#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকা- সাদিয়া মেহরুজ দোলা
| পর্ব-৩১|
তখন সকাল নয়টা ছুঁই ছুঁই! মীরার বাসার নিচে উশান ব্যাস্ত পায়ে পায়চারি করছে৷ তার আপাতত চাওয়া মীরাকে শেষবারের মতো দেখা। আজ তাকে যশোর যেতে হবে। বিকেল পাঁচটায় সে তীব্রর সঙ্গে রওনা দিবে।ট্রেনের টিকিট কাটা শেষ! অস্থির নেত্র বারবার ঘড়িতে সময় দেখছে সে।মীরা আজ এখনো বারান্দায় আসছে না কেনো?মেয়েটা তো ভোর বেলাতেই ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় আসে ফুল গাছে পানি দিতে। কিন্তু আজ?উশান প্রায় তিন ঘন্টা যাবৎ দাঁড়িয়ে মীরার বাসার নিচে। কিন্তু সকাল থেকে মেয়েটার দর্শন পেলো না বিন্দুমাত্র!
পকেট থেকে ফোন বের করে রুহির নাম্বারে কল দেয় উশান। ক্ষীণ বাদে রুহি ফোন রিসিভ করতেই উশান প্রশ্ন ছুড়লো,
-‘ তুমি কি বাসায় রুহি? ‘
অপাশ হতে জবাব আসে ভেঙে ভেঙে,
-‘ না ভাইয়া৷ আমি মায়ানকে নিয়ে বাহিরে এসেছি। আমার খালামনির বাসায়। কেনো? ‘
-‘ মীরাও কি তোমাদের সাথে? ‘
-‘ নাহ। ও তো বাসায়। ঘুমোচ্ছে! সকালবেলা আঙ্কেল ডাকলো কতক্ষণ, আমি আসার সময় ডেকে এলাম। উঠলো না! মীরা বাসায় একা।আঙ্কেল ঢাকা গিয়েছে। ‘
-‘ ওহ্! আমার মীরার সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার ছিলো তাই তোমাকে ফোন দিয়েছি। ‘
-‘ আপনি বাসায় যান ভাইয়া। বাসায় বুয়া আছে। আর মীরাও এতক্ষণে ঘুম থেকে উঠে গেছে হয়তো।’
উশান ফোন কাটার পূর্ব মূর্হতে ছোট্ট করে জবাব দিলো,
-‘ আচ্ছা দেখছি! ‘
উশান দ্রুত পায়ে ওপরে উঠে এলো। তার হটাৎ করেই ভীষণ অস্থির, অস্থির লাগছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ললাটে নোনা ঘামের উৎপত্তি ঘটেছে বিন্দু বিন্দু পরিমাণে। দ্রুত পদে দশ তলায় উঠে এসে কলিং বেলে চাপ দিলো কয়েকবার করে।কিয়ংদশ বাদে দরজা খুললো অল্পবয়সী এক নারী।উশান চেনে তাকে। মীরাদের বাসায় কাজ করে তিনি।নাম রুবা! উশানকে দেখে সে স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল,
-‘ ভাইজান আপনি আইছেন? আল্লাহ রহম করছে! মীরা আফায় তো দরজাই খুলতেছে না রুমের।আমি এই ঘর খোলা রাইখা অন্য জায়গায় কামেও যাইতে পারতেছি না। আপনি একটু বহেন ঘরে আইয়া ভাই, আমি কামে যামু! ‘
উশান চিন্তিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
-‘ মীরা এখনো রুমের দরজা খোলেনি? ‘
-‘ না ভাইজান। আপায় মনেহয় ঘুমায়। ‘
রুবা চলে যায়। উশান ফ্লাটে প্রবেশ করে তড়িঘড়ি করে দরজা আঁটকে ছুটলো মীরার রুমের দিকটায়। দরজায় কড়াঘাত করে মীরার নাম ধরে ডাকলো সে কয়েকবার। অপাশ হতে সাড়া এলো না। অস্থিরতা ক্রমাগত বেড়েই চললো তার। সিদ্ধান্ত নিলো দরজা কোনো ভাবে খুলতে হবেই! খুঁজে খুঁজে ফাইলের উপরিভাগ ছোট্ট টুকরো করে আনলো উশান।নবের ভিতর প্রবেশ করিয়ে মোচড় দিতেই লক খুলে গেলো দরজার। ত্রস্ত পায়ে ভেতরে প্রবেশ করে আশেপাশে দেখলো। শেষে নজরে এলো বাথরুমে খোলা দরজা, সম্পূর্ণ খোলা নয়। শুধুমাত্র কিঞ্চিৎ ফাঁক! উশান সেদিকে এগোল। হন্তদন্ত হয়ে বলল,
-‘ মীরা? মীরা তুমি কি ভেতরে? ‘
প্রতিত্তুর আসলো না। ছটফট করলো উশান।কিছু তো একটা হয়েছে নিশ্চিত। কিন্তু এভাবে বাথরুমে প্রবেশ করবে? মেয়েটা কি অবস্থায় আছে কে জানে! বিছানার ওপর থেকে চাদর টেনে সহসা ভিতরে প্রবেশ করলো উশান। অনুমান স্বরূপ হেঁটে মীরাকে চাদর দ্বারা আবৃত করে চোখ খুললো। তৎক্ষনাৎ তার চক্ষু জোড়া স্তব্ধ! মীরার ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুখোশ্রী সাদা হয়ে আসছে। নীলচে ঠোঁট।পোশাক সিক্ত হয়ে চুপসে! সিক্ত দেহ তার মাত্রাতিরিক্ত শীতল। উশানের শ্বাস রুখে আসলো। স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় মীরার দেহ একটু বেশিই ঠান্ডা হয়ে রয়েছে। মেয়েটা আছে তো বেঁচে? মীরার পালস পরীক্ষা করে উশান। নিম্ন কন্ঠে শুধালো,
-‘ এমনটা কেনো হলো মীরা? ‘
__
-‘ উজান রেজওয়ান! রাইট? ‘
রিনরিনে মিষ্টি একটা কন্ঠ! উজানের ধ্যান কাড়লো কঠোর ভাবে। গুরুত্বপূর্ণ আলাপ ফেলে সে দৃষ্টিপাত ফেললো সম্মুখে। বয়স ১৮ কি ১৯ হবে। অতিরিক্ত পরিমাণে ফর্সা, ভীষণ সুন্দর দেখতে এক মানবী তার সামনে দাঁড়িয়ে৷ উজান এগোতে নিলেই সে চটপট পায়ে এগিয়ে আসলো। মৃদু কন্ঠে বলল,
-‘ আমি সিয়া! আমাকে মীরা আপু পাঠিয়েছিলো। ‘
উজান ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতে তাকালো। অন্তঃকরণে ভাবলো কিছু।অতঃপর কাঙ্ক্ষিত বার্তা সৃতির পর্দায় আসার পর সে ম্লান হেঁসে বলল,
-‘ অহ হ্যা। বসুন প্লিজ! মীরা আমাকে বলেছিলো আপনার কথা পরশুদিন ফোন করে। তো, বলুন আপনার কি হেল্প করতে পারি? ‘
সিয়া উজানের পাশে বসলো। উজান তার হাতের ইশারায় উপস্থিত দু’জন পুলিশ অফিসারকে চলে যেতে আদেশ দিতেই তারা বিদায় জানিয়ে প্রস্থান করে সেখান হতে৷ কাঁধে বহমান ব্যাগটা কোলে নিয়ে সেখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজ বের করলো সে। পরিশেষে উজানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘ আমার ইউনিভার্সিটির থেকে কিছু দূরে একটা কলেজ আছে। গার্লস কলেজ! ওখানকার পরিবেশ টা অতোটা উন্নত না বলতে পারেন। সেখানে প্রায় কয়েকটা ছেলে দাঁড়িয়ে কলেজের মেয়েদের উত্যক্ত করে। দেখা যায় মাঝেমধ্যে খারাপ ভাবে স্পর্শও করে ফেলে। ছেলেগুলোর দাপট আছে সেখানকার এলাকায়। বলতে গেলে ওরা কুখ্যাত সন্ত্রাসী দলের অন্তর্ভুক্ত। যার কারণে ভয়ে কেও ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগও করতে পারেনা। আমি ঐ কলেজের একটা মেয়েকে পড়াই। ও আমাকে আজ বলল! এলাকাটা নিম্নতর তাই কেও সাহস পাচ্ছে না তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলার। তাই আমিই চাচ্ছি ওদের বিরুদ্ধে স্টেপ নিতে। যথেষ্ট প্রমাণ আছে। এইযে! কাগজগুলো দেখুন। ‘
উজান হাত বাড়িয়ে কাগজ গুলো হাতে নিলো।তার দৃষ্টিপাত এখন সম্পূর্ণ কাগজ গুচ্ছের মাঝে৷ প্রতি পাল্টা উল্টে উল্টে দেখা শেষে সে মাথা তুলে মিষ্টি হেঁসে বলল,
-‘ আপনার কাজ বেশ প্রশংসনীয় মিস.সিয়া৷ এই ইনফরমেশন টুকু প্রদান করার জন্য থ্যাংক্স! ‘
-‘ ধন্যবাদ দিবেন না স্যার। এটা আমার দায়িত্ব ছিলো। কোনো হেল্প লাগলে বলবেন।’
ইশারায় সায় জানিয়ে উজান আরেকবার পূর্ণ দৃষ্টি ফেলে কাগজের প্রতি। সিয়া তীক্ষ্ণ চাহনি নিক্ষেপ করলো সম্মুখে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে উজানের মুখোশ্রীতে কিছু খোঁজার প্রয়াস চালালো। শেষে কৌতূহলী কন্ঠে বলল,
-‘ আপনার গায়ের রঙটা কিন্তু খুব সুন্দর।’
উজান অপ্রতিভ দৃষ্টিতে তাকালো। হটাৎ নিজের সম্পর্কে এমন মন্তব্য পেয়ে একটু ভড়কে গিয়েছে। সিয়া নিজেও একটু লজ্জা পেলো। হুট করে এমন মতবাদ পেশ করার মানে আছে? সে কি করলো এটা!
-‘ উপহাস করছেন মিস? আমার গায়ের রঙটা কিন্তু সকলের অপছন্দের তালিকায়। ‘
সিয়া নড়েচড়ে বসলো উজানের প্রতিত্তুর শ্রবণ করার পর। চটপট কন্ঠে বলল,
-‘ অবশ্যই না। কালো একটা সুন্দর রঙ। আমার পছন্দের খুব। আর আমার কাছে মনে হয়কালো ব্যাক্তিরা পৃথিবীর সবথেকে সুন্দরতম ব্যাক্তি কারণ তাদের চেহারার আল্লাহ তায়ালা বিশেষ মায়ার প্রলেপ দিয়ে তৈরি করেছে। ‘
উজান আর কোনো কথা বলল না। সিয়াও নিশ্চুপ। সিয়ার উত্তরে মুগ্ধ হলেও কিছু বলার মতো পেলো না বলে উজান মৌন রইল। এদিকে সিয়ার অবস্থা বেহাল! সে ধরেই নিলো লোকটা হয়তো তার কথায় কষ্ট পেয়েছে তাই আর কথা বলছে না। ফুপিয়ে উঠে চুপ করে রইল সে। উজানের খারাপ লেগেছে! এই ব্যাপারটা তাকে এতো কষ্ট দিচ্ছে কেনো?
____
-‘ ইজ শি অলরাইট ডক্টর? ‘
বিচলিত শোনালো মানবের কন্ঠস্বর। রাহি মীরাকে চেকআপ করা রেখে নত দৃষ্টি ওপরে তুলে জবাব দিলো,
-‘ উম..হু! বলা যায়। কিন্তু আগামী কয়েকদিন ওনাকে বেড রেষ্টে থাকতে হবে স্যার। একেই তো কয়েকদিন আগে এতো বড় ধকল পার করলো তার ওপর এখন এই অবস্থা। রেষ্ট করলেই ঠিক হয়ে যাবে। শরীরের তাপমাত্রা কমে গিয়েছিলো অনেক তাই সেন্সলেস ছিলো। রাতে জ্বর আসতে পারে। ঔষধ লিখে দিচ্ছি ওগুলো খাইয়ে দিবেন তাহলে জ্বর আসার সম্ভাবনা থাকবে না। ‘
স্বস্তির তপ্তশ্বাস ছাড়লো উশান। বুকের ওপর থেকে বিশাল এক পাথর নেমে গিয়েছে। শান্তি লাগছে একটু একটু। রাহি ঔষধ লিখে দিয়ে উশানকে কিছু নির্দেশনা সম্পর্কে ধারণা এবং যথার্থ ব্যাখা দিয়ে চলে যায়। হাতের প্রেসক্রিপশন সাময়িক সময়ের জন্য পাশে ফেলে উশান এগোয় মীরার নিকটবর্তী। রুহিকে ফোন দিয়েছে সে। রুহি আসলেই ঔষধ আনতে যাবে।
মীরার বিছানার পাশে লাগোয়া সোফা। উশান সোফায় গিয়ে বসলো। হাত বাড়িয়ে দিয়ে মীরার মুখে পড়ে থাকা চুলগুলো নরম হাতে কানের পিঠে গুঁজে দিলো। মীরা তখন কাঁপছে। ভয়ংকর কাঁপুনি দিচ্ছে তার সর্বাঙ্গ। দুইটা ব্লাঙ্কেট দিয়েও কাঁপুনি থামানো যায়নি তার। রাহি বলেছে, এটা স্বাভাবিক! আপাতত এই কাঁপুনি মানব দেহের উষ্ণতার মাধ্যমে থামানো প্রয়োজন ছিলো কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মীরা অবিবাহিত। তাই এই উপায় আপাতত বিফলে গেছে! মীরা কাঁপা অবস্থায় কিছু বিড়বিড় করে বলছিলো। কৌতূহল বশত উশান কান পাতে শ্রবণ করার স্বার্থে মেয়েটা কি বলছে!
মীরার ওষ্ঠাধর নিকট মুখ এগোতেই মীরা পাশ ফিরে সজোরে এক থাপ্পড় মারলো। বিকট এক শব্দ হয়ে আবারও নীরবতা কক্ষের মাঝে। উশান তখন স্তব্ধ! মীরা ঘুমে বিভোর। উশানের বুঝতে বেগ পেতে হয়নি মীরা মাত্র করা কর্মটি তন্দ্রাঘোরে করেছে। মেয়েটা ঘুমোলে দিন – দুনিয়ার প্রতি খেয়াল থাকে না৷ উশান বিড়বিড়িয়ে বলল,
-‘ কি ডেঞ্জারাস মেয়ে, মাই গড! ঘুমের ঘোরে খু’ন করলেও তো মনেহয় ঘুম ভাঙবে না। ‘
উশান উঠে যেতে নিলে মীরা তার বাহু আঁকড়ে ধরে।বাহুতে নিজের মুখ ঘষে আবারও গভীর ঘুমে মগ্ন হয়। হাত ছাড়িয়ে চলে যেতে নিতেও থেমে যায় সে। সন্তপর্ণে, নিঃশব্দে বিছানায় বসে। গভীর দৃষ্টিপাতে মীরাকে পর্যবেক্ষণ করার একসময় হুট করে মোহে থাকাকালীন আলত করে নিজের ওষ্ঠাধরের স্পর্শ আঁকে মীরার ললাটে। অতঃপর হাত ছাড়িয়ে লম্বা পা ফেলে প্রস্থান করে কক্ষ হতে। এখানে থাকলে নিশ্চিত কোনো অনর্থ ঘটে যাবে তার আশঙ্কায়।
চলবে…
( অগোছালো লাগতে পারে একটু। অনেকটা তাড়াহুড়ো করে লিখেছি।)