#শুনলাম_বসন্ত_নাকি_আবার_এসেছে
#লেখিকা_সিনথিয়া_জাহান
#পর্বঃ১২
বিকেলের মনোমুগ্ধকর আলোকরশ্মি ধীরে ধীরে হারিয়ে গিয়ে প্রকৃতিটা মৃদু অন্ধকারের দিকে গমন করছে ৷ এখনও ড্রয়িংরুমে ছোটদের আড্ডা অব্যাহত রয়েছে ৷ নীরের সাথে প্রায় ২ সপ্তাহ পর সবার দেখা হলো ৷ তাই তো শেহনাজ নিজের জমানো সব কথাগুলো উগড়ে বের করছে ৷ সাভাশ একদৃষ্টিতে ফোনের দিকেই তাকিয়ে আছে আর ওর ঠোঁটের কোণে এখনও ক্ষণিক হাসির রেখা নজরে আসছে ৷
তানিয়া কিছুক্ষণ আগেই ওদের সবাইকে স্নেকস দিয়ে গেছে ৷ গল্প করতে করতে ওরা সেগুলোই খাচ্ছে ৷ যদিও সাভাশ কিছুই খাচ্ছে না , ওর নজর ফোনে নিবদ্ধ ৷ একবার সাভাশের দিকে আয়েশার নজর গিয়েছিল অবশ্য কিন্তু কিছু বলেনি ৷ এতো সুন্দর আড্ডা রেখে ওর সাথে তর্ক করার মানেই হয় না ৷
সিনু ওদের কিছু লাগবে কিনা দেখার জন্য আসল ৷ হঠাৎ ছেলের দিকে চোখ যেতেই ওর ভ্রু কুঁচকে গেল ৷ ত্রস্ত পায়ে ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,,,
সাভাশ এ কি অবস্থা করেছো নিজের? এসব কি করছো তুমি?
সাভাশ তাড়াহুড়ো করে ফোনের ক্যামেরা অ্যাপ থেকে বের হলো ৷ হঠাৎ মায়ের আগমনে প্রচন্ড ভয় পেয়েছে বৈকি ৷ নিজেকে সামলে নিয়ে সাভাশ বলল,,,
কি করেছি মাম্মা?
নিজের অবস্থা দেখো ৷ ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে আছো ৷ যাও গিয়ে গোসল করো ৷
সাভাশ স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলল ৷ ও অন্যকিছু ভেবেছিল ৷ অতঃপর অবাক হয়ে বলল,,,
এই সময় গোসল করব? আমার কি মাথা খারাপ?
তোমার কথা তো জানি না কিন্তু তুমি এক্ষুণি গোসল করতে না গেলে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে ৷
মাম্মা মাগরিবের আযান দিয়ে দিবে ৷ আমি নামাজ পড়তে যাব না?
তা তো নিঃসন্দেহে যাবে কিন্তু তার আগে গোসল করো ৷ আযান দেওয়ার আরও কিছু সময় বাকি আছে ৷
সাভাশ কিছু বলার আগেই আয়েশা ইচ্ছাকৃত নাকে হাত দিয়ে বলতে লাগল,,, তাই তো বলি দু*র্গন্ধ কোথা থেকে আসছে! তোর শরীর থেকেই তাহলে দু*র্গন্ধ আসছিল ছিহ! যা গিয়ে গোসল কর ৷
সাভাশ বসা থেকে উঠে গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,,, আমি মাটির তৈরি ৷ আমার শরীর থেকে দু*র্গন্ধ আসবে না তো কি মধু ঝড়বে? ফলমূল বেরোবে? নাকি লতাপাতা গজাবে?
আয়েশা মুখ ভেংচি কেটে বলল,,, বে*দ্দব ছেলে কোথাকার!
ধন্যবাদ ৷
দুই ভাই বোনের ঝ*গড়া লাগলেই সবাই একটা বিনোদন পেয়ে যায় কারন ওদের ঝগ*ড়া দেখলে নতুন নতুন কথা শেখা যায় ৷ সাভাশ সিড়েতে পা রাখতে যাবে এমন সময় নীর বসা থেকে উঠে বলল,,,
আমি তাহলে আজ আছি ৷ দেরি হয়ে যাচ্ছে ৷
সাভাশের কদম থেকে গেল , পিছু ঘুরে গোলগাল মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকল ৷ সিনু তৎক্ষণাৎ বলে উঠল,,,
তুমি যাবে মানে? মাথা ঠিক আছে?
আসলে খালামনি বাবা মাম্মা বাসায় একা আছে ৷
তা তো ওরা তোমার জন্মের আগে একাই ছিল ৷ ভয় নেই তোমার বাবা মাম্মাকে কেউ ধরে নিয়ে যাবে না ৷ নাভিন ভাইয়া থাকতে রাইমার কিছু হবে না আর রাইমা দা ক্যারাটে কুইন থাকতে নাভিন ভাইয়ার কিছু হবে না ৷ আজ তুমি এখানেই থাকবে ৷ বুঝেছো?
সবাই জোর করতে লাগল ৷ সাভাশ শান্ত স্বরে বলে উঠল,,, থেকে যাও নিক্কি ৷
সাভাশের দিকে একপলক তাকিয়ে নীর চোখ সরিয়ে নিল ৷ মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল ৷ সিনু কিচেনে যেতে যেতে হেসে হেসে বলল,,,
এখানেই থাকতে চাচ্ছ না ৷ তাহলে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে কিভাবে থাকবে?
কথাটা শুনে সবাই হেসে উঠল ৷ সাভাশ সিড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠে গেল ৷ তুষার নীরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,,,
এখন থেকে প্রস্তুতি নে নীর ৷ খুব দ্রুত কাজে লাগবে ৷
কথাটা বলে তুষারও তিন তলায় চলে গেল ৷ শেহনাজের মন ভালো হয়ে গিয়েছিল কিন্তু তুষারের হাবভাব দেখে আবারও মুড অফ হয়ে গেল ৷ চকিতে খুটিয়ে খুটিয়ে নীরের দিকে তাকিয়ে থাকল ৷ ফর্সা মুখ, চোখের নিচে কালো কুচকুচে একটা তিল যেটা ওর সৌন্দর্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু ৷ কি অপূর্ব মায়াবী একটা চেহারা ৷
শেহনাজ চোখ সরিয়ে নিল ৷ নীর আয়েশার সাথে দোতলার দিকে পা বাড়াল ৷ শেহনাজ নীরের হাঁটা চলাও পর্যবেক্ষণ করতে লাগল ৷ ওরা বেশ খানিকটা উপরে উঠে গেছে ৷ শেহনাজ বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে অপরিসীম আত্মবিশ্বাসের সাথে হাঁটার জন্য পা বাড়াল ৷ তিন কদম ফেলতেই ধড়াম করে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল ৷
কিছু পড়ার আওয়াজে আয়েশা আর নীর চকিতে পিছু ঘুরে তাকাল ৷ সেই পড়ে যাওয়া জিনিসটা শেহনাজ বুঝতে পেরে দুজনে ছুটে আসল ৷ ওদের দুজনের সাহায্যে শেহনাজ উঠে দাঁড়াল ৷ শেহনাজ ওদের দুজনের উদ্বিগ্ন মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে হতাশ শ্বাস ফেলে বলল,,
আমার মতো ব*লদ জীবনে শুধরাবে না! ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনা হারিকেন দিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাচ্ছি না!
°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°
তুবা রাস্তার পাশে একটা বেঞ্চে বসে আছে ৷ এই ক বছরে বাংলাদেশের উন্নয়নের মধ্যে একটি হচ্ছে রাস্তায় নির্দিষ্ট দুরত্ব পরপর কিছু বেঞ্চ আর পানি খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে ৷ এছাড়াও ১০ কদম পরপর একটা করে ডাস্টবিন আছে ৷
গাড়ি রিপায়ারিংয়ে দেওয়ার কারনে তুবাকে আজ ক্যাবে করেই ভার্সিটিতে যেতে হবে ৷ মোবাইলে ক্যাব বুক করে ও চুপচাপ বসে আছে ৷ হঠাৎ একটা কার এসে ওর সামনে থামল ৷ গ্লাস নামাতেই দেখতে পেল একটা রঙিন চশমা পড়া ছেলে ৷ তুবা এক নজর দেখেই বুঝতে পারল এটা সেই বিখ্যাত টিকটকারদের কোনো বংশধর হবে ৷ মাম্মার কাছ থেকে টিকটকের বিষয়ে শুনেছিল ও যেটা বহু আগে ব্যান করে দেওয়া হয়েছে ৷ যারা তবুও টিকটক করতো তাদের আইনের আওতায় আনা হতো ৷ তারপর থেকে কেউ আর সাহস করেনি টিকটক করার ৷
ছেলেটা কার নিয়ে তুবার সম্মুখে এসে সেটা বারবার ঘুরাতে লাগল ৷ ওই যে কার রেসের সময় যেমন করে ওমন কিন্তু এই ছেলে যেটা করছে সেটা একদম সস্তা মানের ৷ কার রেসলার রা এটা দেখলে নিশ্চিত দম আটকে ম*রে যেত!
ছেলেটার অ*ত্যাচার বেড়ে চলল ৷ ক্রমাগত কার ঘুরাতেই লাগল ৷ প্রচন্ড শব্দে তুবার কান ঝালাপালা হয়ে গেল ৷ তুবা বি*রক্ত হয়ে পাশের বেঞ্চে চলে গেল ৷ ছেলেটাও কার নিয়ে সেখানে গেল ৷ এভাবে তিনটা বেঞ্চ বদলানোর পরও যখন দেখল ছেলে শুধরোচ্ছে না তখন তুবা মুখ খুলতে যাবে এমন সময় খুব দ্রুতগতিতে একটা গাড়ি ছেলেটার গাড়ির দিকে এগিয়ে আসতে লাগল ৷ তা দেখে ছেলেটা ভয় পেয়ে গাড়িটা সাইড করতে লাগল কিন্তু তবুও পিছনের গাড়ি ওর দিকেই তুমুল বেগে এগিয়ে আসছে ৷ ছেলেটা ভয় পেয়ে দ্রুত স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে সেখান থেকে চলে যেতে লাগল ৷
পিছনের গাড়িও ওর গাড়ির পিছনে চলে যেতে লাগল ৷ তুবা মজা পেয়ে সেদিকে তাকিয়ে বলল,,,
বাহ লাইভ কার রেসলিং দেখার ফিল পাচ্ছি ৷ দারুন তো!
গাড়ি দুটো উধাও হয়ে গেল ৷ তুবা সেদিকে থেকে চোখ সরিয়ে পুনরায় বেঞ্চে বসে পড়ল ৷ হঠাৎ ওর সামনে সেই গাড়িটা এসে থামল ৷ তুবা চকিতে সেদিকে তাকাল ৷ স্বাধীন গাড়ির কাঁচ নামিয়ে মাথা সামান্য বের করে বলল,,,
আর ইউ ওকে?
আরে সাইকো আই মিন সাইক্রিয়াটিস্ট সাহেব আপনি ছিলেন ওটা?
দূর থেকে দেখলাম কেউ আমার পেসেন্টকে বি*রক্ত করছে তাই একটু শিক্ষা দিলাম ৷
আচ্ছা তো পেসেন্ট জন্য সাহায্য করলেন? তা আমি যদি চশমা পড়তাম তাহলে কি করতেন?
ছেলেটাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে নাক খত দেওয়াতাম আর বাঁ*ন্দর নাচ করাতাম ৷
তুবা হেসে উঠল ৷ স্বাধীন ভ্রু কুঁচকে বলল,,, আপনি এখানে কি করছেন? কোথাও যাওয়ার হলে চলুন লিফট দিচ্ছি ৷
জাযাকাল্লাহ কিন্তু লাগবে না ৷ আমি ক্যাব বুক করেছি, কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে ৷
যেমন টা আপনার ইচ্ছা ৷
বলে স্বাধীন গাড়ির স্টিয়ারিং ঘুরাতে ধরলেই তুবা বসা থেকে উঠে বলল,,, ওহ হ্যাঁ জাযাকাল্লাহ একটু আগে সাহায্য করার জন্য ৷ অবশ্য আপনি না আসলে আমি ওর থেকে হিসাব নেওয়া শুরু করতাম ৷ দুনিয়াতে হিসাব না দিলেও পরকালে গিয়ে নিতাম ই নিতাম ৷
চলবে,,,,,,