছে ভুলবশত।
ঘটনাটা ইচ্ছাকৃত ভাবেই করা মীরার। উশানের বিকেলে বলা কথাটা তার মস্তিষ্কে গেঁথে ছিলো নিপুণ ভাবে। লোকটাকে শাস্তি না দিলে চলেই না! একদম অতিরিক্ত শুধু করেছে। মীরাকে কষ্ট দেয়?বেয়াদব লোক! নাকমুখ কুঁচকে মীরা বলল,
-‘ আমাকে এতোদিন যা কষ্ট দিয়েছেন আপনি তা কাঁটায় কাঁটায় আপনাকে আমি ফিরিয়ে দিবো উশান। বিশাল যন্ত্রণা দিবো। দূরে চলে যাবো। আমার গুরুত্বটা আপনাকে বুঝতে হবে। আমি এতো সস্তা নাকি? আমার অনুভূতির কোনো মূল্য নেই?’
হাতের দিকে গহীনে চোখে তাকায় মীরা। আচানক কষ্ট হচ্ছে। নিদারুণ কষ্ট! কামড়, খামচি, চিমটি, কিল – ঘুষি দিয়েও এতোটা কষ্ট হয়নি যতোটা কষ্ট এই মাত্র প্রায় পাচটা থাপ্পড় দিয়ে হয়েছে। থাপ্পড়টা না দিলে হতো না?স্বগোতক্তি করে নিজেকেই ধমক দেয় মীরা। লোকটার প্রাপ্য ছিলো এটাই। এভাবে এখন অনুশোচনা করার মানেই হয়না। পাশ ফিরে মীরা। মেঘের আড়াল হতে বেড়িয়ে এসেছে চাঁদ। চাঁদের স্বচ্ছ আলোয় উশানের মুখোশ্রী অতীব পবিত্র এবং শুদ্ধ লাগছে। ম্লান হাসে মীরা। নিম্ন সুরে বলে,
-‘ আপনাকে আমি যতো আঘাত, অবহেলা, বিরক্ত করিনা কেনো উশান! আপনি আজীবন আমার প্রেমিক থাকবেন। আমার না হওয়া প্রেমিক। আপনাকে হয়তো কখনোই ঘৃণা করতে পারবোনা আমি। আমার প্রণয় নগরের শেহজাদা আপনি! শুদ্ধতম পুরুষ আপনিই থাকবেন আমৃত্যু। ‘
চলবে..