#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকা-সাদিয়া মেহরুজ দোলা
#পর্ব-৩৩
___________
-‘ ক্যাম্পে ফিরবেন না? রাত অনেক হচ্ছে। ‘
মীরার মিহি কন্ঠস্বর। উশান জবাব দিলো না। বরঞ্চ আরেকটু নিবিড় ভাবে মীরাকে বক্ষঃস্থলের সাথে চেপে ধরলো। মীরা ধরেই নিলো এবার তার হাড়গোড় সব ভেঙে চুরমার হবে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। তবুও মুখ ফুটে বলল না উশানকে সরে যেতে। উশান তার কাধেঁ মাথা রেখে আঁখিজোড়া বন্ধ করে আছে। ঘন ঘন শ্বাস টেনে তার কেশের সুঘ্রাণ নিচ্ছে। কেশের এক গুচ্ছ উশানের হাতের মুঠোয় বন্দী। খানিকক্ষণ বাদে কন্ঠের খাদ নামিয়ে উশান প্রশ্ন করলো,
-‘ কি শ্যাম্পু ইউজ করো চুলে? আমিও এই শ্যাম্পু ইউজ করবো। তাহলে যখন তোমাকে মিস করবো তখন নিজের মাথায় চুল কেটে ঘ্রাণ নিয়ে এটলিষ্ট একটু হলেও অস্থিরতা কমবে। ‘
মীরা গলায় শব্দ কর হাসলো। নম্র হাতে উশানের মাথায় হাত দিয়ে হাস্যরত অবস্থায় বলল,
-‘ আপনার মাথায় চুল আছে যে কাটবেন? ‘
নাক মুখ কুঁচকে নিলো উশান। আসলেই তো! তার মাথায় চুল কোথায় যে কাটবে? তাদের চুল বড় রাখার নিয়ম নেই। একটুখানি চুল বড় হতে নিলেই কেটে ফেলতে হয়৷ কিয়ৎ সময়ের সুখে থাকার প্রক্রিয়াটা বিফলে গেলো ভাবার পর উশান তপ্তশ্বাস ছাড়লো সময় নিয়ে। বক্ষঃস্থলে মিইয়ে থাকা মীরাকে দুই হাতে আগলে ধরলো। ঘন, কাঁধ পর্যন্ত মীরার চুল গুলোতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
-‘ তোমার চুল এতো ঘন কিন্তু ছোট কেনো মীরা? ‘
-‘ কেটে ফেলি। বড় চুল ভালো লাগেনা। ‘
-‘ কিন্তু আমার যে লম্বা চুল পছন্দ। ‘
ভরাট কন্ঠ! মীরার গা শিরশিরিয়ে উঠলো। লোকটার আসক্তি মাখা কন্ঠ এতো চমৎকার কেনো? শ্রবণ করা মাত্রই যেনো হাত – পা হিম হয়ে আসে সম্পূর্ণ।শান্ত বক্ষঃস্থলে উথাল-পাতাল ঝড় বয়ে যায়। মীরা ঘোরে থাকলো কিয়ংদশ। অতঃপর বলল,
-‘ এখন থেকে বড় হলে আর কাটবো না। ‘
জবাব আসলো না কোনো। মীরা হাত ঘড়িতে সময় দেখলো। তৎক্ষনাৎ আঁতকে উঠলো সে। ছিটঁকে সরে গেলো উষ্ণ আলিঙ্গন হতে। উশান একটু চমকে যায়! বলে,
-‘ কি হয়েছে? ‘
মীরা ঘড়ি দেখিয়ে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
-‘ দেখুন! ১২ টা বেজে গিয়েছে। ঐ বিল্ডিংটায় আগে থেকেই বলা ছিলো ১২ টার পর আর প্রবেশ করা যাবেনা ভিতরে। ‘
স্থির ওষ্ঠাধর প্রসারিত হয়ে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। মীরা ভ্র কুঁচকে নেয়! লোকটা হাসছে!কেনো? আশ্চর্য!
-‘ আপনি হাসছেন কেনো? এতো রাত! কোথায় যাবো আমি? ‘
উশান অধর যুগল কোণে হাসি বজায় রেখে ক্ষীণ সুরে বলল,
-‘ কেনো আমি আছিনা? আমার সাথে যাবে। ‘
-‘ কি? পাগল! আপনার ক্যাম্পে গিয়ে আমি কি করবো? আর ওখানে আমাকে ঢুকতে দিবে? ‘
-‘ বোকা মেয়ে! ক্যাম্পে কেনো যাবো?’
মীরা ললাটে ভাজ ফেলে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় সে। তারই ভুল! যদি একটু খেয়াল রাখতো। তখন বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে উশানকে জরীয়ে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলো। তাদের দু’জনের এতোটা সময় কেটেছে বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে। সময়ের পরিধি সম্পর্কে খেয়ালই ছিলো না। এক অদৃশ্য, সম্মোহনী মোহে আঁটকে ছিলো দু’জন।
মীরা জিজ্ঞেস করলো,
-‘ তবে কোথায়া যাবো? আর আপনি না ট্রেনিং দিতে এসেছেন। এভাবে ক্যাম্পে না ফিরলে সমস্যা হবে না। ‘
উশান উঠে দাঁড়ালো। পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে উত্তর দিলো,
-‘ ট্রেনিং দিতে এসেছি। নিতে না মেয়ে! আমি ক্যাম্প থেকে বের হতে পারবো। নিয়ম আছে। বসো তুমি। আজ রাতের জন্য থাকার ব্যাবস্থা করছি। ‘
পূর্ণিমার তখন দ্বিতীয় দিন৷ বেঞ্চিতে পা গুটিয়ে বসেছিলো মীরা।এতক্ষণ পর পা দু’টো ভূমি স্পর্শ করালো। চিনচিন করছে।পুরো একসময়, একাধারে বসে থাকার কারণে পা দু’টো অবশ হয়ে এসেছে। উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটাহাটিঁ করলো। অদূরে দেখলো উশান আসছে। সে মীরার নিকটে পৌঁছে বলল,
-‘ চলো। ‘
মীরা পাল্টা প্রশ্ন করে চটপট,
-‘ কোথায় যাবো?’
-‘ বেশি প্রশ্ন করো মেয়ে। চলো আগে! গেলেই দেখতে পাবে। ‘
বাইকে করে আধাঘন্টার মাঝখানে বিলাসবহুল এক বাংলোর সামনে এসে থামে বাইক। মীরা তার নেত্র যুগল বড়সড় করে দেখছে সম্মুখ। দর্শন করা শেষে কৌতূহলী কন্ঠে বলল,
-‘ এটা কার বাংলো? এখানে কেনো এসেছি? ‘
উশান মাথার হেলমেট খুলতে খুলতে প্রতিত্তুর করলো,
-‘ আমার ফ্রেন্ডের। আজ রাতটা এখানে থাকবো। ‘
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেলে প্রেস করলো না উশান।দরজার পাশে থাকা টাচস্ক্রীনে ফটাফট কয়েকটা সংখ্যা বসিয়ে দিলো। অতঃপর ক্যাচ করে একটা শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো। স্ক্রিনে লিখা উঠলো,
‘ Password Matched ‘ দরজা খুলে যাওয়ার পর মীরার হাত নম্র ভাবে ধরে উশান অন্তর্ভাগে প্রবেশ করলো। চারিপাশে আলিশান ভাব! দেখতে কিছুটা রাজ প্রাসাদের মতো লাগল মীরার নিকট। কিয়ৎ দূর যেতেই একটা পাঁচ বছর বয়সী বাচ্চা ছুটে এসে উশানের পা জরিয়ে ধরে চেঁচিয়ে বলল,
-‘ চাচ্চু ইজ ব্যাক? ‘
আলগোছে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে তার গালে চুমু খায় উশান। হৃষ্টচিত্তে জবাব দেয়,
-‘ ইয়েস! হাউ আর ইউ টুইঙ্কেল? মিস মি? ‘
-‘ মিস’ড ইউ লট চাচু। ‘
-‘ হোয়ার ইজ ইউর পাপা টুইঙ্কেল? ‘
-‘ ড্যাড ইন দ্যা ওয়াশরুম। হি ইজ কামিং! ‘
টুইঙ্কেল লাফিয়ে উশানের কোল থেকে নামলো। মীরার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ গোল গোল করে ওকে দেখলো কিছুক্ষণ। অতঃপর জিজ্ঞেস করলো,
-‘ হু ইজ সি? ইউর ওয়াইফ? ‘
-‘ উডবি ওয়াইফ। প্রিন্সেস! ‘
-‘ ওয়াও। সি ইজ টু মাচ কিউট চাচু। ‘
নিরুত্তর, নির্বাক রূপে উশান আর টুইঙ্কেলের কথোপকথন শ্রবণ করছে মীরা। এতটুকু বাচ্চা মেয়ে! সে কিনা ওয়াইফ মানে বোঝে?আর কত সুন্দর, স্পষ্টত ইংরেজিতে কথা বলছে টুইঙ্কেল! মীরা ধরে নিলো টুইঙ্কেল নির্ঘাত বাংলাদেশী নয়। সে তাকালো উশানের পানে। তৎক্ষনাৎ উশান কন্ঠের খাদ নামিয়ে তাকে বলল,
-‘ টুইঙ্কেল বাংলাদেশে জন্মায়নি। আমার ফ্রেন্ড,ইফরাদ ও এতোদিন আমেরিকায় ছিলো। কয়েকমাস হলো বাংলাদেশে ফিরেছে। ‘
মীরা উশানের কথা শ্রবণ শেষে টুইঙ্কেলকে কোলে তুললো।মিষ্টি হেঁসে প্রশ্ন করলো,
-‘ হোয়াট ইজ ইউর নেম কিউটি? ‘
-‘ টুইঙ্কেল! টুইঙ্কেল ইফরাদ। এন্ড ইউর? ‘
-‘ মীরা। তাঈরাত ইমরোজ মীরা। ‘
টুইঙ্কেল মীরার গালে ফটাফট দুটো চুমু খেলো।বলল,
-‘ সুইট নেম। ‘
সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো সুদর্শন এক পুরুষ। মীরা ধারণা করলো সে টুইঙ্কেলের বাবা এবং উশানের সেই কাঙ্খিত বন্ধু। লোকটা নেমে এসে উশানকে জরিয়ে ধরলো। শেষে মুচকি হেঁসে বলল,
-‘ ফাইনালি আসলি তুই আমার বাসায়? থ্যাংক্স টু ভাবী হাহ্?তারজন্যই এই প্রথমবার আমার বাসায় তোর আসা। ‘
লোকটি তাকালো এবার মীরার পানে। বলল,
-‘ আসসালামু আলাইকুম আপু। আমি ইফরাদ! ‘
মীরা হেঁসে সালামের জবাব নিলো। নিজের নাম বলে আবারও চুপ সে। ইফরাদ – উশান কথা বলতে বলতে সামনে এগোল। মীরা যায় তাদের পিছু পিছু। টুইঙ্কেল তখন মীরার কোলে। মীরার চুল নিয়ে কিছু একটা করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। মীরা গভীর চোখে একবার তা দেখে বলে উঠলো,
-‘ হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট টু ডু উইথ মাই হেয়ার? ‘
-‘ উ..হু! নাথিং ‘
.
টুইঙ্কেলের সাথে মীরার সখ্যতা গড়ে উঠলো যেনো অল্প খানেক সময়ের মধ্যেই। রাতের খাবার মীরার হাতে খেয়ে টুইঙ্কেল অনাবশ্যক জেদ ধরে সে মীরার সঙ্গে ঘুমোবে। ইফরাদ মেয়েকে বুঝিয়ে, শুনিয়ে, ধমকে – ধামকেও নিজের সাথে নিতে পারেনি। শেষে সে হাল ছেড়ে বলল,
-‘ ভাবি? আপনার কি সমস্যা হবে টুইঙ্কেল আপনার সাথে ঘুমোলে? সমস্যা না হলে আজ রাতের জন্য নাহয় ও আপনার সাথে ঘুমোক। মেয়েটা আজ একটু বেশিই জেদ করছে। এর আগে কখনো এমন করেনি। আজ কি হয়েছে বুঝতে পারছি না। ‘
মীরা মৃদু কন্ঠে আশ্বাস দিয়ে বলল,
-‘ নাহ ভাইয়া। কিসের সমস্যা? আপনি গিয়ে নাহয় নিজের কাজ করুন। টুইঙ্কেল আজ আমার সাথেই থাক। ‘
ইফরাদ উশানের সাথে কথা বলতে বলতে বাহিরে চলে যায়। তারা রুম থেকে চলে যেতেই মীরা ব্যাস্ত হয় টুইঙ্কেল কে ঘুম পাড়াতে৷ মেয়েটাকে ঘুম পাড়াতে তেমন একটা বেগ পেতে হয়না তার। ক্ষীণ সময়ের মাঝেই মীরাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জরিয়ে ধরে টুইঙ্কেল ঘুমে বিভোর। কিয়ৎক্ষণ পর মীরা টুইঙ্কেল এর পাশ থেকে সন্তপর্ণে উঠে দাঁড়িয়ে বারান্দায় গিয়ে বসলো। ফোন বের করে রুহিকে নিজের অবস্থান বলল। নাহলে নিশ্চিত মেয়েটা চিন্তায় পাগল হয়ে যাবে! কথা বলা শেষে কল কেটে উঠতে নিবে তৎক্ষনাৎ কোথা থেকে উশান এসে তার কোলে এসে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো। মীরা একটু ভড়কায়। নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্ন করে,
-‘ আপনি এখানে? ‘
উশান নির্লিপ্ত! সে পকেট হাতিয়ে একটা কাগজ আর কলম বের করে মীরার সামনে থাকা সেন্টার টেবিলের ওপর রাখলো। অতঃপর বলল,
-‘ কাগজটায় দ্রুত সাইন করো তো মীরা। ভাজ খুলবে না। ‘
মীরা ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান গলায় বলল,
-‘ কিসের কাগজ এটা? আমার সাইন-ই বা কেনো দরকার এতে? ‘
-‘ দরকার আছে বলেই তো সাইন করতে বলছি।দ্রুত করো। আমার তাড়া আছে। ‘
-‘ ভাজ খুলে একটু পড়ে দেখি? ‘
চট করে উঠে বসলো উশান। মুখোশ্রীর অভিব্যাক্তী বদলালো ক্ষীণ। চেহারায় এলো থমথমে ভাব৷গম্ভীর গলায় ফের বলল,
-‘ তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো না মেয়ে? ওকে দ্যান ফাইন! চলে যাই আমি? সাইন করার দরকার নেই। ‘
কাগজ তুলে উশান উঠতে নিলে মীরা ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বলল,
-‘ আরে আশ্চর্য! এভাবে বলছেন কেনো? দিন আমি করে দিচ্ছি সিগনেচার। ‘
কলম হাতে ধীরে সুস্থে মীরা সিগনেচার করলো।অতঃপর কাগজ, কলম ফিরিয়ে দিলো উশানের কাছে। উশান বসলো। মীরার দিকে একটু নিবিড় হয়ে। কয়েকক্ষণ নীরবতায় কেটে যাওয়ার পর হুট করে উশান মীরার গাল ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো৷ আচানক মীরার খয়েরী বর্ণের অধর জোড়া আঁকড়ে নিলো নিজ ওষ্ঠাধরের মাঝে। মীরা থমকালো! ভীষণ চমকালো! হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইল উশানের বদ্ধ নেত্র যুগলের পানে।
চলবে…