অন্তর্নিহিত কালকূট লেখিনীতে: অনিমা কোতয়াল ১৮.

0
3

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখিনীতে: অনিমা কোতয়াল

১৮.

‘এটা তোমার দক্ষিণ দিক মনে হল?’ দাঁতে দাঁত চেপে বলল রুদ্র। ভীষণ কষ্টে নিজের ক্রোধ সংবরন করে রেখেছে। প্রিয়তা ভীত চোখে আরেকবার তাকাল চারপাশে। পাঁচ ফুট চওড়া কাঁচা রাস্তাটা বহুদূর গিয়ে অদৃশ্য হয়েছে নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে। পেছনে জঙ্গল, সামনে খাল। শব্দ বলতে কেবল কয়েকটা পাখি আর পোকার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। উজ্জ্বল চন্দ্রিমার আলোটুকুর কারণেই চারপাশটা চলনসই বলে মনে হচ্ছে। এর আশেপাশেও যে কোথাও কোন হাইওয়ে নেই সেটা না বোঝার কোন কারণ নেই। প্রিয়তা কম্পমান গলায় বলল, ‘আ-আমার মনে হয়েছিল এট-এটাই দ-দক্ষিণ দিক। আমি বুঝতে পারিনি।’

শেষের শব্দদুটো মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল প্রিয়তা। রুদ্রর ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে ঠাটিয়ে আরও দুটো থা-প্প-ড় মারতে। এতো আত্মবিশ্বাস নিয়ে কেউ এমন ভুল করতে পারে! সেটা এই মেয়েকে না দেখলে জানাই হতোনা। রাগে রুদ্রর গা কাঁপছে একপ্রকার। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল রুদ্র। লাভ নেই আসলে। ওর ওপর হাতের দিকটা কেমন অবশ হয়ে আসছে, মাথা ঝিম ধরেছে। কিন্তু ক্ষ-তটা তাকিয়ে দেখতেও ইচ্ছে হচ্ছেনা। শরীর দুর্বল লাগছে ভীষণ। সেই দুটোর দিকে এক পিস স্যান্ডউইচ আর কফি খেয়েছিল তাজওয়ারের বাড়িতে। এরপর পেটে একফোঁটা পানিও পড়েনি। জঙ্গলের এতোটা পথ পেরিয়ে আসতে কিছুটা হলেও বেগ পেতে হয়েছে ওকে।
রুদ্র একপ্রকার ঝাড়ি দিয়ে ছেড়ে দিলো প্রিয়তার বাহু। কোমরের ওপর দু হাত রেখে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। ভাবছে এখন কী করা যায়। প্রিয়তা মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে ভয়ে গুটিয়ে আছে একদম। সংকোচমিশ্রিত কন্ঠে প্রশ্ন করল, ‘এখন কী করবেন?’

‘ ভাবছি।’ রাস্তা দেখতে দেখতে স্বাভাবিকভাবেই বলল রুদ্র।

‘ কী ভাবছেন?’

রুদ্র ভাবা থামাল। কিন্তু প্রিয়তার দিকে না তাকিয়েই বলল, ‘তোমাকে মে-রে লা-শটা কোথায় গুম করা যায় সেটাই ভাবছি।’

চমকে উঠল প্রিয়তা। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে একবার তাকাল রুদ্রর হাতে থাকা পি-স্ত-লের দিকে। তখনই চোখে পড়ল রুদ্রর বা হাতের বাহু দিয়ে র-ক্ত গড়িয়ে পড়ছে। একহাতে বাঁধার ফলে ঠিকভাবে বাঁধা যায়নি। ঢিলে হয়ে গেছে রুমালটা। চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে র-ক্তের ধারা। মুহূর্তেই প্রিয়তা ভুলে গেল সবকিছু। ভূলে গেল কিছুক্ষণ আগে দেওয়া রুদ্রর প্রাণনাশের হুমকি। সব ভয় যেন মুহূর্তেই পালিয়ে গেল। দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল রুদ্রর কাছে। ওর হাত ধরে ব্যস্ত কন্ঠে বলল, ‘আপনার হাত থেকে কতো র-ক্ত বের হচ্ছে। ঢিলে হয়ে গেছে বাঁধনটা। আপনি এটা নিয়ে এতক্ষণ হাঁটছিলেন?’

রুদ্র এতক্ষণ পরে তাকাল নিজের হাতের ক্ষ-তটার দিকে। সত্যিই অনেকটা র-ক্ত বের হচ্ছে। এইজন্যই এমন অবশ অবশ লাগছিল তাহলে! কিন্তু বিষয়টাকে পাত্তা দিলোনা রুদ্র। হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘এটুকুতে আমার কিছু হয়না।’

প্রিয়তার বিরক্তি হল। ভ্রুকুটি করে বলল, ‘ বললেই হলো?’

কথাটা শেষ করেই চারপাশে তাকাল প্রিয়তা। কিছু খুঁজছে। কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা চোখে পড়তেই প্রায় দৌড়ে গেল সেদিকে। ব্যস্ত হাতে কিছু দুর্বাঘাস তুলে নিয়ে আবারও একইভাবে ছুটে এলো রুদ্রর কাছে। হাঁপানো কন্ঠে বলল, ‘আপাতত এটা ছাড়া আর কোন বিশেষ পাতা নেই আশেপাশে। এতেই চলবে।’

রুদ্র ভ্রু কুঁচকে একবার প্রিয়তার দিকে আরেকবার দুর্বা ঘাসের দিকে তাকাল। অতঃপর গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘এসবের দরকার নেই। আমি ডক্টর দেখিয়ে নেব।’

‘ সে যখন দেখাবেন, দেখাবেন। এখন র’ক্ত বন্ধ করাটা বেশি ইম্পর্টেন্ট।’

কথাটা বলতে বলতেই রুদ্রর হাত ধরে একটা গাছের মোটা উঁচু শেকড়ের ওপর বসিয়ে দিল প্রিয়তা। নিজেও বসল রুদ্রর বাঁ পাশে। রুদ্র বোকা চোখে তাকিয়ে রইল মেয়েটার দিকে। প্রিয়তার সেদিকে কোন খেয়াল নেই। আস্তে করে খুলে ফেলল রুদ্রর হাতে বাঁধা রুমালটা। কালচে র’ক্তে চুবচুবে হয়ে গেছে প্রায়। মুখটা কেমন বিকৃত হয়ে এলো প্রিয়তার। যেন গা গোলাচ্ছে। কোনমতে দু আঙুলে ধরে রুমালটা একপাশে রাখল ও। এরপর দুর্বাঘাসগুলো দুই হাতে পিষে নিল ভালোভাবে। রুদ্রর হাতের ক্ষতের দিকে করুণ চোখে তাকাল একবার।
রুদ্র একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে প্রিয়তার কার্যকলাপ। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে এসব র-ক্ত কা-টা-কা-টি দেখে অভ্যস্ত নয় সে। খুব সহজ-সরল মেয়ে। প্রিয়তা খুব সাবধানে পেষা দুর্বাগুলো লাগিয়ে দিচ্ছে রুদ্রর বাহুর ক্ষতে। কিছুক্ষণ পরপর আঁতকে আঁতকে উঠছে। মনে হচ্ছে ব্যথাটা ওরই লাগছে। সেটা বুঝতে পেরে সামান্য হাসি পেল রুদ্রর। তবে হাসল না। প্রিয়তা রুদ্রর দিকে তাকিয়ে দেখল। রুদ্রর মুখ একদম স্বাভাবিক, গম্ভীর। যেন কিছুই হচ্ছেনা। প্রিয়তা আলতো করে দুর্বা চেপে ধরল ক্ষ-তটাতে। অসহায় কন্ঠে বলল, ‘এই, আপনার ব্যথা লাগছে না? ইশ! এতোটা আঘাত পেলে আর এতো র-ক্ত বেরিয়ে গেলে আমিতো এতক্ষণে অজ্ঞান হয়ে যেতাম। আর আপনি? এই অবস্থায় এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন?’

‘ এইজন্যই আমি তুমি নই।’ নির্বিকার কন্ঠে উত্তর দিল রুদ্র। তবে দুর্বার রস পড়ার সাথেসাথেই আরও ভয়ানকভাবে জ্বলে উঠেছে জায়গাটা। অসহনীয় যন্ত্রণা। কিন্তু ওর চেহারায় তার কোন প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেলোনা। গাছের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইল। প্রিয়তা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। লোকটার মনের সাথে সাথে শরীরও পাষাণ না-কি? অসহ্য যন্ত্রণা হওয়ার কথা হাতে। সহ্য করছে কীকরে?

র-ক্ত বন্ধ হওয়ার পর হল আরেক ঝামেলা। জায়গাটা বাঁধা দরকার। কিন্তু ঐ রুমালটা দিয়ে আবার বাঁধা ঠিক হবেনা। রুমালটায় এখন প্রচুর জীবাণু। ইনফেকশন হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে। একটু ভাবার পরেই নিজের কুর্তিটার দিকে তাকাল প্রিয়তা। কুর্তিটা বেশ লম্বাই। কাজ হবে। প্রিয়তা রুদ্রকে হালকা ঠেলে বলল, ‘শুনছেন?’

রুদ্র ভ্রুকুটি করে চোখ খুলল। বিরক্তি নিয়ে তাকাল প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা ওর কুর্তির নিচের অংশটা রুদ্রর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি একপাশ টেনে ধরছি। আপনি একটু ছিঁড়ে দেবেন? আমি পারব না। আপনি পারবেন। আপনার তো অনেক শক্তি।’

রুদ্রর বুঝতে কয়েক সেকেন্ড লাগল যে প্রিয়তা কেন কথাটা বলছে। বুঝতে পেরে বলল, ‘এসবের দরকার নেই।’

‘আপনি চাইছেন জায়গাটয় ইনফেকশন হয়ে যাক?’

রুদ্র ভাবল, সত্যিই বেঁধে নেওয়াটা জরুরী। আজ রাতে হাইওয়ে পৌঁছানোর কোন সম্ভাবনা নেই। তাই আর কথা বাড়াল না। প্রিয়তার কুর্তির নিজের হাতে তুলে নিল। মাত্র দু সেকেন্ড সংকোচ বোধ করল রুদ্র। কিন্তু অবস্থার গুরুত্ব স্বরণ হতেই একটানে ছিঁড়ে ফেলল নিচের ছোট একটা অংশ। কাপড়ের টুকরোটা প্রিয়তা হাতে দিয়ে আবার একই ভঙ্গিতে গাছে হেলান দিল রুদ্র।
প্রিয়তা খুব ভালোভাবে বেঁধে দিল রুদ্রর হাতটা। রুদ্র চোখ বন্ধ করে আছে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন, খুব ক্লান্ত এখন সে। প্রিয়তাও চুপচাপ বসে রইল রুদ্রর পাশে। কথা বলল না। হয়তো বুঝতে পেরেছে রুদ্রর অবস্থাটা।

মাঘ মাসের রাত। প্রচন্ড ঠান্ডা পড়েছে। প্রিয়তা রুদ্রর জ্যাকেটটা গায়ে জড়িয়ে কিছুটা উষ্ণতা পেলেও; রুদ্রর গায়ে শুধুই একটা টিশার্টই আছে। ভীষণ শীত করছে ওর। শরীর জমে আছে। পানি তেষ্টার সাথে সাথে সিগারেটের তেষ্টাও পেয়েছে। কিন্তু দুটোর কোনটাই এখানে পাবেনা সে। রুদ্র চোখ বন্ধ রেখেই বলল, ‘কী নাম যেন বলছিলে তোমার? প্রিয়?’

‘প্রিয় নয় প্রিয়তা। তবে মা আমাকে প্রিয় বলেই ডাকতো।’ অনেকটা আনন্দিত কন্ঠে বলে উঠল প্রিয়তা।

‘এখন ডাকেনা?’

‘উনি বেঁচে নেই।’

‘তোমার বাবা?’

কিছুক্ষণ চুপ রইল প্রিয়তা। এরপর ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলল, ‘আমি অনাথ।’

এবার চোখ খুলল রুদ্র। ভ্রুকুটি করে ঘাড় ঘোরালো প্রিয়তার দিকে। কয়েকসেকেন্ড চুপ থেকে বলল, ‘তোমাকে ঐ ছেলেগুলো কোথায় পেলো?’

‘একটা জব ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম। সব শেষ করে বের হতে হতে রাত হয়ে গেল। গাড়ি পাচ্ছিলাম না। হঠাৎই কোথা থেকে এসে_’

থেমে গেল প্রিয়তা। বাক্যটা সম্পূর্ণ করার মতো শব্দ খুঁজে পেলোনা হয়তো। রুদ্র আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। আর কিছু জানার ইচ্ছে নেই। আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। অনেকটা সংকোচ নিয়ে প্রিয়তা বলল, ‘আপনার নাম কী?’

‘রুদ্র। রুদ্র আমের।’

প্রিয়তাও আর কিছু বলল না। আবার নিরব হল চারপাশটা। প্রায় পাঁচ মিনিট পর রুদ্র ভাবল, এবার এগোতে হবে। এখানে বেশিক্ষণ থাকাটা ঠিক হবেনা। কথাটা ভেবেই চট করে উঠে দাঁড়াল রুদ্র। হঠাৎ এভাবে উঠে দাঁড়ানোতে চমকে উঠল প্রিয়তা। ওকে আরও বেশি অবাক করে দিয়ে ওর হাত ধরে দাঁড় করাল রুদ্র। শক্ত কন্ঠে বলল, ‘একটা কথাও বলবে না। চুপচাপ চলো।’

প্রিয়তার হাত ধরে পূর্ব দিকে এগোতে শুরু করলো রুদ্র। প্রিয়তা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে দেখছে রুদ্রকে। কিছুক্ষণ আগেও ও সাথে আছে না-কি নেই সেটা নিয়ে কোন মাথাব্যথাই ছিলোনা রুদ্রর। কিন্তু এখন হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে? এটা কী তবে কৃতজ্ঞতা?

কাঁচা রাস্তাটা দিয়ে অনেকটা পথ এগোলো ওরা। অবশেষে লোকালয় দেখতে পেল রুদ্র। ক্ষেতের ওপাশে ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছে। খেতের মাঝে একটা অর্ধনির্মিত পাকা বাড়ি। রুদ্র দাঁড়িয়ে রইল ওখানে কিছুক্ষণ। প্রিয়তার হাত এখনো ছাড়েনি সে। কয়েক সেকেন্ড দ্রুত চিন্তা করল রুদ্র। হঠাৎ প্রিয়তার হাত ছেড়ে লাফিয়ে নামল ক্ষেতে। এরপর প্রিয়তার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘নামো।’

প্রিয়তা বুঝতে পারছেনা রুদ্র কী করতে চাইছে। কিন্তু রুদ্রর কথামতোই ওর হাত ধরে নিজেও ক্ষেতে নামল। এছাড়া এখন অন্যকোন উপায়ও নেই এখন আর।

সম্পূর্ণ ফাঁকা ঘরটার চারপাশে দেয়াল থাকলেও নিচে বালি। বাড়িটা অর্ধেক তৈরী হওয়ার পর কাজ স্থগিত হয়েছে সম্ভবত। পাশের ঘরটায় শুকনো খড়, ভাঙা গাছের ডাল, শুকনো কাঠ পাতা ভর্তি করে রাখা আছে। গ্রামের বিভিন্ন পরিত্যক্ত বা অব্যবহৃত ঘরে এসব রাখা হয়। রুদ্রর কাছে্ও লাইটার ছিল। কিছু গাছের ডাল একত্রিত করে বহু কষ্টে আগুন জ্বালিয়েছে রুদ্র। লাইটারটা পি-স্ত-লের সাথেই নিয়ে এসছিল রুদ্র। এখন কাজে লাগল। মাঘের শীতে ওদের দুজনের অবস্থাই শোচনীয় হয়ে উঠেছিল। গরম পোষাকও নেই। এই উষ্ণতাটুকুতে এখন যা হয়। দুজনেরই প্রচন্ড ক্ষিদে পেয়েছে। কিন্তু এখানে খাবার পাওয়া সম্ভব না। বাইরে একটা টিউবওয়েল ছিল। সেখান থেকে পানি খেয়ে নিয়েছে দুজন। এখন রাতটা কাটানোর একটা ব্যবস্থা করা গেলেই হয়।

পাশের ঘর থেকে খড়গুলো এনে এনে বালির বিছিয়ে নিচ্ছে রুদ্র। চলনসই শোয়ার জায়গা হয়ে যাবে এতে। আজ রাতে ওদের এখানেই থাকতে হবে। এরকম পথ দিয়ে রাতের বেলা হাইওয়ে পৌঁছনো সম্ভব না। কাল সকালে দেখা যাবে। প্রিয়তা মুখ ছোট করে নিচে বিছিয়ে রাখা খড়গুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমাদের এভাবে ঘুমোতে হবে?’

রুদ্র তাকাচ্ছেনা প্রিয়তার দিকে। আগুনের হলদে আলোয় অস্বাভাবিক সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। বিশেষ করে চোখদুটো। না চাইতেও টানা টানা গভীর কালো চোখদুটোতে বারবার আটকা পড়ছে রুদ্র। থমকে যাচ্ছে সবকিছু। রুদ্র চাইছেনা থমকাতে। রুদ্র চির প্রবাহমান। স্থিরতা তার স্বভাববিরুদ্ধ। সে স্থির হতে চায় না। তাই প্রিয়তার দিকে না তাকিয়েই হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, ‘এরচেয়ে ভালো কোন শোবার জায়গা যদি তোমার চোখে পড়ে তুমি শুতেই পারো। কেউ বাঁধা দিচ্ছেনা।’

প্রিয়তা জবাব দিলো না। সত্যিই এখন এরচেয়ে ভালো শোবার জায়গা আর কোথায় পাবে? রুদ্র গিয়ে খড়ের ওপর বসে পড়ল। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘লিসেন, এতক্ষণ বকবক করে আমার মাথা খেয়েছো। এখন আর একটাও কথা বলবে না। আমি ক্লান্ত, ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। তারওপর হাতটাও ব্যথা করছে। সো ডু নট ডিস্টার্ব মি। নিজেও ঘুমাও, আমাকেও ঘুমাতে দাও।’

বলতে বলতে খড়ের ওপর গা এলিয়ে দিলো রুদ্র। প্রিয়তা গাল ফুলিয়ে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে রইল। খু-নি লোকটা ওর শোবার জন্যে আলাদা করে কোন জায়গাও বানায়নি। নির্দয়! ওর নিজেকেই এখন বানিয়ে নিতে হবে। প্রিয়তা খড় আনতে যেতে নিলেই রুদ্র বলে উঠল, ‘যাচ্ছো কোথায়?’

প্রিয়তা এবার বিরক্ত হল। কপাল কুঁচকে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘শোবার জায়গা করতে।’

কিন্তু রুদ্র যা বলল যেটা শোনার জন্যে প্রিয়তা বোধ হয় মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা। রুদ্র অতি স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, ‘তুমি আমার পাশেই শোবে। এসো!’

চোখদুটো বিষ্ফোরিত হয়ে গেল প্রিয়তার। হতভম্ব হয়ে বলল, ‘কী বলছেন কী? পাগল-টাগল হয়ে গেছেন না-কি? নিশ্চয়ই বেশি রক্ত বেরিয়ে যাওয়ার ফল। কিন্তু রক্তশূন্যতায় মানুষ পাগল হয়?’

রুদ্র নির্বিকারভাবে একই আওয়াজে বলল, ‘চুপচাপ আমার পাশে এসে শুয়ে পড়ো। কোলবালিশ ছাড়া ঘুম হয়না আমার। তোমাকে দিয়ে আজ কোলবালিশের কাজ চালাব।’

প্রিয়তা একটা ঢোক গিলে আটকে যাওয়া কন্ঠে বলল, ‘আ-আমি করে নেব শোবার জায়গা।’

রুদ্র কঠোর স্বরে বলল, ‘তুমি নিজে আসবে না-কি আমি উঠে আসব?’

প্রিয়তা উত্তর না দিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কী করবে বুঝে উঠতে পারছেনা যেন। আর কিছু ভাবার আগেই রুদ্র বলে উঠল, ‘কী হল? আমি উঠলে কিন্তু ব্যপারটা আরও বেশি খারাপ হবে। যে খু-ন করতে পারে সে কিন্তু সব করতে পারে। আই হোপ ইউ গট ইট।’

ভয়ে যেন কেঁপে উঠল প্রিয়তা। রুদ্রর কথাগুলোকে কিছুতেই ফাঁকা আওয়াজ ভেবে উড়িয়ে দিতে পারল না। কোন উপায় না পেয়ে গুটিগুটি পায়ে আস্তে করে রুদ্রর পাশে গিয়ে বসল। ডান হাত কপালের ওপর দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে রুদ্র।
এক মিনিট পার হয়ে যাওয়ার পরেও শুতে পারল না প্রিয়তা। চেহারায় অস্বস্তি প্রকাশ পাচ্ছে। ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদোকাঁদো মুখ করে বসে আছে। হঠাৎই প্রিয়তার হাতে টান দিয়ে নিজের হাতের ওপর শুইয়ে দিল রুদ্র। প্রিয়তা চমকে গেল। কিছু বলার আগেই রুদ্র একহাতে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘চুপ! ঘুমিয়ে পড় চুপচাপ। একটা আওয়াজ করলে কিন্তু খারাপ কিছু হয়ে যাবে।’

প্রিয়তা শক্ত হয়ে গুটিয়ে গেল একদম। আগুন নিভু নিভু করছে। উষ্ণতা কমছে। ধীরে ধীরে অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে ঘরটা। কিছুক্ষণ পর গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে যাবে চারপাশ। মাঘের কনকনে শীত, থরথর করে কাঁপছে প্রিয়তা। প্রিয়তার কাঁপুনি অনুভব করতে পারল রুদ্র। একহাতে পাশে খুলে রাখা রুদ্রর সেই জ্যাকেটটা হাতে নিল। সেটা প্রিয়তার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরল নিজের সাথে। প্রিয়তা চোখ খিঁচে বন্ধ করে রেখেছে। সে এখন কিছু জানেনা, বোঝেনা। বুঝতে চায়না। ঘুম চলে আসুক, তাড়াতাড়ি চলে আসুক। এই অস্বস্তির অবসান হোক। রুদ্রও এবার নিশ্চিন্তে চোখ বন্ধ করে ফেলল। শান্তির একটা ঘুম প্রয়োজন এখন। রুদ্রর এই অদ্ভুত আচরণের কারণ প্রিয়তা বুঝতে না পারলেও রুদ্র জানে ও যা করছে তা কেন করছে। বড্ড বেশি নাটকীয় সব ঘটনা ঘটে গেল আজ। কিন্তু কাল সকালে যে আরেক নতুন নাটকীয়তা ওদের জন্যে অপেক্ষা করছে; সেটা কে জানতো?

#চলবে…

[ বিঃদ্রঃ আগের পেইজে অনেকেই এই পর্বগুলো পড়ে ফেলেছেন। যারা পড়েছেন তাদের মধ্যে অনেকেই মন্তব্য করেন। কেউ বা গ্রুপের কমেন্ট প্রতিযোগিতার জন্যে মন্তব্য করেন। যারাই মন্তব্য করবেন, পুরোনো পাঠকরা কোনরকম স্পয়েলার দেবেন না। পরবর্তী পর্বে কী হবে অনুমান করা যায় এমন নূন্যতম কোন শব্দও লিখবেন না মন্তব্যে। এমন কোন মন্তব্য বক্সে পড়লে সেটা সঙ্গে সঙ্গে ডিলিট করে দেওয়া হবে। এবং প্রতিযোগিতা থেকে ডিসকোয়ালিফাইড হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও আছে। গঠনমূলক এবং শুধুমাত্র পর্বভিত্তিক মন্তব্য করুন। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here