#শুনলাম_বসন্ত_নাকি_আবার_এসেছে
#লেখিকা_সিনথিয়া_জাহান
#পর্বঃ১৪
তুবার ক্লাস আজ আগেই শেষ হয়ে গেছে জন্য ও তাড়াতাড়ি ভার্সিটি থেকে চলে গেছে ৷ তাছাড়া ডক্টর স্বাধীন মুক্তাকীর সাথে ওর আজকে অ্যাপয়নমেন্ট ছিল ৷ তুবা চলে যাওয়ায় আয়েশার মনটা খারাপ হয়ে গেল ৷ সেইম ইয়ারের না হলেও ক্লাস শেষে দুজনে মিলে আড্ডা দিত ৷ আয়েশার এখনও দুটো ক্লাস বাকি আছে ৷ ও একা একা ক্যাম্পাসে উদাস মুখে বসে আছে ৷ সবার সাথে টুকটাক কথা বললেও কারো সাথে মাখোমাখো সম্পর্ক নেই ওর একমাত্র তুবা ব্যতীত ৷
কিছুক্ষণ বসে থাকার পর আয়েশা বসা থেকে উঠে ক্লান্ত পায়ে করিডোর দিয়ে হাঁটতে লাগল ৷ হঠাৎ পিছন থেকে কারো নিরেট কন্ঠস্বর ভেসে আসতেই আয়েশার কদম থেমে গেল ৷
আই থিংক ক্লাসের সময় এভাবে ঘুরঘুর করা কোনো আদর্শ স্টুডেন্টের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না?
কন্ঠ শুনেই আয়েশা বুঝে গেল এটা কে হতে পারে ৷ তাই চট জলদি পিছু ঘুরে বলল,,, আমি ক্লাসেই যাচ্ছি স্যার ৷
বারিশ গম্ভীর মুখে হাঁটা শুরু করল ৷ আয়েশাও পিছু পিছু হাঁটতে লাগল আর মনে মনে বলতে লাগল,,, অ্যানাকন্ডা সা*পের ফোসফোসানি শুরু হয়ে গেল!
ক্লাসে বারিশের পরপর আয়েশা ঢুকে পড়ল ৷ সাভাশ ক্লাসেই ছিল ৷ নিজের নির্দিষ্ট আসনে গিয়ে আয়েশা বসে পড়ল ৷ বারিশ নিজের ক্লাস শুরু করল ৷ আয়েশা অনেক চেষ্টা করেও ওর কথাগুলো বুঝতে পারছে না ৷ পড়াশোনা টা ওর কাছে সবচেয়ে কঠিন কাজ ৷ এর চেয়ে এভারেস্ট জয় করা ওর কাছে সহজ মনে হয় ৷
বারিশের লেকচার যত বাড়তে লাগল আয়েশার কপালে তত ভাঁজ পড়তে লাগল ৷ শেষে ব্যর্থ হয়ে আয়েশা মনোযোগ সরিয়ে নিল ৷ অযথা মাথায় চাপ প্রয়োগ করার কোনো মানেই হয় না ৷ ডান পাশে তাকিয়ে দেখল সাভাশ অত্যন্ত মনোযোগের সহিত লেকচার শুনছে পাশাপাশি খাতায় নোট করছে ৷ আয়েশা হতাশ শ্বাস ফেলে আশেপাশে তাকিয়ে দেখল সবার চোখ বারিশের দিকে নিবদ্ধ ৷ অবশ্য ওদের নজর বারিশ স্যারের লেকচারের উপর না এই বিষয়ে আয়েশা নিশ্চিত ৷
মেয়েগুলোর এমন বে*হায়া আচরণ দেখে আয়েশার চোখমুখ কুঁচকে গেল ৷ ওদের থেকে নজর সরিয়ে পুনরায় ও বারিশের লেকচারে একটু মনোযোগ দিল কিন্তু এবারেও ব্যর্থ হলো ৷ কলম দিয়ে নিজের মাথায় গুতো মা*রতে লাগল ও ৷ বারিশ ওর দিকে তাকিয়ে বলল,,,
বিহেভ ইউর সেলফ ৷ আই থিংক তুমি আবারও আমার কাছে অ*পমানিত হতে চাচ্ছ না ৷
ক্লাসের সবাই আয়েশার দিকে তাকাল ৷ এতে করে আয়েশা থতমত খেয়ে গেল ৷ লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল,,,
আফওয়ান ৷
বারিশ পুনরায় ক্লাস আরম্ভ করল ৷ সাভাশ ওর দিকে তাকিয়ে মুখ নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলতে লাগল,,, অপদার্থ, ব*লদ!
আয়েশা চোখ পাকিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ওকে জিহ্বা দেখাল ৷ সাভাশ মুখ ভেংচি কেটে নোট করায় মনোযোগ দিল ৷ আয়েশা গালে হাত দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে বারিশের লেকচার শুনতে লাগল ৷ হঠাৎ ওর মুখে একটা কাগজের টুকরো এসে পড়তেই আয়েশার ভ্রু কুঁচকে গেল ৷ পাশে তাকিয়ে দেখল জিম নামের একটা ছেলে ওর দিকে হাসিহাসি মুখে তাকিয়ে ইশারায় ওকে কাগজ টা পড়তে বলল ৷
আয়েশা বি*রক্ত মুখে কাগজটা কোচরা মোচরা করে নিজের সিটের উপর রেখে বারিশের প্রোজেক্টরে সাজানো লেকচার টা নোট করতে লাগল ৷ এটা ও মনোযোগ দিয়েই নোট করছে ৷ হঠাৎ নিজের সিটের পাশে কারো উপস্থিতি টের পেতেই আয়েশা চকিতে সেদিকে তাকাল ৷ বারিশ ওর পাশ দিয়েই হেঁটে চলে গেল ৷ আচমকা স্যারকে দেখে ভয় পেলেও আয়েশা নিজেকে সামলে নিয়ে পুনরায় নোট করতে লাগল ৷
ক্লাসের যখন আরো পাঁচ মিনিট বাকি আছে তখন বারিশ জিমকে দাঁড় করিয়ে বলল,,,
আজ ক্লাসে যা যা শিখালাম তার প্রেজেন্টেশন তুমি দিবে ৷ আই থিংক তুমি বুঝেছো ৷
জিমের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল ৷ ও কি প্রেজেন্টেশন দিবে? পুরো ক্লাস জুড়ে ওর নজর তো আয়েশার উপর ছিল ৷
বারিশ পুনরায় গম্ভীর গলায় বলল,,, হোয়াট? আসছো না কেন?
জিম ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে গেল ৷ ওর গলা শুকিয়ে গেল ৷ অন্য স্যার হলে মানা যেত কিন্তু বারিশ স্যার ওকে এক চুলও ছাড় দিবে না!
আসলেই ছাড় দিল না ৷ ঠিকঠাক ভাবে প্রেজেন্টেশন না দেওয়ায় বারিশ ওকে নিজের ক্যাবিনে যেতে বলেছে ৷ ওর শা*স্তি ক্যাবিনেই দেওয়া হবে ৷ এটা ভার্সিটির নতুন নিয়ম ৷ ক্লাসে কেউ খারাপ পারফরম্যান্স করলে কিংবা স্যারের সাথে বে*য়াদবী করলে ওই স্যার তাকে নিজের ক্যাবিনে নিয়ে গিয়ে ইউনিক ইউনিক সব স্টাইলে শা*স্তি দেয় ৷ এটা যার যার পছন্দের উপর ৷ বারিশ এখন জীমকে কি শা*স্তি দিবে সেটা বারিশ ই জানে ৷
সবার মুখে উদ্বিগ্নতা ৷ তবে আয়েশার মুখে হাসি ৷ যাক এই উসিলায় জীম একটা শিক্ষা তো পাবে ৷ ক্লাস শেষে আয়েশা বই গুছিয়ে কাধে ব্যাগ চাপিয়ে যেতে ধরেও ফিরে আসল ৷ জিমের দেওয়া কাগজটাতে কি লেখা আছে সেটা দেখতে ইচ্ছা করছে ওর ৷ কিন্তু আশ্চর্য কাগজটা ওখানে নেই ৷ অনেক খুঁজেও আয়েশা সেটা পেল না ৷ অবাক হয়ে বলতে লাগল,,,
কাগজ টা কি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল?
°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°
তুবার মেজাজ টা বিগড়ে গিয়েছে এই বয়সে দামড়া ছেলের মুখে আম্মু ডাক শুনে ৷ ও রিসেপশনে এসে স্বাধীনকে ফোন দিয়েছিল যেন দ্রুত চেকআপ করিয়ে বাসায় যেতে পারে ৷ কিন্তু তার জন্য যে আম্মু ডাক শুনতে হবে সেটা ভাবতেই পারেনি ৷ হঠাৎ পাশে একটা বাচ্চার মুখে ‘আম্মু’ ডাক শুনে খেকিয়ে উঠে বলল,,,
এই কে তোমার আম্মু? আমি কারো আম্মু না ওকে? আমাকে আম্মু বলে ডাকার হিসাব আমি পরকালে গিয়ে নিব!
কথাটা বলার পর তুবা থতমত খেয়ে গেল ৷বাচ্চা আর বাচ্চার মা ওর দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে ৷ তুবা জোরপূর্বক হেসে মিষ্টি স্বরে বলে উঠল,,,
আফওয়ান আমি আপনাদের কিছু বলিনি ৷ আসলে অন্য একজন ভেবে বলে ফেলেছি ৷
উনারা এখনও তুবার দিকে আহাম্মক হয়ে তাকিয়ে আছে ৷ তা দেখে তুবা উনাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বাচ্চা টার দিকে একটা চকলেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল,,,
আফওয়ান ছোট বাবু ৷ এই নাও চকলেট খাও ৷ আন্টি অনেক অনেক সরি বুঝেছো?
বাচ্চাটা মায়ের দিকে তাকিয়ে চকলেট নেওয়া ঠিক হবে কি না সেটা জিজ্ঞাসা করল ৷ মেয়েটা কয়েক পলক তুবার দিকে তাকিয়ে থেকে চকলেট নেওয়ার অনুমতি দিল ৷ অনুমতি পাওয়ার সাথেই বাচ্চা টা চকলেট লুফে নিল ৷ তুবা মেয়েটার সাথে কয়েক মিনিট কথা বলে সব কনফিউশন ক্লিয়ার করে নিল ৷
বর্তমানে ও স্বাধীনের ক্যাবিনের সামনে বসে আছে ৷ ভিতরে অন্য একজন পেসেন্টের সাথে স্বাধীন কথা বলছে ৷ অপেক্ষা করতে করতে তুবার হাই উঠে গেল ৷ ব্যাগ থেকে চকলেট বের করে খেতে লাগল হাই ওঠা কমানোর জন্য ৷ হঠাৎ ক্যাবিনের ভিতরে ভালোভাবে নজর দিতেই দেখতে পেল একটা চশমা পড়া মেয়েকে ৷ তুবার চোখ বড় বড় হয়ে গেল ৷ ও বসা থেকে উঠে ক্যাবিনের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াল ৷ গিয়ে দেখতে পেল স্বাধীন হেসে হেসে মেয়েটার সাথে কথা বলছে ৷
তা দেখে তুবা বিরবির করে বলে উঠল,,, হায় আল্লাহ এই মেয়েকে আজকেই আসতে হলো? ওই সাইকো তো আপনজন পেয়ে গেল ৷ হাসি দেখে তো মনে হচ্ছে সোজা কাজি অফিসে চলে যাবে ওরা ৷
তুবার হঠাৎ কেন জানি হাশফাঁস লাগতে শুরু করল ৷ কি যেন একটা তা*ন্ডব শুরু হয়ে গেল মনের ভিতরে যেটা স্বাধীনের হাসির দিকে তাকালে তরতর করে বেড়ে যাচ্ছে! ওদের হাসির বেগ বেড়ে গেল ৷ সাথে তুবার মুখের রঙও তুমুল বেগে র*ক্তিম হতে লাগল ৷ কাচের ডোরে কান পেতে মনোযোগ দিয়ে ওদের কথোপকথন শোনার চেষ্টা করতে লাগল ৷ ওর কানে শুধু তিন চার টা কথাই আসল ৷ বিয়ে, বাচ্চা, অনুষ্ঠান ৷ থেমে থেমে শুধু এই কয়টা ওয়ার্ড ই ওর কানে এসেছে ৷
তুবা রা*গে ফেটে পড়ল ৷ খুব জোরে কাচের ডোরে একটা ঘু*ষি মে*রে দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগল,,,
সাইকোর সাইকো আমাকে আম্মু বলে এই চশমাওয়ালী নটাঙ্কি মেয়েকে বিয়ে করতে চাচ্ছেন? এর হিসাব আমি পরকালে নিব তার আগে আর একটা কাজ করব ৷ আমাকে যেহেতু আম্মু বানিয়েই দিয়েছেন তো দা*জ্জাল শ্বাশুড়ি হয়ে আপনার সংসারে আ*গুন লাগাব, আপনাদের দুজনের মাঝখানে গিয়ে শুয়ে থাকব আমি!
নিজের রা*গের বহিঃপ্রকাশ করতে গিয়ে তুবা যে কাচের ডোর টা ভেঙে ফেলেছে সেটা খেয়াল হতেই ও চোখ বড় বড় করে ফেলল ৷ কাচটা ভঙ্গুর হয়ে গেছে কিন্তু এখনও টিকে আছে ৷ তুবা আস্তে করে নিজের হাতটা কাচের উপর থেকে সরাল ৷ কাচটা ভেঙে পড়েনি দেখে তুবা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে নিজের জায়গায় গিয়ে বসে থাকল ৷ এমন ভাবে মুখের অঙ্গভঙ্গি করে রাখল যেন ওর মতো ভদ্র আর ভালো মেয়ে এই দুনিয়ায় একটাও নেই ৷
আরো কিছুক্ষণ পর মেয়েটা চলে গেল ৷ এবার তুবার ডাক পড়ল ৷ তুবা মুখে এক চিলতে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল ৷ ওর স্বাধীনের প্রতি সব রা*গ নিজের করা ব*লদামী কাজের নিচে চাপা পড়ে গেছে ৷ স্বাধীন কোনো ভণিতা না করে সোজা কাজের কথা বলতে লাগল ৷ তুবার অবস্থা সম্পর্কে খুঁটিনাটি শুনতে লাগল গভীর পর্যবেক্ষণে ৷
কাউন্সিলিংয়ের পুরো পর্বে তুবার মুখে হাসি লেপ্টে ছিল ৷ অবশ্য স্বাধীন ওই মেয়েটার সাথে যেভাবে হাসতেছিল সেভাবে তুবার সাথে হাসেনি ৷ কাউন্সিলিং শেষে তুবা নিজের চাপা রা*গ খানিকটা প্রকাশ করে বলল,,,
বিয়ে তো ঠিকঠাক করেই ফেললেন ৷ তা আমাকে দাওয়াত দিবেন না?
স্বাধীন ভ্রু কুঁচকে বলল,,, বিয়ে? কার বিয়ে? কার সাথে?
কার আবার আপনার বিয়ে ৷ একটু আগে যে মেয়েটা চলে গেল তার সাথে আপনার বিয়ে ৷
স্বাধীন আশ্চর্যানিত হয়ে বলল,,, ওটা আমার বোন হয় ৷ আপনি কি বলছেন এসব? কার থেকে শুনেছেন?
তুবার সমস্ত রা*গ পড়ে গেল ৷ ভ্রু কুঁচকে বলল,,, আপনার নিজের বোন?
না আমার কোনো ভাই বোন নেই ৷
তাহলে কাজিন?
না তেমন টাও না ৷ আসলে ওই মেয়ে চশমা পড়ে তাই আজ থেকে ও আমার বোন ৷ জানেন আমার বোনের একটা বাচ্চাও আছে ৷ সেই বাচ্চার সমস্যার সমাধান করতেই এসেছিল ৷ আমার ভাগ্নে কারো সাথে সহজে মিশতে পারে না এটাই সমস্যা ৷
তুবা আহাম্মক হয়ে গেল ৷ অস্ফুট স্বরে বলল,,, কে এ? আদৌ মানুষ?
এমন সময় বি*কট আওয়াজ করে কাচের ডোর টা ঝরঝর করে ভেঙে পড়ে গেল ৷ স্বাধীন চট জলদি বসা থেকে উঠে পড়ল ৷ ও যে বেশ আশ্চর্য হয়েছে সেটা ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ৷ ও অবাক হয়ে বলে উঠল,,,
এটা হুট করে ভেঙে গেল কিভাবে? এতোটাও দুর্বল নয় যে সামান্য বাতাসে ভেঙে যাবে!
তুবা থোদরবোদর খেয়ে গেল ,উশখুশ করতে লাগল ৷ স্বাধীনের দিকে তাকিয়ে ৩২ পাটি দাঁত বের করে বলল,,,
আমার রুপের আগুনের ভয়*ঙ্কর তাপের কাছে হয়তো টিকতে পারেনি তাই ভেঙে গেছে!
চলবে,,,,