#হৃদয়েশ্বরী – ৪৭
সাদিয়া মেহরুজ দোলা
অস্থিতিশীল পুরো দেশ। সবার মাঝে যেন অদৃশ্য এক টান টান উত্তেজনা বহাল। গত কয়েক মাসে আকাশপথে হাম’লা হয়েছে। হা’মলার শিকার কিছু গ্রামাঞ্চল। প্রতেকটা অনাকাঙ্ক্ষিত হা’মলা গুলো করা হচ্ছে হেলিকপ্টার দিয়ে। প্রথম হেলিকপ্টার জব্দ না করা গেলেও পরপর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় নং হেলিকপ্টার জব্দ করা হয়েছে। হেলিকপ্টার দু’টো হচ্ছে রবিনসন আর -২২। যার দাম কমপক্ষে দুই কোটি টাকা।এতো টাকা এই সন্ত্রা’সীরা কোথা থেকে জোগাড় করলো তা ভেবে পাচ্ছেনা কেও। এয়ার ফোর্স হেলিকপ্টার জব্দের পাশাপাশি হেলিকপ্টারে থাকা দু’জন লোক পাইলট এবং উপরস্থ হা’মলা করা লোক দু’টোকে আটক করেছে। তবে ভীষণ আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে সেই দু’জনেরই জিহ্বা কে’টে ফেলা হয়েছে। পা দু’টোও জখম। কারো সাহায্য ছাড়া কখনোই তারা চলাচল করতে পারবে না। হাত দু’টোর অবস্থাও নাজেহাল প্রায়। তবুও কি করে এতোটা দক্ষ ভাবে একটা হেলিকপ্টার চালাল পাইলট তা বোঝা দুষ্কর। তাদের দু’জন তার কয়েক মাস পর হামলার দু’জন সহ মোট চারজনকে রিমান্ডে নেয়া হয়। কঠোর হতে কঠোর পাষণ্ডিক অ’ত্যা’চার করেও সেই চারজনের মুখ থেকে একটা শব্দও বের করা যায়নি। শব্দ বের করলেই বা কি? এদের যে জিহ্বাই নেই। হাত দিয়ে কিছু লিখবে?তাও করেনি তারা। পাষণ্ডিক নির্যাতন বন্ধ করে হতাশ হয়ে যখন পুলিশ কর্মকর্তারা বেড়িয়ে আসল জেল থেকে ঠিক তখনি বিস্ফোরণ ঘটে! সেই চার জনকে যেই কক্ষটায় আঁটকে রাখা হয়েছে সেই কক্ষটায়। ধারণা করা হয়, তাদের শরীরের ভেতর বো’ম স্যাট করা ছিলো। ডে’ডবডি হতে তাই বোঝা যায়। কি নিষ্ঠুর, নিখুঁত বুদ্ধি! এগুলো কার কাজ? তা জানতে উৎসুক তখন দেশের এক একটি মানুষ।
ব্যাস্ত করিডর ধরে হাঁটছে উশান।তার চারপাশ দিয়ে যাওয়া জুনিয়র কয়েকজন যাওয়ার পথে সম্মান প্রদর্শন করছিল। পিয়ন কয়েকজন সালাম দিয়ে দিয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে আর উশানের পিছে পিছে হাঁটছে। সালামের উত্তর নেয়া হলোনা উশানের। সে আপনমনে অত্যান্ত মনোযোগ সহিত ভাবছে কিছু। ডান হাতে তার ল্যাপটপ। লম্বা লম্বা পা ফেলে কায়দা করে হাঁটছে। পরিশেষে কাঙ্ক্ষিত কামড়ার সামনে এসে সে কিয়ৎ থামল। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। তাকে প্রবেশ করতে দেখে দুই চারজন দাঁড়াল। বাকি কয়েকজন গম্ভীরমুখো হয়ে বসে। উশান তাদের নিকট এগোল। সম্মান প্রদর্শন করে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত স্থানে গিয়ে দাঁড়াল স্থির হয়ে। উশান প্রজেক্টটরের সামনে দাঁড়ানো। সামনে বসা একজন আদেশের সুরে তাকে বলল,
-” এক্সপ্লেইন ইউর প্ল্যান। ”
-” ইয়েস স্যার। ”
উশান ল্যাপটপ কি – বোর্ডে কিছুক্ষণ টাইপিং করল। প্রজেক্টরে ফুটিয়ে তুলল সে একটা চার্ট। শেষে ভারী কন্ঠে বলা শুরু করল,
-” স্যার আমি ১৯৯৯ সালের ঘটনাটা একটু বর্ণণা করে বলি একবার। ১৯৯৯ সালে মোট পাঁচটি হামলা হয়েছিল স্যার। প্রথম হামলা সংঘটিত হওয়ার তিন মাস পর হয় দ্বিতীয় হা’মলা, দ্বিতীয় হামলার চার মাস পর সংঘটিত হয় চতুর্থ হা’মলা, চতুর্থ হা’মলার পাঁচ মাস পর হয় পঞ্চম এটার্ক! একটু খেয়াল করে দেখলেই দেখবেন স্যার ওদের এর্টাক করে একটা বিন্যস্ত সংখ্যা মিলিয়ে। তিন, চার, পাঁচ! এবং ওরা এটাক করা জেলা ভিত্তিক। একেকটা জেলার ফসলী জমিতে নয়তো গ্রামের ঘরবাড়িতে। যেখানে মানুষ জনের আনাগোনা কম সেখানে। চার্টে দেখুন স্যার! ওরা আসলে মানুষ মারতে চাইছে না। চাচ্ছে অন্য কিছু। দেশে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে চাচ্ছে। ”
লোকটি এবার নড়েচড়ে বসল। স্ক্রিনে দৃষ্টি ফেলল। সে উশানের সিনিয়র বেশ। নাম ইনান শেখ! ইনান শেখ জলদগম্ভীর কন্ঠে শুধাল,
-” হুম দেখলাম। ”
-” স্যার এবার এখনকার সন্ত্রাসী হা’মলার ঘটনাটা খুলে বলা যাক! আগেরবার এই সন্ত্রাসীরা হা’মলা করেছিল ভূ-পথে কিন্তু এবার করছে আকাশপথে। ”
-” যার কারণবশতই এবার এই সন্ত্রাসীদের হ্যান্ডেল করার দায়িত্বটা এয়ার ফোর্সের ওপর এসে পড়েছে উশান। আগেরবার পুলিশ, র্্যাব হ্যান্ডেল করেছিল ব্যাপারটা কিন্তু ফলাফল খুব একটা সুপ্রসন্ন ছিল না। ”
-” ইয়েস স্যার। এবার সন্ত্রাসীরা হামলা করছে অন্য ভাবে। আগেরবার যেমন ওদের হা’মলা করার চার্ট ছিল তিন, চার, পাঁচ! এবার ঠিক তার উল্টোটা। এই বার ওদের প্রথম হা’মলার ওপর দ্বিতীয় হা’মলাটা হয় ছয় মাস পর এবং দ্বিতীয় হা’মলার পর তৃতীয় হামলাটা হয় পাঁচ মাস পর। তাহলে স্যার খুব ইজিলি বলা যায় তৃতীয় হা’মলাটা ওরা করবে ঠিক চার মাস পর। অলরেডি তিনটে হা’মলার তিন মাস চলে গিয়েছে। আমাদের হাতে আছে এক মাস। এন্ড মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট টপিক ইজ পরবর্তী হা’মলাটা ঠিক কোথায় হবে? দ্যান আই এক্সপ্লেইন ইট! প্রথম এটাক হয়েছে সিলেটে। দ্বিতীয় হামলা হয়েছে সিলেট এর পাশ্ববর্তী জেলা মৌলভীবাজার, এবং তৃতীয় হা’মলা হয়েছে মৌলভীবাজার জেলার পাশ্ববর্তী জেলা হবিগঞ্জ! এন্ড ফাইনাল চতুর্থ এটাক টা আসবে ব্রহ্মবাড়িয়াতে। ম্যাপে খেয়াল করলেই দেখা যায় ওরা আসলে এগোচ্ছে ইন্ডিয়ার পাশ্ববর্তী যেই জেলা সেখান থেকে। এটাক টা হতে পারে স্যার সেখানকার মানুষজন কম এমন এক স্থানে। সেই স্থানটা হয়ত টার্গেট করতে পেরেছি। আমি আমার টিম নিয়ে সেখানে আজই যাচ্ছি! ওখানকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। ১ মাস হাতে আছে। ”
কামড়ায় উপস্থিত সকলে মুগ্ধ হলো উশানের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পূর্ণতায়। তবে তারা প্রতিক্রিয়া দেখাল না কোনো। ইনান শেখ উশানের উপস্থাপনা এবং উপস্থিত বুদ্ধিমত্তায় খুশি হলেও সে কিছু তেমন কিছু বলল না। মিনিটখানেক বাদে জিজ্ঞেস করল,
-” এটাক টা নাহয় আমরা আটকাতে পারলাম উশান কিন্তু হোয়াট এবাউট দ্যা মাফিয়া টিম? ওরা বহুদিন যাবৎ দেশের মাটিতে ঘুরে দেশেরই ক্ষতি করছে। ওদেরকে ধরাটা জরুরি। ”
-” এই ব্যাপারটা আমায় ম্যানেজ করতে দিন স্যার। আই উইল হ্যান্ডেল ইট! আগে এই এটার্ক টা সফল ভাবে আঁটকে নেই। তারপর বাকি কাজটাও সহজ হবে। ওদের আস্তানা, ওদের পুরো টিম ধরতে খুব একটা কষ্ট করতে হবেনা। ”
-” আই বিলিভ ইউ ম্যান! তারই পরিপ্রেক্ষিতে এই দায়িত্বটা তোমার আরোপ করেছি। বাই দা ওয়ে তোমার টিমের অবস্থা কি? সবাই রেডি? ”
-” ইয়েস স্যার! ”
-” তোমার লাগবে কিছু?হেলিকপ্টার অর সামথিং?”
-” স্যার আমার হেলিকপ্টার দরকার। বেল- ৪০৭ হলেই চলবে। ত্রিশটা গ্রেনেড, পয়ত্রিশ টা রাইফেল, ১০ টা পিস্তল সাইলেন্সার লাগানো! ওয়া’লথা’র পি’পি’কে ৩১ টা। ”
ইনান ভরাট কন্ঠে জবাব দিল,
-” আজ রাতেই পেয়ে যাবে। ”
____
টুইঙ্কেল বেশ মনোযোগ সহকারে বিরিয়ানি খাচ্ছে। খাচ্ছে বললে ভুল হবে সে আসলে চামচ দিয়ে খাবার নড়াচড়া করছে। চামচের সাহায্যে তার প্লেটে থাকা মাংসের টুকরোগুলো রুহির প্লেটে পাচার করে টুইঙ্কেল স্বস্তির শ্বাস ফেললো। তার গরুর মাংস পছন্দ না।কারণ তার মতানুসারে গরু একটা বিশাল দানবাকৃতির উদ্ভট প্রাণী। উদ্ভট প্রাণীদের মাংস গলাধঃকরণ করতে নেই! সামনের বাটিতে সাজিয়ে রাখা চিকেন ফ্রাই এর অংশবিশেষ থেকে সে একটা চিকেন ফ্রাই তুলে নিল। তারপর সেটাকে কাটা চামচ এর সাহায্যে টুকরো টুকরো করে কেটে খাওয়ায় মনোযোগী হলো।
মায়ান এতক্ষণ আড়চোখেঁ টুইঙ্কেলের কার্যকলাপ দেখছিল। টুইঙ্কেলের করা কর্মটি তার চোখে পাপ! ঘোরতর পাপ বলে মনে হলো। সে তার হাতের চামচ শব্দ করে প্লেটে রেখে কড়া কন্ঠে বলল,
-” এ্যাই ইঁদুর, বাঁদর! এটা কি করলে তুমি? নিজের এঁটো করা খাবার রুহি আপুর প্লেটে দিলে কেন? ”
টুইঙ্কেল চমকে খাওয়া বন্ধ করলো। মাথা তুলে দৃষ্টি ফেললো মায়ানের প্রতি। তার রাগ লাগল! ভীষণ রাগ! মায়ান তাকে ইঁদুর, বাঁদর বলে যখনি ডাকে তখনি তার ইচ্ছে হয় মায়ানকে ধরে মার লাগাতে। কঠিন মার! মায়ান বেশ কয়েকদিন ধরেই টুইঙ্কেল কে এই দু’টো নামে ভূষিত করেছে। তার মূল কারণ এই, টুইঙ্কেল একবার তার হাতে কামড় দিয়ে দাঁতের ছাপ বসিয়ে দিয়েছিল! এই কান্ডের পরিপ্রেক্ষিতে সে টুইঙ্কেল কে ইঁদুর বলে। দ্বিতীয়ত টুইঙ্কেল অনেক ছটফটে। সারাদিন লাফালাফি, ছোটাছুটির মাঝে থাকে তার পরিপ্রেক্ষিতে ‘ বাঁদর ‘ নাম দেয়া।
-” এই পঁচা নামে আমাকে ডাকবেনা। আবার কামড় দিব তাহলে! ”
মায়ান ভেংচি কাটল। বিড়বিড় করে বলল,
-” পারো তো শুধু এটাই। শুধু কামড় আর কামড়। ”
রুহি, মীরা ক্ষীণ দূরে দাঁড়িয়ে। তারা রেস্টুরেন্টে এসেছে আজ। মীরাকে মৌন রূপে দেখে রুহি প্রশ্ন ছুড়লো,
-“মাহদি আঙ্কেল তোর আর উশান ভাইয়ের বিয়ের ব্যাপারে কবে থেকে জানে? ”
মীরা কিয়ৎক্ষণ পর প্রতিত্তুর করল। ধীরেসুস্থে, মোলায়েম কন্ঠে,
-” সেই শুরু থেকেই। আমি যখন জানতে পারলাম তার পরপরই বাবাকে জানিয়েছি। বাবা শুনে রাগ করেনি জানিস? বরং খুব খুশি হয়েছিল। তারপর কয়েকদিন পর উশান ভিডিও কলে বাবাকে সাক্ষী রেখে ধর্মীয় মতে আমাদের বিয়ে হয় আবারও। তুই ছিলিনা তখন!তোর মামার বাসায় যে গেলি? তখন হয়েছে। ”
রুহি ভীষণ মন খারাপ নিয়ে বলল,
-” এইটা ঠিক করোনাই জান। আমারে রাইখা তুমি বিয়া কইরা ফালাইলা। আচ্ছা যাইহোক। আঙ্কেল দেশে ফিরবে কবে? ”
-” মীরা? ”
মাহদির কন্ঠ! মীরা আকাশ’সম চমকে পিছনে তাকাল। মাহদি হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে। বাবাকে দেখে ছুটে গেল মীরা। পরপর ছুটল মায়ান। মীরাকে মাহদি আগে থেকে জড়িয়ে ধরায় মায়ান বাবার পা ধরে ঝুলে আদুরে কন্ঠে বাবাকে ডাকল। টুইঙ্কেল সে দৃশ্য দর্শন করে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
-” আমাকে বাঁদর বলে হুহ্! এখন যে নিজে বাঁদরের মতো ঝুলছে। ”
চলবে~
( রি-চেইক করিনি।)