অন্তর্নিহিত কালকূট লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ২৯.

0
3

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

২৯.

বনানীর ফ্যাল্ট। ড্রয়িং রুমের সোফায় গা ছেড়ে দিয়ে বসে আছে রুদ্র। চোখ জোড়া বন্ধ। বিদ্যুৎ গতিতে চিন্তা চলছে মস্তিষ্কে। অস্থির লাগছে ভীষণ। শত চেষ্টা করেও মন-মস্তিষ্ককে স্থির করতে পারছেনা।

‘ আমি তৈরী।’

বিষণ্ন এক নারী কন্ঠ শুনে চোখ মেলল রুদ্র। ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। দেখল, প্রিয়তা ব্যাগ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্র কয়েক সেকেন্ড অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। চঞ্চল চোখজোড়া আজ অদ্ভুত স্থির। কাজলহীন উদাস চোখদুটোর দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না রুদ্র। তপ্ত শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। যান্ত্রিক গলায় বলল, ‘চলো।’

বলে সোজা হাঁটা দিল। প্রিয়তা পাল্টা কোন কথা বলল না। রুদ্রর পেছন পেছন সে নিজেও হাঁটা দিল। দরজার কাছে আসতেই পা থেমে গেল প্রিয়তার। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ফ্ল্যাটটাকে। এই পঁচিশ দিনে ভীষণ মায়ায় পড়ে গেছে ঘরটার ওপর। নিজের হাতে রোজ গুছিয়ে রাখতো এই ছোট্ট বাসাটা। রুদ্র আর ওর টুকরো টুকরো মধুময় স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই ফ্ল্যাটের প্রতিটা কোণে। ওদের অব্যক্ত প্রেমের নীরব সাক্ষী এই ফ্ল্যাটের প্রতিটা দেয়াল, আসবাবপত্র। চাঁপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফ্ল্যাটটা ছেড়ে বেরিয়ে এলো প্রিয়তা। পেছনে ফেলে এলো দীর্ঘ পঁচিশ দিনের সুখময় কিছু স্মৃতি।

বিশ মিনিটের মতো জিপ চালানোর পর থামল রুদ্র। প্রিয়তাকে নিয়ে রাস্তার পাশের একটা রেস্তোরাঁয় গেল রুদ্র। শুধু একবার জিজ্ঞেস করল, ‘ কী খাবে?’

প্রিয়তা উদাস চোখে তাকাল। উত্তর দিল, ‘ আপনার যা খুশি অর্ডার করুন।’

এইটুকুই কথা হল। এরপর নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করল দুজন। প্রিয়তার খাবার অর্ধেকের বেশি পাতেই পড়ে রইল। রুদ্র ব্যপারটা খেয়াল করল। কিন্তু কিছু বলল না। অদ্ভুত বিষাদের সাগরে ডুবে রইল দুজনেই। আশেপাশের কোনকিছুতে নজর দেওয়ার অবস্থা নেই ওদের। ভেতরের প্রবল ঝড়টাকে সামলাতেই ব্যস্ত ছিল রুদ্র আর প্রিয়তা।

বিল মিটিয়ে প্রিয়তাকে নিয়ে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে এলো রুদ্র। জিপ ছোটালো চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। প্রিয়তা গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। রুদ্র দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির। আজ খুব মনোযোগ দিয়ে ড্রাইভ করছে সে। জিপটা কিছুটা বেশি স্পিডে চালাচ্ছে। বেশিক্ষণ প্রিয়তার সান্নিধ্যে থাকতে চাইছেনা রুদ্র। যদি ওর মন ঘুরে যায়? যদি ছাড়তে না পারে?

অনেকক্ষণ পর প্রিয়তা তাকাল রুদ্রর দিকে। দীর্ঘ সময়ের নীরবতা কাটিয় বলল, ‘এতোদিন আপনাকে অনেক জ্বালিয়েছি তাইনা?’

রুদ্র প্রিয়তার দিকে না তাকিয়েই বলল, ‘এরকম মনে হল কেন?’

‘ আমাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে আপনার এতো তাড়া দেখে বলছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঝামেলা ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে চান, তাইতো?’

‘ সেরকম কিছু না। আমার হাতে অনন্ত সময় নেই। তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আমাকে আবার গুলশান ফিরতে হবে। আরও অনেক জরুরি কাজ করতে হবে।’

রুদ্রর শক্ত কন্ঠে বলা কঠিন বাণীগুলো শুনে মলিন হাসল প্রিয়তা। মুখ দিয়ে শুধু ‘হুম’ শব্দটাই বের হল। রুদ্র কিছু বলল না। কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে প্রিয়তা আবার বলল, ‘জানেন, আমার কোনদিনও ইচ্ছে ছিলোনা আপনার এই শহরে আসার। আপনার ঐ ভয়ানক থাপ্পড়ের পর আর কিছু বলার সাহসই পাইনি। সত্যি বলতে আমিও ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমার লাইফ রিস্কের কথা শুনে। মনে মনে একটাই প্রার্থনা করেছি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেন এসব ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে পারি। ফিরে যেতে পারি আবার ওখানে। নিজের স্বাভাবিক জীবনে। দেখুন আজ সত্যিই ফিরে যাচ্ছি। সব ঝামেলা থেকে মুক্তিও পেয়ে গেছি।’

রুদ্র কোন উত্তর দিলোনা। যেনো শুনতেই পাচ্ছেনা প্রিয়তার কথা। প্রিয়তা শুকনো এক ঢোক গিলে কথার খেই ধরল আবার, ‘আমার দেখা সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যক্তিত্বের মানুষ আপনি রুদ্র। এরকম মানুষ কোনদিন দেখিনি আমি। অনেক চেষ্টা করেও কোন নির্দিষ্ট বিশেষণ খুঁজে পাইনি আপনার জন্যে। যেকোন একটা বিশেষণে বিশেষায়িত করা যায়না আপনাকে। সেজন্যই বোধ হয় আপনার আসল পরিচয় জেনেও আপনাকে ঘৃণা করতে পারিনি আমি। বরং এই কয়েকদিনে আপনার প্রতি_’

বাক্যটা শেষ করার আগেই গলা ধরে এলো প্রিয়তার। পরপর দুটো ঢোক গিলে সামলে নিল নিজেকে। অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল রুদ্রর দিকে। বলল, ‘আপনি শুনছেন আমার কথা?’

‘ হুম শুনছি।’ নির্বিকারভাবে বলল রুদ্র। যেন প্রিয়তার বলা কথাগুলো ওর কাছে কেবলই ব্যর্থ প্রলাপ।

প্রিয়তা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল। রিক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল এই নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন লোকটার দিকে। এর সামনে মাথা ঠোকার চেয়ে পাথরে মাথা ঠোকাও হয়তো বেশি লাভজনক। এতো পাষণ্ড মানুষ হতে পারে! প্রিয়তা তবুও বলল, ‘এই পঁচিশটা দিন আমি কখনও ভুলব না রুদ্র। আপনি এমনই একজন মানুষ, যাকে ভোলা যায়না। আপনার সেই স্পর্শকে চাইলেও মন থেকে মুছে ফেলতে পারব না। আপনার সঙ্গে কাটানো এই পঁচিশ দিনের স্মৃতি চিরকাল আমার সাথেই থাকবে। একটা কথা বলব?’

মৃদু হাসল রুদ্র। সকৌতুকে বলল, ‘এতক্ষণ চুপ ছিলে না-কি?’

এবারও রুদ্রর অবজ্ঞাকে গায়ে মাখলোনা প্রিয়তা। করুণ দৃষ্টিতে তাকাল রুদ্রর দিকে। ভাঙা গলায় বলল, ‘গাড়িটা একটু আস্তে চালাবেন প্লিজ। রাস্তা দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে।’

রুদ্র এতক্ষণে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল প্রিয়তার দিকে। দু সেকেন্ডের বেশি তাকিয়ে থাকতে পারল না। প্রিয়তার অসহায়, মলিন মুখটা সব গুলিয়ে দিচ্ছে ওর। সঙ্গেসঙ্গে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। কমানোর বদলে আরও বাড়িয়ে দিল গাড়ির স্পিড। প্রিয়তা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। লোকটা সত্যিই হৃদয়হীন। নইলে প্রিয়তার এমন করুণ আকুতিকে উপেক্ষা করতে পারতো না। কোনদিন না। তীব্র অভিমানে তিক্ত হয়ে উঠল মেয়েটার মন। আর একটাও কথা বলার প্রয়োজন বোধ করল না। বুঝতে পারল সবই অনর্থক।

চট্টগ্রাম পৌঁছে রুদ্র প্রিয়তাকে বলল কোন একটা হোটেল থেকে লাঞ্চ করে নেওয়ার কথা। কিন্তু প্রিয়তা রাজি হলোনা। মীরা নাকি রান্না করে রেখেছে। রুদ্রও আর কথা বাড়ায় নি। প্রিয়তা নিজে থেকে আর কোন কথা বলছেনা রুদ্রর সাথে। তিক্ততায় স্তব্ধ হয়ে গেছে ভেতরটা। রুদ্রও কেবল প্রয়োজনীয় প্রশ্নটুকুই করছে।

প্রিয়তাদের সেই বিল্ডিং এর সামনেই জিপ থামাল রুদ্র। জিপ থামার পর এক মিনিট সেভাবেই বসে রইল দুজন। কেউ নড়ল না। আর না কেউ কথা বলল। তাকালোও না একে ওপরের দিকে।
রুদ্র নেমে এলো জিপ থেকে। প্রিয়তাও নামল অলস ভঙ্গিতে। রুদ্রর দিকে না তাকিয়েই বলল, ‘ভেতরে চলুন। লাঞ্চ করে যাবেন।’

রুদ্র আপত্তি জানিয়ে বলল, ‘আমি যাওয়ার পথে খেয়ে নেব।’

আবার কিছু সময় কাটল ভয়ানক নীরবতায়। হঠাৎই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল প্রিয়তা। সমস্ত রাগ, অভিমান পরাজিত হলো অনুভূতির কাছে। দু পা এগিয়ে এসে হুট করে জড়িয়ে ধরল রুদ্রকে। সঙ্গেসঙ্গে হাত মুঠো করে ফেলল রুদ্র। প্রবল ইচ্ছে থাকলেও জড়িয়ে ধরলো না প্রিয়তাকে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে জম্মেছে ছেলেটা। প্রিয়তা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘আমাকে ছেড়ে যাবেন না রুদ্র। আপনি যতই অস্বীকার করুন; আমি জানি, সেদিন নেশার ঘোরে বললেও আপনার প্রতিটা কথা সত্যি ছিল। তাহলে কেন করছেন এসব? কী করেছি আমি? আমার কোন ভুল হয়েছে? তাহলে মারুক, বকুন, শাস্তি দিন, কিন্তু ছেড়ে যাবেন না প্লিজ। বিশ্বাস করুন, আসার সময়ও আমার মনে হয়েছিল হয়তো আপনার মায়ায় আটকে গেছি আমি। প্রথমে কষ্ট হলেও কদিন পর ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এখন আমার নিজেকে নিঃস্ব মনে হচ্ছে। আমি জানিনা কী বলছি, কেন বলছি। আমি শুধু এইটুকুই জানি আমি পারবোনা আপনাকে ছাড়া থাকতে। প্লিজ!’

রুদ্র নিজের মুষ্টিবদ্ধ হাত খুলল। ধীরে ধীরে হাত দুটত প্রিয়তার পিঠে রাখতে গিয়েও থেমে গেল এক অজানা দ্বিধায়। হাত রাখল প্রিয়তার দুই বাহুতে। সরিয়ে আনল নিজের বুক থেকে। আলতো করে প্রিয়তার দুই গালে হাত রেখে বলল, ‘চলে যাও প্রিয়।’

অস্ফুট স্বরে ‘না’ বলে উঠল প্রিয়তা। বাচ্চাদের মতো বায়নার ভঙ্গিতে গুঙ্গিয়ে উঠল। রুদ্র প্রিয়তার চোখে চোখ রাখল। সযত্নে মুছে দিল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুকণা। কোমল কন্ঠে বলল, ‘এভাবে কাঁদে না। আমি তোমার কয়েকদিনের দুঃস্বপ্ন ছিলাম প্রিয়। দুঃস্বপ্ন ভেবেই ভুলে যাও বিগত পঁচিশটা দিন। বাস্তবতা অনেক ভয়ংকর। আমি চাইলেও তোমাকে নিজের কাছে রাখতে পারব না। সে অধিকার আমার নেই। তোমার জন্যে অনেক সুন্দর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। আর আমার সান্নিধ্যে থেকে সেটা সম্ভব হবেনা। যাও।’

কথাটা বলে প্রিয়তাকে ছেড়ে দিল রুদ্র। কথাগুলো বলার সময় রুদ্রর কন্ঠস্বরও কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছিল। প্রথমবারের মতো। এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে ঘুরে দাঁড়াল রুদ্র। প্রস্তুত হলো জিপে ওঠার জন্যে। প্রিয়তা আবার কেঁদে ফেলল। হৃদয়বিদারক সেই কান্না। রুদ্র শুনল সেই কান্নার শব্দ। কিন্তু একবারও ফিরে তাকাল না প্রিয়তার দিকে। আরো একবার প্রমাণ করে দিল সে সত্যিই পাষাণ। উল্টো দিকে মুখ করেই অনুভূতিহীন কন্ঠে বলল, ‘ভালো থেকো, প্রিয়।’

বলে আর অপেক্ষা করল না। উঠে বসল গাড়িতে। রুদ্রর হঠাৎ মনে হল ওর শ্বাসনালী কেউ রোধ করে দিয়েছি। তীব্র যন্ত্রণা শুরু হল বুকের মাঝে। এতো ভয়ানক প্রাণঘাতি শারীরিক আঘাত যে ছেলেকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি, আজ এই সামান্য মানসিক আঘাত সেই ছেলেকে গুড়িয়ে দিচ্ছে। সামান্য!
প্রিয়তা ডান হাতে মুখ চেপে ধরল। কাঁদতে কাঁদতে প্রায় দৌড়ে চলে গেল ভেতরে। রাগ, দুঃখ, অভিমানে হয়তো বিষিয়ে গেছে রমনীর মন। একবারও তাকাল না পেছন ফিরে। তাকালে দেখতে পেতো এক শক্ত, কঠোর, নিষ্ঠুর পুরুষের অসহায়, করুণ, নিঃস্ব দৃষ্টি।

*

বর্তমান ~

সদ্য শাওয়ায় নিয়ে বের হল তুহিন। মাঘের তীব্র শীত। এতো রাতে স্নান করতে বারণ করেছিল মাহমুদা। কিন্তু তুহিন শোনেনি। সারাদিন অনেক দৌড়দৌড়ি, জার্নি পড়েছে। প্রচন্ড শীত পড়লেও গা কেমন চটচটে হয়ে আছে। শরীরটা ভালোভাবে ধুয়ে না নিলে ঘুম হতোনা রাতে। শীতেল প্রকোপ থেকে বাঁচতে তাড়াতাড়ি গায়ে একটা জ্যাকেট জড়িয়ে নিল। জ্যাকেটটা খুব নরম, কিন্তু উষ্ণতা দিতে অকৃপন। বাড়িতে পরে বেশ আরাম পাওয়া যায়। মাহমুদা এক্ষুনি চলে আসবে কফি নিয়ে। রাতে তমাল আর ফারিয়ার সাথে বাইরে খেয়ে এসেছে। তাই শুধু কফি দেওয়ার কথা বলেছে আজ। ভেজা চুলগুলো আরেকবার টাওয়েল দিয়ে মুছতে মুছতে কফির জন্যে অপেক্ষা করল তুহিন। আধ মিনিটের মধ্যেই ধোঁয়া ওঠা গরম কফির মগ নিয়ে হাজির হল মাহমুদা। তুহিনকে দেখেই রুষ্ট কন্ঠে বলল, ‘একি! তোমাকে না বললাম এই ঠান্ডায় একদম গোসল করবে না? আমার একটা কথাও কী শুনতে ইচ্ছে করেনা তোমার?’

তুহিন হালকা হাসল। তোয়ালেটা রেখে বলল, ‘ অস্বস্তি হচ্ছিলো খালা। গিজার অন করে নিয়েছিলাম। কোন সমস্যা হয় নি। আর এইতো, কফিটা খেলে একদম সব ঠিক হয়ে যাবে।’

কথাটা বলে কফির মগটা নিয়ে নিল তুহিন। তুহিনের ভুবন ভোলানো হাসি দেখে বকা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলল মাহমুদা। এমন সোনার টুকরো ছেলেকে বকা যায়? তবুও কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলল, ‘ হ্যাঁ সেই। রোগ-বালাই তো সব অপরাধী কি-না। অপরাধীদের মতো অসুখও তোমার কাছে আসতে ভয় পায়। যাই হোক, বেশি রাত জেগোনা। ওসব কাজকর্ম আপিসে গিয়ে করবে। আমি যাচ্ছি। কোমরের ব্যাথাটা অনেক বেড়েছে আজকাল।’

‘ হ্যাঁ তুমি গিয়ে শুয়ে পরো। আর ব্যথার ঔষধ খেও ঠিকমতো। শেষ হলে বলবে। আমি আনিয়ে নেব।’

মাহমুদা মৃদু হেসে বেরিয়ে গেলেন। সে বেরিয়ে যেতেই দরজাটা বন্ধ করে দিল তুহিন। কফি নিয়ে সোজা ব্যালকনিতে চলে গেল। চারপাশটায় একবার চোখ বুলিয়ে চুমুক দিল গরম কফিতে। মুক্ত আকাশ, উঁচুনিচু বিল্ডিং, নিচে কৃত্রিম আলোয় আলোকিত রাস্তা, ব্যস্ত যানবাহন, সঙ্গে এই তীব্র ঠান্ডা। বড্ড বিচিত্র এই পৃথিবী। তার চেয়েও বিচিত্র এই পৃথিবীর মানুষ। কত ব্যস্ততা, কত কাজ, কত আকাঙ্ক্ষা, কত লালসা, কত বাসনা। নিজেকে ভালোর চেয়েও ভালো রাখার জন্যেই এতো এতো লড়াই। অথচ সকলের গন্তব্য এক ও অভিন্ন। মৃ-ত্যু!

হঠাৎই নিজের দার্শনিক সত্ত্বা থেকে বেরিয়ে এলো তুহিন। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে বর্তমান কেইসটাতে গভীর মনোযোগ দিল আরেকবার। সাতটা খু-ন। দুটো দিন হতে চলল; অথচ খুনের মোটিভটাও খুঁজে বের করতে পারেনি তুহিন। আজ ইন্সপেক্টর আজিজের কাছ থেকে যতটুকু শুনেছে, তাতে এইটুকু বুঝেছে যে ভয়ানক কিছু একটা করতে যাচ্ছিল দ্য সোলার সিস্টেম গ্রুপ। এমন কিছু যার জন্যে মৃ-ত্যুর জন্যেও প্রস্তুত ছিল গ্রুপের প্রত্যেকে। কিন্তু কী সেই কাজ? সেই কাজটাই কী সমস্ত ঘটনার মূল কারণ?

ফোনের রিং টোনে ভাবনায় ছেদ ঘটল তুহিনের। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে “ইরাবতী” নামটা। ইশ! ফিরে এসে মেয়েটাকে কল করা হয়নি। কেইসটার ভেতর এতোটাই ডুবে গিয়েছিল যে ভুলেই গিয়েছিল কথাটা। কলটা রিসিভ করে তুহিন কিছু বলার আগেই ইরা বলল, ‘থাক! জানি কী বলবে। তুমি আমার কথাই ভাবছিলে। এইতো এক্ষুনি কল করতে আমাকে। কিন্তু তার আগেই আমি কল করে বসলাম। তাইনা?’

থতমত খেয়ে গেল তুহিন। কোনরকম মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল, ‘ হ্যাঁ।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইরা। হতাশ গলায় বলল, ‘কখন ফিরেছো?’

‘ বেশিক্ষণ হয়নি।’ কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল তুহিন।

‘ সারাদিন বাইরেই ছিলে?’

‘ থাকতে হয়েছে।’

‘ ঐ শাকচুন্নী ফারিয়াও ছিল নিশ্চয়ই?’ ইরার কন্ঠে তীব্র বিরক্তি।

‘ ইরা!’

তুহিনকে গম্ভীর হতে দেখে দমে গেল ইরা। নিচু গলায় বলল, ‘স‍্যরি। কী করছো?’

‘ কফি খেতে খেতে কেইসটার ব্যাপারে ভাবছিলাম।’

‘ হ্যাঁ! শুধু আমার ব্যপারেই ভাবার সময় নেই তোমার।’

ইরার উদাস কন্ঠস্বর শুনে মৃদু হাসল তুহিন। অভিমান হয়েছে ম্যাডামের। না, ইরাবতীকে মলিন মুখে মানায় না। তুহিন এবার খানিকটা দুষ্টুমির স্বরে বলল, ‘তোমার স্কুটিটা চালিয়ে চলে এসো না। খালা ঘুমিয়ে পড়েছে। টের পাবেনা। ততক্ষণে আমি ফার্মেসীর দোকানটা হয়ে আসি। আসছো?’

‘ যাহ্ অসভ্য!’

শব্দ করে হেসে উঠল তুহিন। নিশ্চয়ই লজ্জায় লাল হয়ে গেছে ওর ইরাবতী। না দেখেও যেন স্পষ্ট অনুভব করতে পারল ও সেটা। কথা এড়াতে ইরা বলল, ‘রাতে খেয়েছো?’

‘ হ্যাঁ। বাইরে থেকে খেয়ে এসছি।’

‘ কে কে?’

‘ আমি, তমাল আর, ফারি_’

বলতে নিয়েও থেমে গেল তুহিন। এই মেয়ে না আবার কুরুক্ষেত্র বাধায়। কিন্তু তেমন কিছুই হলোনা। ব্যপারটাতে পাত্তা না দিয়ে ইরা বলল, ‘কবে দেখা করব আবার।’

‘ খুব শীঘ্রই। একটু ফ্রি হয়েই দেখা করব।’

আরও কিছুক্ষণ কথা বলল দুজন। কথা বলে তুহিনের হালকা লাগছে খানিকটা। সত্যিই, ভালোবাসার মানুষটার সান্নিধ্যে সবকিছুই কত সুন্দর হয়ে ওঠে। তাই হয়তো এই রোগ থেকে মুক্তি পায়নি রুদ্রর মতো কঠিন হৃদয়ের মানুষও। আচ্ছা, রুদ্রর সাথে সেই মেয়েটার আর দেখা হয়েছিল? বাকিটাতো শোনাই হলোনা। তার আগেই ডিজির কল চলে এলো। ওদেরও ফিরে আসতে হলো উত্তরা। আরও একবার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে বেজে উঠল তুহিনের ফোন। তমাল কল করেছে। কলটা রিসিভ করে তুহিন বলল, ‘ হ্যাঁ বলো।’

‘ স‍্যরি স্যার, ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?’

‘ না। কিছু হয়েছে?’

‘ মহিউদ্দিন স্যার কাল সকালে একবার দেখা করতে বলেছেন আপনাকে। জরুরি কথা আছে।’

একটু ভাবল তুহিন। ঐ ডেডবডি থেকে অবাক করা কিছু পাওয়া যায়নি তো? বলল, ‘ আমি এমনিতেও কাল একবার ঘুরে আসতাম। কী হয়েছে বলোতো? নতুন কোন খবর?’

‘ জানিনা, আমাকে বলল না। বলল আপনাকেই বলবে। এগুলো নাকি বাচ্চাদের শুনতে নেই। আপনিই বলুন আমাকে বাচ্চা মনে হয় স্যার?’

ঠিক বাচ্চাদের মতোই অভিযোগের সুরে বলল তমাল। ঠোঁট চেপে হাসিটা চেপে গেল তুহিন। গলা ঝেড়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘বাজে কথা রাখো। কালকে ঐ তিনতলা বিল্ডিং এর মালিকটা এলেই স্কেচ বানানো শুরু করে দেবে। আমার আসার অপেক্ষা করবে না।’

‘ ওকে স্যার।’

‘ রাখছি।’

ফোনটা রেখে ঠোঁট কামড়ে ধরল তুহিন। কী বলবে মহিউদ্দিন? এতো জরুরি তলব কেন? খু-নি যদি রুদ্র হয় তাহলে কালকের স্কেচটার সাথে মিলে যাবে রুদ্রর চেহারা। আর লক্ষ্মীবাজারের ভিক্টিমের নখে যে রক্ত পাওয়া গেছে তার সাথে যদি রাশেদের চুলের ডিএনএ ম্যাচ করে যায় তাহলে খু-নি কে সেটা নিয়ে আর কোন সন্দেহই থাকবেনা। কিন্তু যদি স্কেচ বা ডিএনএ কোনটাই ম্যাচ না করে, তাহলে?

আর এই হ-ত্যা’কা-ন্ডের সুত্রপাত হিসেবে যদি ধরা হয় সেই গুপ্ত প্রজেক্টকে; যেটা রাশেদ করতে চাইছিল। তাহলেতো এই সাতজনের মধ্যে অধিকাংশ হ-ত্যা সোলার সিস্টেম গ্রুপেরই হওয়ার কথা। কিন্তু হয়েছে মাত্র দুজনের। সাতটার মধ্যে মাত্র দুটো। আর আজ সন্ধ্যায় ঐ অচেনা লোকটাই বা কী খুঁজতে এসেছিল শূন্য আমের ভিলায়? ঐদিকে খু-নিও কাউকে খুঁজছিল। তারমানে কী এমন কিছু আছে যেটা খোঁজা হচ্ছে? তারজন্যেই এতো খু-ন? সেটা যদি আমের ভিলাতেই থাকার সম্ভাবনা থাকে তাহলে রুদ্র খু-নি হয় কীকরে? কেনই বা হবে? সেটা নিজের ঘরে থাকার সম্ভাবনা আছে সেটা কেউ শহর জুড়ে কেন খুঁজবে? কোন হিসেবই মিলছে না। যা দেখা যাচ্ছে তা ঘটছে না, আর যা ঘটছে তা দেখা যাচ্ছে না। ক্রমশই জটিল হচ্ছে ব্যপারটা।

#চলবে…

#অন্তর্নিহিত_কালকূট

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here